পৃষ্ঠগড়ানো পানি
পৃষ্ঠগড়ানো পানি হলো একধরনের পানির প্রবাহ। ঝড়ো পানি, বরফ গলা পানি বা অন্য কোন পানির উৎস থেকে ভূতলের উপর দিয়ে যখন পানি প্রবাহিত হয় তখন তাকে পৃষ্ঠগড়ানো পানি বলে। এই ধরনের প্রবাহ তখন হয় যখন ভূপৃষ্ঠে পানির ধারণ ক্ষমতা থেকে বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হয়। আবার এটি অনেক সময় এমন জায়গাতেও হয় যেখানে মাটি পানি শোষণ করতে পারেনা। পানিচক্রের একটি মূল্যবান অংশ হলো পৃষ্ঠগড়ানো পানি। মাটি ক্ষয়েরও একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো পৃষ্ঠগড়ানো পানি।[১][২]
উৎপত্তি
[সম্পাদনা]পৃষ্ঠগড়ানো পানি উৎপন্ন হতে পারে বৃষ্টি থেকে, তুষারপাত থেকে বা তুষার গলে বা হিমবাহ থেকে।
তুষার মূলত সেসকল অঞ্চলে গলে যেখানে এগুলো স্থায়ীভাবে তৈরি হওয়ার মতো ঠান্ডা থাকে। তুষার গলে বসন্তকালে এবং হিমবাহ গলে গ্রীষ্মকালে, যার কারণে নদীগুলোতে প্রবাহ বেড়ে যায়। তুষার ও হিমবাহ গলার পরিমাণ নির্ভর করে বাতাসের তাপমাত্রা ও সূর্যের আলোর উপর।
যেসকল জায়গাতে তুষার থাকেনা সেখানে পানিপ্রবাহ হয় বৃষ্টি থেকে। যদিও, সকল বৃষ্টি পৃষ্ঠগড়ানো পানি তৈরি করবেনা কারণ মাটির স্তর হালকা বৃষ্টি শোষণ করতে সক্ষম। অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার অতি পুরোনো মাটিতে,[৩] শিকড়ের অনেক ঘন জাল রয়েছে যেগুলো এতোই পানি শোষণ করতে পারে যে ঘন বৃষ্টিপাতেও পৃষ্ঠগড়ানো পানির সৃষ্টি হয়না।
শোষণের বেশি হলে ভূপৃষ্ঠে প্রবাহ
[সম্পাদনা]এটি হয় যখন মাটিতে পানির শোষণের পরিমাণ থেকে বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হয়, এবং যেকোন ভূস্তর পানি দ্বারা পূর্ণ হয়ে যায়। এটিকক বলা হয় হর্টোনিয়ান ওভারল্যান্ড ফ্লো। এটি মূলত শহর এলাকাগুলোতে হয় যেখানে পানির বন্যা এড়াতে দালান থাকে।
ধারণ ক্ষমতার বেশি হলে ভূপৃষ্ঠ প্রবাহ
[সম্পাদনা]যখন মাটি ভিজে যায় ও মাটির নিচের স্তর পূর্ণ হয়ে যায় এবং বৃষ্টি পড়তেই থাকে, তখন বৃষ্টি মুহূর্তেই পৃষ্ঠগড়ানো পানি তৈরি করে। মাটির স্তর কত সময়ে পূরণ হবে তা মাটির ভেতরের উপাদানের পরিমাণ নির্ভর করে। আর এই ধরনের প্রবাহকে স্যাচুরেটেড ওভারলয়ান্ড ফ্লো বা ডান্নে রানঅফ।
পৃষ্ঠগড়ানো পানির প্রভাব
[সম্পাদনা]বাষ্পীভবন
[সম্পাদনা]পৃষ্ঠগড়ানো পানি ভূপৃষ্ঠের মাটির বাষ্পীভবনের কারণ হতে পারে; আর নির্দিষ্ট দূরত্বে জমা হতে পারে।
মাটির বাষ্পীভবনের কারণে ফসলের উৎপাদন হ্রাস পায়। পৃষ্ঠগড়ানো পানিতে যেসকল মাটির কণা থাকে সেগুলো ব্যাসে ০.০০১ মিলিমিটার থেকে ১.০ মিলিমিটার হয়।
প্রাকৃতিক প্রভাব
[সম্পাদনা]পৃষ্ঠগড়ানো পানির সাথে সম্পৃক্ত প্রাকৃতিক প্রভাব হলো ভূপৃষ্ঠের পানিতে প্রভাব, ভূগর্ভস্থ পানিতে প্রভাব এবং মাটিতে প্রভাব। কারণ পৃষ্ঠগড়ানো পানি নানা ধরনের দূষক পদার্থ এগুলোতে বয়ে নিয়ে যায়। আর এই প্রভাব পড়ে মানুষের স্বাস্থ্যে, প্রকৃতির ভারসাম্যে এবং পানির উৎসতে। যেসকল দূষক পানির উপর বড় প্রভাব ফেলে সেগুলো হলো পেট্রোলিয়ামজাতীয় পদার্থ এবং কীটনাশক।[৪] ভূপৃষ্ঠের উপরের পানিতে এই প্রভাবকে পানি দূষণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, কেননা পৃষ্ঠগড়ানো পানিগুলো নানা নদীতে যায় যেগুলোতে নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ থাকে। ভূপৃষ্ঠের উপরের পানিগুলো যখন খাবার পানির জন্য ব্যবহার করা হয় তখন স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা যায়। ভূপৃষ্ঠের পানিতে এই ধরনের মিশ্রণ নানা জলজ প্রাণী যেমন মাছকে মেরে ফেলতে পারে। কিছু গবেষণাতে দেখা যায়, ডিডিটির মতো কীটনাশকগুলো মাছের লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পারে, যা পুরুষকে নারী মাছে পরিণত করে।[৫]
বনজঙ্গলে তৈরি হওয়া পৃষ্ঠগড়ানো পানি হ্রদের ভেতর তরল নাইট্রোজেন এবং ফসফরাস বয়ে নিয়ে যেতে পারে। কিছু বনের পৃষ্ঠগড়ানো পানিতে হিউমিক এসিডও থাকতে পারে।[৬][৭]
ভূগর্ভস্থ পানির ক্ষেত্রে, প্রধান সমস্যা হলো দূষক পদার্থ খাবার পানির সাথে মিশে যাওয়া, যদি পানির জায়গাটি মানুষের কাজে ব্যবহার করা হয়। মাটিনদূষণের ক্ষেত্রে পৃষ্ঠগড়ানো পানি দুইভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। প্রথমত, পৃষ্ঠগড়ানো পানি দূষিত মাটিকে বয়ে নিয়ে যেতে পারে এবং পানি দূষণ হিসেবে নানা পানির স্তরকে আক্রান্ত করতে পারে। দ্বিতীয়ত, পৃষ্ঠগড়ানো পানি নানা ফসলভূমিকে দূষিত করতে পারে যা স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলতে পারে।
কৃষিতে সমস্যা
[সম্পাদনা]কৃষিতে অন্যান্য সমস্যার মধ্যে রয়েছে পৃষ্ঠগড়ানো পানির দ্বারা কৃষির রাসায়নিক পদার্থ বয়ে নিয়ে যাওয়া (নাইট্রেট, ফসফেট, বালাইনাশক ইত্যাদি)। এই ধরনের সমস্যা তখন হয় যখন রসায়নের সঠিক পরিমাণ ও সঠিক সময়ে ব্যবহার না হয়। পৃষ্ঠগড়ানো পানির সাথে এই ধরনের মিশ্রণ শুধু কৃষিতে রাসায়নিকের অপচয়কেই বুঝায়না বরং এটি পরিবেশের জন্য একটি ঝুঁকিও বটে।
বন্যা
[সম্পাদনা]যখন কোন জলধারা পৃষ্ঠগড়ানো পানির পরিমাণকে ধরে রাখতে পারেনা তখন বন্যার দেখা দেয়। বন্যা একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া যেটি পরিবেশের নানা প্রক্রিয়াকে বজায় রাখে, কিন্তু নদী দখলের মতো কাজ দ্বারা এটির বিরুদ্ধে যাওয়া যায়। বন্যা সমাজের জন্য ভালোও হতে পারে এবং ক্ষতিও করতে পারে। নিচু জমিতে কৃষিকাজ করে বন্যার লাভ নেওয়া যায় কারণ বন্যায় শস্যের জন্য নানা পুষ্টিকর উপাদান থাকে। শহর এলাকায়, পৃষ্ঠগড়ানো পানি বন্যার প্রধান কারণ যা প্রচুর ক্ষতি সাধন করে থাকে।[৮] এধরনের ক্ষতির মাঝে রয়েছে জীবনহানি, সম্পদ নষ্ট, পানি দূষণ, শস্যহানি, অস্থায়ী ঘর হারানো। বন্যা হলো সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাঝে সবচেয়ে ভয়াবহ।
মানুষের প্রভাব
[সম্পাদনা]নগরায়ন পৃষ্ঠগড়ানো পানির পরিমাণকে বৃদ্ধি করছে কারণ নগরে অনেক বেশি দালান ও পাথুরে রাস্তা থাকে যেগুলো পানিকে মাটিতে শোষণ করতে দেয়না। অধিক পৃষ্ঠগড়ানো পানি ভূগর্ভের পানি পূরণ কমিয়ে দেয়, যাতে পানি স্তর নেমে যায় ও খড়া দেখা দেয়। বিশেষ করে কৃষকদের জন্য ও যারা পানির কূয়ার উপর নির্ভর করে তাদের জন্য এটি ভয়াবহ।
নানা ধরনের দূষক পদার্থ দ্বারা মানুষ পৃষ্ঠগড়ানো পানিকে দূষিত করে। এই ধরনের দূষক পদার্থ নালা, নদী, হ্রদ এবং সমুদ্রের সাথে মিশতে পারে যা পানির রাসায়নিক পরিবর্তন করতে পারে এবং পানিচক্রে ও পরিবেশে সেটির প্রভাব পড়তে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় গবেষণা কাউন্সিল ২০০৮ সালের একটি গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্রের নগরে পানিমান সমস্যার প্রধান কারণ হিসেবে ঝড়ো পানিকে উল্লেখ করেছে।[৯]
পরিমাণ এবং গাণিতিক মডেল
[সম্পাদনা]গাণিতিক মডেল ও নানা পানিমান পরীক্ষা পদ্ধতি ব্যবহার করে পৃষ্ঠগড়ানো পানিকে পর্যবেক্ষণ করা যায়। দূষক নির্ভর নানা স্বয়ংক্রিয় পানিমান পরীক্ষা পদ্ধতি যেমন প্রাকৃতিক উপাদান, কৃত্রিম উপাদান, রাসায়নিক উপাদান, পিএইচ ইত্যাদি ব্যবহার করে পরিমাণ বের করা যায়। তাছাড়া, পানির মাঝে নানা রাসায়নিক বা তাত্ত্বিক পরীক্ষা করেও পরিমাণ বের করা যায়।
১৯৫০এর দশকে বা তার আগে, বন্যার আগাম বার্তার জন্য, পৃষ্ঠগড়ানো পানির পরিমাণ হিসাবের জন্য হাইড্রোলোজি ট্রান্সপোর্ট মডেলের আগমন ঘটে। ১৯৭০এর শুরুর দিকে কম্পিউটার মডেল তৈরি করা হয় যা পৃষ্ঠগড়ানো পানিতে কি পরিমান দূষক রয়েছে তা পর্যবেক্ষণ করে।
যুক্তরাষ্ট্র পরিবেশ সুরক্ষা এজেন্সি (ইপিএ) মিলিত হয়ে ১৯৭০এর মধ্যে প্রথম দিককার মডেল তৈরি করেন যা পৃষ্ঠগড়ানো পানিতে রসায়নের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করে।[১০]
অন্যান্য কম্পিউটার মডেলও তৈরি হয়েছে যেগুলো পৃষ্ঠগড়ানো পানিকে অনুসরন করা সম্ভব।
হ্রাস এবং ব্যবস্থা করা
[সম্পাদনা]ভূমি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ। অনেক বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা পৃষ্ঠগড়ানো পানিকে হ্রাস করার জন্য নানা গবেষণায় মনোযোগ দিয়েছে। অনেক পৌরসভা ভূ-উন্নয়নকারীদের জন্য নানা নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। ভূমি নিয়ন্ত্রণের এরকম একটি উদহারন পাওয়া যায় ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান্টা মোনিকা শহরে।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ছিল সংখ্যা নির্ভর, যা ছিল নদীর প্রবাহ সীমা নির্ধারন। পরবর্তীতে প্রবাহসীমা কমানোর জন্য নানা পদ্ধতি তৈরি করা হয়েছে।
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Ronnie Wilson, The Horton Papers (1933)
- ↑ Keith Beven, Robert E. Horton's perceptual model of infiltration processes, Hydrological Processes, Wiley Intersciences DOI 10:1002 hyp 5740 (2004)
- ↑ McMahon T.A. and Finlayson, B.; Global Runoff: Continental Comparisons of Annual Flows and Peak Discharges আইএসবিএন ৩-৯২৩৩৮১-২৭-১
- ↑ W.F. Spencer, Distribution of Pesticides between Soil, Water and Air, International symposium on Pesticides in the Soil, February 25–27, 1970, Michigan State University, East Lansing, Michigan
- ↑ Science News. "DDT treatment turns male fish into mothers." ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে 2000-02-05. (By subscription only.)
- ↑ Klimaszyk Piotr, Rzymski Piotr "Surface Runoff as a Factor Determining Trophic State of Midforest Lake" Polish Journal of Environmental Studies, 2011, 20(5), 1203-1210
- ↑ Renee K. Takesue,Curt D. Storlazzi. Sources and dispersal of land-based runoff from small Hawaiian drainages to a coral reef: Insights from geochemical signatures. Estuarine, Coastal and Shelf Science Journal. 2/13/17
- ↑ Center for Neighborhood Technology, Chicago IL “The Prevalence and Cost of Urban Flooding.” May 2013
- ↑ United States. National Research Council. Washington, DC. "Urban Stormwater Management in the United States." October 15, 2008. pp. 18-20.
- ↑ C.M. Hogan, Leda Patmore, Gary Latshaw, Harry Seidman et al. Computer modeling of pesticide transport in soil for five instrumented watersheds, U.S. Environmental Protection Agency Southeast Water laboratory, Athens, Ga. by ESL Inc., Sunnyvale, California (1973)