ধামের গান

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

হিমালয়ের অদূরবর্তী পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে মহানন্দা-করতোয়া-টাঙ্গন নদীর অববাহিকায় লোকসংস্কৃতির মূল্যবান সম্পদ ধামের গান, গ্রামীণ সমাজে যা এখনো তুমুল জনপ্রিয়। স্থানীয় ইতিহাসবিদরা লোকসংস্কৃতি হিসেবে ধামের গানের উল্লেখ করলেও এর উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে সবিশেষ নজর দেন নি। ভাওয়াইয়া যেমন বৃহত্তর রংপুর-কোচবিহারের প্রধান সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ তেমনি ধামের গানও পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও অঞ্চলের সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ।

ধামের গান আদতে ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় অঞ্চলের স্থানীয় লোকনাট্যের একটি ধারা যা কালের গর্ভে এখনও হারিয়ে যায়নি। এ লোকনাট্য ধারাটি উক্ত অঞ্চলের গ্রামীণ জীবনে সকল ধর্মের সকল বয়সের সাধারণ মানুষের বিনোদনের এক নির্মল উৎস। হেমন্তের শেষ দিকে শুরু হয়ে শীতের শুরু পর্যন্ত ঠাকুরগাঁও অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে শত বছরের প্রাচীন এ লোকনাট্য গানের আসর বসে।

উৎপত্তি ও নামের তাৎপর্য[সম্পাদনা]

ধামের গানের উৎপত্তি ঠিক কবে হয়েছে এ সম্পর্কে সঠিক কোনও তথ্য পাওয়া যায় নি। অনুমান করা হচ্ছে কয়েকশত বছর আগে থেকে এই এলাকার মানুষ ধামের গান উদযাপন করে আসছে। ধাম শব্দের অর্থ স্থান বা আশ্রয়স্থল। শব্দটি ধর্মীয়ভাবে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য স্বীকৃত সমবেত হওয়ার জায়গাকে বোঝায়। এমন স্থানে কথোপকথন ও গানের মাধ্যমে উপস্থাপিত লোকজ নাট্যকেই 'ধামের গান' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় যা বৃহত্তর দিনাজপুর অঞ্চলের লোকনাট্যের একটি বিশেষ প্রকরণ। এই ঐতিহ্যবাহী লোকনাট্য ধারার আরও কয়েকটি নাম রয়েছে। ধান মাড়াইয়ের সাথে মিল থাকার কারণে কোথাও কোথাও এর নাম মারাঘুরা গান, পালা করে গাওয়া হয় বলে পালাটিয়া গান, কালীপূজার (হোলি) সময় অনুষ্ঠিত হয় বলে হুলিগান, লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে আয়োজন করা হলে লক্ষ্মীর ধামের গান নামেও অভিহিত করা হয়। গানের সংলাপ হয় সংক্ষিপ্ত আর ভাষা সম্পূর্ণ আঞ্চলিক। সংলাপ গদ্যেও হয় আবার গানেও হয়। গানের আধিক্যের কারণেই এর নামের শেষে গান যুক্ত করা হয়েছে।

সময়[সম্পাদনা]

শীতের আগমনে লক্ষ্মীপূজার পর থেকে শুরু হয়ে কালীপূজার পরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত এই গানের আসর চলে। সাধারণত ধান কাটা হয়ে গেলে আর ধামের আসর বসে না। গ্রামে গ্রামে রং-বেরঙের কাপড় টাঙিয়ে ও মাটির উঁচু ঢিবির চারপাশে বাঁশের ঘের দিয়ে সেখানে রাতভর এ গান অভিনয় সহকারে গাওয়া হয়। একরাতে তিন-চারটি পালা অনুষ্ঠিত হয়। অতীতে কোন কোন আসর সপ্তাহব্যাপী চলত। ধামের গান উপলক্ষে জন সমাগম কিছুটা লোকজ মেলারও আকার ধারণ করে। পালাগুলোর ব্যাপ্তি গল্পভেদে কয়েক ঘণ্টা হয়ে থাকে। একেকটি দল এসে একেক পালা পরিবেশন করে।

বিষয়বস্তু[সম্পাদনা]

ধর্মীয় উৎসবকে উপলক্ষ করে এর আয়োজন করা হলেও দৈনন্দিন জীবন যাপনের নানা উপকরণ নিয়েই এর গল্প ও গান তৈরি হয়। প্রান্তিক কিংবা সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখ, সাংসারিক জটিলতা, প্রেম, পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের অবহেলা, দুশ্চরিত্রের লাম্পট্য সহ যাবতীয় বিষয়াদি অত্যন্ত সরল সহজভাবে উঠে আসে এসব গানে। জটিল বিষয়গুলোকেও হাস্যরসের মাধ্যমে চিত্তাকর্ষক করে তোলা হয় অভিনয়ের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে গুণী শিল্পীরা ব্যঙ্গাত্মকভাবে সমাজের নানা বৈষম্য অন্যায় অসঙ্গতিও তুলে ধরেন। অর্থাৎ গ্রামীণ জীবনের সরল প্রবহমান ধারায় ঘটে যাওয়া ঘটনা কিংবা সমাজের নানা তির্যক প্রপঞ্চই ধামের গানে বিষয়বস্তু।

ধামের গানের শিল্পীদের তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ থাকেনা। এঁরা আহামরি কোন পেশাদার অভিনেতাও নন। অত্যন্ত চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে এরা বর্গাচাষি, দিন মজুর, ভ্যানচালক, রাজমিস্ত্রীর জোগালি ইত্যাদি সাধারণ পেশার লোক। এসব গানের আসরের কোন পাণ্ডুলিপিও হয় না, থাকে না যাত্রাপালার বা মঞ্চ নাটকের মত মতো কোনো প্রম্পটার। প্রাত্যহিক জীবনের ঘটনাবলী থেকেই নেওয়া হয় চরিত্রগুলো। সুতরাং মূল ধারার নাটক-যাত্রাপালার মত এখানে সংলাপ নিয়েও আহামরি কোন বিচার বিবেচনা করতে হয় না। শিল্পীরা মঞ্চে আসেন আর সাবলীলভাবেই অভিনয় করেন। তাদের অভিনয়ের দক্ষতা সমাজের প্রতি তাদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতারই পরিচয় বহন করে। ধামের গান আঞ্চলিক ভাষাতেই পরিবেশিত হয়। এর বিষয়বস্তু হল প্রতিদিনের চাক্ষুষ পর্যবেক্ষণ এবং তা খুবই জীবন্ত ও সাহিত্যিক মারপ্যাঁচ শূন্য। এ কারণে এতদঞ্চলে ধামের গানের আসক্তি ও জনপ্রিয়তা অন্য সব লোকনাট্য থেকে অনেক বেশি।

বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে ধামের গানকে শাস্ত্রীয়, রংপাঁচালি, পাঁচমিশালি ও যাত্রাপালা এ কয়েকটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা যায়। ধামের গানে যাত্রাপালা আদলে বিষয়বস্তুর সংযোজন সাম্প্রতিকতম সময়ে চলমান, যা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান।

আয়োজক এবং দর্শক-শ্রোতা[সম্পাদনা]

স্থানীয়রা জন সমাজই ধামের গানের আয়োজন করে থাকে। কখনও সবাই চাঁদা তুলে আবার কখনও অবস্থাসম্পন্ন গেরস্থের একক ব্যবস্থাপনায় আসর বসানো হয়। যদিও মূল অভিনেতারা গাঁয়েরই সাধারণ মানুষজন। কখনো কখনো দূরের গ্রাম থেকে পেশাদার অভিনেতাও ডেকে আনা হয়। সেক্ষেত্রে নামমাত্র পারিশ্রমিক দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। ধমের গানের আসর উপলক্ষ করে আয়োজকরা প্রতিযোগিতাও আয়োজন করে থাকেন। এক একটি পালার অভিনেতারা দলভুক্ত হিসেবে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। প্রতিটি দলের অভিনয়ের মান বিচার করেন আয়োজকরাই। পুরস্কারও দেওয়া হয় দলগতভাবে। পুরস্কার হিসেবে টেলিভিশন, বাইসাইকেল, গাভী, ছাগল অনেকে ক্ষেত্রে নগদ টাকাও দেওয়া হয়।

সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এর আয়োজন করলেও বিষয়বস্তু ও চিত্রনাট্যের সার্বজনীনতার কারণে তা সব ধর্মের সকল বয়সের নারী পুরুষের বিনোদনের খোরাক। কয়েক দশক আগেও যখন হেমন্তের ধান কাটার আগে মানুষের হাতে প্রচুর অবসর সময় থাকত তখন কয়েক মাইল অন্তর অন্তর এর আসর বসত আর পছন্দের গান শোনার জন্য মানুষ দল বেধে এ আসর থেকে ঐ আসরে যাওয়া আসা করত।

আসর[সম্পাদনা]

ঠাকুরগাঁও জেলায় প্রায় ছয় শতাধিক ধামের গানের আসর বসে। এ জেলায় প্রায় দুই শতাধিক ছাড়াও পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় বেশ কিছু ধামের গানের দল রয়েছে। ঢোল, খঞ্জনি, একতারা, খোল, বাঁশি, হারমোনিয়ামের ন্যায় সাধারণ বাদ্যযন্ত্রই এসব আসরে ব্যবহার করা হয়। যন্ত্রীরা সাধারণত মঞ্চের মাঝখানে গোল হয়ে বসেন অথবা কখনো কখনো মঞ্চের পাশে বসেন। কুশীলবরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে তাদের অভিনয় করেন এবং অন্যান্য মঞ্চ নাটকের মতোই অভিনয় শেষে প্রত্যাগমন করেন এবং মঞ্চে নতুন কুশীলবের আগমন হয়। প্রয়োজনে মঞ্চে একাধিক শিল্পীর আগমন ঘটে। যন্ত্রীদের বাদ্য যন্ত্রের পাশাপাশি গানের গলাতেও পারদর্শী হওয়া আবশ্যক। মঞ্চাভিনেতার গানের মাঝে মাঝে যন্ত্রীরাই কোরাস গেয়ে থাকেন, কখনো বা তারা তাৎক্ষণিকভাবে নতুন সংলাপের সূচনা করেন। এছাড়াও যন্ত্রীরা মঞ্চে শিল্পীর আগমন ও প্রত্যাগমনের মধ্যবর্তী সময়ে গানের কিছু কলিও গেয়ে থাকেন।

কয়েক ডজন পুরুষ এক একটি ধামের গানের দল গঠন করেন। গ্রামের যুবকরাই মেয়ে সেজে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে একটি কাহিনী ফুটিয়ে তোলেন, কদাচিৎ নারী শিল্পীর দেখা পাওয়া যায়। সনাতন ধর্মাবলম্বী লোকেরাই মূলত এ লোকনাট্যে অভিনয় করে। তবে দুএক জন মুসলিম কুশীলবেরও দেখা মেলে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পালার দলগুলোর নাম শিল্পীদের গ্রাম বা পাড়ার নাম অনুসারে হয়ে থাকে। যেমন কচুবাড়ী পালাটিয়া দল, চুচুলি-বটতলী পালাটিয়া দল, বালাভীর গোয়ালপাড়া পালাটিয়া দল।

সাধারণত বাড়ির আশেপাশের নির্দিষ্ট কোনও উঁচু স্থানে, কখনো কখনো মন্দির চত্বরে কিংবা বড় কোনও গাছের গোড়ায় ধামের গানের আসর বসে। এই মঞ্চ তৈরিতে তেমন কোন ঝক্কি ঝামেলা নেই, খুবই সাদামাটা কিছু যোগাড় যন্ত্রের প্রয়োজন মাত্র। সস্তা শামিয়ানা অথবা পুরনো শাড়ির ছাউনি টাঙিয়ে পরিবেশন করা হয় ধামের গান। কাগজ কেটে নকশা করে সাজানো হয় মঞ্চের প্রবেশপথ ও চারপাশ। দিন ছাড়াও রাতের বেলায় হারিকেন কিংবা হ্যাজাক লাইটের আলোয় রাতভর এই গানের উৎসব চলে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় পুরনো আমলের হারিকেন আর হ্যাজাকের ব্যবহার লোপ পেয়েছে। এর পরিবর্তে স্থান করে নিয়েছে হাল আমলের ডেকোরেশন। এখনও মঞ্চের চারপাশে মাটিতে খড় বা মাদুর বিছিয়ে বসে দর্শকরা এই গান উপভোগ করেন। যারা খড় বা মাদুরে বসার সুযোগ পান না তারা দাড়িয়ে থেকে গান উপভোগ করেন। গানের আসরকে উপলক্ষ করে রকমারি খাবার ও শিশুদের খেলনার দোকান জড়ো হয়ে জন সমাগমটিকে ছোট খাট মেলায় পরিণত করে।

কোচবিহারের লোকনাট্য[সম্পাদনা]

বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর-কোচবিহারের মধ্যে ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও মননশীলতার মধ্যে প্রাচীনকাল থেকেই সাদৃশ্য বিদ্যমান। সেই ধারাবাহিকতায় পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি-কুচবিহার এলাকায় ধামের গানের অনুরূপ লোকনাট্যের প্রচলন রয়েছে। তবে ওখানকার লোকনাট্যের সাথে ধামের গানের কিছুটা হলেও পার্থক্য বিদ্যমান

আধুনিকায়ন[সম্পাদনা]

স্থানীয় উদ্যোগে অনাড়ম্বরভাবে ধামের গানের আয়োজন করা হলেও এতদঞ্চলে এর গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপক। বিগত কয়েক দশকে ধামের গানের আসরের সংখ্যা কমে গেলেও এটি এখনও বিবর্ণ হয়ে যায় নি। বরং আধুনিকতার মিশেলে একে আরও হৃদয়গ্রাহী করে উপস্থাপন করা হচ্ছে। যদিও আজকাল যাত্রাগানের কিছু কিছু উপাদান ধামের গানে অনুপ্রবেশ করে এর স্বকীয়তাকে নষ্ট করছে এমনকি বাদ্যযন্ত্রেও ঢুকে পড়েছে পাশ্চাত্য উপকরণ। লোকসংস্কৃতি গবেষক মনতোষ কুমার একে ধামের গানের বিকৃতি হিসেবেই দেখছেন।[১]

সাহিত্যিক গুরুত্ব[সম্পাদনা]

ধামের গান নিয়ে আলোচনা পত্র পত্রিকায় কিছু লেখালেখি আর অধ্যাপক মনতোষ কুমার দে’র লোকনাট্য প্রসঙ্গ ও ধামের গান বইটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।[২] এর সম্পর্কে সুবিস্তৃত গবেষণা-অনুসন্ধানের আবশ্যকতা রয়েছে। অন্যান্য লোকনাট্যের মতো ধামের গানেরও নির্দিষ্ট রচয়িতা থাকে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পালাগুলো মৌখিক ও তাৎক্ষণিকভাবে রচিত। তবে বিগত কয়েক দশক ধরে মূল ধারার নাটক বা যাত্রার আদলে লিখিত সংলাপের প্রবণতাও কিছুটা লক্ষ্যণীয়। এ অঞ্চলের সমাজজীবনের বাস্তবতা-নিত্যনৈমিকতাই এর বিষয়বস্তু। নাটক বা যাত্রার মত এর গঠনশৈলী হয়ত পূর্ণাঙ্গ নয়, এবং হয়ত এর কোন দরকারও পড়েনা। সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের নানা ঘটনা যেমন হাসি-ঠাট্টা-রঙ্গরসের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয় তেমনিভবে দুঃখ-বেদনাকে আবেগঘন পরিবেশে। এ লোকনাট্যের কথ্য রীতি সম্পূর্ণ আঞ্চলিক।

প্রভাব[সম্পাদনা]

আরও পড়ুন[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "ঠাকুরগাঁওয়ের ঐতিহ্য ধামের গান" ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৬ আগস্ট ২০১৯ তারিখে, সামিউল্যাহ সমরাট, ১৩ নভেম্বর ২০১৬, বাংলা ট্রিবিউন
  2. "লোকনাট্য প্রসঙ্গ ও ধামের গান", রকমারি ডট কম