উচ্চৈঃশ্রবা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
উচ্চৈঃশ্রবা
ঘোটকরাজ
ইন্দ্রদেবের বাহন
মন্দর পর্বতকে বেষ্টনরত বাসুকী নাগ এবং সমুদ্রমন্থনকালে উত্থিত উচ্চৈঃশ্রবা ঘোটক
অন্তর্ভুক্তিঘোড়া
আবাসঅমরাবতী
প্রতীকসমূহসিংহঘোটক
মাতাপিতাসমুদ্রমন্থন কালে উত্থিত

উচ্চৈঃশ্রবা হলো একটি দৈবঘোটক৷ পুরাণ অনুসারে সমুদ্রমন্থনের সময় এই ঘোড়াটি মন্থনোত্থিত হলে দেবরাজ ইন্দ্র এঁর ওপর নিজের কর্তৃৃত্ব বিস্তার করেন৷ হিন্দু পুরাণ অনুসারে এটি সাতটি মাথাযুক্ত এবং উড্ডয়নক্ষম৷ এটিকে সর্বোৎকৃৃষ্ট ঘোড়া হিসাবে মান্যতা দেওয়া হয় এর আদিরূপে সমস্ত ঘোটককুলের রাজা হিসাবে গণ্য হয়৷[১] উচ্চৈঃশ্রবাকে নিয়ে আরেকটি মতামত হলো, কারো মতে এটি সূর্য দেবতার বাহন তথা তার রথের অবস্থিত সাতটি ঘোড়ার একত্ররূপ।

নামকরণ[সম্পাদনা]

উচ্চৈঃশ্রবা নাম টি একটি সংস্কৃৃতমূল শব্দ৷ শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে দুটি পৃৃথক শব্দ পাওয়া যায় যথা, উচ্চৈঃ এবং শ্রবস্৷ দুভাবে উচ্চৈঃশ্রবা শব্দের ব্যাখ্যা করা যায়৷ উচ্চৈঃ বলতে উচ্চস্বর যুক্ত এবং শ্রবস্ বলতে শোনাকে বোঝায় অর্থাৎ যার স্বর উচ্চসুরে শ্রবণীয়৷ আবার উচ্চৈঃশ্রবা বলতে বৃৃহৎ কর্ণযুক্ত প্রাণীকেও বোঝানো হতে পারে৷[১]

দৈহিক বিবরণ[সম্পাদনা]

উচ্চৈঃশ্রবার গায়ের রঙ ছিল সাদা।[২] সাতটি মস্তক ছিলো এবং উড্ডয়নের জন্য ছিলো একজোড়া ডানা৷

কিংবদন্তি ও গ্রন্থে উল্লেখ[সম্পাদনা]

সপ্তমুখী উচ্চৈঃশ্রবা

হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতে উল্লেখ রয়েছে যে, সমুদ্রমন্থনের সময়ে ক্ষীরসাগর থেকে উচ্চৈঃশ্রবা উত্থিত হয় তখন দেবরাজ ইন্দ্র এটিকে কব্জা করেন এবং নিজের বাহন বানান৷ উচ্চৈঃশ্রবার সাথে সাথে সমুদ্র থেকে অন্যান্য গুপ্তধন তথা শ্রী সৌন্দর্য ও ভাগ্যের দেবী লক্ষ্মীর আবির্ভাব হলে শ্রীবিষ্ণু তাকে নিজের পত্নীরূপে গ্রহণ করেন৷ এছাড়া সঞ্জীবনী অমৃৃতের পাত্রও একই সঙ্গে উত্থিত হয়৷[৩] সমুদ্রমন্থনের সময়ে ক্ষীরসাগর থেকে উচ্চৈঃশ্রবার উত্থিত হওয়ার ঘটনা শুধু মহাভারত নয় রামায়ণ, বিষ্ণুপুরাণ, মৎস্যপুরাণবায়ুপুরাণেও উল্লিখিত রয়েছে৷ ভিন্ন ভিন্ন গ্রন্থে মন্থিত সমুদ্র থেকে উত্থিত মণিমাণিক্যের আলাদা আলাদা তালিকা পাওয়া যায় কিন্তু তার মধ্যে উচ্চৈঃশ্রবার উল্লেখ সমস্ত পুস্তকেই স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়৷[৪][৫]

সপ্তমুখী ঘোটক উচ্চৈঃশ্রবা ও সমুদ্রমন্থনের ফলে উত্থিত অন্যান্য মণিরত্নসমূহ

উচ্চৈঃশ্রবার উল্লেখ শ্রীমৎ ভগবদ্গীতাতেও রয়েছে ১০.২৭), যা মহাভারতেরও একটি অংশ৷ গীতাতে বিষ্ণুর অবতার শ্রীকৃষ্ণ তার পরম মিত্র অর্জুনকে উচ্চৈঃশ্রবা বিষয়ে কিছু বোঝাচ্ছেন এমন অবস্থাতে দেখতে পাওয়া যায়৷ কৃৃষ্ণ নিজেকে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের উৎস হিসাবে চিহ্নিত করার পর তিনি বলেন যে সমস্ত ঘোটককুলের মধ্যে যে শ্রেষ্ঠ সেই অমৃত সহিত সমুদ্রমন্থনে উত্থিত উচ্চৈঃশ্রবা আর কেউ নন স্বয়ং তিনিই৷[৬] খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত "হরিহরচতুরঙ্গ" গ্রন্থ অনুসারে সৃষ্টির দেবতা প্রজাপতি ব্রহ্মা একটি যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন করেন ও নিজের একটি প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করলে সেখান থেকে ডানাযুক্ত অকটি সাদা ঘোড়া বেরিয়ে আসে, যেটি উচ্চৈঃশ্রবা নামে পরিচিত৷ আবার সেই একই ঘোড়া সমুদ্রমন্থনের সময়ে উত্থিত হলে অসুর রাজ মহাবলী এটিকে গ্রহণ করেন৷[৭] আবার বিষ্ণুপুরাণ মতে পৃথু পৃৃথিবীর প্রথম অধীশ্বর হিসাবে ঘোষিত হলে অন্যান্যরাও ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে রাজপ্রতিনিধি বা রাজা হিসাবে ঘোষিত হন৷ এই সময়ে উচ্চৈঃশ্রবাকে ঘোটককুলের রাজা হিসাবে ঘোষিত করা হয়৷[৮]

মহাভারতে একে বলা হয়েছে অতুলতেজা। এ বিষয়ে একটি কাহিনী রয়েছে, উচ্চৈঃশ্রবার গায়ের রঙ ছিল সাদা। একবার উচ্চৈঃশ্রবার লেজের বর্ণ নিয়ে কশ্যপের দুই স্ত্রী কদ্রুবিনতার মধ্যে বিতর্ক উপস্থিত হয়। এই তর্কে কদ্রু দাবি করেন অশ্বের লেজ কালো ও এবং বিনতা বলেন সাদা। এই বিষয়ে উভয়ই নিজ নিজ দাবিত অনড় থাকলে, পরের দিন এই বিষয়টি মীমাংসার জন্য উভয়ই শর্ত সাপেক্ষে রাজী হন। শর্তটি ছিল- এই তর্কে যিনি জয়ী হবেন, তার অধীনে অপরজনকে দাসত্ব করতে হবে। বাড়ি ফিরে কদ্রু তার নাগপুত্রেদের বলেন যে, আগামীকাল যখন উচ্চৈঃশ্রবার লেজের রঙ পরীক্ষা করা হবে, তখন নাগরা যেন, উচ্চৈঃশ্রবার লেজে জড়িয়ে থাকে। যাতে উচ্চৈঃশ্রবার লেজের বর্ণ কালো দেখায়। মায়ের এই আদেশ যে সকল নাগ অস্বীকার করে, কদ্রু তাদের অভিশাপ দিয়ে বলেন যে, মাতৃআদেশে লঙ্ঘনকারী নাগেরা পাণ্ডুবংশীয় জনমেজয়ের সর্পসত্রে অগ্নিদগ্ধ হবে। কদ্রু ও বিনতার যখন উচ্চৈঃশ্রবার লেজের রঙ পরীক্ষার জন্য উপস্থিত হন, তখন কদ্রু আদেশ মেনে কিছু নাগ উচ্চৈঃশ্রবার লেজে জড়িয়ে থাকে। এর ফলে দূর থেকে উচ্চৈঃশ্রবার লেজের রঙ কালো দেখায়। এর ফলে শর্তানুসারে বিনতা কদ্রুর দাসীতে পরিণত হয়।[৩][৪] কালিদাস রচিত কুমারসম্ভবম্‌ গ্রন্থটিতে বলা হয়েছে যে, তারকাসুর দেবরাজ ইন্দ্রের এই মহামুল্যবান ঘোটকরাজ উচ্চৈঃশ্রবাটিকে স্বর্গ থেকে চুরি করেছিলেন, যা ছিলো ইন্দ্রে বিজয় প্রতীক৷[৯]

দেবীভাগবত পুরাণে উল্লেখ করা রয়েছে যে, সূর্যদেবের পুত্র রেবন্ত একবার উচ্চৈঃশ্রবার আরোহণ করে বিষ্ণুগৃহ বৈকুণ্ঠধামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন৷ সমুদ্রমন্থনকালে একই সাথে উত্থিত হওয়া লক্ষ্মী ছিলেন একাধারে উচ্চৈঃশ্রবার ভগিনী আবার শ্রীবিষ্ণুর পত্নীও৷ তিনি বুদ্ধির দেব রেবন্তকে উচ্চৈঃশ্রবাতে আরোহিত অবস্থাতে দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, ঐ সময়ে তার উদ্দেশ্যে শ্রী বিষ্ণুর করা একটি প্রশ্নের উত্তর দিতেও তিনি ভুল করেন৷ এসময়ে বিষ্ণু লক্ষ্মীকে ভুল বুঝে তিনি দেবী লক্ষ্মীকে অভিশাপিত করেন যে, তিনি তার পরের জন্মে ঘোটকী রূপে জন্মগ্রহণ করবেন৷[৩]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Doniger, Wendy (২০০৪)। Hindu Myths: A Sourcebook Translated from the Sanskrit (ইংরেজি ভাষায়)। Penguin UK। আইএসবিএন 9780141903750 
  2. http://onushilon.org/myth/hindu/uccosroba.htm
  3. Mani, Vettam (১৯৭৫)। Puranic Encyclopaedia: A Comprehensive Dictionary With Special Reference to the Epic and Puranic Literature। Delhi: Motilal Banarsidass। পৃষ্ঠা 800আইএসবিএন 0-8426-0822-2 
  4. Beér, Robert (২০০৪)। The encyclopedia of Tibetan symbols and motifs। Serindia Publications, Inc.। পৃষ্ঠা 65, 109। 
  5. Horace Hayman Wilson (১৮৪০)। "The Vishnu Purana: Book I: Chapter IX"। Sacred Texts Archive। সংগ্রহের তারিখ ১৪ জুলাই ২০১০ 
  6. Radhakrishnan, S. (জানুয়ারি ১৯৭৭)। "10.27"। The Bhagavadgita। Blackie & Son (India) Ltd.। পৃষ্ঠা 264। 
  7. Dikshitar, V. R. Ramachandra (১৯৯৯)। War in Ancient India। Cosmo Publications। পৃষ্ঠা 175। আইএসবিএন 81-7020-894-7 
  8. Horace Hayman Wilson (১৮৪০)। "Vishnu Purana: Book 1: Chapter XXII"। Sacred Texts archive। সংগ্রহের তারিখ ১৪ জুলাই ২০১০ 
  9. Devahar, C R, সম্পাদক (১৯৯৭)। "2.47"। Kumāra-Sambhava of Kālidāsa। Motilal Banarasidas Publishers। পৃষ্ঠা 25।