বিষয়বস্তুতে চলুন

ধীরেন্দ্রনাথ দাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ধীরেন্দ্রনাথ দাস
জন্ম(১৯০৩-০৮-০৮)৮ আগস্ট ১৯০৩
পাণ্ডুয়া, হুগলি জেলা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ভারত)
মৃত্যু২৫ নভেম্বর ১৯৬১(1961-11-25) (বয়স ৫৮)
পাইকপাড়া কলকাতা পশ্চিমবঙ্গ
ধরননজরুল গীতি
পেশাকণ্ঠশিল্পী, সংগীতজ্ঞ
কার্যকাল১৯২৭–১৯৬১

ধীরেন্দ্রনাথ দাস বা ধীরেন দাস (৮ আগস্ট ১৯০৩ - ২৫ নভেম্বর ১৯৬১) ছিলেন বিশিষ্ট নজরুল সংগীত শিল্পী ও সুরকার। নজরুলগীতির শ্রেষ্ঠ রূপকার ছিলেন তিনি। [১] তার সঙ্গীত প্রতিভায় মুগ্ধ কাজী নজরুল ইসলাম তাকে বলতেন শ্রুতিধর, তার গানের গান্ধারী[২]

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন[সম্পাদনা]

ধীরেন্দ্রনাথ দাসের জন্ম ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট ব্রিটিশ ভারতের অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার পাণ্ডুয়ায় তার মাতুলালয়ে। পিতা কালীচরণ দাস ছিলেন রাণীগঞ্জের বেঙ্গল কোল কোম্পানির নায়েব। অভিনয় ও সঙ্গীতে তার বিশেষ অনুরাগ ছিল। মাতা প্রভাবতী দেবী।[৩] ধীরেনের বাল্য শিক্ষা শুরু হয় কলকাতার পাইকপাড়ার শ্রীকৃষ্ণ পাঠশালায়। এখান থেকেই তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হন। কলেজে পড়ার সময়ই তিনি কলেজের অধ্যাপক শিশিরকুমার ভাদুড়ীর সান্নিধ্যে আসেন।[১] ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের রঘুবীর নাটকে শিশিরকুমারের সঙ্গে তিনি শ্যামলী চরিত্রে প্রথম মঞ্চে অভিনয় করেন। পিতার উৎসাহে ও নির্দেশে তিনি বিজয়া দেবীকে বিবাহ করেন। পরে পিতার মৃত্যু হলে তিনি লয়েডস্ ব্যাঙ্কে চাকরি নেন। [৩]

সঙ্গীত জীবন[সম্পাদনা]

কিন্তু পেশাদারি মঞ্চে অভিনয়ের আগ্রহে তিনি ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে দিয়ে শিশিরকুমারের সম্প্রদায়ে যোগ দেন। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি গান শেখেন রাধিকা গোস্বামী, সাতকড়ি মালাকার, জ্যোতিষপ্রসাদের কাছে। পরবর্তীতে তিনি এইচএমভি গ্রামোফোন কোম্পানিতে যশস্বী সুরকার ভূতনাথ দাসের সহকারী হিসাবে কাজ করতে থাকেন। গ্রামোফোন কোম্পানিই তখন তার প্রধান কর্মক্ষেত্র হয়ে পড়ে। এখানেই তিনি কৃষ্ণচন্দ্র দে, জমিরুদ্দিন খাঁ প্রমুখের কাছে তালিমের সুযোগ পান। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম রেকর্ড (p 8732) 'মন্দিরে একা বসে' আর 'কোন বেনীতে ব্রজের কানু স্থান পেলো' গান দুটি নিয়ে এইচএমভি থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে তার আরো চারটি রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল। তার মধ্যে- 'আমার সোনার বাংলা কাঙাল কিসে' এবং 'কোন দেশেতে তরুলতা' এই দুটি স্বদেশী গানের রেকর্ডটি বেশ জনপ্রিয় হয়।

কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে হৃদ্যতা-

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কাজী নজরুল ইসলাম শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার হিসাবে 'এইচএমভি'-তে যোগ দিলে উভয়ের মধ্যে যেন অগ্রজ-অনুজের সম্পর্ক স্থাপিত হয়।[২] অতি সহজে ধীরেনের গান তোলা আর মনে রাখার ক্ষমতায় নজরুল মুগ্ধ হন। তার এই প্রতিভার জন্য নজরুল তার নাম দেন শ্রুতিধর[১] নজরুল যে গান শিখিয়ে দিতেন ধীরেন সেই গান শেখাতেন শিল্পীদের। ধীরেন্দ্রনাথ দাসই প্রথম নজরুলের গানে সুর দেন কবির আন্তরিক ইচ্ছায়। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন রবীন্দ্রনাথের গানের ভাণ্ডারী ছিলেন, তেমনই ধীরেন দাস ছিলেন নজরুলের গানের ভাণ্ডারী। [৩] ধীরেনের দেওয়া সুরে নজরুলের দু-টি গান হল- কালো মেয়ের পায়ের তলায়আর লুকাবি কোথায় মা কালি[২][১] ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে মৃণালকান্তি ঘোষের কণ্ঠে গীত গান দু-খানি অত্যন্ত সমাদৃত হয়। [১]নজরুলগীতিতে ধীরেন্দ্রনাথ কণ্ঠ দিয়েছেন। ধীরেন্দ্রনাথ এইচএমভি, মেগাফোন টুইন-এ তার কাজীদার দেওয়া নাম গণিমিঞা নাম দিয়ে ইসলামি গান রেকর্ড করেছিলেন। ধীরেন দাসের সব চেয়ে জনপ্রিয় গান দু-টি ছিল-

  • আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও জননী এসেছে দ্বারে
  • আজ আগমনির আবাহনে

কর্মক্ষেত্রে নজরুল আর ধীরেনের এমন গভীর হৃদ্যতা ছিল যে একদিন নজরুল হঠাৎই ধীরেনকে বললেন-

ধীরেন, যে দিন আমি আর তুমি আর এই সুন্দর পৃথিবীতে থাকব না, সে দিন আমাদের এই মধুর সম্পর্ক কেউ কি মনে রাখবে?

উত্তরে ধীরেন বললেন-

কাজীদা, আপনার আমার সম্পর্ক নিয়ে একটা কবিতা লিখে ফেলুন না। আমরা যখন থাকব না, তখন এই কবিতা পড়ে মানুষ আমাদের সম্পর্কের কথা জানতে পারবে।

কবি নজরুল সঙ্গে সঙ্গেই চার পৃষ্ঠার একটি কবিতা লিখে প্রথম পাতায় উৎসর্গ করলেন এভাবে- আমার পরম স্নেহভাজন অনুজোপম শ্রীমান ধীরেন দাস কল্যাণীয়েষু [২]

নজরুলগীতি ছাড়াও, ধীরেন দাস রেকর্ড করেছেন, রাগপ্রধান, গজল, ভাটিয়ালি, বাউল, রবীন্দ্রসঙ্গীত, অতুলপ্রসাদী, দ্বিজেন্দ্রগীতিও। তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড করেছিলেন অনাদি ঘোষদস্তিদারের প্রশিক্ষণে।[১] ধীরেন্দ্রনাথ পাঁচশোর বেশি গানের রেকর্ড করেছিলেন। [৩] ১৯৪৬-৫৩ খ্রিস্টাব্দে স্টার থিয়েটারে কিছু নাটকে সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন, অভিনয় করেছেন। ধীরেন্দ্রনাথ দাস নাটক ও চলচ্চিত্রে যেমন অভিনয় করেছেন চলচ্চিত্রে সুর দিয়েছেন। পাঁচের দশকে তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লোকরঞ্জন শাখার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি শিল্পায়ন নামে একটি নাট্যসংস্থা গঠন করেছিলেন। [১]

অভিনীত নাটক-
  • সীতা
  • চন্দ্রগুপ্ত
  • প্রফুল্ল
  • বাসন্তী
  • বিদ্যাপতি
  • বিসর্জন
  • দুর্গেশনন্দিনী
অভিনীত চলচ্চিত্র-
  • ঋষির প্রেম
  • প্রহ্লাদ
  • পথের শেষে
  • সোনার সংসার
  • হাল বাংলা
  • মণিকাঞ্চন
সুরারোপিত ছায়াছবি-
  • খনা
  • পথের দাবী [২]

পারিবারিক জীবন ও জীবনাবসান[সম্পাদনা]

ধীরেন্দ্রনাথ দাস ও বিজয়া দেবীর সাত পুত্র ও পাঁচ কন্যা সহ পরিবারের সকলেই ছিলেন সঙ্গীতে নিবেদিত প্রাণ এবং বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত। তাদের মধ্যম পুত্র ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের বিশিষ্ট অভিনেতা অনুপ কুমার। আর অনুপ কুমারের জামাইবাবু ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেন[৩] ধীরেন দাস ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ নভেম্বর কলকাতায় প্রয়াত হন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, নভেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠা ৩১৮,৩১৯ আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  2. "কলকাতার কড়চা - অনুপম এক সুর-রসায়ন"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৫-২৫ 
  3. "ধীরেন্দ্রনাথ দাস; বঙ্গ সঙ্গীতের এক স্বতন্ত্র যুগ"।