তুই রাজাকার

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

তুই রাজাকার একটি স্লোগান। এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তা ও সমর্থনকারী বাংলাদেশী বিশ্বাসঘাতকদের বোঝাতে শ্লেষাত্মক প্রতিক্রিয়া ও অভিব্যক্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সর্বপ্রথম ১৯৮৮ সালে হুমায়ূন আহমেদ রচিত বাংলাদেশ টেলিভিশনের নাটক বহুব্রীতিতে প্রথম প্রচার করা হয়, যা ছিল ১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রথম বার রাজাকার শব্দের ব্যবহার। নাটকে প্রচারের পর এটি নিয়ে মুদ্রণ মাধ্যমে সংবাদ নিবন্ধ, কার্টুন আসে। এটি বাংলাদেশের বিভিন্ন মানবতা বিরোধি অপরাধের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলনে বহুল ব্যবহৃত স্লোগান।

উৎপত্তি[সম্পাদনা]

রাজাকার শব্দটি বাংলাদেশে নিন্দনীয় অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে যার অর্থ "বিশ্বাসঘাতক"।[১] এই স্লোগানটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করা হয় হুমায়ূন আহমেদ লিখিত ১৯৮৮ সালের বহুব্রীহি টেলিভিশন ধারাবাহিকে। ধারাবাহিকটির একটি দৃশ্যে প্রথমবারের মতো একটি পাখি স্লোগানটি উচ্চারণ করে।[২] ধারাবাহিকটির ১২ তম পর্বে, সোবহানের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া ইমদাদ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে ঠাট্টা করায় সোবহানের শ্যালক টেপ রেকর্ডারের সাহায্যে তিনটি টিয়াকে "তুই রাজাকার" শব্দটি শেখানোর চেষ্টা করেন। তিনটি পাখির মধ্যে দুটি মারা যায়, কিন্তু শেষ টিয়াটি কথাটি বলতে শেখে।[৩] হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে ধারাবাহিক নাটকটি প্রচারিত হয় যখন রাজাকারদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারতো না।[৪] বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীনতার ইতিহাস সংক্রান্ত বিষয় সরকারী গণমাধ্যমে প্রচার হতো না। সেন্সরশিপ এড়াতে টিয়া পাখিকে দিয়ে 'রাজাকার' উচ্চারণ করানো হয়েছিল।[৫]

ব্যবহার[সম্পাদনা]

নাটক প্রচারের আগ পর্যন্ত ১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশের টেলিভিশন ও রেডিওতে 'রাজাকার' শব্দটি কোন অনুষ্ঠানে ব্যবহার হয়নি। নাটকে 'তুই রাজাকার' স্লোগানের মাধ্যমে দীর্ঘ বিরতির পর 'রাজাকার' শব্দের প্রচার ঘটে।[৩] স্লোগানটি জনপ্রিয় হওয়ার পর রাজাকারদের প্রতি মানুষের ঘৃণা বেড়ে যায়।[২] ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে আজকের কাগজ পত্রিকায় "তুই রাজাকার" শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধে সংক্ষেপে একাত্তরে রাজাকারদের দ্বারা সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বর্ণনা দেওয়া হয়। নিবন্ধটিতে শিশির ভট্টাচার্যের আঁকা একটি কার্টুনও ছিলো।[৬] মানবতাবিরোধী অপরাধের শাস্তি হিসেবে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে রাজাকার হিসেবে কাজ করা আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের প্রতিবাদে ২০১৩-এর শাহবাগ আন্দোলনে আবারও এই স্লোগানটি ব্যবহার করা হয়।[৭]

তাৎপর্য[সম্পাদনা]

দ্য ডেইলি স্টারের পার্থ প্রতিম ভট্টাচার্য এই স্লোগান সম্পর্কে বলেন, "...এই টিয়া পাখিকে সেন্সরশিপের বেড়াজালে আবদ্ধ জাতির রুদ্ধ কণ্ঠের প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছিল এবং প্রশিক্ষিত পাখিটি সুযোগ বুঝে 'তুই রাজাকার' বলে উঠতো। এর মাধ্যমে বলা যায় না এমন একটি কথাও তখন সুকৌশলে সবার সামনে চলে এসেছিল।"[৫] সেলিনা হোসেনের মতে টেলিভিশন ধারাবাহিকটির মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ দেশের মানুষদের যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করেছেন।[৮]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. মুখোপাধ্যায়, নয়নিকা (২০০৯)। Traitors: Suspicion, Intimacy, and the Ethics of State-Building [বিশ্বাসঘাতক: সন্দেহ, অন্তরঙ্গতা এবং রাষ্ট্র-নির্মাণের নীতিশাস্ত্র] (ইংরেজি ভাষায়)। ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়া প্রেস। পৃষ্ঠা ৪৯। আইএসবিএন 978-0-8122-4213-3 
  2. সাজু, শাহ আলম (৬ জানুয়ারি ২০২০)। "সোনালি যুগের জনপ্রিয় নাটক"দ্য ডেইলি স্টার। ১৮ জুলাই ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ 
  3. মজিদ, সাকুর (৯ নভেম্বর ২০১২)। "বহুব্রীহি ও 'তুই রাজাকার'"বিডিনিউজ২৪.কম। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ 
  4. ইসলাম, উদিসা (১৯ জুলাই ২০১৬)। "মুখ বন্ধ রাখার সময়ে হুমায়ূনই বলেছিলেন 'তুই রাজাকার'"বাংলা ট্রিবিউন। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ 
  5. পার্থ প্রতিম ভট্টাচার্য (৩ নভেম্বর ২০২১)। "রাজাকার আখ্যা দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার বিপত্তি"দ্য ডেইলি স্টার। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ 
  6. সৈয়দ বোরহান কবির (৩০ অক্টোবর ২০২১)। "আওয়ামী লীগে 'তুই রাজাকার' বিতর্ক"বাংলাদেশ প্রতিদিন। ৬ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ 
  7. "তুই রাজাকার: সংলাপ থেকে স্লোগান"বাংলানিউজ২৪.কম। ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৩। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ 
  8. হোসেন, সেলিনা (২১ জুলাই ২০১২)। "তুই রাজাকার' তাঁর অমর সৃষ্টি"কালের কণ্ঠ। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২