বহুজন হিতায় বহুজন সুখায় চ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গৌতম বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের বহুজন সুখায় বহুজন হিতায় চ এই আদেশের অধীনে জনসাধারণের কল্যাণ ও সুখের জন্য কাজ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

বহুজন হিতায় বহুজন সুখায় চ ( সংস্কৃতে দেবনাগরী অক্ষরে - "बहुजन हिताय बहुजन सुखाय च") [১] সংস্কৃত ভাষায় রচিত  ঋগ্বেদে উল্লিখিত একটি সূত্র বা স্তোত্র [২]যার বাংলায় আক্ষরিক অর্থ হল- 'আরো বেশি মানুষের উপকারের জন্য' এবং আরও বেশি সংখ্যক মানুষের সুখের জন্য'।

মূলত, হিন্দুধর্মের যে পাঁচটি মৌলিক দার্শনিক ধারণার কথা বলা হয়েছে তার পঞ্চমটিই হল -"অনেকের কল্যাণ, অনেকের সুখ"। [৩]

খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে মহান দার্শনিক ও সংস্কারক গৌতম বুদ্ধ তার শিষ্যদের বেদের এই সূত্র অনুসরণ করে সাধারণ মানুষের কল্যাণ ও সুখের জন্য কাজ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। [৪] পরবর্তীতে ঊনবিংশ শতকে হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ [৫] [৬] এবং ভারতের জাতীয়তাবাদী, স্বাধীনতা সংগ্রামী ও দার্শনিক ঋষি অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখের ন্যায় অন্যান্য অসংখ্য ব্যক্তি স্ব স্ব বক্তব্যে এই একই ধারণা পোষণ করে কাজের নির্দেশ দিয়েছেন।

ভারতের জাতীয় বেতার সম্প্রচার মাধ্যম আকাশবাণী এই সূত্রটিকে নীতিবাক্য হিসাবে গণ্য করে [৭]

ব্যাখ্যা[সম্পাদনা]

চাণক্যের অর্থশাস্ত্র[সম্পাদনা]

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে মৌর্য সাম্রাজ্যের  স্থপতি বিষ্ণুগুপ্ত, যিনি চাণক্য বা কৌটিল্য নামে পরিচিত ছিলেন, মৌলিক অনুশাসনের উপর  তাত্ত্বিকভাবে জনপ্রশাসন সংক্রান্ত এক গ্রন্থ-  “কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র”  প্রবর্তন করেন। কৌটিল্যের দৃষ্টিভঙ্গিতে  মানুষের অগ্রগতির জন্য রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজনীয়তা এবং রাজ্যের শাসকের গৃহীত সমস্ত পদক্ষেপের বিশদ বিবরণ গ্রন্থটিত বিবৃত করা হয়েছে। হিন্দু দর্শনের প্রধান আজ্ঞার বিশদ বিবরণ- "বহুজন সুখায় , বহুজন হিতায়" অর্থাৎ  "জনগণের সুখের মধ্যেই জনকল্যাণ নিহিত" তা নিম্নলিখিত তত্ত্বে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল- [২]

সংস্কৃত শ্লোক :

"প্রজাসুখে সুখম রাজ্যঃ প্রজানাম তু হিতে হিতম্।

নাত্মপ্রিয়ম্ হিতম্ রাজ্যঃ প্রজানাম তু প্রিয়ম্ হিতম্।।"

অর্থাৎ -

প্রজাদের সুখে রাজার সুখ নিহিত, প্রজাদের কল্যাণে রাজার কল্যাণ।

শ্লোকটি মর্মার্থ হল এই  যে, রাজার নিজের সুখের কিছুই নেই। প্রজাদের সুখই রাজার সুখ এবং তার স্বার্থ প্রজাদের স্বার্থে। রাজার প্রিয় ও স্বার্থ কিছুই হয় না, প্রজাদের প্রিয় ও স্বার্থ রাজার প্রিয় ও স্বার্থ।।

হিন্দু ধর্মে[সম্পাদনা]

হিন্দুধর্মের ঐতিহ্যগত যে পাঁচটি মৌলিক ধারণা বা মতবাদ উল্লিখিত হয়েছে, তন্মধ্যে পঞ্চম ধারণা অনুসারে - "অনেকের কল্যাণ, অনেকের সুখ" মতবাদটির মধ্যে কিন্তু বিভিন্ন শ্রেণীর মাঝে দ্বন্দ্বের অনুমতি দেয় না ; বরং এই মর্মবাণীটি সমগ্র মানবজাতির মঙ্গলের জন্য, বিশেষকরে নিম্ন পদদলিত মানুষের জন্য। স্বামী বিবেকানন্দও বিভিন্ন সময়ে মানবজাতির জন্য সেই বার্তাই দিয়ে গেছেন। [৩]

বৌদ্ধ ধর্মে[সম্পাদনা]

হিন্দুধর্মের ঐতিহ্যগত যে পাঁচটি মৌলিক ধারণা বা মতবাদ উল্লিখিত হয়েছে, তন্মধ্যে পঞ্চম ধারণা অনুসারে - "অনেকের কল্যাণ, অনেকের সুখ" মতবাদটির মধ্যে কিন্তু বিভিন্ন শ্রেণীর মাঝে দ্বন্দ্বের অনুমতি দেয় না ; বরং এই মর্মবাণীটি সমগ্র মানবজাতির মঙ্গলের জন্য, বিশেষকরে নিম্ন পদদলিত মানুষের জন্য। স্বামী বিবেকানন্দও বিভিন্ন সময়ে মানবজাতির জন্য সেই বার্তাই দিয়ে গেছেন। [৪]

বিবেকানন্দের দৃষ্টিভঙ্গি[সম্পাদনা]

স্বামী বিবেকানন্দ স্তোত্রের এই শব্দবন্ধটির এক নান্দনিক দৃষ্টি দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন - যে ব্যক্তি আলোকিত, তিনি কখনও তার কর্মের জন্য ফল বা সুখ কামনা করেন না বরং অন্যের কল্যাণের জন্য কাজ করেন। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুন লন্ডন থেকে তিনি বলেছিলেন-

"আমার আদর্শকে অতি সংক্ষেপে প্রকাশ করা চলে, আর তা এই- মানুষের কাছে তার অন্তর্নিহিত দেবত্বের বাণী প্রচার করতে হবে এবং সব কাজে সেই দেবত্ব বিকাশের পন্থা নির্ধারণ করে দিতে হবে। কুসংস্কারের শৃঙ্খলে এই সংসার আবদ্ধ। যে উৎপীড়িত সে নর বা নারীই হোক তাকে আমি করুণা করি। আজ যে উৎপীড়নকারী, সে আমার আরও বেশি করুণার পাত্র। যাঁরা জগতে সবচেয়ে সাহসী ও বরেণ্য, তাঁদের চিরদিন 'বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়' আত্মবিসর্জন করতে হবে। অনন্ত প্রেম ও করুণা বুকে নিয়ে শত শত বুদ্ধের আবির্ভাব প্রয়োজনীয়। আমরা চাই জ্বালাময়ী বাণী এবং তার চেয়ে জ্বলন্ত কর্ম। হে মহাপ্রাণ, ওঠো, জাগো! জগৎ দুঃখে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। তোমার কী নিদ্রা সাজে?”

অল ইন্ডিয়া রেডিওর নীতিবাক্য[সম্পাদনা]

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ভারতের জাতীয় বেতার সম্প্রচার মাধ্যম-অল ইন্ডিয়া রেডিও তথা আকাশবাণী তাদের  সম্প্রচারে শিক্ষা, তথ্য বা বিনোদনের বিষয়বস্তু প্রধানত   জনসাধারণের সেবা  ও উন্নতির লক্ষ্যেই নির্দিষ্ট। সেকারণেই তাদের নীতিবাক্য হিসাবে উল্লিখিত 'বহুজন হিতায় : বহুজন সুখায়'  সূত্রটির নির্বাচন যথাযথ ও প্রাসঙ্গিক।  বিশ্বের বৃহত্তম সম্প্রচার সংস্থার প্রতীকের মাঝে নীতিবাক্যটি প্রকাশমান [৭]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Coleman 1973
  2. "Governance in Classic India" (পিডিএফ)। Transparency India organization। পৃষ্ঠা 13। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল (PDF) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৩ 
  3. Singh 1999
  4. Madan 1999
  5. Vivekananda 1993
  6. Ghosh 2008
  7. "All India Radio"। Official government website of All India Radio। ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৩