আনা ফ্রাঙ্ক

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(আন ফ্রাংক থেকে পুনর্নির্দেশিত)
আনা ফ্রাঙ্ক
১৯৪১ সালে আনা ফ্রাঙ্ক
১৯৪১ সালে আনা ফ্রাঙ্ক
জন্মআনেলিস মারি ফ্রাঙ্ক
(১৯২৯-০৬-১২)১২ জুন ১৯২৯
ফ্রাঙ্কফুর্ট আম মাইন, ভাইমার জার্মানি
মৃত্যু১৯৪৫ সালের মার্চের শুরুর দিকে (১৫ বছর)
বারগেন-বেলজেন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, লোয়ার স্যাক্সনি, নাৎসি জার্মানি
ডাকনামআনা
পেশাডায়েরি লেখিকা
জাতীয়তাজার্মানি (১৯৪১ পর্যন্ত)
জাতীয়তাহীন ১৯৪১-এর পর থেকে
উল্লেখযোগ্য রচনাবলিআনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি (১৯৪৭)
আত্মীয়

স্বাক্ষর

আনেলিস মারি ‘আনা’ ফ্রাঙ্ক (জার্মান: Annelies Marie "Anne" Frank; ১২ জুন ১৯২৯ — ১৯৪৫ সালের মার্চের শুরুর দিক পর্যন্ত) হচ্ছেন হলোকাস্টের শিকার সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও বিখ্যাত ইহুদি ব্যক্তি। তিনি তার মানসম্পন্ন লেখনীর জন্য পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়কার তার দিনলিপি এখন পর্যন্ত বিশ্বের অন্যতম সর্বাধিক পঠিত বই এবং অনেক চলচ্চিত্র ও নাটকের মূল বিষয় হিসেবে গৃহীত।

তার জন্ম ভাইমার জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট আম মাইন শহরে, কিন্তু তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে। জাতীয়তায় ১৯৪১ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন একজন জার্মান। নাৎসি জার্মানির সেমিটিক বিদ্বেষী নীতির কারণে তিনি তার জার্মান নাগরিকত্ব হারান। তিনি আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি লাভ করেছেন তাঁর দিনলিপির জন্য, যেখানে তিনি নেদারল্যান্ডসের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালীন তার অভিজ্ঞতাগুলোকে লিখে রেখেছিলেন।

১৯৩৩ সালে ফ্রাঙ্কের পরিবার আমস্টারডামে চলে যায়। সেই বছরেই নাৎসিরা জার্মানির ক্ষমতায় আসে। ১৯৪০ সালে তারা নাৎসি জার্মানির আমস্টারডাম দখলের কারণে সেখানে অন্তরীন হয়ে পড়েন। ১৯৪২ সালের দিকে ইহুদি জনগণ নিধন বাড়তে থাকায় তারা তার বাবার অটো ফ্রাঙ্কের লুকানো কক্ষে লুকিয়ে অবস্থান করতে থাকেন। দুই বছর পর, ৪ আগস্ট ১৯৪৪ সালের সকালে তারা জার্মান নিরাপত্তা রক্ষীদের হাতে ধরা পড়েন। কে তাদের লুকানো বাসগৃহের কথা জার্মানদের কাছে বখশিসের বিনিময়ে জানিয়ে দিয়েছিলো তা সঠিকভাবে জানা যায় না।[১][২] তারা ধরা পড়েন ও তাদেরকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আনা ফ্রাঙ্ক ও তার বোন মার্গোট ফ্রাঙ্ককে বার্গেন-বেলজান কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে ১৯৪৫ সালে টাইফাসে আক্রান্ত হয়ে তারা দুজনেই মৃত্যুবরণ করেন।

যুদ্ধ শেষে তার পরিবারের একমাত্র বেঁচে থাকা ব্যক্তি বাবা অটো ফ্রাঙ্ক আমস্টারডামে ফিরে আসেন, এবং আনার দিনলিপিটি (ডায়েরি) খুঁজে বের করেন। তার প্রচেষ্টাতেই দিনলিপিটি ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয়। এটি মূল ওলন্দাজ ভাষা থেকে পরবর্তীকালে ১৯৫২ সালে প্রথম বারের মতো ইংরেজিতে অনূদিত হয়। এর ইংরেজি নাম হয় দ্য ডায়েরি অফ আ ইয়াং গার্ল। বাংলায় এটি আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি নামে অনূদিত হয়। এটি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ডায়েরিটি আনার ১৩তম জন্মদিনে উপহারস্বরূপ দেওয়া হয়েছিলো। যেখানে আনার জীবনের ১২ জুন ১৯৪২ থেকে ১ আগস্ট ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত সময়ের ঘটনাগুলো ফুটে উঠেছে।

প্রারম্ভিক জীবন[সম্পাদনা]

আনা ফ্রাঙ্ক ১৯২৯ সালের ১২জুন জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে মেইনগাউ রেড ক্রস হাসপাতালে জন্ম গ্রহণ করেন। তার মাতা পিতা ছিলেন এডিথ ফ্রাঙ্ক ও অটো হেনরিখ ফ্রাঙ্ক।তার বড় বোন ছিলেন মার্গট।আনার পরিবার ছিল একটি উদার ইহুদী পরিবার। তারা ইহুদী ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান তেমন পালন করতেন না। ‌তারা ইহুদী ও অইহুদি লোকজনের মাঝে একটা বহুজাতিক সমাজে বসবাস করতেন। এডিথ ও অটো ফ্রাঙ্ক উভয়ে নিষ্ঠাবান মাতা পিতা ও জ্ঞানার্জনে আগ্রহী ছিলেন। তাদের একটি বড় লাইব্রেরী ছিল। তারা দুজনই তাঁদের সন্তানদের বই পড়ায় আগ্রহী করে তোলেন। আনার জন্মের সময় তার পরিবার ৩০৭,মারবাচওয়েগ, ফ্রাঙ্কফুর্টে অবস্থিত একটি বাড়িতে থাকতো। সেখানে তারা দুই তলা ভাড়া নিয়েছিলেন‌। ১৯৩১ সালে তারা বাসা বদল করে ডর্নবুশের একটি উদার ও উন্নত এলাকা গ্যাংহোফার্সট্রাস-২৪ এ চলে যায়।এই এলাকাকে কবিদের এলাকাও বলা হতো। এই দুইটি বাড়িই এখনো আছে।

১৯৩৩ সালে তখন হিটলারের নাজি পার্টি ক্ষমতায় আসে এবং হিটলার চ্যান্সেলর হয় তখন এডিথ ফ্রাঙ্ক বাচ্চাদের নিয়ে তার মায়ের সাথে থাকার জন্য এচেনে চলে যান। অটো ফ্রাঙ্ক ফ্রাঙ্কফুর্টে থেকে যান। পরে তিনি একটি কোম্পানি খোলার প্রস্তাব পান। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গোছানো আর পরিবারের বসবাসের ব্যবস্থা করতে তিনি আমস্টারডামে চলে আসেন‌‌। সেখানে তিনি ওপেক্টা ওয়ার্কস নামের কোম্পানির সাথে কাজ শুরু করেন। এডিথ এচেন থেকে আমস্টারডামে আসা যাওয়ার মধ্যে ছিলেন। একসময় তিনি আমস্টারডামের কাছেই রিভারেনবার্টের মারওয়েভ স্কয়ারে একটি এপার্টপেন্ট খুঁজে পান। সেই এলাকায় বেশির ভাগ জার্মান ইহুদী রিফিউজরা বসবাস করতো। ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বরে এডিথ, মার্গটকে নিয়ে তার স্বামীর কাছে চলে আসেন আর আনা ফ্রাঙ্ক তার নানীর কাছে থেকে যান। পরের ফেব্রুয়ারিতে আনার পরিবার নেদারল্যান্ডে মিলিত হয়। আনার পরিবার জার্মানি থেকে ১৯৩৩-৩৯ এর মধ্য পালিয়ে যাওয়া ৩০০,০০০ ইহুদীর মধ্যে ছিল।

আমস্টারডামে আসার পর মার্গটকে একটি সরকারি স্কুলে ভর্তি করা হয় আর আনা ফ্রাঙ্ককে মন্টেসরি স্কুলে ভর্তি করা হয়। প্রাথমিক ভাবে ডাচ ভাষা নিয়ে সমস্যায় পড়লেও মার্গট আমস্টারডামে ছাত্রী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। আনা ফ্রাঙ্ক মন্টেসরি স্কুলে বাড়ির মত পরিবেশ পান এবং সেখান সমবয়সী অনেকের দেখা পেয়েছিলেন; যেমন হানা গস্পেল, পরবর্তীতে তিনি আনার ভালো বন্ধুদের একজন হয়ে গিয়েছিলেন।

১৯৩৮ সালে অটো ফ্রাঙ্ক পেকটানন নামের আরেকটি কোম্পানি খোলেন যে কোম্পানি ঔষধি গাছ গাছড়া, আঁচারের লবণ আর বিভিন্ন ধরনের মসলার ব্যবসা করতো। ১৯৩৯ সালে আনা ফ্রাঙ্কের নানী তাদের কাছে চলে আসেন এবং ১৯৪২ সালে তার মৃত্যু পর্যন্ত তাদের সাথেই ছিলেন।

১৯৪০ সালে জার্মানি নেদারল্যান্ড দখল করে। দখলদার সরকার ইহুদিদেরকে বিভিন্ন দমন ও বৈষম্যমূলক আইন করে নির্যাতন করতে থাকে। বাধ্যতামূলক নিবন্ধন ও পৃথকীকরণ ব্যবস্থা চালু করা হয়। অটো ফ্রাঙ্ক নিরাপদ আবাসের খোঁজে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদের ভিসা আবেদন বিবেচনা করার সুযোগই হয় নি। কারণ রটারডামে অবস্থিত ইউএস কনসুলেট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আর ভিসার আবেদন সহ সব কাগজপত্র হারিয়ে গিয়েছিল। তবে ভিসার আবেদন বিবেচনা করা হলেও লাভ হতো না।কারণ ইউএস সরকারের আশঙ্কা ছিল যেসব লোকের নিকটাত্মীয় জার্মানিতে আছে তাদেরকে দিয়ে জোর করে গুপ্তচরবৃত্তি করানো হতে পারে।

ডায়েরির সময়ধারা[সম্পাদনা]

লুকানোর পূর্বে[সম্পাদনা]

১২ জুন ১৯৪২ সালে ১৩ তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে আনা ফ্রাঙ্ক ছোট তালাসহ লাল-সাদা ডোরাকাটা একটি অটোগ্রাফের খাতা উপহার পান। ফ্রাঙ্ক সেটি ডায়েরি হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন এবং তখনই লেখা শুরু করেন। ১৯৪২ সালের ২০ জুন আনা তার লেখায় নেদারল্যান্ডের ইহুদী জনগণের উপর আরোপিত বিধিনিষেধের তালিকা করেছিলেন।

অটো ও এডিথ ফ্রাঙ্ক বাচ্চাদের নিয়ে ১৯৪২ এর ১৬ জুলাইয়ে লুকানো স্থানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু যখন মার্গট কোন শ্রমশিবিরে স্থানান্তরের জন্য কেন্দ্রীয় ইহুদী প্রত্যাবাসন অফিস থেকে ডাক পায় তখন তাঁরা পরিকল্পনা ১০ দিন এগিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছিলেন। অজ্ঞাতবাসে যাওয়ার আগে আনা তার প্রতিবেশি বন্ধু টুসি কুপার্সকে একটি বই, এক সেট চায়ের কাপ এবং এক বাক্স মার্বেল দিয়ে গিয়েছিলেন। ৬ জুলাই ফ্রাঙ্করা কুপার্স পরিবারকে তাদের বিড়াল মুর্টজের খেয়াল রাখা অনুরোধ করে একটি চিরকুট লিখে রেখে চলে যায়। এসোসিয়েটেড প্রেসের প্রতিবেদনে কুপার্স বলেন যে আনা তাকে বলেছিল: "আমার মার্বেলগুলো নিয়ে আমি চিন্তিত কারণ আমার আশঙ্কা হচ্ছে এগুলো ভুল কারো হাতে পড়তে পারে। তুমি কি এগুলো আমার জন্য কিছুদিন রাখতে পারবে?"

একটারহুইসের জীবন[সম্পাদনা]

৬ জুলাই ১৯৪২ সোমবার সকালে আনা ফ্রাঙ্ক ফ্যামিলি তাদের গোপন স্থানে চলে যায়; সেটা ছিল একটি ৩ তলা ভবন যেখানে প্রিনসেনগ্রাচটে অবস্থিত অপেক্টা অফিসের উপর একটি সিঁড়ি থেকে প্রবেশ করা যেত; সেখানে অটো ফ্রাঙ্কের কিছু বিশ্বস্ত কর্মচারী তাদের সহযোগী হয়েছিল। এই গুপ্তস্থানটি Acterhuis নামে পরিচিত হয়েছিল, ডায়েরির ইংরেজি সংস্করণে একে secret Annex বা গুপ্ত ঘর বলা হয়েছে। তাদের এপার্টমেন্ট ছত্রভঙ্গ অবস্থায় ফেলে আসা হয়েছিল যাতে মনে হয় তারা হঠাৎ করে চলে গেছে। অটো ফ্রাঙ্ক একটি চিরকুট রেখে এসেছিলেন যাতে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল যে তাঁরা সুইজারল্যান্ড যাচ্ছেন। গোপনীয়তা প্রয়োজনে আনার বিড়াল মুর্টজকে ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা। যেহেতু ইহুদীদের জন্য গণপরিবহনে চড়া নিষিদ্ধ ছিল তাই তাদেরকে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে যেতে হয়েছিল। একটারহুইসের দরজা একটা বইয়ের তাক দিয়ে আড়াল করা হয়েছিল যাতে গুপ্ত ঘর কেউ দেখে না ফেলে।

ভিক্টর কাগলার, জোহানেস ক্লিম্যান, মিয়েপ গিয়েস এবং বিপ ভসকুজি এরাই শুধু গুপ্ত ঘরের বাসিন্দাদের ব্যাপারে জানতো। গিয়েসের স্বামী জ্যান গিয়েস এবং ভসকুজির বাবা জোহানেস হেন্ডরিখ ভসকুজি সহ এরাই ছিল অজ্ঞাবাসে তাদের সহযোগী। বাহিরের জগতের সাথে গুপ্ত ঘরের বাসিন্দাদের একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে তারা তাদেরকে যুদ্ধ ও রাজনৈতিক উন্নতির খবরাখবর দিতো। তারা তাদের সব প্রয়োজন পূরণ করেছিল, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল এবং খাবার সরবরাহ করেছিল; সময়ের সাথে সাথে এই কাজ কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। ফ্রাঙ্ক কঠিন সময়ে ঘরের লোকদের সাহস ধরে রাখতে তাদের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টার কথা লিখেছেন। তারা এটা জানতো যে ধরা পড়লে ইহুদীদের আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে তাদের ফাঁসি হতে পারে।

১৩ জুলাই ১৯৪২ সালে ভ্যান পেলস পরিবারের হারম্যান, অগাস্ট এবং ১৬ বছর বয়সী পিটার ফ্রাঙ্ক পরিবারের সাথে যুক্ত হয়েছিল। নভেম্বরে যুক্ত হন পারিবারিক বন্ধু ও দাঁতের ডাক্তার ফ্রিটজ পিফার। ফ্রাঙ্ক কথা বলার মানুষ পাওয়ায় তার আনন্দের কথা লিখেছেন। কিন্তু বন্দি জীবন যাপনে বাধ্য হওয়া এই মানুষদের মাঝে খুব দ্রুতই উদ্বেগ বেড়ে গিয়েছিল। পিফারের সাথে রুম ভাগাভাগি করে থাকতে গিয়ে তাকে ফ্রাঙ্কের অসহ্য মনে হতো। তার অনধিকার প্রবেশে তিনি বিরক্ত হতে থাকেন। তিনি অগাস্ট ভ্যান পেলসের সাথে ঝগড়া করেছিলেন; তাকে আনার কাছে নির্বোধ মনে হতো। তিনি হারম্যান ভ্যান পেলস ও ফ্রিটজ পিফারকে স্বার্থপর মনে করতেন; বিশেষত খাবার খাওয়ার ব্যাপারে।

প্রথম দিকে তেমন পছন্দ না করলেও কিছুদিন পর ফ্রাঙ্ক পিটার ভ্যান পেলসের সাথে নৈকট্য অনুভব করেন এবং তারা দুইজন প্রেমে পড়ে যায়। তিনি তাঁর প্রথম চুমু পিটারের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রতি ফ্রাঙ্কের মায়া কমতে থাকে। কারণ তার মনে প্রশ্ন জাগে যে পিটারের প্রতি তাঁর অনুভূতি কি বাস্তব নাকি একসাথে বন্দি থাকার ফলাফল। আনা ফ্রাঙ্ক তাদের সহযোগীদের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন। অটো ফ্রাঙ্ক পরবর্তীতে বলেছিলেন যে আনা অধৈর্য ও আগ্রহ নিয়ে তাদের দৈনিক সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করতেন। তার মতে আনার সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক হয়েছিল তরুণ টাইপিস্ট বিপ ভসকুজির সাথে। তাঁরা দুজন মাঝে মাঝে ঘরের কোণায় দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কথা বলতেন।

তরুণ ডায়েরি লেখক[সম্পাদনা]

আনা ফ্রাঙ্ক তাঁর লেখায় পরিবারের সদস্যদের সাথে তার সম্পর্ক ও তাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব যাচাই করেছেন। তিনি মনের দিক থেকে তাঁর বাবাকে সবচেয়ে কাছের মনে করতেন। অটো ফ্রাঙ্ক পরবর্তীতে বলেন: "মার্গটের চেয়ে আনার সাথে আমার বেশি ভালো সম্পর্ক ছিল।মার্গটের সম্পর্ক ভালো ছিল তার মায়ের সাথে। এর কারণ হতে পারে মার্গট খুব কমই তার অনুভূতি প্রকাশ করতো। তার খুব কমই সাহায্যের প্রয়োজন হতো কারণ আনার মত তার অতো মেজাজের উঠানামা হতো না।"

ফ্রাঙ্করা দুই বোন লুকিয়ে থাকার সময় আগের চাইতে বেশি কাছাকাছি এসেছিল,তবে আনা মাঝে মাঝে মার্গটকে ঈর্ষা করতেন, বিশেষত যখন পরিবারের লোকজন মার্গটের মত ভদ্র ও শান্ত স্বভাবের না হওয়ায় তার সমালোচনা করতো। আনা বড় হয়েছিলেন, ফলে দুই বোন একে অপরকে বিশ্বাস করতে শুরু করেন। ১৯৪৪ সালের ১২ জুনের লেখায় আনা লিখেছেন: "মার্গট অনেক ভালো..........। আজকাল সে আর অতো হিংসা করে না। আস্তে আস্তে সে ভালো বন্ধু হয়ে যাচ্ছে। সে আর আমাকে নগন্য ছোট বাচ্চা মনে করে না।"

আনা প্রায়শঃ মায়ের সাথে তাঁর ঝগড়ার সম্পর্ক ও মায়ের প্রতি তার বিরূপ মনোভাবের কথা লিখেছেন। ৭ নভেম্বর ১৯৪২ এর লেখায় সে তার মায়ের প্রতি ঘৃণা এবং অবহেলা, বিদ্রুপ ও কঠিন হৃদয়ের কারণে তার সামনে যেতে না পারার কথা লিখেছেন। শেষে লিখেছেন, "তিনি আমার মা'ই নন"। পরবর্তীতে সম্পাদনার সময় তিনি তাঁর রুক্ষ মনোভাবের জন্য অনুতপ্ত হয়ে লিখেছেন, "আনা, এটাই কি আসল তুমি যে ঘৃণার কথা লিখেছো? আন , তুমি কীভাবে পারলে এমন করতে?" তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তাদের দূরত্বের জন্য তাঁরা উভয়েই দোষী। তিনি লক্ষ্য করেছিল যে তিনি তাঁর মায়ের অপ্রয়োজনীয় দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। এটা বুঝার পর থেকে আনা তার মায়ের সাথে সহিষ্ণুতা ও সম্মানের সাথে ব্যবহার করতে শুরু করেন।

ফ্রাঙ্করা দুই বোনই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্কুলে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন। এই অবস্থায়ও তারা নিয়মিত পড়াশোনা করছিলেন। মার্গট তো দূরশিক্ষণের মাধ্যমে বিপ ভসকুজির নামে একটি সাঁটলিপির কোর্সও করে ফেলেছিলেন এবং ভালো নম্বরও পেয়েছিলেন। আনার বেশির ভাগ সময় পড়ালেখা করে কাটতো। তিনি নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন আর ১৯৪৪ এর মার্চ থেকে লেখা সম্পাদনাও শুরু করেছিলেন। চলমান ঘটনাগুলো লেখার সাথে সাথে তিনি তার অনুভূতি, বিশ্বাস,স্বপ্ন ও আশা আকাঙ্ক্ষার কথা লিখতে থাকেন, যেগুলো সে কারো সাথে আলোচনা করতে পারতেন না। নিজের লেখার ক্ষমতায় তাঁর বিশ্বাস বাড়ছিল আর তিনি বড়ও হচ্ছিলেন। তাই তিনি বিমূর্ত বিষয় নিয়ে লেখা শুরু করেন। যেমন স্রষ্টার ব্যপারে তাঁর বিশ্বাস, মানুষের প্রকৃতি নিয়ে তাঁর ভাবনা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছিলেন।

ফ্রাঙ্ক সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন।১৯৪৪ সালের ৫ এপ্রিল তিনি লিখেছেন,

" অবশেষে আমি বুঝতে পারলাম যে অশিক্ষিত থাকা থেকে বাঁচতে হলে আমাকে স্কুলের কাজগুলো করতে হবে; যাতে আমি জীবনে উপরে উঠতে পারি,যাতে আমি সাংবাদিক হতে পারি; কারণ এটাই আমি চাই।আমি জানি আমি লিখতে পারি। কিন্তু দেখতে হবে আমার আসলেই প্রতিভা আছে কিনা।

আর আমি যদি বই বা পত্রিকার প্রবন্ধ নাও লিখতে পারি, আমি অন্তত আমার নিজের জন্য লিখতে পারি। কিন্তু আমি এর চেয়ে বেশি কিছু অর্জন করতে চাই। আমি মা, মিসেস ভ্যান ডান বা অন্য সব মহিলার মত হতে চাই না, যারা নিজেদের কাজ করে আর বিস্মৃতির গহ্বরে হারিয়ে যায়। স্বামী-সন্তানের পাশাপাশি আমার আত্ম-নিবেদনের জন্য কোন কিছু থাকতেই হবে।

আমি উপকারী মানুষ হতে চাই; আমি সব লোকের জন্য সুখ নিয়ে আসতে চাই; এমনকি তাদের জন্যও যাদেরকে আমি কখনো দেখিও নি। আমি আমার মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকতে চাই। স্রষ্টাকে অনেক ধন্যবাদ; তিনি আমাকে এই প্রতিভা দিয়েছেন; যার মাধ্যমে আমি নিজের উন্নয়ন করতে পারি এবং আমার ভিতরের কথা প্রকাশ করতে পারি।

যখন আমি লিখি তখন আমি সমস্ত পরোয়া ত্যাগ করি‌। আমার সব দুঃখ উড়ে যায়; আমার উদ্দিপনা ফিরে আসে। কিন্তু প্রশ্ন হলো আমি কি মহান কোন কিছু লিখে যেতে পারবো? আমি কি সাংবাদিক বা লেখক হতে পারবো?"

তিনি ১ আগস্ট, ১৯৪৪ পর্যন্ত নিয়মিত লিখেছিলেন।

গ্রেফতার[সম্পাদনা]

১৯৪৪ সালের ৪ আগস্ট একটারহুইস এলাকায় সিলবার বাউয়ারের নেতৃত্বে একদল জার্মান পুলিশ হামলে পড়ে। আনা ফ্রাঙ্কের পরিবার ও আরো অনেককে গ্রেফতার করে RSHA হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়‌। সেখানে তাদেরকে সারারাত জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ৫ আগস্ট তাদের কে Huis Van Bewaring (বন্দিশালা)য় পাঠিয়ে দেওয়া হয় যেটি ছিল ওয়েটারিংচ্যান্স এর জনবহুল জেলখানা। দুইদিন পর তাদেরকে ওয়েস্টারবুর্কের ট্রানজিট ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে ঐ ট্রানজিট ক্যাম্প দিয়ে ১,০০,০০০ ইহুদী পার হয়ে গিয়েছিল। যেহেতু আনা ফ্রাঙ্কের পরিবার লুকিয়ে থাকা অবস্থায় গ্রেফতার হয়েছিল তাই তাদেরকে কঠোর পরিশ্রম করানোর জন্য শাস্তি ব্যারাকে পাঠানো হয়েছিল।

অটো ফ্র্যাংকের সেক্রেটারি মাইয়েপ গিয়েস আর তাদের প্রতিবেশি বিপ ভসকুজি কেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। নিরাপত্তা বাহিনী তাদেরকে হুমকি-ধামকি দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল। তাঁরা পরেরদিন একটারহুইসে ফিরে আসেন এবং আনা ফ্রাঙ্কের কাগজপত্র ও বিভিন্ন পারিবারিক ছবি মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেন। তারা সেগুলো কুড়িয়ে নেন। গিয়েস ঠিক করেছিলেন যুদ্ধের পর সেগুলো আনা ফ্রাঙ্ককে ফিরিয়ে দিবেন। ৭ আগস্ট গিয়েস পুলিশ প্রধান সিলবার বাউয়ারের সাথে দেখা করে টাকার বিনিময়ে বন্দিদের ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু তিনি প্রস্তাবে রাজি হন নি।

যদিও দাবি করা হয় যে কোন এক গোপন সংবাদদাতা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, কিন্তু একটারহুইসে পুলিশি অভিযানের তথ্যদাতাকে ঠিকমত শনাক্ত করা যায় নি। নৈশপ্রহরী মার্টিন স্লিজার এবং অজ্ঞাত এক পুলিশ অফিসার ১৯৪৪ এর এপ্রিলে ঐ বাড়িতে একটি চুরির তদন্ত করতে আসে এবং বইয়ের তাকের পিছনে গুপ্ত দরজা দেখে ফেলে বলে জানা যায়। অটো ফ্রাঙ্কের জীবনীকার ক্যারল এন লির মতে ন্যাশনাল সোশালিস্ট পার্টি ইন নেদারল্যান্ড এর সদস্য টনি এহলার ছিল সেই সংবাদদাতা। আরেকজন সন্দেহভাজন সংবাদদাতা ছিল স্টকরুম ম্যানেজার উইলেম ভ্যান মারেন‌। সেই বাড়ির বাসিন্দারা তাকে বিশ্বাস করতো না। সে স্টকরুমের ভিতরে আসা লোকদের বিষয়ে অনেক প্রশ্ন করতো। আনা ফ্রাঙ্কের জীবনীকার মেলিসা মুলার, লিনা হার্টগ কে গোপন সংবাদদাতা বলে সন্দেহ করেন। যেহেতু সন্দেহভাজন এসব লোক একে অপরকে চিনতো তাই হতে পারে তারা সবাই মিলে এই কাজ করেছিল‌। যুদ্ধের পর এদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও আসল লোকটাকে বের করা যায় নি।

২০১৫ সালে সাংবাদিক জেরিন ডি ব্রায়ান এবং বিপ ভসকুজির ছোট ছেলে জুপ ভ্যান উইকজ একটি জীবনীগ্রন্থ লেখেন। বইয়ের নাম: Bep Voskuiji,the silence is over: a biography of the youngest helper of the secret annex. এই বইতে তারা বিপ ভসকুজির ছোট বোন নেলিকে(১৯২৩-২০০১) সন্দেহ করেন। নেলি তার বিপ ও তাদের বাবার ইহুদিদেরকে সহযোগিতার সমালোচনা করতো। তার বোন ডিনাই ও তার বোনের বাগদত্তা বার্টাস জানান যে সেই ৪ আগস্ট সকালে নেলি গেস্টাপোকে ফোন করে ফ্রাঙ্ক পরিবারের তথ্য দিয়েছিল। নেলি ১৯-২৩ বছর বয়স পর্যন্ত নাজি বাহিনির সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিল।

২০১৬ সালে আনা ফ্রাঙ্ক হাউজ একটি নতুন গবেষণা পত্র প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়েছে যে বিশ্বাসঘাতকতার চেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা হলো একটি রেশন কার্ড জালিয়াতির তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ ফ্রাঙ্ক পরিবারের লুকানো অবস্থান আবিষ্কার করে। তাছাড়া এ ভবনে অবস্থিত অটো ফ্রাঙ্কের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেখেও পুলিশ এসে থাকতে পারে। তবে এই গবেষণা পত্র বিশ্বাসঘাতকতার সম্ভবনা একদম উড়িয়ে দেয় নি।

স্থানান্তর[সম্পাদনা]

৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪৪ সালে তাদেরকে শেষবারের মত ওয়েস্টারবুর্ক থেকে অসউইজ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়। তারা ৩ দিন পর সেখানে পৌঁছায়। এ সময় ব্লয়েম ইভার্স এমডেন ফ্রাংকদের সাথে একই ট্রেনে ছিলেন। তিনি আমস্টারডামের স্থানীয় বাসিন্দা। ১৯৪১ সালে আনা ও মার্গটের সাথে একটি ইহুদী বিদ্যালয়ে তার বন্ধুত্ব হয়েছিল। ব্লয়েম অসউইজে আনা, মার্গট ও তাদের মাকে নিয়মিত দেখতে যেত। তিনি গাছ পরিচালক উইলি লিন্ডার পরিচালিত টিভি ডকুমেন্টারি Last seven months of Anne Frank (1988) এবং বিবিসি ডকুমেন্টারি Anne Frank remembered (1995)  তে অসউইজে আনা ফ্রাঙ্কের জীবন নিয়ে সাক্ষাৎকার দেন।

অসউইজে পৌঁছার পরই পুরুষদের কে নারী ও শিশুদের থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। অটো ফ্রাঙ্ক তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। যাদের কর্মক্ষম মনে হতো তাদের কে শ্রম শিবিরে নিয়ে যাওয়া হতো আর যাদের অক্ষম মনে হতো তাদেরকে সাথে সাথে মেরে ফেলা হতো। ১০১৯ জন যাত্রীর মধ্যে ১৫ এর কম বয়সী শিশু সহ প্রায় ৫৪৯ জনকে সরাসরি গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। আনা ফ্রাঙ্ক, যিনি কিনা তিন মাস আগেই ১৫ বছর শেষ করেছিলেন, তিনি তাঁর ট্রেনের বেঁচে যাওয়া কম বয়সীদের একজন ছিলেন। তিনি অচিরেই জানতে জানতে পারলেন যে তার ট্রেনের অধিকাংশ মানুষ মারা গেছে‌। তবে একটারহুইসের সবাই এই ঘটনায় বেঁচে ছিল কিনা তিনি জানতে পারেন নি। তিনি মনে করেছিলেন তাঁর পঞ্চাশোর্ধ দুর্বল বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে।

বেঁচে যাওয়া আরো অনেক নারী ও শিশুর সাথে আনা ফ্রাঙ্ককেও উলঙ্গ করে জীবাণুনাশক দেওয়া হয়েছিল, মাথা কামিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং বাহুতে একটা শনাক্তকারী সংখ্যা এঁকে দেওয়া হয়েছিল। দিনে নারীদেরকে দাসশ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা হতো। আনা ফ্রাঙ্ক পাথর  বহন ও ঘাসের আঁটি বাঁধার কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আর রাতে তাদেরকে সংকীর্ণ ব্যারাকে গাদাগাদি করে রাখা হতো। পরবর্তীতে কিছু প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন যে শিশুদের গ্যাস চেম্বারে নিতে দেখে আনা ভয়ে কুঁকড়ে যেতেন। তবে অন্য কিছু প্রত্যক্ষদর্শী বলেছে যে তিনি শক্ত ও সাহসী ছিলেন। তাঁর সামাজিক ও আত্মবিশ্বাসী প্রকৃতি তাঁকে তার বোন, মা ও নিজের জন্য বেশি খাবার সংগ্রহ করতে সাহায্য করেছে। অনেক আগেই আনা চর্মরোগে খারাপ ভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁদের দুইবোনকে সেখানকার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে সারাক্ষণ অন্ধকার থাকতো আর চারিদিকে ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি করতো। এডিথ ফ্রাঙ্ক খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তিনি খাবারের প্রতিটি দানা তার মেয়েদের জন্য রেখে দিতেন এবং হাসপাতালের দেয়ালের ফুটো দিয়ে সেগুলো তার মেয়েদের কাছে পৌঁছাতেন।

১৯৪৪ সালের অক্টোবরে ফ্রাঙ্কদেরকে আপার সিলিসিয়ার লিবাউ শ্রম শিবিরে স্থানান্তরের জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়। ব্লয়েম ইভার্স এমডেন কেও একই সাথে স্থানান্তরের নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে আনা ফ্রাঙ্ককে সেখানে যেতে নিষেধ করা হয়।কারণ তাঁর চর্মরোগ চরম আকার ধারণ করেছিল। তার মা ও বোন তার সাথে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ব্লয়েম তাদের ছাড়াই চলে যায়।

অক্টোবরের ২৮ তারিখে নারীদেরকে বার্গেন-বেলসেন এ পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য তালিকা করা শুরু হয়। আনা ও মার্গট ফ্রাঙ্ক এবং অগাস্ট ভ্যান পেলস সহ প্রায় ৮০০০ নারীকে সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এডিথ ফ্রাঙ্ক অসউইজেই রয়ে যান এবং না খেতে পেয়ে মারা যান‌।

বার্গেন-বেলসেন এ তাঁবু খাটিয়ে হাজার হাজার বন্দির থাকার ব্যবস্থা করা হয়। বন্দিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। এখানে ফ্রাঙ্ক তাঁর বন্ধু হানেলি গসলার ও নানেটে ব্লিটজের দেখা পান। ব্লিটজকে স্টার্নলাগার থেকে এই ক্যাম্পে ফ্রাঙ্কের সেকশনেই ১৯৪৪ এর ডিসেম্বরে আনা হয়েছিল। আর গসলার স্টার্নলাগারে ১৯৪৪ এর ফেব্রুয়ারি থেকে ছিলেন। এই দুই নারী যুদ্ধের পরও বেঁচে ছিলেন। তারা ফ্রাঙ্কের সাথে মে আলাপ হয়েছিল তা পরে আলোচনা করেছিলেন। ব্লিটজ সরাসরি কথা বলতে পারতেন; আর গসলার কথা বলতেন কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে। গসলার বলেছেন অগাস্ট ভ্যান পেলস আনা ও মার্গটের সাথে ছিলেন। তিনি অসুস্থ মার্গটের দেখাশোনা করতেন। গসলার এটাও বলেছেন যে তিনি মার্গটকে দেখেন নি‌। কারণ সে এতো অসুস্থ ছিল যে বিছানা থেকেই নামতে পারতো না। আর ব্লিটজ বলেন যে তিনি তাদের দুইবোনকেই দেখেছেন। আনা গসলার ও ব্লিটজকে বলেছিলেন যে তিনি বিশ্বাস করেন তাঁর বাবা মা মারা গেছেন তাই তিনিও আর বাঁচতে চান না‌। গসলার অনুমান করেন তাদের সাক্ষাৎ জানুয়ারির শেষ বা ফেব্রুয়ারির শুরুতে হয়েছিল।

মৃত্যু[সম্পাদনা]

১৯৪৫ এর শুরু দিকে টাইফাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এতে প্রায় ১৭০০০ বন্দি মারা যায়। এছাড়া টাইফয়েডও ছড়িয়ে পড়েছিল। এই বিশৃঙ্খল অবস্থায় আনা ফ্রাঙ্কের মৃত্যুর আসল কারণ নির্ণয় সম্ভব নয়। তবে এতটুকু প্রমাণ আছে যে সে মহামারীতে মারা যায়। বার্গেন-বেলসেন ক্যাম্পের একজন বেঁচে যাওয়া বন্দি, গিনা টার্গেল, আনাকে চিনতেন। ২০১৫ সালে গিনা ব্রিটিশ পত্রিকা দি সান'কে বলেছেন: " তার বিছানা আমার কাছেই এক কোণায় ছিল। সে প্রায় উন্মাদ ও ভয়ঙ্কর হয়ে গিয়েছিল।" তিনি আরো বলেন যে তিনি ফ্রাঙ্ককে পরিষ্কার হওয়ার পানি এনে দিতেন। গিনা ক্যাম্পের হাসপাতালে কাজ করতেন। তিনি জানান যে মহামারী অসংখ্য বন্দির প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। " শত শত মানুষ পোকা-মাকড়ের মত মারা যাচ্ছিল। রিপোর্ট আসতো ৫০০ লোক মারা গেছে। ৩০০ লোক মারা গেলে আমরা বলতাম স্রষ্টাকে ধন্যবাদ।মাত্র তিন শত।

প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যমতে মার্গট তার বিছানা থেকে পড়ে যান এবং এর আঘাতে মারা যান। আনা ও মার্গটের মৃত্যুর সঠিক তারিখ রেকর্ডে নেই। অনেকদিন যাবত ভাবা হতো যে ১৯৪৫ সালের ১৫ এপ্রিলে ব্রিটিশ সৈন্যরা এই ক্যাম্পটি মুক্ত করে দেওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে তারা মারা যায়। কিন্তু ২০১৫ সালের গবেষণায় দেখা যায় তারা ফেব্রুয়ারিতে মারা গিয়েছিলেন।অন্যান্য প্রমাণের সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য বলে যে আনা ফ্রাঙ্কের মধ্যে ৭ ফেব্রুয়ারিতেই টাইফাসের লক্ষণ দেখা যায়।ডাচ স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে অধিকাংশ টাইফাস আক্রান্ত মানুষ চিকিৎসাহীন অবস্থায় ১২ দিনের মধ্যে মারা গিয়েছিল। উপরন্তু গসলার বলেন তার বাবা হ্যান্স গসলার তাদের ১ম সাক্ষাতের এক বা দুই সপ্তাহ পর মারা গিয়েছিলেন। হ্যান্স মারি যান ২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৫।

যুদ্ধের পর হিসাব করে দেখা যায় ১৯৪২-৪৪ এর মধ্যে নেদারল্যান্ড থেকে স্থানান্তর করা ১০,৭০০০ মানুষের মধ্যে মাত্র ৫০০০ হাজার মানুষ বেঁচে ছিল। প্রায় ৩০,০০০ ইহুদী নেদারল্যান্ডেই ডাচদের সহযোগিতায় লুকিয়ে ছিল। তাদের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ যুদ্ধের পরও বেঁচে ছিল।

অটো ফ্রাঙ্ক অসউইজের বন্দিদশায় বেঁচে ছিলেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তিনি আমস্টারডামে ফিরে আসেন। সেখানে তিনি জ্যান ও মাইয়েপ গিয়েসের আশ্রয়ে থেকে তার পরিবারকে খোঁজার চেষ্টা করেন‌‌। তিনি অসউইজে তার স্ত্রী এডিথের মৃত্যু হয়েছে বলে জানতে পেরেছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন হয়তো তার মেয়েরা বেঁচে আছে‌। কয়েক সপ্তাহ পর তিনি জানতে পারেন যে মার্গট আর আনাও মারা গেছে। তিনি তাঁর মেয়েদের বন্ধুদের খোঁজার চেষ্টা করে জানতে পারলেন যে এদের অনেককেই মেরে ফেলা হয়েছে। আনার ডায়েরিতে প্রায়শঃ উল্লেখিত সেন লিডারম্যানকে তার মাতাপিতা সহ গ্যাস চেম্বারে মারা হয়েছিল। তার বোন বারবার- যে মার্গটের বন্ধু ছিল- বেঁচে গিয়েছিল। ফ্রাঙ্কদের কয়েকজন স্কুল বন্ধু বেঁচে ছিল। অটো ফ্রাঙ্ক ও এডিথ ফ্রাঙ্কের পরিবারের অনেকে বেঁচে গিয়েছিল কারণ তারা ১৯৩০ এর দশকেই জার্মানি ত্যাগ করেছিল। তাদের কেউ সুইজারল্যান্ড, কেউ যুক্তরাজ্য আর কেউ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস শুরু করে।

আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি[সম্পাদনা]

প্রকাশনা[সম্পাদনা]

১৯৪৫ এর জুলাই মাসে যখন রেড ক্রস ফ্রাঙ্ক-ভগ্নিদ্বয়ের মৃত্যু নিশ্চিত করলো তখন মাইয়েপ গিয়েস অটো ফ্রাঙ্ককে সেই ডায়েরি ও কিছু ছুটা কাগজ দিলেন যেগুলো তিনি আনাকে ফিরিয়ে দিবেন বলে জমা করে রেখেছিলেন। পরবর্তীতে অটো ফ্রাঙ্ক বলেছিলেন যে তিনি ভাবতেই পারেন নি আনা ফ্রাঙ্ক তাদের লুকিয়ে থাকাকালীন জীবনের বিবরণ এতো সঠিক ও সুন্দর ভাবে লিখে রেখেছে। তার স্মৃতিচারণে তিনি উল্লেখ করেছেন, কতটা বেদনা নিয়ে তিনি ডায়েরি পড়েছিলেন, কীভাবে তিনি উল্লেখিত ঘটনাগুলো স্মরণ করছিলেন। তার মনে পড়েছিল যে এসব লেখার কিছু অংশ তার মেয়েরা তাকে পড়ে শুনিয়েছিল। তিনি প্রথমবারের মতো তার মেয়ের ব্যক্তিগত দিকটি লক্ষ্য করলেন। তিনি ডায়েরির সেই অংশগুলোও দেখলেন যেগুলো সে আর কারো সাথে আলোচনা করেন নি। তিনি বলেন এটা আমার জন্য একটা আবিষ্কার। তার চিন্তা ও অনুভূতির ব্যাপারে আমার কোন ধারণাই ছিল না। সে তার অনুভূতি তার নিজের কাছেই রেখেছিল‌‌। আনার লেখক হবার আকাঙ্ক্ষার কথা চিন্তা করে তিনি এই ডায়েরিটি প্রকাশ করার কথা ভাবতে লাগলেন।

ফ্রাঙ্কের ডায়েরি শুরু হয়েছে তার ব্যক্তিগত চিন্তার বিবরণ দিয়ে। তিনি কয়েকবার উল্লেখ করেছেন যে তিনি এটা কাউকে পড়তে দিবেন না। তিনি তার জীবন, পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও তাদের অবস্থার কথা সাদাসিধে ভাবে বর্ণনা করে গেছেন। এরই মধ্যে তিনি গদ্য লেখা ও প্রকাশের প্রতি তার আগ্রহের কথা বুঝতে শুরু করেছিলেন। ১৯৪৪ সালের মার্চে তিনি লন্ডনে নির্বাসনে থাকা ডাচ সরকারের সদস্য গেরিট বলকেস্টেইনের রেডিও-আলোচনা শুনেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন যে যখন যুদ্ধ শেষ হবে তখন তিনি জার্মান দখলদারিত্বে ডাচ নাগরিকদের নির্যাতনের বিষয়ে একটি সরকারি রেকর্ড তৈরি করবেন। তিনি চিঠি ও ডায়েরি প্রকাশের কথা উল্লেখ করেছিলেন।তাই আনা ফ্রাঙ্ক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যখন সময় আসবে তখন তিনি তাঁর কাজ জমা দিবেন। তিনি প্রকাশের কথা মাথায় রেখে তার লেখা সম্পাদনা, কিছু সংশোধন ও পুনর্লিখন শুরু করেছিলেন।

মূল খাতার সাথে আরো কিছু খাতা ও ছুটো কাগজ যুক্ত হয়েছিল। ফ্রাঙ্ক তাঁর পরিবারের সদস্য ও তাদের সহযোগীদের ছদ্মনাম ঠিক করেছিলেন। ভ্যান পেলস পরিবারের সদস্যদের নাম হয়ে গেল হারম্যান, পেট্রোলিনা এবং পিটার ভ্যান ডান‌।আর ফ্রিটজ পিফার হয়ে গেলেন আলবার্ট ডসেল। তিনি এই সম্পাদিত সংস্করণে প্রতিটা অধ্যায়ে কিটিকে সম্বোধন করে কথা বলেছেন। সে ছিল মূলত চিসি ভ্যান মার্ক্সভেল্দের লেখা জুপ টার হেউল উপন্যাসের একটি কাল্পনিক চরিত্র। এই বইটি পড়ে আনার ভালো লেগেছিল।

ফ্রাঙ্ক প্রকাশিত সংস্করণ প্রস্তুত করার জন্য আনার মূল ডায়েরি- ভার্সন_এ নামে পরিচিত আর তার সম্পাদিত সংস্করণ- যেটা ভার্সন_এ নামে পরিচিত - দুটোই ব্যবহার করেছিলেন। যদিও তিনি তার পরিবারের সদস্যদের নামগুলো ঠিক করে দিয়েছিলেন, তিনি অন্যান্যদের নাম পরিবর্তন করেন নি। অটো ফ্রাঙ্ক ডায়েরিটি ইতিহাসবিদ এনি রোমিন ভার্সচুরকে দেন। তিনি এটি প্রকাশ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। অতঃপর তিনি এটা তার স্বামী জ্যান রোমিনকে দেন। জ্যান রোমিন এবিষয়ে ৩ এপ্রিল,১৯৪৬ এ Het parool পত্রিকায়  kinderstem (একটি শিশুর কন্ঠস্বর) নামে একটি নিবন্ধ লেখেন।  তিনি লেখেন যে এই ডায়েরি একটি শিশুর জড়তা জড়ানো কন্ঠে নুরেমবার্গ ট্রায়ালে উপস্থাপিত প্রমাণাদির চেয়েও বেশি দক্ষতার সাথে ফ্যাসিজমের নৃশংসতার কথা প্রকাশ করে। তার নিবন্ধ প্রকাশকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় এবং এর ফলে ১৯৪৭ সালে Het Acterhuis( the annex) শিরোনামে ডায়েরিটা প্রকাশিত হয় এবং ১৯৫০ সালের মধ্যে এর ৫ টি পুণর্মূদ্রণ প্রকাশিত হয়।

এই ডায়েরি ১৯৫০ সালে জার্মানি ও ফ্রান্সে প্রকাশিত হয় এবং কয়েকজন প্রকাশক প্রত্যাখ্যান করলেও শেষে ১৯৫২ সালে যুক্তরাজ্যে প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালে আনা ফ্রাঙ্ক: দ্য ডায়েরি অব আ ইয়াং গার্ল নামে এর প্রথম মার্কিন সংস্করণ বের হয় এবং ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া লাভ করে। এই বই জার্মানি, ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রে সফলতা লাভ করে কিন্তু যুক্তরাজ্যে পাঠকপ্রিয়তা পায়নি। ফলে ১৯৫৩ সালের মধ্যে সেখানে এর মূদ্রণ বন্ধ হয়ে যায়। জাপানে এটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করে। সেখানে এটি সমালোচকদের প্রশংসা লাভ করে এবং প্রথম সংস্করণেই ১০০,০০০ কপি বিক্রি হয়। জাপানে আনা ফ্রাঙ্ক খুব দ্রুতই গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক প্রতিকে পরিণত যা যুদ্ধের মধ্যে তরুন সমাজের বিপর্যয়কে উপস্থাপন করতো।

এই ডায়েরির উপর ভিত্তি করে রচিত একটি নাটক ফ্রান্সিস গুডরিচ ও আলবার্ট হ্যাকেটের নির্দেশনায় নিউইয়র্কে ১৯৫৫ এর ৫ই অক্টোবরে মঞ্চায়িত হয়। এই নাটক পরবর্তীতে নাটকে পুলিৎজার পুরস্কার অর্জন করে। পরবর্তীতে দ্য ডায়েরি অব আ ইয়াং গার্ল (১৯৫৯) নামে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় যা সমালোচকদের প্রশংসা ও ব্যবসায়িক সাফল্য লাভ করে। পরবর্তীতে জীবনীকার মেলিসা মুলার লিখেছেন যে নাটকে রুপান্তরকরণ আনার কাহিনীকে আকর্ষণীয়, আবেগপূর্ণ ও বৈশ্বিক কাহিনীতে পরিণত হতে সাহায্য করেছে।

প্রতিবছর এই ডায়েরির পাঠকপ্রিয়তা বেড়েছে এবং বিভিন্ন স্কুলে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের অনেক স্কুলে, এটি পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যাতে নতুন প্রজন্মের কাছে আনা ফ্রাঙ্ককে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়।

মূল্যায়ন[সম্পাদনা]

সাহিত্য মানের জন্য এই ডায়েরি প্রশংসিত হয়েছে। আনা ফ্রাঙ্কের লিখনশৈলীর বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে নাট্যকার মেয়ের লেভিন একটি ভালো উপন্যাসের মত করে উত্তেজনা ধরে রাখার জন্য আনা ফ্রাঙ্কের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। তিনি ফ্রাঙ্কের কাজের মানে এত বেশি মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি বইটি প্রকাশিত হওয়ার অল্প কিছুদিন পর অটো ফ্রাঙ্কের সাথে মিলে একে নাট্যরুপ দান করেছিলেন। লেভিন আনা ফ্রাঙ্কের প্রতি এত বেশি মুগ্ধ ছিলেন যে তিনি তার আত্মজীবনী 'দি অবসেশনে' এই মুগ্ধতার বিবরণ দিয়েছেন। কবি জন বেরিম্যান একে শুধু বয়ঃসন্ধির নয় বরং একটি শিশুর পূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠার চিত্রায়ণ বলে মনে করেছেন কারণ এটি বিস্ময়কর সততার সাথে সুনির্দিষ্ট, আত্মবিশ্বাসী ও পরিমিত শৈলিতে লেখা হয়েছে।

প্রথম আমেরিকান সংস্করণের ভুমিকায় ইলিনর রুজভেল্ট লিখেন:" এটি যুদ্ধ ও মানুষের উপর এর প্রভাব বিষয়ে আমার পড়া সবচেয়ে প্রজ্ঞাপূর্ণ ও চলমান বিবরণ।" জন এফ. কেনেডি ১৯৬১ সালের ভাষণে আনের কথা আলোচনা করেন। তিনি বলেন, "ইতিহাসে যত মানুষ নৃশংসতা ও দুর্ভোগের সময় মানবীয় মর্যাদার কথা বলেছে তাদের মধ্যে আনের কন্ঠই সবচেয়ে বেশি আবেদনপূর্ণ।" একই বছর সোভিয়েত লেখক ইলিয়া এহরেমবার্গ তার ব্যাপারে লেখেন: " একটি কন্ঠই ৬০ লক্ষ মানুষের কথা বলে- সেই কন্ঠ কোন মুনিঋষি বা কবির নয় বরং একটি ছোট্ট সাধারণ মেয়ের।

লেখক ও মানবতাবাদী হিসেবে আনের খ্যাতি বাড়তে থাকে এবং তাকে হলোকাস্ট (ইহুদি নিধন) ও বৃহত্তরভাবে নির্যাতনের প্রতিকৃতি ধরে আলোচনা হতে থাকে। হিলারি ক্লিনটন ১৯৯৪ সালে এলি উইসেন মানবতাবাদী পুরস্কার গ্রহণের সময় দেওয়া বক্তৃতায় আনের ডায়েরি থেকে পড়ে শোনান। তিনি বলেন, এটি আমাদেরকে আমাদের উদাসিনতা ও তরুন সমাজের উপর এর ক্ষতি সম্পর্কে সতর্ক করে।"  ক্লিনটন একে সেসময়ের সারায়েভো, সোমালিয়া ও রুয়ান্ডার ঘটনার সাথে মিলিয়ে দেখেন। আনা ফ্রাঙ্ক ফাউন্ডেশন থেকে একটি মানবতাবাদী পুরস্কার গ্রহণের পর নেলসন ম্যান্ডেলা জোহানেসবার্গে একটি বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন যে তিনি কারাগারে থাকতে আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি পড়েছেন এর থেকে প্রচন্ড উদ্দিপনা লাভ করেছেন। তিনি তার বৈষম্য বিরোধী সংগ্রামকে আনের নাজি বিরোধী সংগ্রামের সাথে তুলনা করেছেন। এই দুইটি দর্শনের মাঝে একটি সমান্তরাল রেখা এঁকে তিনি বলেন: " যেহেতু এসব বিশ্বাস স্পষ্টভাবেই ভুল এবং এগুলো আনের মত লোকদের দ্বারা মোকাবেলার শিকার হয়েছে এবং হতে থাকবে, সুতরাং এগুলো ব্যর্থ হবেই।" ১৯৯৪ সালে ভ্যাকলভ হ্যাভেল বলেন, আন ফ্রাঙ্কের স্মৃতি খুব ভালো ভাবে জীবিত আছে এবং এটি আমাদেরকে দিক নির্দেশনা দিতে থাকবে। তিনি সেসময়ের সাবেক পূর্বাঞ্চলীয় দেশগুলোতে ঘটা রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের কথা বলতে গিয়ে এই কথা বলেন।

প্রিমো লেভি বলেন যে আনা ফ্রাঙ্ককে প্রায়শঃ সেসব মানুষের প্রতিনিধি রুপে তুলে ধরা হয় যারা তারই মত দুর্ভোগ করেছেন এবং মারা গিয়েছেন কারণ একজন আনই আমাদের কে ঐ সমস্ত মানুষদের থেকে বেশি নাড়া দিয়েছে তারা তারই মত দুর্ভোগে পড়েছেন কিন্তু তাদের চেহারাগুলো ছায়ায় ঢেকে গেছে। সম্ভবত ব্যাপারটা এমন হওয়াই বেশি ভালো। কারণ আমরা যদি ঐসব লোকের সব কষ্ট ধারণ করতে চাই তবে আমরা আর বাঁচতেই পারবো না।মুলার লিখিত আনা ফ্রাঙ্কের জীবনীতে মিয়েপ গিয়েস তার শেষ কথাগুলো একই সুরে বলেছেন। 'আনা হলোকাস্টের ৬০ লক্ষ ভুক্তভোগিকে উপস্থাপন করে' তার দৃষ্টিতে এমন ভুল ধারনাকে সংশোধন করে তিনি বলেন, "আনার জীবন ও মৃত্যু ছিল আনার একান্ত ব্যক্তিগত নিয়তি, যে নিয়তি ৬০ লক্ষ বার ঘটেছে।আনা সেসমস্ত মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না-করা উচিতও নয়- যাদের জীবন নাজিরা কেড়ে নিয়েছিল। কিন্তু তার নিয়তি আমাদেরকে হলোকাস্টের ফলে পৃথিবীর যে প্রচন্ড ক্ষতি হয়েছে তা বুঝতে সহায়তা করে।"

অটো ফ্রাঙ্ক তার মেয়ের স্মৃতিরক্ষক হয়ে তার বাকি জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন,"এটা একটা অদ্ভুত ভুমিকা। সাধারণভাবে বিখ্যাত ব্যক্তির সন্তানরা তাদের মাতা-পিতার কাজ এগিয়ে নেওয়ার সম্মান ও দায়িত্ব পায়। আমার ক্ষেত্রে এই ঘটনা উল্টো হয়ে ঘটেছে। তিনি এই বইয়ের পাঠক-প্রিয়তার বিষয়ে তার প্রকাশকের ব্যাখ্যা স্মরণ করে মন্তব্য করেন: "তিনি বলেছিলেন যে এই ডায়েরি জীবনের এত বেশি দিককে ধারণ করেছে যে এটি একজন পাঠককে ব্যক্তিগতভাবে স্পর্শ করে‌। সাইমন ওয়াইসেনথাল প্রায় একই রকম আবেগ প্রকাশ করেন যখন তিনি বলেন যে এই ডায়েরি হলোকাস্ট সম্পর্কে নুরেমবার্গ ট্রায়ালের চাইতে বেশি ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করতে পেরেছে। কারণ মানুষ এই শিশুকে চিনতে পেরেছে।এটা ছিল হলোকাস্টের ফলাফল, এটা আমার এবং তোমার পরিবারের মতই একটা পরিবার,তাই তুমি বুঝতে পারছো।

১৯৯৯ সালের জুন মাসে টাইম ম্যাগাজিন Time 100: the most important people of the century শিরোনামে একটি বিশেষ সংস্করণ প্রকাশ করে।আনা ফ্রাঙ্ককে একজন নায়ক ও আদর্শ হিসেবে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। লেখক রজার রজেনব্লাট তার পরম্পরার ব্যাপারে বলেন: "এই বই যে আবেগ প্রকাশ করে তা আমাদেরকে নির্দেশ করে যে প্রতিটি মানুষ আনা ফ্রাঙ্কের কাছে ঋণী। সে হলোকাস্ট, ইহুদি ধর্ম,নারীত্ব এমন কী ভালো-খারাপেরও ঊর্ধ্বে উঠে গেছে এবং আধুনিক বিশ্বে পূজনীয় প্রতিকৃতিতে পরিণত হয়েছে। ধ্বংসাত্মক অস্ত্রে ঘেরা মানুষের নৈতিক মস্তিষ্ক বাঁচার অধিকার ও মানুষের ভবিষ্যতের আশা আকাঙ্ক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করে।" তিনি উল্লেখ করেন যে তাঁর সাহস ও বাস্তববাদীতার কারণে তিনি জনপ্রিয় হয়েছেন। তাঁর নিজেকে বিশ্লেষণের ক্ষমতা এবং তাঁর লেখার মান তাকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। তিনি লেখেন: "তিনি চিরজীবি হবেন তার সাহিত্যের কারণে। তিনি যে কোন বয়সের হিসেবে একজন ভালো লেখক। তাঁর কাজের এমন মান সরাসরি তাঁর প্রচন্ড সৎ প্রকৃতির ফলাফল বলে মনে হয়।"

সত্যতা অস্বীকার ও আইনি পদক্ষেপ[সম্পাদনা]

৫০ এর দশকে ডায়েরিটি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হওয়ার পর ডায়েরি ও এর বিষয়বস্তুর বিশ্বাসযোগ্যতা বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছিল। প্রথম দিকের অভিযোগগুলো উঠেছিল সুইডেন ও নরওয়েতে‌।

১৯৫৭ সালে সুইডেনের নব্য ফ্যাসিবাদি সংগঠন ন্যাশনাল লীগ অব সুইডেন এর মুখপত্র Fria Ord (মুক্ত শব্দ) ড্যানিশ লেখক ও সমালোচক হ্যারাল্ড নিলসেনের একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। এই নিবন্ধের লেখক আগেও ড্যানিশ ইহুদি লেখক জর্জ ব্রান্ডস সম্পর্কে ইহুদী বিদ্বেষী লেখা লিখেছিলেন। অন্যান্য বিষয়সহ এই নিবন্ধ দাবি করে যে এই ডায়েরি মেয়ের লেভিন লিখেছেন।

১৯৫৪ সালে আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির মঞ্চায়নের সময় সিমন উইসেনথাল একদল লোকের আক্রমনের শিকার হয়েছিলেন।তারা বলছিল যে আনা ফ্রাঙ্কের আসলে কোন অস্তিত্বই নেই। তারা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল যে উইসেনথাল পারলে আনা ফ্রাঙ্ককে যে ব্যক্তি  গ্রেফতার করেছিল তাকে হাজির করে ফ্রাঙ্কের অস্তিত্ব প্রমাণ করুক‌। উইসেনথাল বাস্তবেই কার্ল সিলবার বাউয়ারের খোঁজ করতে লাগলেন এবং ১৯৬৩ সালে তাকে খুঁজে বের করেন। ইন্টারভিউতে সিলবার বাউয়ার তার ভুমিকা স্বীকার করেন এবং একটি ছবি থেকে ফ্রাঙ্ককে গ্রেফতারকৃতদের একজন বলে শনাক্ত করেন।সিলবার বাউয়ার সব ঘটনার বিবরণ দেন, এমনকি মেঝেতে সব ফেলে দিয়ে কাগজভর্তি একটি সুটকেস খালি করার কথাও স্মরণ করেন। তার বিবরণ অটো ফ্রাঙ্ক সহ অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণকে সমর্থন করে।

১৯৫৯ সালে অটো ফ্রাঙ্ক লিউবেকে লোথার স্টিলাউ নামের এক স্কুল শিক্ষক ও হিটলার ইয়ুথের সদস্যের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন; তিনি একটি স্কুল-প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন যা ডায়েরিটিকে বানোয়াট বলে অভিহিত করে।এই অভিযোগ পত্রে হেনরিখ বাডিগার্গের নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যিনি সমর্থনে একটি চিঠি লিখে লিউবেকের একটি সংবাদ পত্রে প্রকাশ করেন। আদালত ১৯৬০ সালে ডায়েরিটি পরীক্ষা করে এবং এর হস্তলিপি আনা ফ্রাঙ্কের চিঠিপত্রের লেখার সাথে মিলে বলে নিশ্চিত করে‌।তারা ডায়েরিটি আসল বলে নিশ্চিত করেন।স্টিলাউ তার আগের বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেয়।অটো ফ্রাঙ্কও এই মামলা আর এগিয়ে নেন নি‌।

১৯৭৬ সালে অটো ফ্রাঙ্ক ফ্র্যাঙ্কফুর্টের হেইনজ রুথের বিরুদ্ধে মামলা করেন; যিনি একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন যাতে ডায়েরিটিকে বানোয়াট বলা হয়েছিল।বিচারক আদেশ দেন যে রুথ যদি তার বক্তব্য আর কখনো প্রচার করে তবে তাকে ৫০০,০০০ জার্মান মার্ক জরিমানা আর ছয় মাসের জেলের শাস্তি দেওয়া হবে। রুথ কোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে।সে ১৯৭৮ সালে মারা যায়।এর একবছর পর তার আপিল খারিজ করা হয়।

অটো ফ্রাঙ্ক ১৯৭৬ সালে আর্নেস্ট রোমারের বিরুদ্ধে মামলা করেন; যিনি The diary of Anne Frank, Bestseller, A lie (আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি, বেস্টসেলার,একটি মিথ্যা) শিরোনামের একটি পুস্তিকা বিতরণ করেছিলেন। এডগার গিস নামের এক ব্যক্তি কোর্টরুমের মধ্যেই সেই পুস্তিকা বিতরণ করায় তাকেও অভিযুক্ত করা হয়।রোমারকে ১৫০০০ মার্ক জরিমানা করা হয় আর গিসকে ছয় মাসের জেলের শাস্তি দেওয়া হয়। আপিলে গিসের সাজা কমে যায়। পরবর্তী আরেক আপিলে এই কেস খারিজ করা হয় কারণ মানহানির মামলা করার সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল।

১৯৮০ সালে অটো ফ্রাঙ্কের মৃত্যুর পর মূল ডায়েরি, চিঠিপত্র ও ছুটো কাগজগুলো উইলের মাধ্যমে ডাচ ইনস্টিটিউট ফর ওয়ার ডকুমেন্টেশন পায়; ১৯৮৬ সালে নেদারল্যান্ডের বিচার মন্ত্রণালয় এই প্রতিষ্ঠানকেই ডায়েরির ফরেনসিক পরীক্ষার কাজে নিযুক্ত করে। তারা হাতের লেখার সাথে আনা ফ্রাঙ্কের হস্তলিপির সাথে মিলিয়ে দেখে এবং দেখতে পায় যে সেগুলো মিলে যাচ্ছে। তারা নিশ্চিত করে যে যে সময় ডায়েরি লেখা হয়েছে বলে দাবি করা হয় তখন এই কাগজ,আঠা ও কালি সহজলভ্য ছিল।তারা সিদ্ধান্ত দেয় যে ডায়েরিটি আসল। তাদের গবেষণার ফলাফল ডায়েরির সমালোচনামূলক সংস্করণে প্রকাশিত হয়। ১৯৯০ সালে হ্যামবুর্গের আদালত ডায়েরির সত্যতা নিশ্চিত করে।

১৯৯১ সালে হলোকাস্ট অস্বীকারকারী রবার্ট ফরিসন এবং সিগফ্রিড ভারবিক The diary of Anne Frank: A critical approach নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে; যাতে ডায়েরিটি অটো ফ্রাঙ্ক লিখেছেন এমন অভিযোগটি পূনর্জীবিত করা হয়। পূর্বের মতই ডায়েরির কিছু অসঙ্গতি, 'গদ্যশৈলি ও হস্তলিপি কিশোরীর মত নয়', 'একটারহুইসে লুকিয়ে থাকা অসম্ভব ছিল' এসব বিষয়কে প্রমাণ বলে দাবি করা হয়। ১৯৯৩ সালে আমস্টারডামের 'আনা ফ্রাঙ্ক হাউজ' এবং বাসেলের 'আনা ফ্রাঙ্ক ফন্ডস' এই দুই সংগঠন নেদারল্যান্ডে ফরিসন ও ভারবিকের পুস্তিকা বিতরণের উপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে একটি দেওয়ানি মামলা করে।১৯৯৮ সালে আমস্টারডামের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট বাদিদের পক্ষে রায় দেয়‌।কোর্ট এই ডায়েরির সত্যতা অস্বীকারকে নিষিদ্ধ করে এবং এই দাবি সংবলিত প্রকাশনাসমুহ বিনামূল্যে বিতরণ নিষিদ্ধ করে এবং প্রতিবার এই আদেশ অমান্যের জন্য ২৫০০০ গিল্ডার জরিমানার আদেশ দেয়।

সেন্সর[সম্পাদনা]

প্রথম প্রকাশের পর আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির কিছু অংশ আবিষ্কৃত হয়, যেগুলো প্রথম দিকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। সেগুলো পরবর্তী সংস্করণে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।এর মধ্যে কিছু অনুচ্ছেদ ছিল যেগুলোতে তার যৌনতা, জননেন্দ্রিয়ের অনুসন্ধান এবং মাসিক বিষয়ে তাঁর ভাবনার বর্ণনা ছিল। ২০০১ সালে মালিকানা-বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার পরে নতুন সংস্করণগুলোতে অটো ফ্রাঙ্ক কর্তৃক বাদ দেওয়া সেসব অনুচ্ছেদগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয় যেগুলোতে আনা ফ্রাঙ্ক তার মাতা-পিতার অসুখ বিবাহ নিয়ে তার সমালোচনামূলক মন্তব্য এবং মায়ের সাথে তার তিক্ত সম্পর্কের কথা আলোচনা করেছেন।আনা দুইটি পাতা বাদামী কাগজ দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে এগুলোর পাঠোদ্ধার করা হয়।তাতে যৌন শিক্ষা ব্যাখ্যার একটা প্রচেষ্টা ও কিছু অশ্লীল কৌতুক ছিল।

উত্তরাধিকার[সম্পাদনা]

প্রিনসেনগ্রাচট ভবনকে ভাঙন থেকে রক্ষা করা এবং জনসাধারণের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ১৯৫৭ সালের ৩রা মে অটো ফ্রাঙ্ক ও আরো কিছু নাগরিক মিলে আনা ফ্রাঙ্ক ফাউন্ডেশন গঠন করেন‌। ১৯৬০ সালের ৩রা আনা ফ্রাঙ্ক হাউজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। অপেক্টার গুদামঘর, অফিস এবং গোপন ঘর এর অধীনে আছে; এসব ঘর খালি করা হয়েছে যাতে দর্শনার্থীরা সহজে ঘুরে ফিরে দেখতে পারে। এসব ঘরে পূর্বের বাসিন্দাদের কিছু নিদর্শন রয়ে গেছে। যেমন, আনা ফ্রাঙ্কের লাগানো চলচ্চিত্র তারকার ছবি,অটো ফ্রাঙ্কের লাগানো পোস্টারের অংশবিশেষ যেখানে তিনি তার মেয়েদের উচ্চতা বৃদ্ধির হিসাব রাখতেন এবং একটা মানচিত্র যেখানে তিনি মিত্রশক্তির অগ্রগতি চিহ্নিত করে রাখতেন।এসব এখন এক্রেলিক গ্লাসে ঢাকা আছে। পিটার ভ্যান পেলস যে রুমে থাকতো সে রুম থেকে পাশ্ববর্তী ভবনে যাওয়ার পথ ছিল। ঐ ভবন আনা ফ্রাঙ্ক ফাউন্ডেশন কিনে নিয়েছে। এই ভবনগুলো ডায়েরি রাখার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও সময়ে সময়ে এখানে হলোকাস্টের বিভিন্ন দিক নিয়ে এবং বর্তমান দুনিয়ায় ঘটা জাতিগত অসহিষ্ণুতা নিয়ে প্রদর্শনী হয়।এই স্থান আমস্টারডামের প্রধানতম ভ্রমণ-আকর্ষণগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। ২০০৫ সালে এখানে ৯,৬৫,০০০ দর্শনার্থী এখানে এসেছে। আনা ফ্রাঙ্ক হাউজ ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য সরবরাহ এবং বিদেশে প্রদর্শনী করে থাকে।২০০৫ সালে ইউরোপ, এশিয়া, উত্তর আমেরিকাদক্ষিণ আমেরিকার ৩২ টি দেশে এর প্রদর্শনী হয়েছিল।

অটো ফ্রাঙ্ক ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী এলফ্রিড গিরিঞ্জার মার্কোভিটস ১৯৬৩ সালে সুইজারল্যান্ডের বাসেলে আনা ফ্রাঙ্ক ফন্ডস নামের দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।অটো ফ্রাঙ্ক উইল করে গিয়েছেন যে তার মৃত্যুর পর আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির স্বত্ব আনা ফ্রাঙ্ক ফন্ডসের হাতে থাকবে।তবে এর বাৎসরিক আয় থেকে ৮০,০০০ সুইস ফ্রাঁ তার উত্তরাধিকারীরা পাবে। এই সংস্থা আনা ফ্রাঙ্কের লেখা ও ফ্রাঙ্ক পরিবারের চিঠিপত্রের স্বত্ব নিয়ন্ত্রণ করে। এটি আনা ফ্রাঙ্ক ও তার পরিবার সম্পর্কিত বইগুলো অনুবাদ, সংস্করণ ও সংকলনের অধিকার সংরক্ষণ করে।এই সংস্থার উদ্দেশ্য হলো তরুন সমাজকে বর্ণবৈষম্যের ব্যপারে শিক্ষা দেওয়া।২০০৩ সালে আনা ফ্রাঙ্ক ফন্ডস যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থিত হলোকাস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়ামকে প্রদর্শনের জন্য আনার কিছু কাগজপত্র ধার দিয়েছিল। সে বছর এই সংস্থার বার্ষিক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এর কার্যক্রম বিশেষত জার্মানি, ইজরায়েল,ভারত, সুইজারল্যান্ড,যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে এর প্রকল্পগুলোর বিবরণ দেওয়া হয়েছিল।

১৯৯৭ সালে ফ্রাঙ্কফুর্টের পাশ্ববর্তী শহর ডর্নবুশ, যেখানে আনা ফ্রাঙ্ক ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত বসবাস করতো, সেখানে আনা ফ্রাঙ্ক শিক্ষা কেন্দ্র চালু করা হয়। এই কেন্দ্রে তরুণ ও বয়স্করা জাতীয় সমাজতন্ত্রের ইতিহাস জানতে পারে এবং আজকের দিনে এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা করতে পারে।

১৯৩৩ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত ফ্রাঙ্ক পরিবার যে মারউইডিপ্লেইন এপার্টমেন্টে থাকতেন সেটা ২০০০ সাল পর্যন্ত কারো ব্যক্তি মালিকানাধীন ছিল। এ ব্যাপারে টেলিভিশনে একটি প্রতিবেদন প্রচারিত হওয়ার পর একটি ডাচ হাউজিং কর্পোরেশন ভাঙাচোরা অবস্থায় এটি কিনে নিয়েছিল। ফ্রাঙ্ক পরিবারের কিছু ছবি ও চিঠির বিবরণ অনুসারে একে ১৯৩০ এর রুপে ফেরত নেওয়া হয়েছিল। আনা ফ্রাঙ্ক হাউজের টেরেসা ডে সিলভা এবং আনা ফ্রাঙ্কের কাজিন বার্নার্ড বাডি এলিয়াস এপার্টমেন্ট সংস্কার কাজে অংশগ্রহণ করেছিল।২০০৫ সালে এটি খুলে দেওয়া হয়। প্রতিবছর এমন একজন লেখক এখানে থাকার সুযোগ পান যিনি নিজের দেশে মুক্তভাবে লিখতে পারেন না।পুরো বছর তিনি সেখানে থাকেন এবং লেখালেখি করেন। সর্বপ্রথম নির্বাচিত লেখক ছিলেন আলজেরিয়ার কবি ও ঔপন্যাসিক এল মাহদী একারকোর।

আনা ফ্রাঙ্ককে নেদারল্যান্ডের ইতিহাস সংকলনের একটি অধ্যায় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এই সংকলন ২০০৬ সালে ফ্রিৎজ ভ্যান ওসট্রোম এর নেতৃত্বে একটি কমিটির মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয় এবং শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞান মন্ত্রী মারিয়া ভ্যান দার হোভেনের নিকট উপস্থাপন করা হয়।এই সংকলনে মোট ১৫ টি অধ্যায় আছে‌।এর উদ্দেশ্য হলো ডাচ ইতিহাসের ধারাবাহিক বিবরণ দেওয়া, যা নেদারল্যান্ডের প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রথম দুই বছরে পড়ানো হবে। ২০০৭ সালের ৩রা জানুয়ারি আনা ফ্রাঙ্কের অধ্যায়টিসহ এই সংকলনের একটি পরিমার্জিত সংস্করণ ডাচ সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হয়।

২০০৭ সালের জুন মাসে বাডি এলিয়াস প্রায় ২৫,০০০ পারিবারিক ডকুমেন্ট আনা ফ্রাঙ্ক হাউজকে দান করেন।এসব কাগজপত্রের মধ্যে নেদারল্যান্ড ও জার্মানিতে তোলা ফ্রাঙ্ক পরিবারের কিছু ছবি এবং ১৯৪৫ সালে মাকে লেখা অটো ফ্রাঙ্কের চিঠিও ছিল যাতে নাৎসি বাহিনীর হাতে তার স্ত্রী ও মেয়েদের মৃত্যুর খবর দিয়েছিলেন।

২০০৭ সালে ছত্রাকে আক্রান্ত আনা ফ্রাঙ্ক ট্রি (একটি চিনা বাদাম গাছ) কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যাতে এটি পাশ্ববর্তী ভবনের উপর না পড়ে। ডাচ অর্থনীতিবীদ আর্নল্ড হার্টজে বলেন, "এটি শুধু গাছ নয়। আনা ফ্রাঙ্ক ট্রি ইহুদী নির্যাতনের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে।" গাছ সংরক্ষণবাদীদের একটি সংগঠন  দি ট্রি ফাউন্ডেশন গাছটি রক্ষার জন্য একটি দেওয়ানি মামলা দায়ের করে।এই ঘটনা আন্তর্জাতিক ভাবে মিডিয়া কভারেজ পায়। আদালত সরকারি কর্মকর্তা এবং সংরক্ষণবাদীদেরকে একটি বিকল্প সমাধান বের করার আদেশ দেন।তারা একটি লোহার কাঠামো নির্মাণ করে যাতে গাছটি আরো ১৫ বছর টিকে থাকতে পারে।তবে তিন বছর পর ২০১০ সালের ২৩ আগস্ট প্রচন্ড বাতাসে এটি ভেঙ্গে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের আনা ফ্রাঙ্ক সেন্টার পরিচালিত একটি প্রকল্পের মাধ্যমে এই গাছের ১১টি চারা বিভিন্ন জাদুঘর,স্কুল,পার্ক এবং হলোকাস্ট স্মরণ কেন্দ্রে বিতরণ করা হয়।প্রথম চারাটি রোপন করা হয় ইন্ডিয়াপলিস শিশু জাদুঘরে ২০১৩ সালে।আরো যেসব স্থানে চারাগাছ পাঠানো হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে  আরকানসাসের লিটল পার্কে অবস্থিত স্কুল- যেটি পূনর্মিলন যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান এবং ম্যানহাটনের লিবার্টি পার্ক- যেটি ১১ সেপ্টেম্বরের আক্রমনের স্মরণে নির্মিত। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের আরো বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়েছিল। ২০১০ সালে আলাবামার বার্মিংহামে কেলি ইংগ্রাম পার্কে আনা ফ্রাঙ্কে সম্মানে আরো একটি চিনা বাদাম গাছ লাগানো হয়।

এখন পর্যন্ত আনা ফ্রাঙ্ককে নিয়ে কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তাঁর জীবন ও লেখা বিভিন্ন ধরনের শিল্পী ও সমাজ-প্রবক্তাদের অনুপ্রাণিত করেছে।তারা সাহিত্য, জনপ্রিয় সঙ্গীত, টেলিভিশন এবং আরো বিভিন্ন মাধ্যমে তার প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। এর মধ্যে রয়েছে এডাম দারিউসের "আনা ফ্রাঙ্ক ব্যালে নৃত্য"- যা ১৯৫৯ সালে প্রথম মঞ্চায়িত হয়েছিল। আরো রয়েছে গণসঙ্গীত "এনেলিস"(২০০৫) এবং মার্কাস পাউসের "দি বিউটি দ্যাট স্টিল রিমেইনস"(২০১৫)‌। আনা ফ্রাঙ্কের একমাত্র ভিডিও চিত্র পাওয়া যায় তাঁর প্রতিবেশীর বিয়েতে নির্মিত নির্বাক চলচ্চিত্রের মধ্যে। এতে দেখা যায় তিনি দোতলার জানালা থেকে ঝুঁকে বর-কনেকে দেখার চেষ্টা করছেন। এই দম্পতি যুদ্ধ থেকে বেঁচে ফিরে এই ভিডিও চিত্র আনা ফ্রাঙ্ক হাউজকে দিয়েছিলেন।

১৯৯৯ সালে টাইম ম্যাগাজিন বিশ শতকের আদর্শ ও বীরদের তালিকায় আনা ফ্রাঙ্ককে স্থান দিয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছে, গোপনে রক্ষিত একটি ডায়েরির মাধ্যমে তিনি নাজিদের মোকাবেলা করেছেন এবং মানুষের মর্যাদার লড়াইয়ে একটি উন্নত কন্ঠস্বরের মাধ্যমে যোগদান করেছেন। ফিলিপ রুথ তাকে "ফ্রান্‌ৎস কাফকার হারানো ছোট্ট মেয়ে" বলে অভিহিত করেছেন। মাদাম তুসো জাদুঘরে ২০১২ সালে আনা ফ্রাঙ্কের একটি মোমনির্মিত প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়। ১৯৯৫ সালে তাঁর নামে গ্রহাণু "৫৫৩৫-আনা ফ্রাঙ্কের" নামকরণ করা হয়।এটি আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৯৪২ সালে।

আনা ফ্রাঙ্কের নামের সাথে মিলিয়ে আমস্টারডামে একটি স্কুলের নাম দেওয়া হয়েছে "৬নং মন্টেসরি প্রাইমারি স্কুল-আনা ফ্রাঙ্ক"। যুক্তরাষ্ট্র ও আরো কিছু দেশে তার নামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম হলো ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ডালাসের আনা ফ্রাঙ্ক এলিমেন্টারি স্কুল। আরো কিছু স্কুল রয়েছে তার নামে।যেমন ফিলাডেলফিয়ার আনা ফ্রাঙ্ক এলিমেন্টারি স্কুল এবং টেক্সাসের আনা ফ্রাঙ্ক ইন্সপায়ার একাডেমি। শেষোক্তটি ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।

টীকা ও তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Barnauw, David and Gerrold van der Stroom (২০০৩-০৪-২৫)। "Who Betrayed Anne Frank?" (পিডিএফ)। Netherlands Institute for War Documentation, Amsterdam। ২০০৭-১০-৩১ তারিখে মূল (PDF) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-১১-১২ 
  2. "Who Betrayed the People in Hiding?"Anne Frank House website। Anne Frank Organizations। সংগ্রহের তারিখ ২ এপ্রিল ২০১০ 

গ্রন্থপঞ্জি[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]