স্বরগ্রাম

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
  {
\override Score.TimeSignature #'stencil = ##f
\relative c' {
  \clef treble \key c \major \time 7/4 c4 d e f g a b c b a g f e d c2
} }
মুখ্য সি স্বরগ্রাম (সি মেজর C major), আরোহী ও অবরোহী

স্বরগ্রাম (সাতটি স্বরের ক্ষেত্রে স্বরসপ্তক) বলতে কোনও সঙ্গীতে ব্যবহারের জন্য বাছাইকৃত সাঙ্গীতিক স্বরগুলিকে একটি স্বরাষ্টকের ভেতরে স্বরতীক্ষ্ণতার (তথা মৌলিক কম্পাংকের) আরোহী বা অবরোহী অনুক্রমে বিন্যস্ত করে প্রাপ্ত স্বর-সমাহারকে বোঝায়। কোনও প্রদত্ত স্বরগ্রামের সর্বপ্রথম স্বর এবং এটির পরপর দুইটি স্বরের মধ্যে ব্যবধানগুলির প্রকৃতি (অর্ধ ধাপ নাকি পূর্ণ ধাপ) ও সামগ্রিক বিন্যাসের উপরে স্বরগ্রামটির ধ্বনিগত প্রকৃতি ও স্বাতন্ত্র্য নির্ভর করে এবং এভাবে একটি স্বরগ্রামকে অপর একটি স্বরগ্রাম থেকে পৃথক করা যায়। স্বরগুলিকে নিচু থেকে উঁচু স্বরতীক্ষ্ণতায় ক্রমবিন্যস্ত করলে একটি আরোহী স্বরগ্রাম পাওয়া যায়, আর উঁচু থেকে নিচু স্বরতীক্ষ্ণতায় ক্রমবিন্যস্ত করলে একটি অবরোহী স্বরগ্রাম পাওয়া যায়।

দুইটি ভিন্ন স্বরতীক্ষ্ণতার স্বরের মধ্যে উচ্চ স্বরতীক্ষ্ণতার বা উচ্চ গ্রামের স্বরটির কম্পাংক যদি নিম্ন স্বরতীক্ষ্ণতার স্বরটির কম্পাংকের দ্বিগুণ হয়, তাহলে ঐ দুই স্বরের মধ্যে ব্যবধানকে স্বরাষ্টক (Octave) বলে। সাধারণত একটি স্বরাষ্টককে সমান ব্যবধানে অবস্থিত ১২টি স্বরে ভাগ করা হয়, যেখানে প্রতিটি স্বরের কম্পাংক তার পূর্ববর্তী স্বরের কম্পাংক অপেক্ষা প্রায় ৬% বেশি, এভাবে চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পেতে পেতে দ্বাদশ স্বরটির কম্পাংক প্রথম স্বরটির কম্পাংকের ১০০% বেশি হয়, অর্থাৎ দ্বিগুণ হয়। ১২টি স্বরের একটি থেকে এর অব্যবহিত পরের স্বরটির দূরত্বকে বলা হয় অর্ধ ধাপ (half step)। একটি স্বর থেকে এর পরের পরের স্বরটির দূরত্বকে বলা হয় পূর্ণ ধাপ (whole step)। তবে গুণগতভাবে স্বরাষ্টকের শেষ স্বরটিকে প্রথম স্বরটির সাথে অভিন্ন গণ্য করা হয় ও দুটিকে একই সংকেত বা নাম দিয়ে ডাকা হয়, এবং শেষ স্বরটিকে স্বরতীক্ষ্ণতায় এক স্তর উঁচুতে অবস্থিত ধরা হয়।

সাধারণত যেকোনও সঙ্গীতের সুরে ও ঐকতানে ব্যবহার করার জন্য সচেতনভাবে বা অবচেতনভাবে বিভিন্ন ধরনের স্বরের একটি বিশেষ সমাহার বাছাই করা হয়। এই বাছাইকৃত স্বরগুলির স্বরতীক্ষ্ণতাগুলির (মৌলিক কম্পাংকগুলির) মধ্যবর্তী সম্পর্কের একটি স্বাভাবিক বিন্যাস ফুটে ওঠে, যে বিন্যাসটিকে একটি স্বরাষ্টকের পরিসরের মধ্যে স্বরগুলিকে কিছু নির্দিষ্ট ব্যবধানে (অর্ধ ধাপ ও পূর্ণ ধাপ ব্যবধানে) বসিয়ে আরোহী বা অবরোহী অনুক্রমে বিন্যস্ত করে প্রকাশ করা সম্ভব, এবং এই বিন্যাসটিই হল ঐ সঙ্গীতে ব্যবহৃত স্বরগ্রাম।[১] একটি সঙ্গীতের স্বরগ্রামের জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বরাষ্টকের বারোটি স্বর থেকে প্রথম স্বরটিসহ মোট সাতটি স্বর বাছাই করা হয় এবং স্বরাষ্টকের দ্বাদশ কিন্তু স্বরগ্রামের প্রেক্ষিতে "অষ্টম" স্বরটি প্রথম স্বরের দ্বিগুণ তীক্ষ্ণতা বা কম্পাংকের হয়; এ কারণেই "স্বরাষ্টক" নামটি প্রচলিত, যদিও একটি স্বরাষ্টককে বারোটি স্বরে ভাগ করা হয়। একটি স্বরগ্রামকে তাই দুইটি জিনিস দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা হয়। প্রথমটি হল সাতটি স্বরের (অতিপ্রচলিত স্বরগ্রামগুলিতে সাধারণত সাতটি স্বর থাকে) মধ্যে স্বর-থেকে-স্বরে ব্যবধানগুলির বিন্যাস, অর্থাৎ এগুলির একটির সাথে আরেকটির অর্ধ ধাপ ও পূর্ণ ধাপের পার্থক্যের বিন্যাস, যা একটি স্বরগ্রামের একান্তই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য যা এটিকে একটি স্বতন্ত্র ধ্বনিগত প্রকৃতি প্রদান করে এবং এটিকে অপর একটি স্বরগ্রাম থেকে পৃথক করে। দ্বিতীয়ত স্বরাষ্টকের সবচেয়ে নিচের যে বিশেষ স্বরটি দিয়ে স্বরগ্রামটি শুরু হয়, সেটিও স্বরগ্রামটিকে সংজ্ঞায়িত করে। এটিকে স্বরগ্রামের প্রথম ধাপ (First degree) বা সেটির প্রধান স্বর (Tonic) বলে। একটি স্বরগ্রামের নামকরণে এই দুইটি ব্যাপারেরই প্রতিফলন ঘটে। যেমন মুখ্য সি (সি মেজর) স্বরগ্রামের প্রধান স্বরটি হল "সি" এবং এটির ব্যবধানের বিন্যাসটি "মুখ্য" (মেজর) ধরনের, অর্থাৎ এই স্বরগ্রামের স্বর সাতটি পূর্ণধাপ-পূর্ণধাপ-অর্ধধাপ-পূর্ণধাপ-পূর্ণধাপ-পূর্ণধাপ-অর্ধধাপ এই ব্যবধান বিন্যাসে অবস্থিত। ব্যবধান বিন্যাসের উপর ভিত্তি করে স্বরগ্রামগুলিকে শ্রেণীবদ্ধ করা যায়, যেমন প্রকৃত স্বরগ্রাম (diatonic scale), বারোস্বরী স্বরগ্রাম (Chromatic scale), মুখ্য স্বরগ্রাম (Major scale), গৌণ স্বরগ্রাম (Minor scale), ইত্যাদি।

কোনও সঙ্গীতের সুরে উঁচু নিচু তীক্ষ্ণতার একাধিক স্বরাষ্টক থেকে বিভিন্ন স্বর ব্যবহার করতে পারে; কিন্তু স্বরাষ্টকগুলিকে ক্রিয়াগতভাবে সমতুল্য (functionally equivalent) ধরা হয় এবং একটিকে অপরটির চেয়ে কেবলমাত্র স্বরতীক্ষ্ণতায় এক স্তর উপরে বা নিচে গণ্য করা হয়। তাই কোনও সঙ্গীতে ব্যবহৃত সমস্ত স্বরকে একটিমাত্র স্বরাষ্টকের মধ্য সীমাবদ্ধ স্বরগ্রাম দ্বারা চরিত্রায়িত করা সম্ভব। এ কারণে স্বরগ্রামকে কোনও সঙ্গীতে ব্যবহৃত সুরের একটি বিমূর্তন হিসেবে গণ্য করা যায়।

কিছু কিছু স্বরগ্রামে ৭টির পরিবর্তে ৮টি স্বর (হ্রাসকৃত স্বরগ্রাম), ৬টি স্বর (পূর্ণধাপী স্বরগ্রাম), ৫টি স্বর (পঞ্চস্বরী স্বরগ্রাম), এমনকি ১২টি স্বরের সবগুলি (বারোস্বরী স্বরগ্রাম) থাকতে পারে। তাত্ত্বিকভাবে একটি স্বরাষ্টকের ১ থেকে ১২ পর্যন্ত যেকোনও সংখ্যক স্বর বাছাই করে সেগুলিকে ক্রমবিন্যস্ত করে একটি স্বরগ্রাম তৈরি করা সম্ভব; এরকম করে ১২টি স্বর থেকে তাত্ত্বিকভাবে বহু হাজার ধরনের স্বরগ্রাম তৈরি করা সম্ভব। তবে সাধারণত একটি সংস্কৃতিতে বা সাঙ্গীতিক ঐতিহ্যে নির্দিষ্ট সংখ্যক কিছু স্বরগ্রাম ব্যবহার করে সঙ্গীত রচনার রীতি-রেওয়াজ গড়ে ওঠে। তাই কোনও সংস্কৃতিতে প্রচলিত সঙ্গীতের স্বরগ্রামগুলি ঐ সংস্কৃতিটির আত্মপরিচয়ের একটি উপাদান হতে পারে। যেমন কিছু আদিম আদিবাসী সংস্কৃতিতে মাত্র দুইটি বা তিনটি স্বর ব্যবহার করে নির্মিত অত্যন্ত সীমিত স্বরগ্রামের ভিত্তিতে সঙ্গীত রচনার উদাহরণ আছে। সাঙ্গীতিকভাবে অগ্রসর সংস্কৃতিগুলিতে, অর্থাৎ যেগুলিতে ধ্রুপদী, শাস্ত্রীয় বা উচ্চমার্গীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্য আছে, সেগুলির রচয়িতারা স্বরগ্রামের ব্যবহারবিধির প্রথা, রীতিনীতি ও নিয়মকানুন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত থেকেই সঙ্গীত রচনা করে থাকেন। অন্যদিকে লোকসঙ্গীতে ঐরূপ সচেতনতা ছাড়াই সঙ্গীত রচনা করা হতে পারে, যা থেকে পরবর্তীতে বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যবহৃত স্বরগ্রামগুলি বের করে নিতে হয়।

পাশ্চাত্যের সঙ্গীতে সাধারণত প্রতিটি সঙ্গীতকর্ম একটি নির্দিষ্ট স্বরগ্রামের উপরে ভিত্তি করে রচিত হয়। সেই স্বরগ্রামটিকে ঐ সঙ্গীতকর্মের ভিত্তি (Key) বলে এবং এটিকে সঙ্গীতকর্মটির স্বরলিপিতে একটি প্রমিত ভিত্তি স্বাক্ষর (Key signature) দিয়ে নির্দেশ করা হয়।[২]

উপরের আলোচনায় যদিও একটি স্বরাষ্টককে ১২টি সমান ভাগে ভাগ করার প্রচলিত রীতিটি আলোচিত হয়েছে, কিন্তু এরূপ বিভাজনের কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। একটি প্রদত্ত সাঙ্গীতিক ব্যবধানের মধ্যে (যেমন একটি স্বরাষ্টকের প্রথম স্বর ও শেষ স্বরের মধ্যে) কতগুলি ভাগ করা যাবে, তার কোনও নির্দিষ্ট সীমা নেই। এ ব্যাপারটি বিশেষ করে অণুস্বরী সঙ্গীতের (Microtonal music) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এভাবে চিন্তা করলে অসীম সংখ্যক স্বরগ্রাম সৃষ্টি করা সম্ভব।

পটভূমি[সম্পাদনা]

স্বরগ্রাম, ধাপ ও ব্যবধান[সম্পাদনা]

বারোস্বরী বৃত্তে একটি প্রকৃত স্বরগ্রামকে একটি অন্তর্লিখিত সপ্তভুজ দিয়ে নির্দেশ করা হয়েছে।

স্বরগ্রামগুলিকে সাধারণত নিম্ন স্বরতীক্ষ্ণতা থেকে উচ্চ স্বরতীক্ষ্ণতায় বিন্যস্ত করা হয়। সিংহভাগ স্বরগ্রাম স্বরাষ্টক-পুনরাবৃত্তিমূলক, অর্থাৎ এগুলি স্বরের বিন্যাস প্রতিটি অষ্টকের জন্য একই থাকে (বোলেন-পিয়ার্স স্বরগ্রাম এর একটি ব্যতিক্রম। একটি স্বরাষ্টক-পুনরাবৃত্তিমূলক স্বরগ্রামকে স্বরতীক্ষ্ণতার শ্রেণীসমূহের একটি বৃত্তাকার সজ্জায় উপস্থাপন করা সম্ভব। তীক্ষ্ণতা অনুযায়ী স্বরগুলিকে ক্রমবর্ধমান বা ক্রমহ্রাসমান অনুক্রমে বিন্যস্ত করা হতে পারে। যেমন আরোহী মুখ্য সি স্বরগ্রামটি হল সি–ডি–ই–এফ–জি–এ–বি–[সি]; শেষের [সি] স্বরটিকে বন্ধনীর মধ্যে রেখে নির্দেশ করা হচ্ছে যে সেটি প্রথম সি স্বরের এক স্বরাষ্টক উপরে অবস্থিত। অন্যদিকে অবরোহী মুখ্য সি স্বরগ্রামটি হল সি-বি-এ-জি-এফ-ই-ডি-[সি], যেখানে শেষের বন্ধনীতে রাখা [সি] স্বরটি প্রথম সি স্বরের এক স্বরাষ্টক নিচে অবস্থিত বোঝায়।

কোনও স্বরগ্রামের পরপর দুইটি স্বরের মধ্যবর্তী দূরত্বকে স্বরগ্রামীয় ধাপ বা শুধু ধাপ বলে।

স্বরগ্রামের প্রথম স্বরটিকে এর প্রথম ধাপ বলে। স্বরগ্রামের অবশিষ্ট স্বরগুলিকে সেটির প্রথম ধাপ থেকে সংখ্যায়িত করা হয়। যেমন মুখ্য সি স্বরগ্রামের প্রথম স্বরটি হল সি, দ্বিতীয়টি হল ডি, তৃতীয়টি ই, ইত্যাদি। দুইটি স্বরকে একে অপরের সাপেক্ষেও সংখ্যায়িত করা যেতে পারে। যেমন সি ও ই-এর মধ্যে একটি তৃতীয়া ব্যবধান আছে (এক্ষেত্রে মুখ্য তৃতীয়া ব্যবধান); ডি ও এফ-এর মধ্যেও একটি তৃতীয়া ব্যবধান আছে (এক্ষেত্রে গৌণ তৃতীয়া ব্যবধান)।

স্বরতীক্ষ্ণতা স্তর[সম্পাদনা]

একটি স্বরগ্রামকে বহু বিভিন্ন স্বরতীক্ষ্ণতা স্তরে অভিব্যক্ত করা সম্ভব। যেমন একটি মুখ্য সি স্বরগ্রাম সি৪ (মধ্য সি; বৈজ্ঞানিক স্বরলিপি দেখুন) থেকে শুরু করে এক স্বরাষ্টক আরোহণ করে সি৫-এ গিয়ে সমাপ্ত হতে পারে। অথবা এটি সি৬-এ শুরু হয়ে এক স্বরাষ্টক আরোহণ করে সি৭-এ গিয়ে সমাপ্ত হতে পারে।

স্বরগ্রামের ধরন[সম্পাদনা]

 {
\override Score.TimeSignature #'stencil = ##f
\relative c' {
  \clef treble \time 12/4
  c4 cis d dis e f fis g gis a ais b
  c2
  }
}

স্বরগ্রাম কতগুলি স্বর (স্বরতীক্ষ্ণতা শ্রেণী) নিয়ে গঠিত, তার উপর ভিত্তি করে স্বরগ্রামগুলিকে বর্ণনা করা হতে পারে:

উপরের স্বরগ্রামগুলির মধ্যে পঞ্চস্বরী স্বরগ্রামগুলি পশ্চিমা দেশগুলি বাদে বাকী সমস্ত সংস্কৃতিতে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। পশ্চিমা সঙ্গীত একটি ব্যতিক্রম, যাতে পঞ্চস্বরী স্বরগ্রামগুলির আধিপত্য নেই। পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপীয় লোকসঙ্গীতে পঞ্চস্বরী স্বরগ্রামগুলির ব্যাপক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। পঞ্চস্বরী স্বরগ্রামগুলির সবচেয়ে বেশি প্রচলিত প্রকারভেদগুলিতে কোনও অর্ধ ধাপ ব্যবধান থাকে না (অন্য ভাষায় এগুলিতে মুখ্য দ্বিতীয়া ব্যবধান ও গৌণ তৃতীয়া ব্যবধান ব্যবহার করা হয়), এগুলিকে অর্ধধাপবিহীন নামে চরিত্রায়িত করা হয়। পঞ্চস্বরী স্বরগ্রামগুলি এতই সুদূরপ্রসারিত যে যেসমস্ত সঙ্গীত চতুঃস্বরী স্বরগ্রামের উপরে ভিত্তি করে রচিত সেগুলিকেও ভুল করে একটি স্বর বিবর্জিত পঞ্চস্বরী স্বরগ্রামের বলে মনে করা হতে পারে। ষড়স্বরী স্বরগ্রামগুলি বিরল ক্ষেত্রে লোকসঙ্গীতে ও নিরক্ষর সংস্কৃতিগুলিতে পাওয়া যায়।

বিশ্বের ধ্রুপদী, শাস্ত্রীয়, উচ্চমার্গীয়, শৈল্পিক সাঙ্গীতিক ঐতিহ্যগুলিতে সপ্তস্বরী স্বরগ্রামগুলিই আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। ভারত, পারস্য ও ইউরোপ তথা পাশ্চাত্যের স্বরসংশ্রয়গুলি সম্পূর্ণরূপে সপ্তস্বরী। এমনকি যেসব দেশের শৈল্পীক সঙ্গীত কেবলমাত্র সপ্তস্বরী স্বরগ্রামভিত্তিক নয়, যেমন জাপানের রিতসু স্বরগ্রাম বা জাভা দ্বীপের পেলোগ স্বরগ্রাম, সেগুলিতেও সপ্তস্বরী স্বরগ্রামের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।

পশ্চিমা শৈল্পিক সঙ্গীত মূলক সপ্তস্বরী স্বরগ্রামের উপরে ভিত্তি করেই রচিত হয়, যাকে প্রকৃত স্বরগ্রাম (diatonic scale) বলে। প্রাচীন গ্রিসে এই স্বরগ্রামের উৎপত্তি ঘটে।

১৭শ শতকের আগে প্রকৃত স্বরগ্রামের ১২টি ভিন্ন উপস্বরগ্রাম (Mode) প্রচলিত ছিল। বর্তমানে এগুলির মধ্যে মাত্র দুইটি উপস্বরগ্রাম বা প্রকারভেদ বিগত প্রায় ৩০০ বছর ধরে বহুল প্রচলিত; এগুলি হল মুখ্য স্বরগ্রাম ও গৌণ স্বরগ্রাম। একটি প্রকৃত স্বরগ্রাম পাঁচটি পূর্ণ ধাপ ও দুইটি অর্ধ ধাপ ব্যবধান নিয়ে গঠিত। মুখ্য স্বরগ্রাম পূর্ণধাপ-পূর্ণধাপ-অর্ধধাপ-পূর্ণধাপ-পূর্ণধাপ-পূর্ণধাপ-অর্ধধাপ এই অনুক্রমটি নিয়ে গঠিত। অন্যদিকে গৌণ স্বরগ্রাম পূর্ণধাপ-অর্ধধাপ-পূর্ণধাপ-পূর্ণধাপ-অর্ধধাপ-পূর্ণধাপ-পূর্ণধাপ এই অনুক্রমটি নিয়ে গঠিত।

প্রকৃত সঙ্গীতে গৌণ স্বরগ্রামটিকে দুইভাবে পরিবর্তিত করে কিছু কিছু নির্দিষ্ট স্বরের উপর জোর দেওয়া হতে পারে। সমঞ্জস গৌণ স্বরগ্রামে সপ্তম স্বরটিকে অর্ধ ধাপ উত্থিত করা হয়। আবার সুরেলা গৌণ স্বরগ্রামে ষষ্ঠ ও সপ্তম স্বরগুলির উভয়কেই আরোহী বিন্যাসে অর্ধ ধাপ উত্থিত করা হয়, কিন্তু অবরোহীতে অপরিবর্তিত রাখা হয়।

১৯শ ও ২০শ শতকে এসে পশ্চিমা সঙ্গীত রচয়িতারা উত্তরোত্তর বেশি করে প্রকৃত তথা সপ্তস্বরী স্বরগ্রামের বাইরে অবস্থিত স্বর বা স্বরতীক্ষ্ণতার ব্যবহার করেন। এই প্রবণতাটির কারণে প্রকৃত স্বরগ্রামের বিকল্প অনেক বিচিত্র ধরনের অভিনব স্বরগ্রাম ব্যবস্থার বিকাশ ঘটে। যেমন অস্ট্রিয়াতে জন্ম নেওয়া সুরকার আর্নল্ড শ্যোনবের্গ ২০শ শতকের শুরুতে বারোস্বরী স্বরগ্রামকে ভিত্তি করে সঙ্গীত রচনার মূলনীতিগুলি লিপিবদ্ধ করেন। ফরাসি সুরকার ক্লোদ দ্যবুসিসহ ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের অন্যান্য অনেক সুরকার পূর্ণধাপী স্বরগ্রাম ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেন। এছাড়া ২০শ শতকে বিক্ষিপ্তভাবে অণুস্বরী স্বরগ্রামগুলির আবির্ভাব ঘটে। এগুলির মধ্যে সিকিস্বর (quarter tone), অর্থাৎ অর্ধস্বরের অর্ধেক দূরত্বের স্বর ব্যবহার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে গণ্য হয়।


দ্বিমাত্রিক স্বরগ্রাম[সম্পাদনা]

একটি বিশেষ সুর ও তার এক অষ্টক উপসুরের মধ্যে সম সঙ্গতিপূর্ণ বিভিন্ন কম্পাঙ্কের আর ছয়টি সুর সন্নিবেশ করে যে স্বরগ্রাম প্রস্তুত করা হয় তাকে দ্বিমাত্রিক স্বরগ্রাম বলে।

অর্থাৎ এই স্বরগ্রাম সাতটি ক্রমবর্ধমান কম্পাঙ্ক দ্বারা গঠিত। এদের সাধারণত C D E F G A B C দ্বারা সূচিত করা হয়। উপমহাদেশে এদের নাম ‘’’সা রে গা মা পা ধা নি সা’’’ এবং পাশ্চাত্যে এদের নাম যথাক্রমে ‘’’do re mi fa sol la si do’’’। এদের কম্পাঙ্ক যথাক্রমে ২৫৬, ২৮৮, ৩২০, ৩৪১.৩৩, ৩৮৪, ৪২৬.৬৬, ৪৮০ এবং ৫১২। D:C, G:F এবং B:A এই অনুপাতগুলোকে প্রধান টোন বলা হয়। এরা প্রত্যেকে ৯/৮ এর সমান হওয়ায় এগুলোকে প্রধান দ্বিমাত্রিক স্কেলও বলা হয়। এই স্বরগুলো দিয়ে সবসময় সুরের মাধুর্য রক্ষা করা যায় না। তাই আরও পাঁচটি বিকৃত স্বরকে এই স্বরগ্রামের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এদের কড়ি ও কোমল বলে। কম্পাঙ্কের এই সামান্য পরিবর্তনকে সুর পরিমিত বলে। সা ও পা এর কোন বিকৃত স্বর নেই। মা এর বিকৃত স্বরকে কড়ি এবং অন্যান্য বিকৃত স্বরকে কোমল বলে। সুরকে আরও শ্রুতিমধুর করার জন্য তার যন্ত্রে (যেমনঃ গীটার) আরও সূক্ষ্ম স্বর তৈরি করা সম্ভব। এদের শ্রুতি বা নোট বলে। এসব শ্রুতি দিয়ে সংগীতে মোট ২২ টি স্বর বিবেচনা করা হয়।[৩][৪]

সংগীত সংক্রান্ত শব্দ[সম্পাদনা]

ত্রয়ীঃ তিনটি শব্দের কম্পাংকের অনুপাত ৪:৫:৬ হলে এরা মিলিত হয়ে একটি মধুর সুর উৎপন্ন করে। একে ত্রয়ী বলে। সা, গা, পা এবং মা,ধা, সা নিয়ে ত্রয়ী গঠিত হয়।

স্বরসংগতিঃ যদি শব্দের কম্পাংকের অনুপাত ৪:৫:৬:৮ হয় অর্থাৎ ত্রয়ীর সাথে এর নিম্নতম কম্পাংকের অষ্টক যুক্ত হয় তবে এক প্রকার শ্রুতিমধুর শব্দের উৎপত্তি হয়। এরূপ সমন্বয়কে স্বরসংগতি বলে।

সমতানঃ কতগুলো শব্দ মিলিত হয়ে যদি ঐকতানের সৃষ্টি করে তবে তাকে সমতান বলে।

স্বর-মাধুর্যঃ কতগুলো শব্দ যদি একের পর এক ধ্বনিত হয়ে একটি সুমধুর সুরের সৃষ্টি করে তবে তাকে স্বর-মাধুর্য বা মেলোডি বলে। পাশ্চাত্য সংগীত স্বর-মাধুর্যকে ভিত্তি করে ত্রয়ী ও স্বর-সংগতি সমন্বয়ে গীত হয়। কিন্তু বাংলাদেশীভারতীয় সংগীত স্বর-মাধুর্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত।[৪]

সলো বা একক সঙ্গিতঃ একটিমাত্র বাদ্যযন্ত্র বাজালে যে সুরের সৃষ্টি হয় বা একই ব্যক্তি সংগীত পরিবেশন করলে যে সংগীত হয় তাকে সলো বলে।

অর্কেস্ট্রাঃ যখন একাধিক বাদ্যযন্ত্র একই সাথে বাজিয়ে একটি সমতান বা একটি স্বর-মাধুর্য অথবা একই সঙ্গে সমতান ও স্বর-মাধুর্য সৃষ্টি করে তখন সেটাকে অর্কেস্ট্রা বলে।

সুর-বিরাম[সম্পাদনা]

দুটি সুরের কম্পাংকের অনুপাতকে সুর-বিরাম বা সুর বিভেদ বা সুরানুপাত বলে। এর দ্বারা কম্পাংকগুলোর তীক্ষ্ণতার পার্থক্য বোঝা যায়। ক, খ, গ ও ঘ নামক সুরের কম্পাংক যথাক্রমে ১, ২, ৩, ৪ হলে ‘’’খ ও ক’’’, ‘’’গ ও খ’’’, ‘’’ঘ ও গ’’’ এর সুর-বিরাম যথাক্রমে ২, ৩/২, ৪/৩। ‘’’ঘ ও ক’’’ এর সুর-বিরাম হচ্ছে ৪= ২ X ৩/২ X ৪/৩। অতএব দেখা যাচ্ছে যেকোনো দুইটি সুরের বিরাম এগুলোর মধ্যবর্তী বিরামগুলোর গুণফলের সমান। যদি দুটি শব্দের কম্পাংকের পরিবর্তনে তাদের কম্পাংকের অনুপাতের পরিবর্তন না ঘটে তবে শব্দের পার্থক্য বোঝা যায় না। বিভিন্ন সুর-বিরামকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। যেমন-

১:১ সমায়ন, ২:১ অষ্টক, ৩:১ পঞ্চক, ৫:৪ তীব্র বা গুরু তিস্রক, ৬:৫ লঘু তিস্রক, ৩:২ গুরু পঞ্চক, ৫:৩ গুরু ষষ্ঠক, ৮:৫ লঘু ষষ্ঠক, ৮:৯ গুরু সুর, ১০:৯ লঘু সুর, ১৬:১৫ অর্ধ সুর। [৫][৪]

সংগীতগুণ[সম্পাদনা]

প্রকৃতি অনুযায়ী শব্দকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। ১। সুরযুক্ত শব্দ এবং ২। সুরবর্জিত শব্দ। উৎসের কম্পন নিয়মিত বা পর্যাবৃত্ত হলে যে শব্দের সৃষ্টি হয় তাকে সুরযুক্ত শব্দ বলে। উৎসের কম্পন অনিয়মিত বা অপর্যাবৃত্ত হলে যে শব্দের সৃষ্টি হয় তাকে সুরবর্জিত শব্দ বলে। সুরযুক্ত শব্দের তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যথা- ১। তীব্রতা বা প্রাবল্য, ২। তীক্ষ্ণতা এবং ৩। গুণ বা জাতি।

তীব্রতা[সম্পাদনা]

শব্দ সঞ্চালনের অভিমুখে লম্বভাবে স্থাপিত কোন বস্তুর উপর কোন বিন্দুর চারদিকে একক ক্ষেত্রফল দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে যে পরিমাণ শক্তি প্রবাহিত হয় তাকে তীব্রতা বা প্রাবল্য বলে। এটি তরঙ্গের বিস্তার ও কম্পাংকের উভয়ের বর্গের সমানুপাতিক। উৎস বড় আকারের হলে মাধ্যমের বেশি আয়তনকে কাঁপাতে পারবে, ফলে শব্দের তীব্রতা বেড়ে যাবে। মাধ্যমের ঘনত্ব বেশি হলে শব্দের তীব্রতা বেড়ে যায়। উৎস থেকে শব্দ যত দূরে যায় তত বেশি এলাকায় ছড়িয়ে পরে। ফলে একক ক্ষেত্রফলে শব্দের পরিমাণ কমে যায়। তাই তীব্রতাও কমে যায়। তীব্রতা দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। উৎসের নিকট বেশি ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট কোন বস্তু থাকলে পরবশ কম্পনের ফলে অনুনাদ সৃষ্টি হয়। ফলে শব্দের তীব্রতা বেড়ে যায়। এজন্যই তারের বাদ্যযন্ত্র ফাঁকা কাঠের বাক্সের উপর রাখা হয় যাতে কাঠের বাক্স ও এর ভেতরের ফাঁপা অংশের বায়ুতে পরবশ কম্পন সৃষ্টি হয়। উৎসের নিকট উপযুক্ত প্রতিফলক থাকলেও শব্দের তীব্রতা বেড়ে যায়।[৪]

তীক্ষ্ণতা[সম্পাদনা]

যে বৈশিষ্ট্যের দ্বারা সুরযুক্ত শব্দের বা স্বরগ্রামের একই তীব্রতার চড়া শব্দ ও খাদের শব্দের পার্থক্য বোঝা যায় তাকে তীক্ষ্ণতা বলে। মোটা শব্দের তীক্ষ্ণতা কম ও চড়া শব্দের তীক্ষ্ণতা বেশি। কম্পাংক বাড়লে তীক্ষ্ণতা বাড়ে এবং কম্পাংক কমলে তীক্ষ্ণতা কমে। যেহেতু বেগ= কম্পাংক X তরঙ্গ দৈর্ঘ্য, যদি শব্দের বেগ স্থির রাখতে হয় তাহলে কম্পাংক বাড়লে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কমতে থাকে। তীক্ষ্ণতা সুরযুক্ত শব্দের বৈশিষ্ট্য। আলোর বিভিন্ন রঙের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য তথা কম্পাংক বিভিন্ন, তেমনি বিভিন্ন তরঙ্গ দীর্ঘবিশিষ্ট শব্দের তীক্ষ্ণতাও বিভিন্ন । এজন্য তীক্ষ্ণতাকে কখনও কখনও সুরের বর্ণ বলা হয়।

গুণ বা জাতি[সম্পাদনা]

শব্দের যে বৈশিষ্ট্য দ্বারা একই তীব্রতা ও তীক্ষ্ণতাসম্পন্ন সুরযুক্ত শব্দের পার্থক্য নিরূপণ করা যায় তাকে জাতি বা গুণ বলে। একই সুরে অর্থাৎ তীব্রতা ও তীক্ষ্ণতায় যদি বাঁশি, বেহালা , এস্রাজ, হারমোনিয়াম বাজতে থাকে তবুও একজন শ্রোতা এই গুণের জন্য কোনটা বাঁশির শব্দ, কোনটা হারমোনিয়ামের তা বলে দিতে পারবেন।[৪]


আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Hewitt, Michael (2013). Musical Scales of the World, pp. 2–3. The Note Tree. আইএসবিএন ৯৭৮-০-৯৫৭৫৪৭০-০-১.
  2. Benward, Bruce and Saker, Marilyn Nadine (2003). Music: In Theory and Practice, seventh edition: vol. 1, p. 25. Boston: McGraw-Hill. আইএসবিএন ৯৭৮-০-০৭-২৯৪২৬২-০.
  3. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; physics1st নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  4. পদার্থবিজ্ঞান প্রথম পত্র- গনি, সুশান্ত, অচিন্ত্য।
  5. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; পদার্থ১ম নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি

আরও পড়ুন[সম্পাদনা]

  • Barbieri, Patrizio (২০০৮)। Enharmonic Instruments and Music, 1470–1900। Latina, Italy: Il Levante Libreria Editrice। আইএসবিএন 978-88-95203-14-0 
  • Yamaguchi, Masaya (২০০৬)। The Complete Thesaurus of Musical Scales (revised সংস্করণ)। New York: Masaya Music Services। আইএসবিএন 978-0-9676353-0-9 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]