বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্র বিরোধী আন্দোলন
বাঁশখালী পাওয়ার প্ল্যান্ট আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় একটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য বাংলাদেশী-চীনা কনসোর্টিয়াম কর্তৃক কৃষি জমি, কবরস্থান এবং বাড়ি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের একটি আন্দোলন। এতে বিক্ষোভকারী ও পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে সংঘর্ষে চারজন (পুলিশের মতে) বা পাঁচজন (বিক্ষোভকারীদের মতে) নিহত হন।[১][২] বিক্ষোভকারীদের মতে, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর আরও চারজন নিখোঁজ হন।[৩]
পটভূমি
[সম্পাদনা]২০১৬-এর ফেব্রুয়ারীতে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড দুটি কোম্পানির একটি কনসোর্টিয়াম-বাংলাদেশ ভিত্তিক এস আলম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ এবং চীন ভিত্তিক শানতং ইলেকট্রিক পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন III-এর কাছ থেকে বিদ্যুত ক্রয়ের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।[৪] বিশেষজ্ঞরা নতুন কয়লা প্ল্যান্টের পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করেন,[৫] এবং ২০১৬ সালের ১৬ মার্চ থেকে (চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কিছুক্ষণ পর) প্রতিবাদ শুরু হয়।
২০১৬ সালের মার্চ মাসে বিক্ষোভ সহিংস হয়ে ওঠে যখন কোম্পানির ভাড়াটে লোকেরা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরোধিতাকারীদের প্রতিবাদ মিছিলে গুলি চালায়। এতে আহত হন বেশ কয়েকজন। ভাড়াটে লোকেরা ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল।[৪] বিক্ষোভ চলাকালে স্থানীয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতাদের সহায়তায় বিদ্যুৎ বোর্ড বলপূর্বক জমি অধিগ্রহণ শুরু করে।[৬]
২০১৬-এর ২রা এপ্রিল, যখন কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিক ও প্রকৌশলীরা নির্মাণস্থল পরিদর্শন করার চেষ্টা করেন, তখন বিক্ষোভকারীরা কর্মকর্তাদের গাড়িতে আঘাত হানে। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের দমন করে সাতজনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা ৪ এপ্রিল জনসমাবেশের আহ্বান জানান।[৭]
একই দিনে একই স্থানে আওয়ামী লীগ নেতারা সভা আয়োজন করে। স্থানীয় পুলিশ এলাকায় জনসমাগম নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে।[৮] ৪ এপ্রিল স্থানীয় বাসিন্দারা আন্দোলন করতে জড়ো হলে পুলিশ গুলি চালিয়ে কমপক্ষে পাঁচজনকে হত্যা করে।[৯] ভারতের ঝাড়খণ্ডে ছয় জনকে হত্যার পর কয়লা বিরোধী বিক্ষোভে এটিই সবচেয়ে বড় প্রাণহানির ঘটনা।[৩]
চুক্তি
[সম্পাদনা]২০১৩ এর ৩১ অক্টোবর, পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন না থাকা সত্ত্বেও এস. আলম গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজকে আওয়ামী লীগ সরকার চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয়।[১০] ডিসেম্বরে গ্রুপটি (বাংলাদেশের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল সমষ্টিগুলির মধ্যে একটি) একটি কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য চীন ভিত্তিক শক্তি কোম্পানি শানতং ইলেকট্রিক পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন III এর সাথে একটি চুক্তি সই করে।[৮] ২০১৬-এর ১৬ ফেব্রুয়ারী সরকার প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা ৳ ৬.৬১ দরে প্ল্যান্টটি থেকে (যার ক্ষমতা ১.২২ মেগাওয়াট) বিদ্যুৎ ক্রয়ের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।[৬]
ভূমি অধিগ্রহণ
[সম্পাদনা]২০১৩ সালে, এস. আলম গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ (প্ল্যান্টের স্থানীয় মালিক) ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহায়তায় স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণ শুরু করে। বাসিন্দারা অভিযোগ করেছে যে তাদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি এবং গ্রুপটির নির্বাহীদের সাথে যোগাযোগ করতে তাদের নিষেধ করা হয়েছে।[৬]
সুরক্ষা কমিটি
[সম্পাদনা]এস আলম গ্রুপ প্রায় ৬০০ একর (২৪০ হেক্টর) ভূমি অধিগ্রহণ করেছে বলে জানানোর পরে বাসস্থান ও কবরস্থান রক্ষার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়, প্রাথমিকভাবে যার সদস্যরা ছিলেন জীবিকা নির্বাহকারী লবণ চাষী। সাবেক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতা লিয়াকত আলীকে এস আলম গ্রুপের কাছ থেকে কৃষি ও আবাসিক জমি, মসজিদ, মন্দির ও কবরস্থান রক্ষার জন্য একটি সমাবেশের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য মনোনীত করা হয় এবং একটি গণশুনানিতে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়।[৫]
ঘটনা
[সম্পাদনা]যখন এস. আলম গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ এবং সরকারের ক্রিয়াকলাপের প্রতিবাদে শত শত লোক জড়ো হয়, তখন দাবি উপেক্ষা করে এবং যথাযথ ক্ষতিপূরণ ছাড়াই স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণের হতাশার মধ্য দিয়ে ১১ই মার্চ, ২০১৬-এ বিক্ষোভ শেষ হয়। ১৯ মার্চের সমাবেশে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সদস্যরা জনতার ওপর গুলি চালায়। তবে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে তা সহিংস রূপ নেয়।[৪]
আন্দোলন তখনো অব্যাহত ছিল, এবং ২৩ মার্চের একটি জনসভায় প্রায় ৩০০০ জন লোকের উপস্থিতিতে তাদের দাবিগুলি বিবেচনা করা হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল।[৭] গণশুনানি সত্ত্বেও এস. আলম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের কর্মকর্তারা তাদের কাজ চালিয়ে যায়; ২ এপ্রিল, বেশ কয়েকজন প্রকৌশলী এবং একজন কোম্পানির পরিচালক প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন। বিক্ষোভকারীরা তাদের গাড়িবহরে হামলা চালায় এবং একটি সিএনজি চালিত অটোরিকশা ভাংচুর করে। এতে স্থানীয় বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয় এবং ২৪ ঘন্টার মধ্যে সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।[৮]
গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে, "আবাসস্থল ও কবরস্থান রক্ষা কমিটি" কর্তৃক ৪ এপ্রিল একটি সমাবেশের কথা ছিল। তবে সমাবেশ বানচাল করার জন্য, আওয়ামী লীগের সদস্যরা একই দিনে এবং একইন স্থানে একটি সভা নির্ধারণ করে এবং স্থানীয় পুলিশ জনসমাগম নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। [৮]
২০১৬-এর ৪ এপ্রিল প্রায় ৫০০ গ্রামবাসী ১৪৪ ধারা অমান্য করে পুলিশ ও সরকারের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সদস্যদের বহনকারী ৩০টি মোটরসাইকেল এসে বিক্ষোভকারীদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। বিক্ষোভকারীরা রাজি না হলে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সদস্যরা জনতার ওপর গুলি চালাতে থাকে। ঘটনাস্থলেই চারজন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও দুজন মারা যায়।[৮]
ফলাফল
[সম্পাদনা]৪ এপ্রিল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রধান বেগম খালেদা জিয়া এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সরকারের সমালোচনা করে একটি বিবৃতি দেন এবং দোষীদের চিহ্নিত করতে ও তাদের বিচারের আওতায় আনার জন্য সরকারকে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করার দাবি জানান।[৮] নিহতের প্রতিবাদে ছাত্র ঐক্য ফোরাম বাঁশখালীতে সাধারণ ধর্মঘট ঘোষণা করে এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পকে এই এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানায়। [৫] ৫ এপ্রিল চট্টগ্রামে বিক্ষোভ সমাবেশে তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ, বিদ্যুৎ ও বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতারা অবিলম্বে খুনিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবি জানান। CoalSwarm-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা টড নেইস-এর মতে, ২০১১ সালে ভারতে ঝাড়খণ্ডের কয়লা-বিরোধী বিক্ষোভের পর এটিই সবচেয়ে বড় প্রাণহানি।[৩] ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ দুটি কমিটি গঠন করে। পরে সুপ্রিম কোর্ট এস আলম গ্রুপকে নিহতদের পরিবার প্রতি ৫ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেন।[১১]
আরো দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "Bangladesh power plant protest: Four dead and three held"। BBC। ৪ এপ্রিল ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৪-০৬।
- ↑ বাঁশখালীতে শোকের মাতম। Manab Zamin। ৪ এপ্রিল ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৪-০৬।
- ↑ ক খ গ "Bangladesh coal plant protests continue after demonstrators killed"। The Guardian। ৭ এপ্রিল ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৪-০৮।
- ↑ ক খ গ বাঁশখালীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পবিরোধী মিছিলে গুলি। Jugantor। ১৯ মার্চ ২০১৬। ২০১৮-১২-২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৪-০৬।
- ↑ ক খ গ "Banshkhali locals vow to protect land"। ঢাকা ট্রিবিউন। ৬ এপ্রিল ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৪-০৬।
- ↑ ক খ গ "3,000 villagers prosecuted for Banshkhali killing"। New Age। ৪ এপ্রিল ২০১৬। ৬ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৪-০৬।
- ↑ ক খ বাঁশখালীতে পুলিশের গুলি : নিহত ৫। Jugantor। ৪ এপ্রিল ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৪-০৬।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ "4 killed in clash over setting up power plant"। দ্য ডেইলি স্টার। ৪ এপ্রিল ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৪-০৬।
- ↑ "Banshkhali firing: Relatives file 2 cases, cops sue 3,000"। দ্য ডেইলি স্টার। ৪ এপ্রিল ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৪-০৬।
- ↑ অভিজ্ঞতা ছাড়াই বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ পেল এস আলম গ্রুপ। Jugantor। ৪ এপ্রিল ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৪-০৬।
- ↑ "HC asks S Alam Group to pay Tk 500,000 each to families of Banshkhali shooting victims"।