পৌণ্ড্রক্ষত্রিয়
পৌন্ড্রক্ষত্রিয়, পুণ্ড্ররা বা পোদ বেদবাক্য মতে ছিল একটি জনগোষ্ঠী।
ইতিহাস
[সম্পাদনা]মহাভারতের দিগ্বিজয় শাখায় তাদের আবাস রূপে মুঙ্গেরের পূর্বদিক এবং কোশীর তট(অন্য নাম সপ্তকোশী নদী) শাসনকারী যুবরাজের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গুপ্ত শাসনকালে উৎকীর্ণ লিপি বা তাম্রশাসন এবং প্রাচীন চীনা লেখকরা পুণ্ড্রবর্ধনকে উত্তরবঙ্গে পুণ্ড্রদের স্থান রূপে উল্লেখ করে। পুণ্ড্রদের আবাসস্থলই পুণ্ড্র বা পুণ্ড্রবর্ধন নামে খ্যাত হয়েছিল।পৌন্ড্রক্ষত্রিয়রা অনেকের মতে অনার্য একটি সম্প্রদায়।[১][২][৩]
কিন্তু পরবর্তীতে তারা ব্রাত্য ক্ষত্রিয়তে পরিণত হয়। পঞ্চানন বর্মা বাংলার বর্ণবাদী হিন্দুদের দৌরাত্ম ও নির্যাতনের শিকার উত্তরবঙ্গের ক্ষত্রিয়দের অবহেলিত রাজবংশী ক্ষত্রিয় থেকে আর্য জাতির পৌন্ড্রক্ষত্রিয় হিসেবে পুনরায় উচ্চবর্ণের বাঙালিদের শ্রদ্ধা ও স্বীকৃতি অর্জন করতে এই আন্দোলন করেন। তিনি মনে করেছিলেন রাজবংশীদের অবশ্যই সংগঠিত ও শিক্ষিত হওয়া উচিত যা তিনি ক্ষত্রিয় সভার মাধ্যমে অর্জন করার চেষ্টা করেছিলেন। এই সমিতিটি প্রমাণ করে যে রাজবংশীরা রাজকীয় বংশের ক্ষত্রিয় ছিলেন এবং কোচবিহারের রাজা বিশ্ব সিংহের সাথে তাদের ঐতিহাসিক ভাবে যোগসূত্র রয়েছে। সংস্কৃত সাহিত্য এবং ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের উপর ভিত্তি করে তারা শতাব্দী ধরে পরশুরামের ভয়ে নিজেদের সত্য পরিচয় গোপনকারী ক্ষত্রিয় বলে প্রমাণ করেছিল। এই দাবির সমর্থনে এই আন্দোলনটি একটি আনুষ্ঠানিক ক্ষত্রিয়করণ প্রক্রিয়া পরিচালনা করে। বাংলা ১৩১৯ সালের ২৭ মাঘ পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে লক্ষাধিক রাজবংশীর গণউপনয়ন করা হয়। [৪] যার ফলে উত্তরবঙ্গের গ্রামগুলিতে কয়েক হাজার রাজবংশীকে ‘ক্ষত্রিয় রাজবংশী’ হিসাবে প্রমাণ করার জন্য তাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ্য রীতিনীতির পুনঃপ্রবর্তন করা হয়েছিল। [৫]
বর্তমানে ভারতবর্ষের ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গে তারা একটি তফসিলি জাতি।[৬] পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাস্তুচ্যুত বাঙালি সম্প্রদায়ের এই লোকদেরকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে তফশিলী জাতি হিসাবে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।[৭] পৌন্ড্রক্ষত্রিয় একটি ‘আত্মপরিচয়’ ঘোষণা করে আত্ম-সম্মানের বোধ তৈরি করেছিল।[৮] ২০০১ সালে পশ্চিমবঙ্গে এদের মধ্যে ২,২১৬,৫১৩ জন ছিল। জনগণনা অনুসারে, ০-৬ বয়সের মধ্যে লিঙ্গ অনুপাত মেয়েদের ক্ষেত্রে জাতীয় গড়ের নিচে ছিল।[৯]
শিক্ষার হার ৭২.১, পুরুষদের ৮৩.৫ এবং মহিলাদের ৫৯.৯।[৯] এখানে স্পষ্ট হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ রয়েছে।[৯] তাদের প্রধান উপগোষ্ঠীগুলি হল চাষী , মেছো , তাঁতি এবং ধামনা ।[১০] গোষ্ঠীগুলির মধ্যে পার্থক্যের জন্য মনে হয় যে পেশাগুলির মধ্যে এর উৎস রয়েছে। এদেরকে ধুলাপুরে, বাজিতপুরে, বারুনি, মেদিনীপুর এবং সাদপুরেতে ভাগ করা হয়েছে।[১১] এগুলি কয়েকটি জনগোষ্ঠীতে বিভক্ত।[১২] পৌন্ড্রক্ষত্রিয়দের অনেক সময় পোদ বলা হয়। যা পূর্ববাঙ্গালীদের জন্য অবমাননাকর শব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।[১৩] সম্ভবত তারা আদিবাসী বংশোদ্ভূত।[১৪] ১৯১১ সালে, ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী মেয়েদের মধ্যে, ৩৫.৭% বিবাহিত বা বিধবা হয়েছিল।[১৫] ১৯১১ সালের আদমশুমারিতে তারা কমপক্ষে ৫ লক্ষেরও বেশি ছিলেন, অনেকে ছিলেন কৃষক বা মৎস্যজীবী।[১৬] ১৯০১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই গোষ্ঠীর জনসংখ্যা ৪,৬৪,৭৩৬; ১৯১১ সালে ৫,৩৬,৫৬৮; ১৯২১ সালে ৫,৮৮,৩৯৪ এবং ১৯৩১ সালে ৬,৬৭,৭৩১ ছিল।[১৭]
কলকাতা মেট্রোপলিটন অঞ্চলের পরোক্ষ অর্থনীতিতে এই গোষ্ঠীর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে।[১৮]
১৮৭২ সালের ভারতের জনবিবরণীতে প্রথম এই জনগোষ্ঠীকে ‘পোদ’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। পৌন্ড্রক্ষত্রিয় জনসমষ্টির আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯২১ সালের জনবিবরণীতে ‘পোদ’ শব্দের পাশে বন্ধনীতে ‘পৌন্ড্র’ লেখা হলেও ১৯৩১ সালে এর ব্যতিক্রম ঘটে। ১৯৩৮ সালের ৬ মে তৎকালীন ভারতের বঙ্গীয় সরকারের সচিব একটি পত্রে পতিরাম রায় এমএলএকে অবহিত করেন যে, সামাজিকভাবে এই জনগোষ্ঠীকে ‘পৌন্ড্রক্ষত্রিয়’ নামে অভিহিত করা হবে। এরপর ১৯৩৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় ৭৬ নং তারকা চিহ্নিত স্থানে পতিরাম রায় এই জাতির ‘পৌন্ড্রক্ষত্রিয়’ নাম দাবি করায় তা গ্রহণযোগ্য হয়।
কোনো কোনো পণ্ডিত মনে করেন যে পৌন্ড্রক্ষত্রিয় এবং আরও অনেক বর্ণ মিলে নমঃশুদ্র জাতির উদ্ভব হয়েছে। নমঃশুদ্র, পোদ,পৌন্ড্রক্ষত্রিয় নৈকট্য দেখে মনে হয় যে, এরা সবাই একই বৈশিষ্ট্যের মানুষ। নৃতাত্ত্বিক বিচারে, এরা কেউ বিস্তৃত-শির নয়, সবাই নাতিদীর্ঘ বা মাঝারি আকারের।
পৌন্ড্রক্ষত্রিয় জনগোষ্ঠীদের অনেক বর্ণবাদী নিম্ন বর্ণের বললে পৌন্ড্রক্ষত্রিয়রা নিজেদের ক্ষত্রিয় বলে পরিচয় দেয় ও ব্রাহ্মণ্য় মূল্যবোধ, উপবীত ধারণ, দ্বাদশাহাশৌচ ইত্যাদি করছে। তাদের অনেকে যেমনঃ রাজবংশীরা নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠায় সামাজিক আন্দোলন করে আসছে।[১৭]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Hossain, Md. Mosharraf, Mahasthan: Anecdote to History, 2006, pp. 69-73, Dibyaprakash, 38/2 ka Bangla Bazar, Dhaka, আইএসবিএন ৯৮৪-৪৮৩-২৪৫-৪
- ↑ Ghosh, Suchandra। "Pundravardhana"। Banglapedia। Asiatic Society of Bangladesh। ২০০৯-১১-০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-১১-১০।
- ↑ Majumdar, Dr. R.C., History of Ancient Bengal, First published 1971, Reprint 2005, p. 10, Tulshi Prakashani, Kolkata, আইএসবিএন ৮১-৮৯১১৮-০১-৩.
- ↑ Desk, Online। "নিশিগঞ্জে পালিত হল ক্ষাত্র দিবস | Uttarbanga Sambad | Latest Bengali News | বাংলা সংবাদ, বাংলা খবর | Live Breaking News North Bengal | COVID-19 Latest Report From Northbengal West Bengal India" (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২১-০৮-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-২৪।
- ↑ সরকার, আই (২০০৬)। "The Kamatapur Movement: Towards a Separate State in North Bengal"। গোবিন্দ চন্দ্র রাথ। Tribal development in India: the contemporary debate। Sage। আইএসবিএন 978-0-7619-3423-3।
- ↑ "Inclusion in Scheduled Castes List"। pib.nic.in। সংগ্রহের তারিখ ৭ জানুয়ারি ২০১৮।
- ↑ "THE CONSTITUTION (SCHEDULED CASTES) ORDER (AMENDMENT) BILL, 2007" (পিডিএফ)। 164.100.47.4। সংগ্রহের তারিখ ১ ডিসেম্বর ২০১৮।
- ↑ Rup Kumar Barman (১ জানুয়ারি ২০১৪)। "From Pods to Poundra: A Study on the Poundra Kshatriya Movement for Social Justice 1891–1956"। Contemporary Voice of Dalit। 7 (1): 121–138। ডিওআই:10.1177/0974354520140108।
- ↑ ক খ গ "West Bengal : DATA HIGHLIGHTS: THE SCHEDULED CASTES : Census of India 2001" (পিডিএফ)। Censusindia.gov.in। সংগ্রহের তারিখ ১ ডিসেম্বর ২০১৮।
- ↑ O'Malley, Lewis Sydney Steward; I.C.S (৭ জানুয়ারি ২০১৮)। Bengal District Gazetteers: 24-Parganas। Concept Publishing Company। আইএসবিএন 9788172681937। সংগ্রহের তারিখ ৭ জানুয়ারি ২০১৮ – Google Books-এর মাধ্যমে।
- ↑ Singh, Kumar Suresh; Bagchi, Tilak; Bandyopādhyāẏa, Śekhara; Bhattacharya, Ranjit Kumar (৭ জানুয়ারি ২০১৮)। People of India: West Bengal। Anthropological Survey of India। আইএসবিএন 9788170463009। সংগ্রহের তারিখ ৭ জানুয়ারি ২০১৮ – Google Books-এর মাধ্যমে।
- ↑ Bera, Gautam Kumar (৭ জানুয়ারি ২০১৮)। The Unrest Axle: Ethno-social Movements in Eastern India। Mittal Publications। আইএসবিএন 9788183241458। সংগ্রহের তারিখ ৭ জানুয়ারি ২০১৮ – Google Books-এর মাধ্যমে।
- ↑ Jalais, Annu (৩ জুন ২০১৪)। Forest of Tigers: People, Politics and Environment in the Sundarbans। Routledge। আইএসবিএন 9781136198687। সংগ্রহের তারিখ ৭ জানুয়ারি ২০১৮ – Google Books-এর মাধ্যমে।
- ↑ Pillai, V. Kannu (৭ জানুয়ারি ২০১৮)। Caste: Observation of I.C.S. Officers and Others Since 1881। Gautam Book Center। আইএসবিএন 9788190558365। সংগ্রহের তারিখ ৭ জানুয়ারি ২০১৮ – Google Books-এর মাধ্যমে।
- ↑ Bandyopadhyay, Sekhar (১৯ আগস্ট ২০০৪)। Caste, Culture and Hegemony: Social Dominance in Colonial Bengal। SAGE Publications। আইএসবিএন 9780761998495। সংগ্রহের তারিখ ৭ জানুয়ারি ২০১৮ – Google Books-এর মাধ্যমে।
- ↑ Risley, Sir Herbert Hope; Crooke, William (১ ডিসেম্বর ১৯৯৯)। The People of India। Asian Educational Services। আইএসবিএন 9788120612655। সংগ্রহের তারিখ ৭ জানুয়ারি ২০১৮ – Google Books-এর মাধ্যমে।
- ↑ ক খ Roy, Suranjan (২০১২)। "Paundra-Kshatria"। Islam, Sirajul; Jamal, Ahmed A.। Banglapedia: National Encyclopedia of Bangladesh (Second সংস্করণ)। Asiatic Society of Bangladesh।
- ↑ Chandra, Uday; Heierstad, Geir; Nielsen, Kenneth Bo (২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫)। The Politics of Caste in West Bengal। Routledge। আইএসবিএন 9781317414773। সংগ্রহের তারিখ ৭ জানুয়ারি ২০১৮ – Google Books-এর মাধ্যমে।