আলাপ:কুমিল্লা সেনানিবাস

পাতাটির বিষয়বস্তু অন্যান্য ভাষায় নেই।
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

কুমিল্লা সেনানিবাসের ইতিহাস[সম্পাদনা]

গুপ্ত সম্রাটদের যুগ থেকে কুমিল্লা যে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দিক থেকে অপরিশীম গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় চতুর্থ শতাব্দির স্তম্ভ লিপিতে। আর পঞ্চম শতাব্দিতে গুপ্ত সম্রাটদের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে আসা সমতট রাজ্যের কেন্দ্র ছিল ত্রিপুরা বা কুমিল্লা অঞ্চল। এখানে ছিলেন মহারাজা রুদ্র দত্ত ও মহারাজা বিজয় সেন নামে দুই সামন্ত অর্থরক্ষক ও শান্তি রক্ষক। সে সময় কুমিল্লা সুনির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমারেখা দ্বারা চিহ্নিত না থাকলেও ১৭৮১ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যে প্রশাসনিক অঞ্চল কাঠামো প্রস্তুত করে তাতে কুমিল্লার ভৌগলিক সীমারেখা নির্ধারিত হয়। পার্বত্য ত্রিপুরার কুমিল্লা জেলা ও পার্শ্ববর্তী আরো কিছু এলাকাকে ত্রিপুরা রাজ্য বলে তারা অবহিত করে। ১৬৫২ সালে স্যানসন ডি আবাবিলের মানচিত্রে ট্রপই নামে একটি এলাকার অবস্থান দেখা যায়। এই ট্রপই ত্রিপুরার সঠিক অবস্থান। তিপরা বা টিপরা বাজার নামে একটি এলাকা এখনো কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় রয়েছে। এই কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকার পাশ দিয়ে বিশাল প্রশস্ত একটি সড়ক কুমিল্লা-চট্টগ্রাম অতিক্রম করে বার্মায় গিয়ে পৌঁচেছে। ধারণা করা হয় নবম থেকে একাদশ শতকে আরাকান চন্দ্রবংশীয় রাজাদের আমলে এ সড়ক নির্মিত হয়েছিল। ইংরেজ আমলে এই সড়কটি ‘শাহসুজার সড়ক’ বলে মানচিত্রে রয়েছে। সড়কটি চট্টগ্রাম ও আরাকানের সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত ছিল। বহুবছর ধরে বাংলাদেশের কুমিল্লার লালমাই ময়নামতি অঞ্চল থেকে চট্টগ্রাম হয়ে মিয়ানমারের আরাকান পর্যন্ত চলাচলের এটিই ছিল সহজ পথ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ সালের শেষের দিকে জাপানীরা যখন বঙ্গোপসাগর দিয়ে এসে বার্মা বা মিয়ানমারের উপকূলে উঠে এবং রেঙ্গুন শহর দখল করে নেয় তখন ব্রিটিশ বাহিনী উত্তর দিকে পিছু হটে যায়। তারা তখন বিপর্যন্ত এবং তাদের মনোবল একদম ভেঙ্গে যায়। সে সময় প্রতিরক্ষা বিভাগ লেফটেন্যান্ট জেনারেল উইলিয়াম যোসেফ স্লিম (আঙ্কেল বিল)কে ১৪ আর্মির দায়িত্ব প্রদান করে। ধারনা করা হয়, বন্যামুক্ত পাহাড়ি অঞ্চল, মিয়ানমারে যাতায়াত সুবিধাজনক হওয়ায় এবং কুমিল্লায় একটি বিমান বন্দর নির্মাণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন থাকায় ১৪ আর্মির কমান্ড পোষ্ট কুমিল্লার ময়নামতিতে স্থাপন করা হয়। ১৯৪৩ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৪৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত কুমিল্লার ময়নামতিতেই ১৪ আর্মির কমান্ড পোষ্ট ছিল। কমনওয়েলথ ওয়্যার গ্রেভস কমিশনের তথ্য অনুযায়ী কুমিল্লার ময়নামতি গ্যারিসন প্রতিষ্ঠার আগে ময়নামতি অঞ্চলটিতে একটি ছোট্ট গ্রাম ছিল এবং এখানে ডজনখানেক ঘর ছিল। বিশ্বযুদ্ধের সময় এখানে বড় ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখানে কয়েকটি অর্ডিন্যান্স ডিপো, বৃটিশ ও ভারতীয় একটি মিলিটিরি হাসপাতাল ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৪ ও ১৫০ নম্বর বৃটিশ জেনারেল হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে নিহতদের ময়নামতি ওয়্যার সিমেট্রিতে সমাধিস্থ করা হয়। কিছু হতাহতকে বার্মাও থেকে এখানে আনা হয়। কমনওয়েলথ ওয়্যার গ্রেভস কমিশন বলছে, এর সময় কাল ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত। ১৯৪০-৪১ সালে বিশ্বযুদ্ধের সময় জমি অধিগ্রহণ করে কুমিল্লা বিমান বন্দর নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। কার্যাদেশে কাগজপত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ি, ১৯৪২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভারত সরকারের গণপূর্ত বিভাগ বিমান বন্দর নির্মাণের নিমিত্ত্বে বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহের জন্য ঠিকাদারদের কার্যাদেশ প্রদান করেন। বলা যেতে পারে ঐ সময়ে বিমান বন্দর নির্মিত হয়। ১৯৪৩ সালের ১৫ জানুয়ারি ( কলকাতা গেজেট নং-৩৬০ডিফে) থেকে ত্রিপুরায় জননিরাপত্তা ও সরবরাহ যথাযথ রখার জন্য জমি অধিগ্রহণ করাসহ বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ত্রিপুরার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট এ.বি. স্কট এ আদেশ জারি করেন। ১৯৪৩ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৪৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত কুমিল্লার ময়নামতিতে ১৪ আর্মির কমান্ড পোষ্ট দায়িত্বরত ছিল এবং কুমিল্লা বিমানবন্দর বিমান ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এখানে ৩ শ’ যুদ্ধ বিমান, ৫০টি বোমারু বিমান ছিল বলে কথিত রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয় পাওয়ার পর লেফটেন্যান্ট জেনারেল উইলিয়াম যোসেফ স্লিম তার বাহিনী নিয়ে মনিপুরের ইম্ফলে চলে যান। ফলে ময়নামতি পাহাড়ি এলাকাটি পরিত্যক্ত হিসেবে থেকে গেলেও সামরিক স্থাপনা ও হাসপাতাল রক্ষণাবেক্ষণে জনবল নিয়োগ করা ছিল। ভারত-পাকিস্তান দেশ বিভাগের পর ১৯৪৯-১৯৫০ সালে কুমিল্লার ময়নামতি গ্যারিসনকে পূর্ণাঙ্গ সেনানিবাস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম-সিলেট বিভাগের হেডকোয়ার্টার। ১৯৫০ সালের ১২ জুলাই এ সেনানিবাসকে সরকারিভাবে ময়নামতি সেনানিবাস হিসেবে নামকরন করা হয়। ১৯৫১ সালের ২১ ডিসেম্বর তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এক গেজেটের মাধ্যমে কুমিল্লার কোতয়ালী থানাধীন ময়নামতি পাহাড়ি অঞ্চলের ১ হাজার ৮শ’ ৫৪ দশমিক ৯৩ একর ভুমি হুকুম দখলের মাধ্যমে এখানে সেনানিবাস ঘোষণা করা হয় (গেজেট নম্বর ১০০০/৫১)। ১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসে তৎকালিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ‘৫৩ ব্রিগেড’ পশ্চিম পাকিস্তানের হায়দ্রাবাদ থেকে পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসে স্থানান্তর করা হয়। এই ব্রিগেডটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ১৪ ডিভিশনের অধীনে ছিল এবং এর প্রথম কমান্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার ওমরাও খান। তবে তারও আগে ১৯৫০ সালের এপ্রিলে ১৪/১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং জুনে ৩ পাঠান রেজিমেন্ট ময়নামতি সেনানিবাসে স্থানান্তর করা হয়। সেই সাথে একই বছরের অক্টোবরে স্থানাস্তর করা হয় ৭/১৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। এই ইউনিটসমূহ ৫৩ ব্রিগেডের অধীনে ছিল। ব্রিগেড সদর দপ্তর ময়নামতি সেনানিবাসে ১৪/১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং ৩ পাঠান রেজিমেন্ট অবস্থিত ছিল এবং ৭/১৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল সিলেটে। কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, পরবর্তিতে ১৪/১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের নাম পরিবর্তন করে ২০ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং ৩ পাঠান রেজিমেন্টের নাম পরিবর্তন করে ১৯ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট নামকরণ করা হয়েছিল। আর ৭/১৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের নাম পরিবর্তন করে ১২ এফএফ রেজিমেন্ট করা হয়েছিল। ১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে কুমিল্লা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল এবং ১৯৫১ সালের মে মাসে আর্মি সাপ্লাই ডিপো প্রতিষ্ঠা হয়। আর কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫১ সালের ২১ ডিসেম্বরে। ১৯৫৫ সালে ময়নামতি সেনানিবাসের নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা সেনানিবাস হিসেবে নামকরণ করা হয়। ১৯৬২ সালের ১২ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান গর্ভনরের আদেশে স্বরাষ্ট্র বিভাগের সচিব এম হাসান কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ের জমি অধিগ্রহণ করেন। ফিল্ড ফায়ারিং এন্ড আর্টিলারি প্রাক্টিস আইন ১৯৩৮ এর অধিনে এক আদেশে এ জমি অধিগ্রহণ করা হয়। অধিগ্রহণকৃত জমির মৌজার নাম ‘লালমাই পাহাড়’(গেজেট নং ৮১৪) । আগেই বলা হয়েছে ১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসে তৎকালিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ‘৫৩ ব্রিগেড’ পশ্চিম পাকিস্তানের হায়দ্রাবাদ থেকে পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসে স্থানান্তর করে এবং ব্রিগেডটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ১৪ ডিভিশনের অধীনে ছিল এবং এর প্রথম কমান্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার ওমরাও খান। পরে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৫৭ সালে কুমিল্লা সেনানিবাসের ৫৩ পদাতিক ডিভিশনের প্রধান ছিলেন ব্রিগেডিয়ার শিরীন খান। তিনি চট্টগ্রাম বিভাগের সামরিক প্রধানও ছিলেন। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের অধিনে ছিল চট্টগ্রাম-সিলেটও। সে সময় বেলুচ রেজিমেন্টের একটি ব্রিগেড ময়নামতি গ্যারিসন বা কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থান ছিল বলে স্থানীয় লোকজনের সূত্রে জানা গেছে। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর মার্শাল ল জারির পর চট্টগ্রাম বিভাগের সামরিক প্রশাসক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার শিরীন খান। স্থানীয়দের মতে, তিনি ছিলেন নম্্র মেজাজের মানুষ। তবে তার অধীনস্ত অফিসার ছিলেন অত্যন্ত রুক্ষ ও বদমেজাজি। ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৬৩ সালের আগষ্ট পর্যন্ত কুমিল্লা সেনানিবাসে ৫৩ পদাতিক ডিভিশনের প্রধান ছিলেন ব্রিগেডিয়ার গোলাম মোহাম্মদ, ১৯৬৩ সালের আগষ্ট থেকে ১৯৬৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ব্রিগেডিয়ার আবু ওসমান, ১৯৬৬ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ ইকবাল খান, ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ব্রিগেডিয়ার আবদুল মজিদ, ১৯৭০ সালের আগষ্ট থেকে ১৯৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ ইকবাল সফি দায়িত্ব পালন করেন। ব্রিগেড কমান্ডারদের দায়িত্বকালের এ তথ্য পাওয়া যায় কুমিল্লা ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল ও কলেজ থেকে। ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরে স্কুলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে পদাধিকার বলে স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। তবে ব্রিগেডিয়ার ওমরাও খান ও ব্রিগেডিয়ার শিরীন খানের দায়িত্বকালের যথার্থ তথ্য পাওয়া যায় নি। কারণ সেনানিবাসের কমান্ডারদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার একমাত্র অবলম্বল এই স্কুলটি তাদের দায়িত্বকালের সময় প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ১৯৬৫ সাল থেকে একটি ডিভিশনের কমান্ডার ছিলেন মেজর জেনারেল আবু বকর ওসমান মিঠা (এওমিঠা)। তিনি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ডেপুটি ক্রোপস কমান্ডারও ছিলেন। তার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে এ তথ্য পাওয়া যায়। কুমিল্লা সেনানিবাসে ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ৫৩ পদাতিক ডিভিশন, ১১৭ পদাতিক ডিভিশন, ১৪/১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ৩ পাঠান রেজিমেন্ট ,৭/১৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ১৫ তম ও ৩৯ তম বেলুচ রেজিমেন্ট, ২৩ এফএফ, ২২ বেলুচ, ১৯, ২০, ২৩ তম ও ৩০তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, তৃতীয় ও চতুর্থ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ১২ তম ও ২১তম আজাদ কাশ্মির, ২৫ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স, ১৩৫ ফিল্ড ওয়ার্কশপসহ বেশ কয়েকটি ইউনিটের অবস্থান ছিল। বিভিন্ন সেনা কর্মকর্তার কুমিল্লা সফর: ১৯৫৮ সালের মাঝামাঝিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ মুসা কুমিল্লা সফর করেন। একটি বিমানে করে তিনি কুমিল্লা বিমান বন্দরে অবতরণ করেন এবং ময়নামতি সেনা নিবাসের প্রধান ব্রিগেডিয়ার শিরিন খান ও কুমিল্লার জেলা প্রশাসক আবদুস সালাম চৌধুরী তাঁকে স্বাগত জানান। এ সময় ব্রিগেডিয়ার শিরিন খান নিজেকে ‘ইমাম’ বলছি উল্লেখ করে সবাইকে জানান ‘বড় ইমাম’ এখনই পৌছঁবেন। ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর প্রধান সামরিক শাসক আইয়ূব খান ক্ষমতা দখলের কিছুদিন পর কুমিল্লা সফর করেন। তিনি কুমিল্লা টাউন হলে প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বক্তব্য রাখেন। সামরিক আইন জারির করার পর জনমনে যে ভয়ভীতি তৈরি হয়েছিল সেই ভয়ভীতি তৈরিকারী প্রধান সামরিক শাসককে দেখতে তখন হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশনে জেনারেল আইয়ুব খানকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয়। সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা তাঁকে এ সংবর্ধনা প্রদান করেন। ১৯৫৮ সালের ১১ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান সামরিক শাসনকর্তা মেজর জেনারেল ওমরাও খান ব্রাহ্মণবাড়িয়া সফরে আসেন। মেজর জেনারেল ওমরাও খান ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৫ ভারতের দেরাদুন থেকে ইন্ডিয়ার মিলিটারি একাডেমির কমিশন্ড লাভ করেন। ১৯৬১ সালে কুমিল্লা সেনানিবাসে পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং মেজর জেনারেল ওমরাও খানকে বিদায় সংবর্ধনা দেয়া হয়। এ সময় বেসামরিক ব্যক্তিবর্গকেও আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং ভোজসভার নিমন্ত্রণ দেয়া হয়। ১৯৬৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে কুমিল্লা সেনানিবাসে আসেন ১৪ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল ফজল মুকিত খান। ১৯৬৮ সালের ১ জানুয়ারি স্কুলটির নবনির্মিত ভবনের কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ ইকবাল খান। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনের সময়ের পূর্বে ঘুর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা দেখতে কুমিল্লার দাউদকান্দিতে আসেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। এ সময় কুমিল্লা সেনানিবাসের প্রধান ও চট্টগ্রাম বিভাগের সামরিক প্রধান তাদের দাউদকান্দির কোন কোন এলাকায় কি পরিমান ক্ষতি হয়েছে তা বর্ণণা করে জানান। পাকিস্তানি সেনাদের চরিত্র: কুমিল্লা সেনানিবাসে অফিসার্স কাবে (আইয়ূব কাব) একটি বার এবং কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশনের দক্ষিণ পার্শ্বে রিফ্রেসমেন্ট রুমের পাশে ‘কেলনার’ নামে একটি খাবারের দোকানে আরেকটি বার ছিল। কুমিল্লা সেনানিবাসে পাকিস্তানি সেনারা অবস্থানকালে এবং রেলপথে যাতায়াতের সময় এ্যালকোহল সেবন করতেন। তাছাড়া কুমিল্লা সেনানিবাসে কর্মরত পাকিস্তানি সেনাদের অনেকে কুমিল্লা শহরের চকবাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অবস্থিত পতিতালয়ে যেতেন বলেও প্রমাণ পাওয়া যায়। তাদের কেউ কেউ কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে ব্যাক্ট্র কিনিক্যাল ল্যাবে ডা. সুরেশ চন্দ্র বসুর কাছে চিকিৎসা নিতেন। এ সময় তাদের কারো কারো যৌন রোগ সিফিলিস-গনোরিয়া ধরা পড়লে চাকুরি হারানোর ভয়ে তারা চিকিৎসককে রোগের কথা প্রকাশ না করার অনুরোধ করতো এবং যে কোন মূল্যে তাদের সুস্থ করার অনুরোধ জানাতো। ডা. সুরেশ চন্দ্র বসুই একমাত্র এ রোগের পরীক্ষা করতে পারতেন। ডা. সুরেশ চন্দ্র বসুর ছেলে অনুপ বসু আলাপচারিতায় এ সব তথ্য জানিয়েছেন। তবে পাকিস্তানি সেনাদের এই সব অপতৎপরতা রোধে তৎপর থাকতো মিলিটারি পুলিশ। তারা সাদা পোশাকে পতিতালয় এবং আশপাশে নজরদারি করতো। অনেক সময় ছুটি না নিয়ে আসা পাকিস্তানি সেনাদের ধরে সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হতো। রবিবার ছাড়া কোন সেনা সদস্য সিনেমা দেখতে পারতো না। সেনা সদস্যদের জন্য সিনেমার টিকিটেরও আলাদা দাম ও কাউন্টার ছিল। রবিবার ছাড়া অন্য কোন দিন সেনা সদস্যরা সিনেমা দেখতে গিয়েছে কিনা তাও নজরদারি করতো মিলিটারি পুলিশ। পাকিস্তানি সেনাদের আচরণ: ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোরব পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্জা সংবিধান বাতিল করে সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে মার্শাল ল জারি করে সামরিক বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সেনা প্রশাসকের দায়িত্ব দেন। ২৭ অক্টোবর আইয়ূব খান বিনা রক্তপাতে ইস্কান্দর মির্জাকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেন। ইস্কান্দর মির্জাকে বন্দি করে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সকল প্রকার রাজনৈতিক কর্মকান্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি কার হয় এবং ইলেকটিভ বডিস ডিসকোয়ালিফিকেশন (এবডো) অর্ডার আইন দ্বারা বিশিষ্ট রাজনৈতিকদের রাজনীতি করার অধিকার ৬ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। সংবাদপত্রের মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৬২ সালের জুলাই মাসে রাজনৈতিক দল বিধি পাশ হলে রাজনৈতিক দলগুলো সীমিত আকারে কর্মকান্ড পরিচালনা করার অধিকার পায়। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই ছাত্ররা শিক্ষা সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে মার্শাল ল সরকারের বিরোধীরা ভ্যানগার্ড হিসেবে ছাত্রদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্ররাও এটি গ্রহণ করে। ফলে মার্শাল ল সরকার তিন বছরের ¯œাতক প্রোগাম বাতিল করতে বাধ্য হয়। যে সব বিশিষ্ট রাজনৈতিকদের রাজনীতি করার অধিকার ৬ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় তাদের মধ্যে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যাপক আশরাফ উদ্দিন, ন্যাপের মোজাফ্ফর আহমেদ, শাহ আবদুল ওদুদ ও আলী হোসেন প্রমুখদের নাম শোনা যায়। তাদের ধরতে কুমিল্লা সেনানিবাসের সেনা সদস্যরা প্রায় তাদের বাড়িতে হানা দিতেন। এদের মধ্যে মোজাফ্ফর আহমেদের বোন হাসিনা মোর্শেদের কুমিল্লা শহরের তালপুকুর পাড়ের বাসায় বেশ কয়েকবার পাকিস্তানি সেনারা গিয়েছিল। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর জারি করা মার্শাল ল জারির পর চট্টগ্রাম বিভাগের সাব এডমিনিস্ট্রেটর ছিলেন ব্রিগেডিয়ার শিরীন খান। মার্শাল ল জারির ১০ দিনের মাথায় ১৯৫৮ সালের ১৭ অক্টোবর কুমিল্লা জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট কার্যালয়সহ সরকারি বিভিন্ন অফিস, হাসপাতাল, জেলখানা ও রেলওয়ে স্টেশন পরিদর্শন করেন। তিনি রেলওয়ে স্টেশন পরিদর্শন করে স্টেশন মাস্টারকে যাত্রীসেবা ও স্টেশনের স্বাস্থ্য রক্ষায় মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ দেন। তিনি কুমিল্লা সদর হাসপাতাল পরিদর্শন করেন এবং হাসপাতালের খাবার পরীক্ষা করেন। এরপর তিনি কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শন করেন এ সময় তিনি কয়েদীদের কুটির শিল্প সম্পর্কে শিক্ষা দান এবং খাদ্য সমস্যা সমাধান এবং অল্প বয়সী কয়েদীদের লেখা পড়া শেখানোর উপদেশ দেন। মার্শাল ল বলবৎ থাকাকালীন সময়ে সামরিক প্রশাসকের দপ্তর কুমিল্লা সার্কিট হাউসে ছিল বলে জানা গেছে। সামরিক কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়। মার্শাল ল বলবৎ থাকাকালীন সময়ে পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা সাধারণ মানুষের উপর প্রায়শ:ই নির্দয় হতেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড় মনোহরপুর সড়কে বর্তমান খন্দকার হক ম্যানশনের সামনে এক যুবক ফুলহাতা শার্টের হাতা ভাজ করে হাফহাতা শার্টের মতো পড়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এমন সময় পাকিস্তানি সেনারা তাকে ধরে বেত দিয়ে বেদম প্রহার করে এবং একজন দর্জিকে দিয়ে তার শার্টের হাতা কেটে হাফ করে দেন। অপর একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, ১৯৫৮ সালে মাশাল ল জারির কিছু দিনের মধ্যে জাফর খান ও পূর্ণ শশী নামে দুইজনসহ আরো ৫জন রেশন ডিলারকে মজুদদারি, মাপে কারচুপি ও কালোবাজারির অপরাধে বুড়িচং, কোতয়ালী ও অন্য থানা থেকে ধরা হয়। তাদেরকে কুমিল্লা টাউন হলে হান্টার দিয়ে বেত্রাঘাত করা হবে বলে শহরে প্রচার করা হয়। এতে ঐদিন বিপুল সংখ্যক মানুষ সৎসাহে তা দেখতে কুমিল্লা টাউন হল মাঠে আসে। কুমিল্লা জেলার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত মেজর সাহেব ও সদর মহকুমার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত একজন লেফটেন্যান্ট কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আসা একজন জল্লাদ, সিভিল সার্জন ডা. নন্দী, চিকিৎসক প্রমোদ পাল ও কুমিল্লা টাউন হলের সম্পাদক সুলতানুর রহমান মাঠে আসার পর গাড়িতে করে আনা হয় আটক ৫ ডিলারকে। তাদের কুমিল্লা টাউন হলের বারান্দার ছাদে এনে শুধু নেংটি পড়িয়ে তোলা হয়। এ সময় কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার কয়েকটি বেত সিভিল সার্জনকে দিলে তিনি সেগুলো পরীক্ষা করে দুটি বেত নির্বাচন করে দেন। ঐ বেত দিয়ে কারাগারের জল্লাদ এক ডিলারের পাছায় কয়েকবার আঘাত করে। এ সময় ঐ ডিলারের শরীর থেকে রক্ত বের হয়। সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তার রক্ত দেখে অপর ডিলাররাও অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এ ঘটনা দেখতে উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে । তারা পাকিস্তানি সেনাদের এমন নির্দয় আচরনে বিস্মিত হয়ে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক কথাবার্তা ও গালিগালাজ করতে থাকে। খবর পেয়ে পুলিশ আসে। ঐ মেজর ও লেফটেনেন্ট ডিলারদের আর বেত্রাঘাত না করে আসামীদের কারাগারে বেত্রাঘাত করা হবে বলে জানিয়ে কুমিল্লা টাউন হল মাঠ ত্যাগ করেন। মজুদদার ও চোরাকারবারি এবং কালোবাজারির বিরুদ্ধে নেয়া মার্শাল ল সরকারের পদক্ষেপে কুমিল্লার মানুষের সমর্থন-উৎসাহ থাকলেও পরে এ ঘটনা ক্ষোভে পরিণত হয়। পাকিস্তানি এই সেনাদের কর্মকান্ড সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি আরো বাড়িয়ে দেয়। জানা গেছে, কুমিল্লার ধর্মসাগর পাড়স্থ রাণীর কুঠিরে ছিল সামরিক কর্মকর্তাদের অফিস। দৈনিক আজাদ পত্রিকা থেকে জানা যায়, সামরিক আইন জারির পর কুমিল্লায় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের যে উর্ধ্বগতি ছিল তা কমে যায়। এ সময় যেখানে প্রতি সের সরিষা ৪ টাকা ৪ আনা বিক্রি হতো সেখানে প্রতি সের সরিষা বিক্রি হতে থাকে তিন টাকায়। কাপড়, জ্বালানী কাঠ, প্রশাধনী সামগ্রী, মসলাসহ সকল পণ্যের দাম কমতে থাকে। এ সময় সামরিক কর্তৃপক্ষ দোকানদারদেরকে দোকানের সামনে জিনিষপত্রের মূল্য তালিকা টাঙ্গিয়ে রাখার নির্দেশ দেন। ১৯৫৮ সালের ২২ অক্টোবর থেকে বিভিন্ন শহরে পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালিত হয়। সামরিক কর্তৃপক্ষের আবেদনের ফলে সাধারণ মানুষ তখন নিজ নিজ বাসাবাড়ি, রাস্তার ময়লা পরিস্কার করে ফেলেন। শুধু বাসা বাড়িই নয় দোকান পাঠ, অফিস, সরকারি অফিসও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়। ১৯৫৮ সালের ৩ নবেম্বর ঝড়ে কুমিল্লায় ব্যাপক ক্ষতি হয়। বড় বড় বট গাছ, শাল গাছ, মেহগণি গাছ রাস্তার উপর ভেঙ্গে পড়ে। টেলিফোন, রেডিও গ্রাম, টেলিগ্রাম ও বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিশেষ সংখ্যার ২১ এর পৃষ্ঠার পর।। সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সরকারি কর্মচারীরা এ সব গাছ সরিয়ে যান চলাচলের উপযুক্ত করেন। এ সময় সেনাবাহিনী ক্রেন দিয়ে গাছ সরায় এবং করাতিদের দিয়ে কয়েকদিন ধরে গাছ কেটে সরিয়ে নেয়। এই সময় কুমিল্লা ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুরে হাজার হাজার ভুয়া রেশন কার্ড উদ্ধারের ঘটনা ঘটে। কুমিল্লা সেনানিবাসে কর্মরত সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যরা ছুটির দিন রবিবার ছাড়া সেনানিবাস থেকে বের হওয়ার বৈধ সুযোগ পেতেন না। রবিবার তারা কেনাকাটা করতেন এবং সিনেমা দেখে চিত্ত বিনোদন করতেন। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের সাথে কেনাকাটা ছাড়া তাদের কোন যোগাযোগ ছিল না। সাধারণ মানুষের সাথে পাকিস্তানি সেনারা যোগাযোগ রাখে কিনা সে বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি চালানো হতো। ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে মরণপন যুদ্ধ শুরু হলেও মূলত এটির সূচনা ঘটে এপ্রিলে পশ্চিম পাকিস্তানের কচ্ছের রান এলাকায়। সেখানে ভারত আক্রমণ করে বসে। জুন মাসে যুদ্ধ বিরতি হয়। তবে আগষ্টে আজাদ কাশ্মিরে ভারতীয়রা হামলা করলে পাকিস্তানিরা পাল্টা আক্রমণ করে চাম্ব ও জুরিয়ান দখল করে। পরে ভারতীয়রা আখনুরের ৬ মাইলের মধ্যে চলে আসলে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে মরণপন যুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধ ১৭ দিন স্থায়ী হয়। ১৯৬৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়া হয়। এই যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত ৫৩ ব্রিগেড ভারতীয় সীমান্তে মোতায়েন করা হয়। পাকিস্তানি সেনারা এ সময় শহরে টহল দিতো। যুদ্ধের সময় বেশিরভাগ সময় ব্লাক আউট থাকতো। এ সময় কুমিল্লার কুমিল্লা জিলা স্কুলসহ প্রায় সব স্কুলের শিক্ষার্থীদের যুদ্ধের সময় কিভাবে আত্মরক্ষা করতে হবে তার প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। এ ক্ষেত্রে স্কাউট ও জুনিয়র ক্যাডেট কোরের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। তবে প্রশিক্ষণ প্রদান করতেন সেনা কর্মকর্তারা। যুদ্ধের সময় ভারতীয়রা আক্রমণ করলে কিভাবে আত্মরক্ষা করতে হবে এবং সাইরেন বাজালে ‘ভি’, ‘ডব্লিই’ আকারের বাঙ্কারে চলে যেতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে ধারণা দেওয়া হতো। পাকিস্তান ভারত যুদ্ধের সময় ভারতে থেকে কিছু রিফিউজি আসলে তাদের কুমিল্লার ঈশ্বর পাঠশালায় আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়। ছাত্ররা এ সময় মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ করতে মিছিল করতো। ব্লাক আউট হলে ঘরে থাকতে হবে তা চোঙ্গা দিয়ে জানিয়ে দিতেন। ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান ভারত যুদ্ধের পর কুমিল্লায় বসবাসরত বাঙালি হিন্দুদের উপর নির্যাতন ও ধরপাকড় চালায় পূর্ব পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কুমিল্লায় কর্মরত অংশটি। তারা বাঙালি হিন্দুদের ভারতীয় অনুচর ও দেশের শক্র মনে করতেন। এ কারণে কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান বিপ্লবী অতীন্দ্র ভদ্র, আইনজীবী যতীন ভদ্র, অমূল্য ব্যানার্জিসহ অনেক রাজনৈতিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। কুমিল্লা সেনানিবাসের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গোমতী নদী ভরা মৌসুমে পানিতে টইটুম্বর থাকতো। এ সময় নদীর বাঁধে ভাঙ্গন দেখা দিতো। অভিযোগ রয়েছে, সেনাবাহিনী কুমিল্লা শহর রক্ষা এবং সেনানিবাস রক্ষার জন্য নদী ডান দিকে বাধ ভেঙ্গে দিয়ে নদীর পানি বুড়িচং, দেবীদ্বার, মুরাদনগর এলাকায় ছেড়ে দিতেন। ১৯৭১: ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি সেনাকর্মকর্তাদের মিথ্যা কথা বলে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে সরিয়ে দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মেতে উঠে ইতিহাসের নির্মম হত্যাযজ্ঞে। ‘অপারেশন কিল অ্যান্ড বার্ন’ নামে এক অভিযান চালিয়ে হাজার হাজার বাঙালি মুক্তিকামী নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। পুরো কুমিল্লা সেনানিবাসকে বানিয়ে ফেলে বধ্যভূমি। ২৯ মার্চ, সোমবার। কুমিল্লার সংগ্রামী ইতিহাসে ভয়ঙ্কর এক কালো দিন। একটি কালো রাত। এ দিন কুমিল্লায় সংগঠিত হয় ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর গণহত্যা। কি নির্মম, কি বর্বর আর পাষন্ড ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর রক্ত পিপাসু সেনা কর্মকর্তারা তার প্রমাণ মেলে পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা লে. কর্ণেল মনসুরুল হকের প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমান যুদ্ধ তদন্ত কমিশনের কাছে দেয়া সাক্ষ্যে। তিনি বলেন-‘কুমিল্লা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা ২৩ এফএফ ও ২২ বেলুচের সমন্বয়ে গঠিত ৫৩ ব্রিগেড গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান লে. কর্ণেল ইয়াকুব মালিক ২৫ মার্চের পর থেকে আটকে রাখা এবং ২৯ মার্চ বাঙালি সেনাসদস্যরা বিদ্রোহ ঘোষণার পর আটক ১৭ জন বাঙালি অফিসারসহ ৯১৫ জনকে অঙ্গুলি হেলনে জবাই ও গুলি করে হত্যা করে।’ অবশ্য প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমান যুদ্ধ তদন্ত কমিশনের এক স্থানেএ গণহত্যা ২৭-২৮ মার্চ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, ‘এই ঘটনাটি এ-ব্যাপারে উদাহরণ হিসাবে যথেষ্ট হওয়া উচিত। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অফিসার, সাধারণ সৈনিক এমনকি জেনারেল পদমর্যাদার সেনা-অফিসারদের মধ্যে বাঙালির বিরুদ্ধে ঘৃণার মনোভাব বিদ্যমান ছিলো। সালদা নদী এলাকায় অন্তত ৫শ লোককে হত্যা করা হয়েছিলো। ছোট ছোট শহর ও গ্রাম্য এলাকা শত্রুমুক্ত করার জন্য সেনাবাহিনী অভিযান চালাতে গিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলো অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে। তারা হত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে এগুচ্ছিলো।’ পূর্বপাকিস্তানে অভিযান চালানোর সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে সব অপরাধ করেছে বা নৃশংসতা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয় তার মধ্যে কুমিল্লা সেনানিবাসের বাঙালি সেনা ইউনিটগুলোকে নিরস্ত্র করার সময় সংগঠিত হত্যাকান্ডকে গুরুতর অভিযোগ বা বাড়াবাড়ি হিসেবে দেখানো হয় হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টে। কমিশনের সামনে প্রমাণ হিসেবে এই মর্মে সুনির্দিষ্ট করে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে যে, ৫৩ ফিল্ড রেজিমেন্টের কমান্ডার লে: কর্নেল ইয়াকুব মালিক কুমিল্লা সেনানিবাসে ১৭ জন অফিসার এবং অন্যান্য র‌্যাঙ্কের ৯১৫ জনকে হত্যার জন্য দায়ী। সেনানিবাসের ৪ ইষ্ট বেঙ্গল রাইফেল, ৪০ ফিল্ড এম্বুলেন্স এবং এস এমজি’র বাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করার সময় এই হত্যাকান্ড চালানো হয়। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট অফিসারের কাছ থেকে যে-ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তাতে তিনি তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন যে, ‘নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া চালানোর সময় ওই সেনানিবাসের উল্লিখিত ইউনিটগুলো প্রতিরোধের সৃষ্টি করে এবং এর ফলে সংঘর্ষে উভয়পইে হতাহত হয়।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পরিস্থিতি স্থিতাবস্থায় আসার পর বহুসংখ্যক নিরস্ত্র বাঙালিকে সেনা-ব্যারাকগুলিতে আটক রাখার বিষয়টি নবম ডিভিশনের সদরদপ্তরকে জানানো হয়। এতে প্রমাণ হয় যে, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া চালানোর সময় এ ধরনের কোনো হত্যাকা- হয়নি।’ অথচ পুরো পৃথিবীর মানুষ সংবাদপত্রের কল্যাণে তখন জেনে গিয়েছিল সেনা নিবাসের গণহত্যার কাহিনী। ৫৩ ব্রিগেড গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান লে. কর্ণেল ইয়াকুব মালিকের নির্দেশে সেনানিবাসে নারকীয় এই গণহত্যা যারা চালিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাঞ্জাবি কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্ণেল খিজির হায়াত খান, ব্রিগেডিয়ার আসলাম, ১৪ এফএফআর ইউনিটের কমান্ডিং অফিসার শাহপুর খান, অর্টিলারীর লেফটেন্যান্ট মীর, লেফটেন্যান্ট কর্ণেল বাকি, মেজর সুলতান আহমেদ, সিকিউরিটি বিভাগের মেজর সেলিম, মেজর মোস্তফা, মেজর সিদ্দিকী, মেজর মোহাম্মদ ইয়াসিন খোকা, মেজর আবদুল করিম, মেজর মুজাফফর হাসান গার্দিজি, ৯ ডিভিশনের এসএসও মেজর বশির, মেজর রাঠোর, মেজর ধর, মেজর নুসা, মেজর খালেদ, মেজর আজাদ, ক্যাপ্টেন ওবায়দুর রহমান, সুবেদার মুস্তফা খান, ক্যাপ্টেন জাহিদ জামান ও ক্যাপ্টেন কবির, ক্যাপ্টেন জাবেদ ইকবাল, ক্যাপ্টেন আগা বোখারী, ক্যাপ্টেন বোখারী, ক্যাপ্টেন সারওয়ার, ক্যাপ্টেন জিয়া, ৩৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন গোনদেজ ও সুবেদার মেজর ফয়েজ সুলতান, ক্যান্টনমেন্টে মুজাহিদ বাহিনীর অফিসার ক্যাপ্টেন মন্তাজ, ক্যাপ্টেন জং, সুবেদার আরব খান, সুবেদার আশরাফ, হাবিলদার বশির উদ্দিন এবং আরো অনেক পাকিস্তানি নরপিশাচ সেনা কর্মকর্তা নারকীয় উল্লাসে মেতে নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। পাকিস্তানি সুবেদার মেজর ফয়েজ সুলতান পাগলা কুকুরের মত ক্যান্টনমেন্টের যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় এবং বাঙালি দেখলেই গুলি করে হত্যা করে। ২৯ মার্চ সাড়ে তিনটায় ৪০ নং ফিল্ড এম্বুলেন্স ইউনিটে কিছুক্ষণ গোলাগুলি চলে। বাঙালি অফিসাররা বিদ্রোহ করে তখন। কিন্তু তাঁরা টিকতে পারে নি। তার পরপরই সেনানিবাসের বিভিন্ন এলাকা থেকে সকল বাঙালি অফিসার ও অন্যান্য কর্মচারীকে ব্রিগেড হেড কোয়াটারে নিয়ে জমা করা হতে থাকে। বিকেল চারটায় ব্রিগেড হেডকোয়াটারের তিনটি কামরায় আটকে রাখা প্রায় তিন শ’ সামরিক ও বেসামরিক মানুষকে ব্রিগেড অফিসের পাশে একটি কুল গাছের নিচে নিয়ে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। প্রথমে একজন একজন করে হত্যা করা হয়। এতে সময় বেশি লাগায় তাড়াতাড়ি নিধনযজ্ঞ সমাপ্তির জন্য প্রতি দড়িতে ৪ জনকে বাঁধা অবস্থায় ঐ কুল গাছের নিচে নিয়ে বন্দিদের গুলি করে হত্যা করা হয়। পরদিন ভোরবেলা তাঁদেরকে মাটি চাপা দেয়া হয়। ঐ দিন বাঙালি সামরিক অফিসার এম্বুলেন্সের ৪০ নং ফিল্ড কমান্ডিং অফিসার লে. কর্ণেল জাহাঙ্গীর, লেঃ কর্ণেল আনোয়ারুল ইসলাম, সিএনএইর আর কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল খুরশেদ উদ্দিন, মেজর খালেক, মেজর শহিদুজ্জামান, মেজর হাসিব এস.এস.ও, ক্যাপ্টেন হুদা, ক্যাপ্টেন বদরুল আলম, লেফটেন্যান্ট ফারুক, লেঃ এনামুল হক, লেঃ তুর্কে (ডাক নাম), ক্যাপ্টেন আইয়ুব আলী, লে. সালাহউদ্দিন, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আতিকুর রহমান সিরাজী, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হারুনুর রশিদ, ক্যাপ্টেন নুরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন সিদ্দিক, ৪০ নং ফিল্ড এমবুলেন্সের নায়েক সুবেদার আবদুল হামিদ, প্রশাসনিক জেসি সুবেদার আকবর খান এবং আর্মি এডুকেশন কোরের ক্যাপ্টেন মকবুল আহমেদ, লে. বাতেন, ব্রিগেড মসজিদের ইমাম মাওলানা মান্নান, হাবিলদার এসএস রহমান, ইঞ্জিনিয়ার্সের একজন ক্যাপ্টেন, ব্রিগেডিয়ারের সহকারী কেরানী, নায়েব সুবেদার এবং আরো অনেক বাঙালি অফিসারসহ অন্তত তিনশতেরও বেশি লোককে হত্যা করা হয়েছে। এভাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর ১২ জন বেসামরিক লোক থেকে যায়। তার সঙ্গে যে ১২ জন বেসামরিক লোক ছিলো, তাঁরা হচ্ছে ইস্পাহানী হাইস্কুলের সহকারী অধ্যক্ষের দুই পুত্র, রমণীসহ চারজন নরসুন্দর ও দুজন ঝারুদার-এই বারো জনের দশ জনকে ব্রিগেড পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সহকারী অধ্যক্ষের দুই ছেলেকে একই স্থানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা। Kazi Abdur Rakib (আলাপ) ০৩:২৭, ৩০ জুলাই ২০১৯ (ইউটিসি)[উত্তর দিন]