জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম
জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম جمیعت علمائے اسلام | |
---|---|
সংক্ষেপে | জে.ইউ.আই. |
প্রতিষ্ঠাতা | শাব্বির আহমদ উসমানি |
প্রতিষ্ঠা | ২৬ অক্টোবর ১৯৪৫ |
বিভক্তি | জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ |
পরবর্তী | |
ভাবাদর্শ | |
দলীয় পতাকা | |
জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম একটি ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল। ১৯৪৫ সালের ২৬ অক্টোবর শাব্বির আহমদ উসমানির নেতৃত্বে জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দলটি পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করে। বর্তমানে এটি কয়েক ভাগে বিভক্ত।[১]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ
[সম্পাদনা]মূল জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ প্রতিষ্ঠা হয় ব্রিটিশ ভারতে ১৯১৯ সালে। [২]
জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম
[সম্পাদনা]১৯৪৫ সালের ১১ জুলাই কলকাতার একটি সম্মেলনে শাব্বির আহমদ উসমানিকে সভাপতি করে জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম গঠিত হয়। ১৯৪৯ সালে শাব্বির আহমদ উসমানির মৃত্যুর পরে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী জাফর আহমদ উসমানি এর প্রধান বা আমির হন।[১][২] স্বাধীন পাকিস্তানে মুসলিম লীগ নেতারা ইসলামি শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে কালক্ষেপণ করতে থাকে। দীর্ঘ তিন বছর জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম সরকারের সাথে চেষ্টা করে যখন ইসলামী সংবিধানের কোনো ব্যবস্থা হয়নি তখন মুহাম্মদ আলী জালন্দরীর চেষ্টায় এহতেশামুল হক থানভীর আহ্বানে ২১, ২২, ২৩, ২৪ জানুয়ারী ১৯৫১ তারিখে সায়্যিদ সুলায়মান নদভীর সভাপতিত্বে আলেমদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং সর্বসম্মতিক্রমে ইসলামের ২২ দফা মূলনীতি তৈরি করা হয়। ১৯৫২ সালে জমিয়তের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। আহমদ আলী লাহোরীকে সভাপতি ও এহতেশামুল হক থানভীকে সেক্রেটারী করা হয়। ১৯৫৩ তে জমিয়তের ডাকে খতমে নবুওয়াত আন্দোলন হয়। ৭,৮, ৯ অক্টোবর ১৯৫৬ ইং মুলতানে উলামা কনভেনশনে লাহোরীকে সভাপতি ও হাযারভীকে সেক্রেটারী নির্বাচন করা হয়। ২৮, ২৯, ৩০ জুন ১৯৫৭ তারিখে জমিয়তের উদ্যোগে মুলতানে ১৮৫৭ থেকে শুরু হওয়া জিহাদে আযাদীর শত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে জমিয়তের নির্বাচনি ইশতেহার মঞ্জুর করা হয়। ১৯৫৮ সালে আহমদ আলী লাহোরীকে আহবায়ক করে নির্বাচনী বোর্ড তৈরি করা হয়। ৭ অক্টোবর ১৯৫৯ সালে দেশে সামরিক শাসন জারি হয়। ফলে সব রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হয়ে গেলে জমিয়ত 'নেযামুল উলামা' গঠন করে এবং নেযামুল উলামার পক্ষ থেকে আইয়ুব খানের কাছে ইসলামী শাসন চালু করার প্রস্তাব পেশ করা হয়। অতঃপর ৬২ সাল পর্যন্ত জমিয়ত নেযামুল উলামা নামে কার্যক্রম চালিয়ে যায়। ২২ ফেব্রুয়ারী ১৯৬২ সালে আহমদ আলী লাহোরী মৃত্যুবরণ করেন। অতঃপর ২১ মার্চ ১৯৬২ লাহোরে নেযামুল উলামার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আব্দুল্লাহ দরখাস্তিকে নেযামুল উলামার আমীর নিযুক্ত করা হয়। মে ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মুফতি মাহমুদ জাতীয় পরিষদে এবং গোলাম গৌউস হাযরাভী প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হন। ১৯৬৩ সালে জানুয়ারীতে দরখাস্তি, গোলাম গৌছ হাযরভী ও মুফতী মাহমূদ পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন। এই বছর মার্চে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। মুফতী মাহমূদ পাকিস্তানের সংবিধানে অনেক সংশোধনী বিল উত্থাপন করেন। ৩ জুলাই ১৯৬৩ অধিবেশনে মুফতী মাহমুদ মুসলিম পারিবারিক আইনের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক আলোচনা করেন। ফলে সরকার বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখিন হয়। ১৯৬৬-৬৭ সালে জমিয়ত নেতৃবৃন্দ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে পাঁচ হাজারের মত সভা করেন। দরখাস্তি ৫০০, হাযারভী ৪০০, মুফতী মাহমুদ ২০০, উবায়দুল্লাহ আনওয়ার ৫০, কাজী মাযহার হুসেইন ৪০০, কাজী আব্দুল লতীফ ৪০০, আজমল খান ১৫০ সফর করেন। ৩,৪,৫ মে ১৯৬৮ সালে লাহোরে জমিয়তের ঐতিহাসিক উলামা কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। উভয় পাকিস্তানের প্রায় পাঁচ হাজার উলামা উপস্থিত হন। পূর্ব পাকিস্থান থেকে মাওলানা বশিরুদ্দীন শায়খে বাঘা, আব্দুল করীম শায়খে কৌড়িয়া, শামছুদ্দীন কাসিমী, শফিকুল হক আকূনী, আরিফ রাব্বানী, আশরাফ আলী বিশ্বনাথী, নূরুদ্দীন গওহরপুরী ও মহিউদ্দিন খানসহ ২০-২২ জনের প্রতিনিধি দল উলামা কনভেনশনে যোগ দেন। পূর্ব পাকিস্তানের জমিয়ত নেতৃবৃন্দকে লাহোর এয়ারপোর্টে ঐতিহাসিক সম্বর্ধনা প্রদান করা হয়। ৬৮ সালে নিখিল পাকিস্তানে সর্বত্র আইনে শরীয়ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১০ মার্চ ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খান রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক করেন। মুফতী মাহমুদ ইসলামী হুকুমতের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবী উত্থাপন করেন। পাকিস্তানি নেতাদের মধ্যে শুধু মুফতী মাহমুদ ইসলামী হুকুমতের শর্তে শেখ মুজিবেে ছয় দফা সমর্থন করেন। ২৫ মার্চ ৬৯ সালে আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দেন। ২৬ মার্চ ইয়াহয়া খান প্রেসিডেন্ট হন এবং ডিসেম্বর ৭০ সালে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। ১৯৭০ এর নির্বাচনের পর সিমান্ত প্রদেশে জমিয়ত সরকার গঠন করে। মুফতী মাহমুদ মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। জাতীয় পরিষদে আওয়ামীলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মর্যাদা লাভ করে। মুফতী মাহমূদ, ওলীখানসহ অনেক নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ইয়াহয়া খানের উপর চাপ সৃষ্টি করেন। কিন্তু ভুট্টু ও ইয়াহয়া খানের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে বাধ্য হয়।
মুফতী মাহমুদ সীমান্তের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তার রাজ্যে:
- মদ ও জুয়া নিষিদ্ধ করেন।
- মহিলাদের জন্য পর্দার আইন চালু করেন।
- সেলওয়ার ও পাঞ্জাবীকে জাতীয় পোশাক ঘোষণা দেন।
- ইউনিভার্সিটি ও কলেজে ভর্তির জন্য কুরআন শরীফের বিশুদ্ধ তেলাওয়াতকে আবশ্যকীয় করেন।
- ১৯১ টি মডেল ও হাই স্কুলের প্রত্যেকটিতে একজন কারী, একজন দীনিয়াতের শিক্ষক ও একজন আরবী শিক্ষক নিয়োগ দেন।
- যৌতুকের পরিমাণ নির্ধারণ করে অতিরিক্ত যৌতুক নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
- রমযানে হোটেল - রেস্তোরা বন্ধের বিল পাশ করেন।
- সরকারী ভাষা উর্দু নির্ধারণ করেন।
কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক আইন হওয়াসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত জমিয়তেরই চেষ্টার ফল। একইভাবে কেন্দ্রে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, কাদিয়ানীদের অমুসলিম মাইনরটি ও এভাবে অনেক ক্ষেত্রে মুফতী মাহমুদ সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে জমিয়তের সাতজন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ছয় জন এম.পি. ছিলেন। জমিয়তের মহাসচিব মুফতী মাহমূদ পাকিস্তান সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন। তিনি গোলাম গৌছ হাজারভী ও আব্দুল হক হক্কানীকে নিয়ে নিম্নে বর্ণিত দফাগুলোকে সংবিধানের মূলনীতিতে নিয়ে আসতে সক্ষম হন।
- পাকিস্তানের সরকারী ধর্ম ইসলাম হবে।
- পাকিস্তানের অর্থনৈতিক নেযাম সুদবিহীন হবে।
- পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী মুসলমান হবে।
- পাকিস্তানের সংসদের স্পীকার, ডেপুটি স্পিকার ও সিনেটর মুসলমান হবে।
- উলামাদের তৈরি করা ২২ দফা সংবিধানের অংশ হিসাবে গণ্য হবে।
- একমাত্র আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতা ও হাকিমিয়াতের মালিক পাকিস্তানের জনগণ কুরঅন - সুন্নার আলোকে পাকিস্তানে আল্লাহর দীন বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে।
১৯৭৪ সালে জমিয়ত খতমে নবুওত আন্দোলনের ডাক দিলে সারাদেশে হরতাল পালন করা হয় এবং কাদিয়ানীদের বয়কট করা হয়। ৩০ জুন বিরোধী দলীয় ২২ সাংসদের পক্ষ থেকে মুফতী মাহমূদ সংসদে কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম সংখ্যালঘু’র বিল উত্থাপন করেন। পরবর্তী সংসদ অধিবেশনে মির্জা নাছিরকে সংসদে তলব করা হয়। মির্জা সংসদে তার দুইশত পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। মুফতী মাহমুদ তাকে ১৭ টি প্রশ্ন করেন। কিন্তু মির্জা তার কোনো উত্তর দিতে পারেনি। ফলে ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ সংসদে কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম সংখ্যালঘুর বিল পাস হয়ে যায়। ১৯৭৭ সালে জমিয়ত “নেযামে মুস্তফা” আন্দোলন চালায়। ১৯৭৯ অক্টোবরে মুফতী মাহমুদ আফগানিস্তানে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জেহাদের ঘোষণা দেন। জমিয়তের পক্ষ থেকে আফগানীদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বপ্রকার সহযোগিতা করা হয়। ১৯৮০ সালের ১৪ অক্টোবর মুফতী মাহমুদ ইন্তেকাল করেন। ১৯৮১ সালে জমিয়তের মজলিসে উমূমী সিরাজ আহমদ দীনপুরীকে সভাপতি ও ফযলুর রহমানকে জেনারেল সেক্রেটারী নির্বাচন করে।
সাংগঠনিক বিভক্তি
[সম্পাদনা]মুফতি মাহমুদের মৃত্যুর পর, জিয়াউল হকের শাসনামলে এই দলটি বিভক্ত হয়ে যায়। জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম (স) সরাসরি জিহাদকে সমর্থন করে এবং জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম (ফ) পাকিস্তানের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনকে সমর্থন দেয়।[১]
২০০৭ সালে তালেবানদের প্রকাশ্যে দিয়ে জমিয়ত (ফ) থেকে আলাদা হয়ে মুহাম্মদ আসমতুল্লাহর নেতৃত্বে জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম (ন) গঠিত হয়। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে তা আবার মাতৃ সংগঠনের সাথে মিলিত হয়ে যায়।[৩]
মূল দল থেকে বিভক্ত:
- ফজলুর রহমানের নেতৃত্বধীন – জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম (ফ)[১]
- সামিউল হকের নেতৃত্বধীন - জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম (স) [১]
- জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম (ন) (বর্তমানে বিলুপ্ত)
- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]উদ্ধৃতি
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ গ ঘ ঙ "জমিয়ত উলামায়ে ইসলামের ইতিহাস"। Islamopediaonline.org। ১ জানুয়ারি ২০১৫। ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ মার্চ ২০২০।
- ↑ ক খ জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম - ফজলু ডন, ৫ এপ্রিল ২০১৩ প্রকাশিত
- ↑ প্রতিবেদক, নিজস্ব (২০১৬-০২-২৬)। "জমিয়তের দুটি দল সংযুক্ত"। ডন (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-১৭।
গ্রন্থপঞ্জি
[সম্পাদনা]- আহসান, সৈয়দ (১২ জানুয়ারি ২০১৮)। "ইতিহাসে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও মাছিহাতা সম্মেলন ১৯৫০ – ১"। দৈনিক ইনকিলাব।
- আহসান, সৈয়দ (১৯ জানুয়ারি ২০১৮)। "ইতিহাসে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও মাছিহাতা সম্মেলন ১৯৫০ – ২"। দৈনিক ইনকিলাব।