বিষয়বস্তুতে চলুন

সিদ্ধেশ্বর সেন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
সিদ্ধেশ্বর সেন
জন্ম(১৯২৬-০৫-২৬)২৬ মে ১৯২৬
চুঁচুড়া, হুগলি জেলা ব্রিটিশ ভারত (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ)
মৃত্যু২১ এপ্রিল ২০০৮(2008-04-21) (বয়স ৮১)
কলকাতা পশ্চিমবঙ্গ ভারত
ভাষাবাংলা
জাতীয়তাভারতীয়

সিদ্ধেশ্বর সেন (২৬ মে ১৯২৬ - ২১ এপ্রিল ২০০৮) ছিলেন বিশ শতকে রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট কবি। [১]

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন

[সম্পাদনা]

সিদ্ধেশ্বর সেনের জন্ম ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মে (১৩৩৩ বঙ্গাব্দের ১২ চৈত্র) ব্রিটিশ ভারতের অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুঁচুড়ায়। পিতা সত্যেন্দ্রনাথ সেন, মাতা নির্ঝরিণী দেবী। সিদ্ধেশ্বরের বিদ্যালয়ের পাঠ প্রথমে দিল্লি ও সিমলায়। তারপর কলকাতা ও হাওড়ায়। ১৯৪০-এর বছরগুলিতে তিনি ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে সামিল হন। পরে কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী সিদ্ধেশ্বর সেন সাংবাদিকতায় কর্মজীবন শুরু করলেও, পরিচিতি লাভ করেন কবি হিসাবেই। পার্টির মুখপত্র "স্বাধীনতা পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন তিনি। স্বাধীনতা প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেলে তিনি 'সোভিয়েত দেশ' পত্রিকার তথ্য বিভাগে যোগ দেন। অবসর নেন ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে। [১]কর্মজীবনে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মুকুল গুহ, বুদ্ধদেব বসু, প্রমুখের।

সাহিত্যকর্ম

[সম্পাদনা]

সিদ্ধেশ্বর সেন প্রথম যৌবন থেকেই নিয়মিত কবিতা রচনা করেছেন। তার ঊনিশ বৎসর বয়সে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার সম্পাদিত অরণি পত্রিকায় ছাপা হয় কবিতা 'প্রস্তুতি' এবং ওই বছরেই বুদ্ধদেব বসুর 'কবিতা' পত্রিকায় বের হয় তার 'অনুরণন' নামের লিরিক। চল্লিশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে কলকাতার নানা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত কবিতা ছাপা হলেও ১৯৫০-এ ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকায় চার-পর্বে-বিন্যস্ত দীর্ঘ কবিতা ‘আমার মা-কে’ কবিতাটির প্রকাশের মধ্য দিয়েই সিদ্ধেশ্বর সেন কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। তার প্রথম জীবনের এই কবিতা সে-সময়ে সকলকে স্পর্শ করেছিল। ইনি কেবল জন্মদাত্রী মা নন, তিনি সমুদ্রমেখলা পৃথিবী, আদিমাতা বসুন্ধরা এই কবিতার পশ্চাৎপট সম্পর্কে তিনি লিখেছেন—

পার্টির বেআইনির সময়ে জেলখানায় থাকতে ছোটো বোন খুকুর মৃত্যুতে মায়ের মুখ মনে পড়ত খুবই। তাই এই দীর্ঘ কবিতা।

১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে জেল থেকে মুক্তি পাওয়া কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বিশেষ উদ্যোগে কবিতাটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন সুনীল জানা। কবি সমর সেন কর্তৃক অনুবাদটি দেখার পর পি. সি. জোশীর সম্পাদনায় এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়া টুডে’ পত্রিকায় সেটি প্রকাশিত হয়।

আমেরিকান লোককথা থেকে উঠে আসা 'উই শ্যাল ওভারকাম সামডে' মার্টিন লুথার কিং এর বক্তৃতায় বারবার ধ্বনিত হয়েছে। চার্লস পিনলে সুরারোপিত ও পিট সিগারের কণ্ঠে গীত এই 'মানবতার গান' সিদ্ধেশ্বর সেনের বঙ্গানুবাদে আমরা করব জয় নিশ্চয় সোভিয়েতে ছাপা হয়েছে, যদিও অনুবাদের একক খ্যাতি সিদ্ধেশ্বর পান নি।[১] লুই আরাগঁ-এর কবিতা 'মাই পার্টি'-র বঙ্গানুবাদ তার অন্যতম সৃষ্টি। মায়াকোভস্কির দীর্ঘ কবিতা 'ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন' কবিতাটির বঙ্গানুবাদও সার্থক।

১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে চব্বিশ বৎসর বয়সে কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেলেও এবং অবিরতই কবিতা লিখলেও, পরবর্তী বিশ বৎসরে তার একটিও কবিতা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে ১৪ মার্চ প্রকাশিত হয় - 'ঘন ছন্দ মুক্তির নিবিড়'। তাও মূলত কবি অরুণ সেন আর দেবেশ রায়ের উদ্যোগে। কবি শঙ্খ ঘোষ তার মৃত্যুতে স্মরণ করেন

সেই সিদ্ধেশ্বর সেন, প্রথম যৌবন থেকে অবিরতই কবিতা লিখেছেন যিনি, কিন্তু পঞ্চাশ বছর বয়স হয়ে যাবার পরও যিনি তাঁর নিজের পছন্দমতো কোনো বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করে উঠতে পারেননি; সেই সিদ্ধেশ্বর সেন, প্রবীণ কবির অগোচরেই যাঁর দু-চারজন অনুজ সুহৃদ প্রকাশ করে দিয়েছেন তাঁর বই; সেই সিদ্ধেশ্বর সেন, যিনি অনেক অনুনয় করে মধ্যরাতে প্রেসের দরজা খুলিয়েছেন কবিতার একটা-কোনো কমা ঠিক করে দেবার জন্য ... ।"

অভিন্ন অনুরাগীজন ও সুহৃদদের উদ্যোগে সিদ্ধেশ্বর সেনের মোট আটটি কাব্যগ্রন্থ ও কবিতা-সংকলন প্রকাশিত হয়েছে—

  • ঘন ছন্দ মুক্তির নিবিড় (১৯৮০, সারস্বত),
  • সিদ্ধেশ্বর সেনের কবিতা ১ (১৯৮১, পরিচয়),
  • তোমার শুধু মানুষ (১৯৮৩, সাহিত্য সমবায়),
  • দীর্ঘায়ু আর অমর তৃষ্ণায় (১৯৮৩, পরিচয়),
  • আয়না-আঁটা সপ্ততলা (১৯৮৩, নাভানা),
  • সিদ্ধেশ্বর সেনের কবিতা ২ (১৯৮৪, পরিচয়),
  • পুরাণকল্পে পুনর্বার(১৯৮৯, প্রতিক্ষণ) এবং
  • সিদ্ধেশ্বর সেনের কবিতা (২০০১)

সম্মাননা

[সম্পাদনা]

কবি সিদ্ধেশ্বর সেন তার সাহিত্যকীর্তির জন্য সম্মানিত হয়েছেন—

  • মস্কোর মৈত্রী ও সাংস্কৃতিক সমিতি প্রদত্ত 'সাইটেবাম' সম্মাননায়
  • সাহিত্য অকাদেমি প্রদত্ত লেখক গ্রান্ট
  • মণিপুর রাজ্যকলা আকাদেমি সম্মাননা
  • কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের একুশে সম্মাননা
  • কবি বিষ্ণু দে পুরস্কার
  • কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার [১]

জীবনাবসান

[সম্পাদনা]

নিঃসন্তান কবি সিদ্ধেশ্বর সেন ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের ২১ এপ্রিল (১৪১৫ বঙ্গাব্দের ৮ বৈশাখ) কলকাতার নীলরতন সরকার হাসপাতালে পরলোক গমন করেন। ১৬ এপ্রিল হাসপাতালে রোগশয্যায় শুয়েই মুখে মুখে বলে যান— "আমার মা-কে মনে পড়ে/রোগশয্যায় শুয়ে/রোগশয্যা কিছু নয়/রোগশয্যা ছাড়িয়ে মা অনন্ত শয্যায়।/ সেই শৈশবে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়/যেখানে মা আর আমি /শিশুর মতো জগৎকে ছুঁয়ে আছি।"[১]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৯ পৃষ্ঠা ৪৩০, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-২৯২-৬