মোহিনী মিল
ধরন |
|
---|---|
শিল্প | তাঁত শিল্প |
প্রতিষ্ঠাকাল | ১৯০৮ |
প্রতিষ্ঠাতা | মোহিনী মোহন চক্রবর্তী [১] |
বিলুপ্তিকাল | ২০১১ |
সদরদপ্তর | মিল পাড়া, , |
বাণিজ্য অঞ্চল | বিশ্বব্যাপী |
মোহিনী মিল ব্রিটিশ ভারতের বস্ত্র শিল্পের ইতিহাসে এক বিশেষ অগ্রদূতের ভূমিকা রেখেছে। বর্তমান বাংলাদেশের এবং তৎকালীন পূর্ব বাংলার নদিয়া জেলার কুষ্টিয়া জেলায় স্থাপিত মোহিনী মিল।[২] ব্রিটিশ শাসনামলে উপমহাদেশের ইতিহাসে যে কয়টি বস্ত্রকলের নাম পাওয়া যায় মোহিনী মিল তার অন্যতম। অন্যদিকে পূর্ব বাংলায় এ মিলের স্থান ছিল অনন্য উচ্চতায়। কারণ বঙ্গের পুরো ভূভাগে এই একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানই সে সময় গড়ে উঠেছিল। যদিও ইউরোপে ঘটে যাওয়া শিল্প বিপ্লবের ছোঁয়া থেকে দূরে ও অনেক পরে মিলটি স্থাপিত হয় তথাপি শুধু অর্থনৈতিক বিচারেই নয়, মিলটি পুরো বাংলা ভূখণ্ডের মর্যাদাকেই বৃদ্ধি করেছিল। এ মর্যাদা অখণ্ড ও আরো শক্তিশালী হয়ে দেখা দিয়েছিল যখন এ মিলেরই উৎপাদিত সুতা দিয়ে তৈরি ধুতি, শাড়ি, মার্কিন ও শালু কাপড়ের সুখ্যাতি ছড়িয়ে যায় ভারতজুড়ে। ইতিহাসের এ রকম পাতাজোড়া সম্মান ওই সময়ে আর কিছুতেই এত অনায়াসে আসেনি।[৩]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]মোহিনী মিল লিমিটেড ছিল একটি বাণিজ্যিক উদ্যোগ। এটি মোহিনী মোহন চক্রবর্তীর আমলাতান্ত্রিক চিন্তাধারা ও ভাবনার বাইরের গল্প। ব্রিটিশ শাসনের ওই সময়ে ভারতজুড়ে নানা অস্থিরতা। একদিকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দিকে দিকে নানা অসন্তোষ, অন্যদিকে ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের স্বদেশী আন্দোলনও বেশ জোরালো। সেই সময়েই মোহিনী মিলস প্রতিষ্ঠার চিন্তা করা হয়। এটি উল্লেখ করা যেতে পারে যে এরই মধ্যে প্রথম আধুনিক সুতির টেক্সটাইল মিলস ১৮৫৮ সালে রঞ্জোদোদলাল ছোটাল নামে একজন গুজরাটি আহমেদাবাদে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনিও ছিলেন একজন সিভিল সার্ভেন্ট। কিন্তু বাংলায় মোহিনী মোহন ছিলেন প্রথম বাঙালি, যার হাত ধরে ভারতের পূর্ব অংশে সুতি বস্ত্রকলের প্রতিষ্ঠা পায়। চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর চাকরি থেকে পাওয়া সমুদয় অর্থ দিয়ে তিনি এ মিলস প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন।
১৯০৮ সালে মাত্র আটটি তাঁত যন্ত্র নিয়ে মোহিনী মোহন চক্রবর্তী যাত্রা শুরু করেন মোহিনী মিলের। স্থান হিসেবে বেছে নেন তৎকালীন নদিয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমাকে। জায়গাটি বেছে নেয়ার অনেকগুলো কারণ ছিল। জায়গাটি ছিল শহরের প্রাণকেন্দ্র। অদূরেই ছিল কুষ্টিয়া রেলওয়ে স্টেশন। তার পাশেই ছিল ছোট নদীবন্দর। মিলের পাশ দিয়েই গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ। সেখান থেকে নদী পেরোলেই ঢাকা শহর। আবার পাশেই বড়বাজার। গড়াই নদের ঘাট থেকে নদীপথে বড় বড় নৌকায় সুতা থেকে উৎপাদিত পণ্য কলকাতার শিয়ালদহ ও দেশের পাবনা, শাহজাদপুর, গাজীপুর, নাটোরসহ দেশের প্রায় সব এলাকায় পৌঁছে যাওয়ার সুযোগ ছিল।
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/a/a3/%E0%A6%AE%E0%A7%8B%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%80_%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%B2_2.jpg/220px-%E0%A6%AE%E0%A7%8B%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%80_%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%B2_2.jpg)
প্রতিষ্ঠার কিছুদিনের মধ্যেই মিলটি একটি লাভজনক শিল্পে পরিণত হয়। ১৯০৮ সালের মধ্যেই ১০০ একর জায়গার ওপর ছড়িয়ে যায় পুরো মিলটি। ১৯১০ থেকে ১৯১৮ সময়কালে সুদূর ইংল্যান্ড থেকে পিতলের হ্যান্ডলুম মেশিন আর পিতলের তৈরি প্রায় ২০০ তাঁত আমদানি করে মিলসের কলেবর ও উৎপাদন বহুগুণে বাড়িয়ে তোলা হয়। এ সময়ে প্রতিদিন কুষ্টিয়া বড় স্টেশনে ভারতের শিয়ালদহ থেকে কয়েকটি বগি রিজার্ভ আসত মোহিনী মিলের সুতা নেয়ার জন্য। আবার বড়বাজার গড়াই নদের ঘাট থেকে বড় বড় নৌকায় সুতা যেত দেশের বিভিন্ন জায়গায়। পাবনা, শাহজাদপুর, গাজীপুর, নাটোরসহ দেশের প্রায় সব এলাকা থেকে তাঁতিরা এখানে আসতেন সুতা কিনতে। এটিই ছিল পূর্ব বাংলার প্রথম বড় টেক্সটাইল মিলস।
এ সময়ে মিলটি একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয়, যার প্রাথমিক পুঁজি ছিল ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। পরবর্তী সময়ে কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে ৬০ লাখ টাকা সংগ্রহ করা হয়। ছয় মাসের মধ্যেই এক-তৃতীয়াংশ শেয়ার বিক্রি হয়ে যায়, যার অধিকাংশের ক্রেতা বরিশাল, সিলেট, ঢাকা, চট্টগ্রাম, ভারতের পাটনা ও রেঙ্গুনের ব্যবসায়ীরা। কুষ্টিয়ায়ই ছিল শেয়ার রেজিস্ট্রার অফিস। মিলের প্রথম সাধারণ সভা হয় ১৯১৮ সালের ১৮ আগস্ট। মিলের ১৪ জন বোর্ড অব ডিরেক্টরসের নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়। এরা হলেন বাবু মোহিনী মোহন চক্রবর্ত্তী, মাধবচন্দ্র রাও, বিহারী লাল সেন, কালিদাস নন্দী, চন্দ্রমণি সান্যাল, চণ্ডীচরণ চট্টোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ রায়, তারাপদ মজুমদার, গোকুল চন্দ্র মণ্ডল, পূর্ণচন্দ্র রায় (প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের ভ্রাতা) ও মোহাম্মদ রওশন খান চৌধুরী। আরো তিনজন বিশেষ ব্যক্তি ওই বোর্ড অব ডিরেক্টরসে ছিলেন তারা হলেন রাজা প্রমথভূষণ দেব রায় বাহাদুর (নালন্দার জমিদার), জগিকশোর আচার্য (ময়মনসিংহের জমিদার) ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (জোড়াসাঁকোর জমিদার) অচিরেই ভারতবর্ষজুড়ে একটি আধুনিক সুতাকলের মধ্যে মোহিনী মিলসের নাম চলে আসে। ১৯২০-এর দশকের মধ্যে মিলে প্রায় তিন হাজার মানুষ কাজ করত। এ সময় এখানে উন্নতমানের সুতা, মোটা শাড়ি, ধুতি, বেডশিট, তোয়ালে, হাসপাতালে ব্যবহূত গজ, ব্যান্ডেজ, ধূসর বর্ণের ও রঙিন সুতা তৈরি হতো। স্বদেশী যুগে দেশী কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা মেটাতে মিলটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে থাকে। মোহিনী মিলসের মার্কিন ও শাড়ি কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা ছিল। ধীরে ধীরে মিলটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে। মিলটি থেকে ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, বার্মায় প্রচুর পরিমাণে সুতা রফতানি হতো। মিলটি পুরো এশিয়ার মধ্যেই একটি স্থান দখল করে নেয়। এ সময় মিলের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল লক্ষ্মী কটন মিলস ও ঢাকেশ্বরী কটন মিলস লিমিটেড। ইতিহাস বলছে, এ সময় মিলে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ পিস ধুতি ও শাড়ি তৈরি হতো। এ সময় মিলের অথরাইজড ক্যাপিটাল ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ২ লাখে পৌঁছে। ১৯১৮ সালে সেটা পৌঁছে ৬ লাখে। ১৯১৪-১৯১৫ ছাড়া ১৯১২ থেকে ১৯১৮-এর মধ্যে কোম্পানিটি প্রতি বছরই লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে।[৪]
বর্তমান অবস্থা
[সম্পাদনা]২০১১ সালে আব্দুল মতিন নামের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিক্রির চুক্তি করে সরকার। তারা কিছু টাকা পরিশোধ করে ২০১১ সাল পর্যন্ত। এরপর ২০১২ সালে মিল দেয়া হয় মেসার্স দিনার এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী এম আসলামকে। টাকা পরিশোধের জন্য তাকে সময় দেয়া হয় ২৮ দিন। স্বত্বাধিকারী অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে পরে মন্ত্রণালয় ইনারগোটেক লিমিটেডকে মিলটি দিয়ে দেয়। জমিসহ মিলটির দাম ৪৮ কোটি ৩৯ লাখ ৭৩ হাজার টাকা ধরে ইনারগোটেক লিমিটেডের কাছে হস্তান্তর করা হয়।[৫] তারাও সময়মতো টাকা না দেয়ায় মিলটি এখন পাট মন্ত্রণালয়ের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়া বা ধার পরিশোধ নিয়ে কাজ করে যে শাখা সেই লিকুইডেশন বা অবসায়ন শাখার তত্ত্বাবধানে।[৬] মিলটির বর্তমান মূল্যের মূল্যায়ন চলছে। এর স্থাবর সম্পত্তির মূল্যায়ন করছেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার আর অস্থাবর সম্পত্তির মূল্য নির্ধারণের জন্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।[৭]
মিলের ৯৯ বিঘা সম্পত্তির মধ্যে কারখানা আছে প্রায় ২৮ বিঘা জমির ওপর। কারখানার ভেতরের যন্ত্রাংশ পরিত্যক্ত। বিএমআরই ইউনিট এখন বন্ধ। ওই জমিতে চারটি মসজিদ, চারটি মন্দির, একটি স্কুল, একটি কলেজ, খেলার মাঠ, একটি দাতব্য হাসপাতাল রয়েছে। বেশকিছু জমি ও স্থাপনা বিভিন্ন প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে।
মিলের পুরো জায়গাটি কুষ্টিয়া পৌরসভার মধ্যে। জমির বর্তমান মূল্যমান বিচেনায় কাঠাপ্রতি দাম বর্তমানে ২০ লাখ টাকার ওপরে। সেই হিসাবে ৯৯ বিঘা জমির বাজারদর প্রায় ২০০০ কোটি টাকা।[৮]
চিত্রশালা
[সম্পাদনা]![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/6/61/%E0%A6%AE%E0%A7%8B%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%80_%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%B2.png/220px-%E0%A6%AE%E0%A7%8B%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%80_%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%B2.png)
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "জাতীয় তথ্য বাতায়ন"। www.kushtia.gov.bd। সংগ্রহের তারিখ ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪।
- ↑ "কুষ্টিয়ার ইতিহাসে মোহিনী মোহন চক্রবর্তী ও মোহিনী মিলস্"। Kushtia 24 | News (ইংরেজি ভাষায়)। ২১ জুলাই ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪।
- ↑ "মোহিনী মিলস"। মোহিনী মিলস (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪।
- ↑ "মোহিনী মিলস"। মোহিনী মিলস (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪।
- ↑ প্রতিবেদক, নিজস্ব (১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩)। "হাতবদলের চক্রে মোহিনী মিল"। Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪।
- ↑ সরকার, প্রদীপ (১৫ জানুয়ারি ২০২৪)। "৪ দশকেও বিক্রি হলো না কুষ্টিয়ার মোহিনী মিল"। Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪।
- ↑ "ষষ্ঠবারের মতো হাতবদল হচ্ছে মোহিনী মিল"। Newsbangla24। সংগ্রহের তারিখ ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪।
- ↑ "মোহিনী মিলের পিলার চুরির চেষ্টা, বাধ্য হয়ে মুসা খানের দায়সারা কাজ"। কুষ্টিয়া জিলাইভ। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৩-০৮।