একজটী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
একজটি দেবী

একজটী বা একজটা (সংস্কৃত; জটাধারী নারী) হলেন ইন্দো-তিব্বতীয় পুরাণের সবচেয়ে শক্তিশালী ও ভয়ংকরী দেবী। তিনি মাহচীনতারা নামেও পরিচিত।[১] একজটী হলেন বৌদ্ধধর্মের ২১ জন তারার অন্যতম। তিব্বতি কিংবদন্তি অনুসারে, তিনি অন্য সংস্কৃতি থেকে গৃহীত স্বর্গের এক দেবী। তান্ত্রিক গুরু পদ্মসম্ভব তাঁর একটি চোখ বিদ্ধ করেছিলেন, যাতে তিনি তিব্বতি দৈত্যদের বিজয়ে পদ্মসম্ভবকে আরও কার্যকরী উপায়ে সাহায্য করতে পারেন।

একজটী "নীলতারা" নামেও পরিচিত। ন্যিংমা শাখা তাঁকে তিনজন প্রধান রক্ষাকর্তার অন্যতম মনে করে (অপর দুজন হলেন রাহুলবজ্রসাধু)।

হরিত তারার মণ্ডলে একজটীকে মাঝে মাঝেই নির্বাণদাত্রী রূপে দেখা যায়। সেই সঙ্গে তাঁর অন্যান্য ক্ষমতাগুলি হল শত্রুভয় নিবারণ, আনন্দ বৃদ্ধি ও বোধিলাভের পথে ব্যক্তিগত বাধাগুলির অপসারণের ক্ষমতা।

একজটী হলেন গোপন মন্ত্রসমূহের রক্ষয়িত্রী এবং “সকল বুদ্ধের মাতাদের মাতা”। তিনি পূর্ণ ঐক্যের প্রতীক। এমনকি তাঁর নিজের মন্ত্রটিও গোপন। বজ্রযান শিক্ষার (বিশেষত আভ্যন্তরিণ তন্ত্রতেরমাদের) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রক্ষয়িত্রী। মন্ত্রের রক্ষয়িত্রী রূপে তিনি ধর্মানুশীলনকারীকে ডাকিনী বিদ্যার প্রতীকগুলি বিতারণে সাহায্য করেন এবং তন্ত্রপথে সাধনার যথাযথ সময় ও পরিবেশ নির্ণয় করেন। তিনি যেহেতু সযত্নে সকল ধর্মগ্রন্থ ও মন্ত্র সম্পূর্ণ অনুধাবন করতে পারেন, তিনি অনুশীলনকারীকে গোপনীয়তার মূল্য মনে করিয়ে দেন।[২] দুসুম খ্যেনপা, প্রথম কর্মপা লামা ছেলেবেলায় তাঁকে ধ্যান করতেন।

নামখাই নোরবুর মতে, একজটী হলেন জোগচেন শিক্ষার প্রধান অভিভাবক এবং তিনি “প্রাথমিক শক্তির মূলগত অভিন্ন প্রকৃতির একজন প্রতিমূর্তি।”[৩]

জোগচেন হল তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের সবচেয়ে নিবিড়ভাবে রক্ষিত শক্ষা। এই মতে, একজটী প্রধান অভিভাবক এবং সর্বোচ্চ স্থানে স্থাপিত। কথিত আছে, শ্রীসংঘ নিজে তাঁর যত্নে “হৃদয়মূল” মতবাদ গড়ে তুলেছিলেন। মহাগুরু লোংচেনপা, যিনি জোগচেন শিক্ষার কিছু বিস্তার ঘটান, তিনি একজটীকে আশ্চর্যজনকভাবে ব্যক্তিগত অভিভাবক মেনেছিলেন। তাঁর যখন ৩২ বছর বয়স, সেই সময় একজটী তাঁর সামনে আবির্ভূত হন এবং ‘ডাকিনীদের হৃদয়মূল’ ক্ষমতায়নের প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানকে দেখে দেন। একজটীই তাঁকে ময়ূরের পালক ব্যবহার এবং অপ্রয়োজনীয় অববাহিকাগুলি সরিয়ে ফেলতে বলেন। লোংচেনপা যখন অনুষ্ঠানগুলি পালন করছিলেন, তখন একজটী মাথা নেড়ে সেগুলিতে সম্মতি জানান, কিন্তু তাঁর উচ্চারণ শুদ্ধ করে দেন। তিনি যখন মন্ত্র উচ্চারণ করছিলেন, তখন একজটী তাঁকে থামিয়ে বলেন, “আমাকে নকল কর।” এই বলে তিনি একটি ডাকিনীদের ভাষায় একটি অদ্ভুত সুরেলা গান ধরেন। পরে তিনি একটি সমাবেশে আবির্ভূত হয়ে পদ্মসম্ভব ও ডাকিনীদের সম্মতি দিয়ে আনন্দ সহকারে নৃত্য করেন।[৪]

উৎস[সম্পাদনা]

বৌদ্ধ ও হিন্দু উভয় দেবমণ্ডলীতেই একজটীকে দেখা যায়। অধিকাংশের মতে, তাঁর উৎস বৌদ্ধ দেবমণ্ডলী। কিন্তু কয়েক জন বিশেষজ্ঞ তা মানেন না।[৫][৬] আরও মনে করা হয় যে, একজটীর উৎসস্থান হল তিব্বত। খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে তান্ত্রিক নাগার্জিন সেখান থেকে তাঁকে নালন্দায় নিয়ে আসেন।[১] কোনো কোনো মতে তাঁকে অক্ষোভ্য থেকে উৎসারিত বলে মনে করা হয়।[৭]

মূর্তিতত্ত্ব[সম্পাদনা]

একজটীর গায়ের রং নীলাভ। তাঁর মাথার চুল লাল এবং জটার আকারে বাঁধা। তাঁর একটি মাথা, তিনটি স্তন, দুটি হাত এবং তিনটি চোখ। কোথাও কোথাও তাঁকে অন্য মূর্তিতেও দেখানো হয়েছে। সেখানে তাঁর বারোটি পর্যন্ত মাথা, চব্বিশটি হাত এবং তান্ত্রিক ধারায় হাতে খর্পর, নীল পদ্ম, কুঠার বজ্র, কুকরি, ফুরবা ইত্যাদি রয়েছে।

অন্য একটি মূর্তিতে তাঁর চুল একটি বিনুনির জটায় আবদ্ধ। এটি এবং তাঁর অন্যান্য বৈশিষ্ট্য তাঁর সঙ্গে অভিন্নতাবাদের সম্পর্কটি প্রদর্শন করে। একজটীর একটি মাত্র চোখ এবং সেটি বিরাট মহাবিশ্বের দিকে তাকিয়ে আছে। একটি মাত্র ধারালো দাঁত বাধাবিঘ্নকে বিদ্ধ করেছে। একটি মাত্র স্তন “তাঁর সর্বোচ্চ অনুশীলনকারী সন্তানজ্ঞানে পালন করছে।” তিনি বোধির মতো নগ্ন। শুধু সাদা মেঘ ও ব্যাঘ্রচর্মের একটি বস্ত্র তাঁর কোমর থেকে ঝুলছে। ব্যাঘ্রচর্মটি হল সিদ্ধের পোষাকের প্রতীক। এটি নির্ভীক বোধিরও প্রতীক। তাঁর গহনা সাপের এবং গলায় নরমুণ্ডের মালা। কোনো কোনো মূর্তিতে তিনি এক পদে দণ্ডায়মান। তিনি শ্যামবর্ণা, খয়েরি বা গাঢ় নীল। তিনি একটি ত্রিকোণাকার অগ্নিময় মণ্ডলে দণ্ডায়মান। তাঁকে ঘিরে থাকে তাঁর অনুগামী ভয়ংকরী ম্যামো দানবীগণ। এরা গুপ্ত শিক্ষার সমর্থনে তাঁর নির্দেশ পালন করেন। তিনি এক হাজার ভয়ংকর লৌহ নারী-নেকড়ের জন্ম দেন তাঁর বাঁ হাত থেকে। বিমুখ বা অলস অনুশীলনকারীদের উদ্দেশ্যে তিনি ‘বোধির তীর’ নিক্ষেপ করে তাঁদের জাগরিত করে তোলেন। শ্রদ্ধাহীন অনুশীলনকারীদের প্রতি তিনি ভয়ংকরী। তিনি এই অনুশীলনকারীদের অহংকার ধ্বংস করে তাঁদের ধর্মকায়ের কাছে নিয়ে আসেন। ডান হাতে তিনি একটি ছিন্ন রক্তমাখা হৃদয় ধরে থাকেন। এটি বজ্রযান অনুশীলনের অবিশ্বস্তদের হৃদয়।[২]

সবচেয়ে সুপরিচিত মূর্তিটিতে একজটীর হাতে থাকে খড়্গ, কুঠার বা খট্টাঙ্গ এবং একটি খুলির পাত্র। তাঁর জটায় অক্ষোভ্যের একটি ছবি থাকে।

তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞার প্রতীক। ডান পা তিনি রাখেন মৃতদেহের উপর। এটি অহংকারের প্রতীক। তাঁর বজ্র হাসির মাধ্যমে দেখা যায় তাঁর জিহ্বা দ্বিখণ্ডিত এবং তাঁর একটি মাত্র দাঁত। তাঁর গলায় খুলির মালা থাকে। গায়ে থাকে ব্যাঘ্র বা নরচর্ম। বোধির প্রতীক আগুন তাঁকে ঘিরে থাকে।

বিভিন্ন সন্তজীবনীতে দেখা যায়, একজটী যখন যোগীদের কাছে আবির্ভূত হন, তিনি ভয়ংকর বেশে আসেন। তিনি তীক্ষ্ণ চীৎকারে কথা বলেন। তাঁর চোখ জ্বলে এবং তাঁর দাঁত চকচক করে। কোনো কোনো সময়ে তিনি মানুষের দ্বিগুণ উচ্চতার মূর্তিতে আসেন। সেই সময় তিনি অস্ত্র বের করেন এবং ডাকিনীরা তাঁকে রক্তে ধুইয়ে দেয়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. The Alchemical Body: Siddha Traditions in Medieval India By David Gordon White. pg 65
  2. Dakini's Warm Breath: The Feminine Principle in Tibetan Buddhism By Judith Simmer-Brown. pg 276
  3. Namkhai Norbu (১৯৮৬)। The Crystal and the Way of Light। London: Routledge & Kegan Paul। আইএসবিএন 1-55939-135-9 
  4. Dakini's Warm Breath: The Feminine Principle in Tibetan Buddhism By Judith Simmer-Brown. pg 278
  5. "The Goddess Mahācīnakrama-Tārā (Ugra-Tārā) in Buddhist and Hindu Tantrism" by Gudrun Bühnemann. Bulletin of the School of Oriental and African Studies, University of London, Vol. 59, No. 3 (1996), pp. 472
  6. Kooij, R. K. van. 1974. "Some iconographical data from the Kalikapurana with special reference to Heruka and Ekajata", in J. E. van Lohuizen-de Leeuw and J. M. M. Ubaghs (ed.), South Asian archaeology, 1973. Papers from the second international conference of South Asian archaeologists held in the University of Amsterdam. Leiden: E. J. Brill, 1974 pg. 170.
  7. "The Cult of Jvālāmālinī and the Earliest Images of Jvālā and Śyāma." by S. Settar. Artibus Asiae, Vol. 31, No. 4 (1969), pp. 309

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]