নির্মলকুমার বসু

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
নির্মলকুমার বসু
জন্ম(১৯০১-০১-২২)২২ জানুয়ারি ১৯০১
মৃত্যু১৫ অক্টোবর ১৯৭২(1972-10-15) (বয়স ৭১)
জাতীয়তাভারতীয়
পেশাঅধ্যাপক,নৃবিজ্ঞানী, সমাজকর্মী
পিতা-মাতাবিমানবিহারী বসু (পিতা)
কিরণশশী দেবী (মাতা)

নির্মলকুমার বসু (২২ জানুয়ারি ১৯০১ – ১৫ অক্টোবর ১৯৭২)[১] ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি নৃবিজ্ঞানী। ভারতের ঐতিহ্যবাহী সমাজ ও সংস্কৃতির পরিবর্তন ধারাকে নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণের সাথে নৃতত্ত্বে ভারতীয় ঐতিহ্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। [২] নৃতত্ত্ব,  প্রত্নতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান,  ভূতত্ত্ব, লোকসংস্কৃতি প্রভৃতি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহু ক্ষেত্রে তাঁর অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য।  ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীর একান্ত-সচিব হয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। লবণ সত্যাগ্রহ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নিয়ে কারাদণ্ড ভোগ করেন। [৩]

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন[সম্পাদনা]

নির্মলকুমারের জন্ম বৃটিশ ভারতের অধুনা পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার মইনগর গ্রামে। পিতা বিমানবিহারী বসু এবং মাতা কিরণশশী দেবী। বিভিন্ন বিদ্যালয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পডাশোনা করেন। যেমন ― পাটনার অ্যাংলো-সান্সক্রিট স্কুল, কামারহাটি সাগর দত্ত ফ্রি স্কুল,  রাঁচি ও পুরী জেলা স্কুল। তারপর কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজপ্রেসিডেন্সি কলেজ। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ভূতত্ত্ববিদ্যায় প্রথম শ্রেণিতে অনার্স সহ বিএসসি পাশ করেন। [৩] তারপর ভূতত্ববিদ্যায় স্নাতকোত্তর করতে ভরতি হন কলকাতা অধীনস্থ তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজে। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার কারণে পাঠ শেষ করতে পারলেন না। পরে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে অবশ্য তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃতত্ত্ববিদ্যায় এমএসসি ডিগ্রী লাভ করেন।[১]

নৃবিজ্ঞানে অবদান[সম্পাদনা]

অধ্যাপক নির্মলকুমার বসুর প্রধান ব্রত ছিল ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতির পরিবর্তনের ধারাকে নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণ করা। এজন্য তিনি নৃতত্ত্বের পদ্ধতির সাথে হিউম্যান জিয়োগ্রফি, মানবপ্রকৃতি বিজ্ঞানের সামাজিক ইতিহাস এবং প্রত্নতত্ত্বের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। ভারতীয় মন্দির-স্থাপত্য, লোকসংস্কৃতি, গ্রামজীবন এবং প্রাচীন ইতিহাস বিষয়ে তিনি প্রায় সারাজীবন গবেষণা করেছেন। ভারতের ৩২২টি নির্বাচিত গ্রামের মধ্যে ৩১১টি গ্রাম হতে গ্রামজীবনের সাংস্কৃতিক উপকরণ সংগ্রহ করে তিনি ভারতের "প্রেজেন্ট লাইফ ― এ স্টাডি অন ইউনিটি ইন দি ডাইভার্সিটি" গ্রন্থটি সম্পাদনা করেন।

তবে নৃতত্ত্ব বিষয়ে তিনি প্রথম গবেষণামূলক কাজ করেন ওড়িশার জুয়াংয়ে ১৯২৪-২৫ খ্রিস্টাব্দে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের সময়।[৪] ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে  বিশ্বে নৃবিজ্ঞান ও সমাজের  উন্নতির উপর একটি গ্রন্থ কালচারাল অ্যানথ্রোপলজি প্রকাশ করেন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ওড়িশার শিল্প ও স্থাপত্য নিয়ে রচনা করেন ক্যাননস অফ ওড়িসান আর্কিটেকচার। একজন নগরবিদ হিসাবে,  সমাজবিজ্ঞানের  উপরও তাঁর সমান আগ্রহ ছিল। যেমন ― ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত সাম এস্পেক্টস অফ বেঙ্গল, একজন নগরবিদের দৃষ্টিতে বাংলার জাতি নিয়ে রচনা করেন ক্যালকাটা ১৯৬৪: এ সোশ্যাল সার্ভে এবং ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত অ্যানথ্রোপলজি অ্যান্ড সাম ইন্ডিয়ান প্রবলেমস্, ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত 'দি স্ট্রাকচার অফ ইন্ডিয়ান সোসাইটি উল্লেখযোগ্য। [৫]

মানুষকে জানা ও বোঝার জন্য পদব্রজে প্রায় গোটা ভারতবর্ষ পরিক্রমা করেছেন। তাঁর বিজ্ঞান চেতনার অন্তরালে যে কবিপ্রাণতা ও দার্শনিক উপলব্ধি স্রোত প্রবাহিত ছিল তার পরিচয় পাওয়া যায় ―পরিব্রাজকের ডায়রী, বিদেশের টিঠি, নবীন ও প্রাচীন প্রভৃতি গ্রন্থে।

তিনি ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ হতে আমৃত্যু শরৎচন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত "ম্যান ইন ইন্ডিয়া" পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন এবং তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার পরিচালক ছিলেন। ১৯৫৭-৫৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি বার্কলে যান ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে যান। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে অসমের পার্বত্যজেলা জরিপে অংশগ্রহণ করেন এবং পরের বছর তৎকালীন  উত্তর-পূর্ব সীমান্ত অঞ্চল বর্তমানের অরুণাচল প্রদেশ উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায়।

তিনি দীর্ঘ কর্মজীবনে রাজনৈতিক আন্দোলনে ও সরকারি দপ্তরে সময় ব্যয় করেও বাংলা ও ইংরেজীতে সাতশোর বেশি নিবন্ধ এবং প্রায় ত্রিশটি গ্রন্থ রচনা করেছেন।[৬]

অধ্যাপক বসু ওড়িশার কোনার্কে অবস্থিত সূর্য মন্দির সম্পর্কে বাখ্যাসহ কোনার্কের বিবরণ শীর্ষক গ্রন্থ রচনা করেন। দীর্ঘদিন পর প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত ও সৌমেন পালের টীকাসহ বইটির নূতন সংস্করণ কলকাতার প্রকাশনা সংস্থা নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড প্রকাশ করে। প্রখ্যাত শিল্প ইতিহাসবিদ ও শিল্প বিশেষজ্ঞ  স্টেলা ক্র্যামিশ্চ বইটিতে এবং অন্যান্য ইংরাজীতে লেখা গ্রন্থে বর্ণিত কোনার্কের স্থাপত্য নিয়ে  পর্যালোচনা করেন।[৭]

১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত হন। এছাড়াও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে সংস্থার প্রভূত উন্নতি করেন। [৩]

সামাজিক ক্রিয়াকলাপ ও গান্ধীজীর সহযোগী[সম্পাদনা]

নির্মলকুমার ছাত্রাবস্থায় ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্র বসুর সংস্পর্শে এসে নানা রকম সামাজিক কাজকর্মে সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত হন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্ব শাখার রিসার্চ ফেলো হিসাবে কাজ করার সময় গান্ধীজির আহ্বানে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দেন ও কারাবরণ করেন। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি গান্ধীজির একান্ত সহযোগী ছিলেন। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময় থেকে তাঁর সচিব হিসাবে কাজ করেন। তিনি মহাত্মা গান্ধীর মতাদর্শ অনুপ্রাণিত ছিলেন এবং বিশ্লেষণ সহ মতাদর্শের  প্রশংসা  করে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে  রচনা করেন স্টাডিজ ইন গান্ধীজম। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে দ্বিতীয়বার কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯৪৬ - ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার সময় সচিব থাকায় গুরুদায়িত্ব পালন করেন। গান্ধীজির রাজনৈতিক দর্শন ও রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতি তিনি বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করে তাঁর মতবাদ প্রচার করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু যা তিনি যুক্তি দিয়ে গ্রহণ করতে পারেন নি তা বর্জন করেছেন। গান্ধীজির প্রার্থনাসভায় তাঁকে দেখা যেত না। গান্ধীজি সম্পর্কে তিনি তাঁর চিন্তা রেখে গেছেন ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত “মাই ডেজ উইথ গান্ধীজি” গ্রন্থে।[৮][৯]

উত্তরাধিকার[সম্পাদনা]

অধ্যাপক বসু গান্ধীর দর্শনকে উচ্চ মর্যাদায় ধারণ করতেন। তাই ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ হতে  ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল সেন্টার ফর দ্য আর্টস প্রতি দুই বছরে একবার এন কে বোস মেমোরিয়াল লেকচার্স আয়োজন করে থাকে। এছাড়া ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে নৃতত্ত্ববিদ সুরজিৎচন্দ্র সিনহা অধ্যাপক নির্মলকুমার বসুর জীবনী নিয়ে রচনা করেছেন অ্যানথ্রোপলজি অফ নির্মলকুমার বোস (১৯৭২–নির্মলকুমার বসুর নৃতত্ত্ব), নির্মলকুমার বোস: স্কলার ওয়ান্ডারার্স (১৯৮৬–নির্মলকুমার বসু: প্রাজ্ঞ পরিব্রাজক)।[১০]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "National Library" 
  2. Anthropology of Nirmal Kumar Bose, Surajit Chandra Sinha, 1970, quoted in http://www.hindu.com/mag/2006/02/12/stories/2006021200140300.htm ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৭ নভেম্বর ২০১২ তারিখে
  3. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু  (২০১৬)। সাহিত্য সংসদ, কলকাতা। পৃষ্ঠা ৩৬৩। আইএসবিএন 978-81-7955-135-6  অজানা প্যারামিটার | শিরোনাম= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য); |শিরোনাম= অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য)
  4. http://ignca.nic.in/nl002002.htm
  5. "Deceased Fellow"। INSA। ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ১৩ মে ২০১৬ 
  6. Bose, Nirmal Kumar, The Routledge Dictionary of Anthropologists
  7. Architectural Description of Konark Sun-Temple
  8. My days with Gandhi, Nirmal K Bose, Orient Longmans 1953
  9. My days with Gandhi, Nirmal K Bose
  10. Bhattacharjee, Nabanipa। "Through Thick and Thin Reflections on Nirmal Kumar Bose"