বিষয়বস্তুতে চলুন

কোলয়েড

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

কোলয়েড (ইংরেজি: Colloid) হলো পদার্থের এমন একটি অবস্থা, যার মধ্যে একটি পদার্থ (কঠিন, তরল বা গ্যাসীয়) অপর একটি পদার্থের (কঠিন, তরল বা গ্যাসীয়) মধ্যে ১০–৭ থেকে ১০–৫ সেমি[১][২] ব্যাস বিশিষ্ট কনা রূপে বিস্তৃত থেকে স্থায়ী অসমসত্ত্ব তন্ত্র উৎপন্ন করে।[৩]

একটি কোলয়েডের স্ক্যানিং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ চিত্র

পদার্থের কোলয়েড অবস্থা পৃষ্ঠতল ও কোলয়েড বিজ্ঞানের অংশ। ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী ফ্রান্সিসকো সেলমি এই বিষয়ে প্রথম আলোকপাত করেন।[৪][৫][৬][৭] তিনি পদার্থের এই অবস্থার নাম দেন Pseudosolution বা ছদ্ম দ্রবণ। পরে বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে এর আরো ব্যাখ্যা দেন[৮] এবং বিজ্ঞানী থমাস গ্রাহাম কোলয়েড নামটি প্রদান করেন (১৮৬১)।[৯]

ইউপ্যাক প্রদত্ত সংজ্ঞা

কোলয়েড: কোলয়েডীয় তন্ত্রের ক্ষুদ্ররূপ।[১০][১১]

Colloidal: State of subdivision such that the molecules or polymolecular particles dispersed in a medium have at least one dimension between approximately 1 nm and 1 μm, or that in a system discontinuities are found at distances of that order.[১০][১১][১২]

উপাদান[সম্পাদনা]

কোলয়েড সিস্টেমে দুটি উপাদান বর্তমান যথাক্রমে বিস্তৃত দশা ও বিস্তার মাধ্যম।

  1. বিস্তৃত দশা: যে উপাদানটি ১০–৭ থেকে ১০–৫সেমি ব্যাস বিশিষ্ট কণারূপে অপর দশার মধ্যে অসমভাবে বিস্তৃত থাকে তাকে বিস্তৃত দশা (ইংরেজি: Dispersed phase) বলে।
  2. বিস্তার মাধ্যম: যে উপাদানে বিস্তৃত দশার কণাগুলি অসমভাবে ছড়িয়ে থাকে তাকে বিস্তার মাধ্যম (ইংরেজি: Dispersion medium) বলে।

শ্রেণীবিভাগ[সম্পাদনা]

বিস্তার মাধ্যম ও বিস্তৃত দশার ভৌত অবস্থার উপর ভিত্তি করে[সম্পাদনা]

বিস্তার মাধ্যম গ্যাস তরল কঠিন
বিস্তৃত
দশা
গ্যাস ফোম কঠিন ফোম
তরল তরল অ্যারোসল ইমালসন জেল
কঠিন কঠিন অ্যারোসল সল কঠিন সল
উদাহরণ তালিকা
  • ফোম: সাবানের ফেনা, সোডা ওয়াটার।
  • কঠিন ফোম: ঝামা পাথর, কেক।
  • তরল অ্যারোসল: কুয়াশা, মেঘ।
  • ইমালসন: দুধ, শ্যাম্পু, ক্রিম।
  • জেল: পনির, দই, জেলি।
  • কঠিন অ্যারোসল: ধোয়া, বায়ুর ধুলো।
  • সল: রং, গোল্ড সল, মিল্ক অফ ম্যাগ্নেসিয়া।
  • কঠিন সল: রঙিন কাচ, সংকর ধাতু।

বিস্তার মাধ্যমের প্রতি বিস্তৃত দশার আসক্তি অনুযায়ী[সম্পাদনা]

এটির সাপেক্ষে কোলয়েডকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়, যথাক্রমে: দ্রাবক-আকর্ষী কোলয়েড (ইংরেজি: Lyophilic Colloid) ও দ্রাবক-বিকর্ষী কোলয়েড (ইংরেজি: Lyophobic Colloid)।

বৈশিষ্ট্য দ্রাবক-আকর্ষী কোলয়েড দ্রাবক-বিকর্ষী কোলয়েড
বিস্তৃতি দশার প্রকৃতি প্রধানত জৈব যৌগকে ব্যবহার করা হয় প্রধানত অজৈব যৌগকে ব্যবহার করা হয়।
প্রস্তুতি খুব সহজে প্রস্তুত করা যায় সহজে প্রস্তুত করা যায় না, বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োজন।
দৃশ্যমানতা পরা-অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে সহজে দেখা যায় না পরা-অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে সহজে দেখা যায়।
দ্রাবকায়ন কণাগুলি সবসময় দ্রাবক দ্বারা সংযোজিত থাকে এদের থাকে না।
স্থায়িত্ব ও প্রকৃতি বেশি স্থায়ী ও পরাবর্ত প্রকৃতির কম স্থায়ী ও অপরাবর্ত প্রকৃতির
সান্দ্রতা বিস্তার মাধ্যম অপেক্ষা বেশি সান্দ্র। বিস্তার মাধ্যমের প্রায় অনুরূপ।
পৃষ্ঠটান সাধারণত বিস্তার মাধ্যম অপেক্ষা কম হয়। বিস্তার মাধ্যমে প্রায় অনুরূপ হয়।
টিন্ডাল প্রভাব অস্পষ্ট অতি স্পষ্ট
তঞ্চন সহজে সম্ভব নয়। তঞ্চনের জন্য অতিরিক্ত তড়িৎবিশ্লেষ্য প্রয়োজন সহজেই তঞ্চিত হয়। অল্প পরিমাণ তড়িৎবিশ্লেষ্য তঞ্চন ঘটাতে পারে
তড়িৎ ক্ষেত্রের প্রভাব কণাগুলি তড়িৎ ক্ষেত্রের প্রভাবে উভয়দিকেই গমন করতে পারে অথবা কোন দিকেই গমন নাও করতে পারে। কারণ কণাগুলি তড়িদাহিত হতেও পারে নাও হতে পারে। কণাগুলি তড়িৎ ক্ষেত্রের প্রভাবে ক্যাথোড বা অ্যানোড যেকোনো একদিকে গমন করে। কারণ কণাগুলি ধনাত্মক বা ঋণাত্মক যেকোনো এক ধরনের আধানে আহিত হয়।
জেল গঠন খুব সহজে গঠিত হতে পারে কদাচিৎ গঠিত হয়

বিস্তৃত দশার প্রকৃতি অনুযায়ী[সম্পাদনা]

বিস্তৃত দশার প্রকৃতি অনুযায়ী কোলয়েড তিন প্রকার:

বহু অণুসমন্বিত কোলয়েড (Multimolecular)[সম্পাদনা]

যে কোলয়েড সিস্টেমে বিস্তার মাধ্যমে বিস্তৃত কোলয়েড কণাগুলি বিস্তৃত দশার বহু সংখ্যক পরমাণু বা অণুর একত্রীভবনে সৃষ্ট হয়, তাকে বহু অণুসমন্বিত কোলয়েড বলে।

এক্ষেত্রে বিস্তৃত দশার অণু বা পরমাণু গুলি পরস্পরের সঙ্গে ভ্যান ডার ওয়ালস বলের মাধ্যমে আবদ্ধ থাকে। এগুলি সাধারণত দ্রাবক বিকর্ষী প্রকৃতির হয়।

উদাহরণ – সালফার সল (বহুসংখ্যক সালফার অণু একত্রিত হয়ে জলীয় মাধ্যমে কোলয়েড কণার আকারে বিস্তৃত থাকে)।

বৃহদাণবিক কোলয়েড (Macromolecular)[সম্পাদনা]

এই কোলয়েডের ক্ষেত্রে বিস্তার মাধ্যমে বিস্তৃত প্রতিটি কোলয়েড কণা একটি করে বৃহৎ আকারের অণু দ্বারা গঠিত হয়।

এই ধরনের কোলয়েড খুব স্থায়ী হয় এবং দ্রাবক আকর্ষী প্রকৃতির হয়।

উদাহরণ – পলিমার যৌগ গুলি যেমন শ্বেতসার, প্রোটিন, জিলাটিন, অ্যালবুমিন

সংযোজিত কোলয়েড (Associated)[সম্পাদনা]

দীর্ঘ হাইড্রোকার্বন শৃঙ্খল যুক্ত কিছু বিশেষ জৈব যৌগের (যেমন – সাবান, ডিটারজেন্ট) আণবিক বা আয়নীয় সংযোজনের ফলে এই কোলয়েড উৎপন্ন হয়।

এই যৌগ গুলির অণুর গঠনে দীর্ঘশৃঙ্খলযুক্ত হাইড্রোকার্বনের একটি অংশ এবং একটি আয়নীয় বা ধ্রুবীয় অংশ বর্তমান। হাইড্রোকার্বন অংশটি তাই এটি জল বিকর্ষী এবং আয়নীয় অংশটি জল আকর্ষী।

উদাহরণ – সোডিয়াম স্টিয়ারেটকে (সাবান) জলে দ্রবীভূত করলে এরূপ কোলয়েড গঠিত হয়।

প্রস্তুতি[সম্পাদনা]

দ্রাবক-আকর্ষী কোলয়েড[সম্পাদনা]

এই ধরনের কোলয়েড সহজেই প্রস্তুত করা সম্ভব। বিস্তৃত দশাকে বিস্তার মাধ্যমে যুক্ত করে ঝাঁকালে বা উপযুক্ত উষ্ণতায় উত্তপ্ত করলে উৎপন্ন হয়ে যায়।

দ্রাবক-বিকর্ষী কোলয়েড[সম্পাদনা]

দুই ভাবে প্রস্তুত করা হয়:

বিভাজন পদ্ধতি[সম্পাদনা]

  • যান্ত্রিক বিভাজন: কোলয়েড মিল নামক যন্ত্রের সাহায্যে যে পদার্থের কোলয়েড তৈরি করতে হবে সেটিকে যথাসম্ভব গুঁড়ো করে বিস্তার মাধ্যমের সাথে মিশিয়ে প্রলম্বন তৈরি করা হয়। তারপর দুটি গোলাকার ধাতব চাকতি প্রবল বেগে বিপরীত দিকে ঘুরতে থাকার ফলে সেই প্রলম্বন কোলয়েডে পরিণত হয়।

ঘনীভবন পদ্ধতি[সম্পাদনা]

  • ব্রেডিগের আর্ক পদ্ধতি
  • দ্রাবক বিনিময় পদ্ধতি: যে পদার্থের কোলয়ডীয় দ্রবণ তৈরি করতে হবে, সেটিকে একটি উপযুক্ত তরলে দ্রবীভূত করা হয়। তারপর উৎপন্ন দ্রবণটিকে এমন একটি তরলের সাথে যুক্ত করা হয় যার মধ্যে পদার্থটি অদ্রাব্য বা স্বল্প দ্রাব্য, তারপর ধীরে ধীরে কোলয়েড তৈরি হয়।
  • রাসায়নিক পদ্ধতি:

(ক) বিজারণ পদ্ধতিতে সোনা, তামা, রূপো এবং প্ল্যাটিনাম ধাতুর সল প্রস্তুত করা যায়।

2PtCl4 + 4SnCl2 → 4SnCl4 + 2Pt (সল)

(খ) জারণ পদ্ধতিতে কিছু অধাতব মৌলের সল উৎপন্ন করা হয়, যেমন সালফার

H2S + Br2 → 2HBr + S (সল)

ধর্ম[সম্পাদনা]

টিন্ডাল প্রভাব[সম্পাদনা]

ব্রাউনীয় গতি[সম্পাদনা]

বিশুদ্ধিকরণ[সম্পাদনা]

সংরক্ষক কোলয়েড[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. International Union of Pure and Applied Chemistry. Subcommittee on Polymer Terminology; Jones, Richard G. (২০০৯)। Compendium of polymer terminology and nomenclature : IUPAC recommendations, 2008। Cambridge: Royal Society of Chemistry। আইএসবিএন 978-1-84755-942-5ওসিএলসি 406528399 
  2. Stepto, Robert F. T. (২০০৯-০১-০১)। "Dispersity in polymer science (IUPAC Recommendations 2009)"। Pure and Applied Chemistry81 (2): 351–353। এসটুসিআইডি 95122531ডিওআই:10.1351/PAC-REC-08-05-02অবাধে প্রবেশযোগ্য 
  3. Israelachvili, Jacob N. (২০১১)। Intermolecular and surface forces (4rd সংস্করণ)। Burlington, MA: Academic Press। আইএসবিএন 978-0-08-092363-5ওসিএলসি 706803091 
  4. Selmi, Francesco "Studi sulla dimulsione di cloruro d'argento". Nuovi Annali delle Scienze Naturali di Bologna, 1845.
  5. Selmi, Francesco, Studio intorno alle pseudo-soluzioni degli azzurri di Prussia ed alla influenza dei sali nel guastarle, Bologna: Tipi Sassi, 1847
  6. Hatschek, Emil, The Foundations of Colloid Chemistry, A selection of early papers bearing on the subject, The British Association Committee on Colloid Chemistry, London, 1925
  7. Selmi, Francesco - Sur le soufre pseudosoluble, sa pseudosolution e le soufre mou, Journal de Pharmacie et de Chimie, tome 21, 1852, Paris
  8. Tweney, Ryan D. (২০০৬)। "Discovering Discovery: How Faraday Found the First Metallic Colloid"। Perspectives on Science14: 97–121। এসটুসিআইডি 55882753ডিওআই:10.1162/posc.2006.14.1.97 
  9. "X. Liquid diffusion applied to analysis"। Philosophical Transactions of the Royal Society of London151: 183–224। ১৮৬১। এসটুসিআইডি 186208563ডিওআই:10.1098/rstl.1861.0011 . Page 183: "As gelatine appears to be its type, it is proposed to designate substances of the class as colloids, and to speak of their peculiar form of aggregation as the colloidal condition of matter."
  10. Richard G. Jones; Edward S. Wilks; W. Val Metanomski; Jaroslav Kahovec; Michael Hess; Robert Stepto; Tatsuki Kitayama, সম্পাদকগণ (২০০৯)। Compendium of Polymer Terminology and Nomenclature (IUPAC Recommendations 2008) (2nd সংস্করণ)। RSC Publ.। পৃষ্ঠা 464। আইএসবিএন 978-0-85404-491-7 
  11. Stepto, Robert F. T. (২০০৯)। "Dispersity in polymer science (IUPAC Recommendations 2009)" (পিডিএফ)Pure and Applied Chemistry81 (2): 351–353। এসটুসিআইডি 95122531ডিওআই:10.1351/PAC-REC-08-05-02। ২০২২-১০-০৯ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। 
  12. Slomkowski, Stanislaw; Alemán, José V.; Gilbert, Robert G.; Hess, Michael; Horie, Kazuyuki; Jones, Richard G.; Kubisa, Przemyslaw; Meisel, Ingrid; Mormann, Werner; Penczek, Stanisław; Stepto, Robert F. T. (২০১১)। "Terminology of polymers
    and polymerization processes in dispersed systems (IUPAC Recommendations 2011)"
    (পিডিএফ)Pure and Applied Chemistry83 (12): 2229–2259। এসটুসিআইডি 96812603ডিওআই:10.1351/PAC-REC-10-06-03। ২০২২-১০-০৯ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা।