ভাওনা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ভাওনাতে দুজন ভাবরীয়া এবং নামঘরের দর্শক

আসাম-এর সর্বতোকালের সর্বোত্তম মহাপুরুষ শ্রীমন্ত শংকরদেব-এর অনুপম সৃষ্টি অংকীয়া নাট ভাওনা।[১] শ্রীমন্ত শংকরদেব এবং মাধবদেব রচনা করা নাটসমূহকে 'অংকীয়া নাট' আখ্যা দেয়া হয়। মহাপুরুষ দুজনই তাদের রচনা করা নাটসমূহকে যাত্রা ঝুমুর বলেছিলেন। পরবর্তী কালে কোনো কোনো বৈষ্ণব ভকত একে অংকীয়া নাট বলে নামকরণ করে। ভাওনা শব্দের প্রকৃত অর্থ ভাব দিয়ে দেখানো কার্য। অংকীয়া নাটের অভিনয়কেই দরাচলে ভাওনা বলা হয়। বর্তমান এমন নাটকে ভাওনা বলা হয় এবং রচনা কার্যকে নাট-কাটা বা নাট-লেখা বলা হয়।

উদ্দেশ্য[সম্পাদনা]

মহাপুরুষ শংকরদেবের নাটকর্মের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে ধর্ম প্রচার মোক্ষপ্রাপ্তি এবং কামনা পূরণ। শংকরদেব-এর নাট-এর প্রথম নান্দী শ্লোক-এর পরে সূত্রধার-এর শ্লোক এবং সূত্র-এর উক্তিগুলি থেকে এই কথা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।[২] সেই সময়ের নিরক্ষর জনসাধারণ ধর্মের কথাগুলি যাতে সহজে উপলব্ধি করতে পারে তার জন্য শাস্ত্র পাঠ এবং মৌখিক উপদেশ দিয়ে নাটাভিনয় অধিক ফলপ্রদ উপায় ছিল। সেজন্য তিনি সংস্কৃতির দিকে লোকব্যঞ্জক আহিলা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন অংকীয়া নাট-এর প্রদর্শন অর্থাৎ ভাওনাকে। ভাগবত পুরাণ ছাড়াও সমসাময়িক ভারতীয় লোক নাটক, সংস্কৃত নাটক এবং আসামে আগে থেকে চলতে আসা ওঝাপালি, পুতুল নাচ ইত্যাদি লোক পরিবেশন কলা থেকে সমল সংগ্রহ করে শংকরদেব অংকীয়া নাট রচনা করেছিলেনেন। লোক শিক্ষার সহজ এবং কার্যকরী উপায় হিসাবে গুরুজনই নাটাভিনয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন এবং তৎকার্যে সফলও হয়েছিলেন। ভাওনার সঙ্গে সম্বন্ধ না থাকা, আগে ভাওনা না দেখা সমাজটির লোকদের শিখিয়ে-বুঝিয়ে, নিজে নাট কেটে, বাদ্যযন্ত্র প্রস্তুত, আহার্য রংবরণক ইত্যাদি করে ভাওনা প্রদর্শন অব্দি যাবতীয় কাজ-কর্ম শংকরদেবকে নিজেই করতে হয়েছিল।[৩][৪]

ধর্মীয় বিশ্বাস[সম্পাদনা]

ভাওনার আগেরদিন একভাগ শরাই-শলিতা দিয়ে মাস-প্রসাদে নামঘরে প্রার্থনা জানানো হয়। গায়ন-বায়ন, সূত্রধার এবং শ্রীকৃষ্ণ-এর ভাও নেওয়ারা আগের দিন উপবাসে থেকে পরের দিন লঘু আহার গ্রহণ করে দিনে জনতার নাম-কীর্তনে অংশগ্রহণ করে নামের পরে আশীর্বাদ গ্রহণ করে। ভাওনার দিন সত্র বা রাজকীয় নামঘরে একটি পবিত্র অনুষ্ঠানরূপে পালন করা হয়।[২]

বৈশিষ্ট্য[সম্পাদনা]

  1. সূত্রধার : সূত্রধারজন সংস্কৃত নাটক, পুতলা নাচ বা ওজাপালির ওঝার অনুরূপ হলেও শংকরদেব নাটের সূত্রধার সুকীয়া। সূত্রধারকে কুশল অভিনেতা, গীতি-বাদ্য-নাট বিশারদ এবং সুপরিচালক হিসাবে গুরু জানিয়ে তাঁর নাটে স্থান দিয়েছেন।
  2. দ্বিতীয় গীতি-শ্লোক এবং পয়ারের প্রয়োগ
  3. ব্রজবুলি ভাষার ব্যবহার
  4. লয়যুক্ত গদ্য প্রয়োগ
  5. সংস্কৃত শ্লোক-এর ব্যবহার[২]

বর্ণনা[সম্পাদনা]

শংকরদেব তাঁর নাটকে নাট, নাটক এবং যাত্রা শব্দগুলির ব্যবহার করেছেন। মাধবদেব-এর নাটকে ঝুমুরা, যাত্রা ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার হয়েছিল। সুখ-দুঃখের উৎপত্তি দেখানো এবং শৃঙ্গার ইত্যাদি রসের পরিপূর্ণতাই নাটের বিষয়বস্তু যদিও সাত্ত্বিক অভিনয়ই মূল কথা।[২] ‘অংকো বা ‘অংকীয়া নাট’ কথাটি পরে চরিতকাররাই ব্যবহার করেছেন। নাটের বিভিন্ন বিভাগগুলিকে ‘অংকো' বলা হয়।[২]

ভরত মুনির মতে রূপক দশ রকম এবং উপরূপক আঠার রকম। রূপকের অংক বা উৎসৃষ্টিকাংক এবং উপরূপকের হল্লীসের সঙ্গে অংকীয়া নাটের কিছু সাদৃশ্য আছে। কিন্তু মূল লক্ষণগুলির ক্ষেত্রে যথেষ্ট অমিলও আছে। অংকীয়া নাট এক অংক বিশিষ্ট নাট বলা হয়। ভাওনা হল নাট্য, নৃত্ত এবং নৃত্যের সমাহার। নৃত্ত এবং নৃত্য হল মুকাভিনয় কিন্তু শ্লোক, বচন, গীতি, পয়ারের সাথে সাথে নৃত্য বা নাচের চাল-চলন, মুদ্রা ইত্যাদিও থাকে।[২]

পুতনার চরিত্রে একজন ভাবরীয়া

ভাওনার শ্লোক, অপিচ এবং সূত্রধারের বচনের ওপর সম্পূর্ণ পরিচালনার ভার সূত্রধারের।[৫] গীতি-পদ-রাগ-তালের কর্ত্তব্যটি গায়ন-বায়নের ওপর নির্ভর করে। গীতি-নৃত্যে মহিলা, ঋষি-মুনিদের প্রবেশ হয়। ভাবরীয়া প্রবেশে সূত্রধার, কৃষ্ণ বা রাম-এর, রাজা-মহারাজা, মন্ত্রী-যুবরাজ, সৈন্যদের, অসুরদের, রাক্ষস-রাক্ষসীদের এবং দূতের প্রবেশ-প্রস্থানে খোল-এর চেও আলাদা আলাদা। ভাওনার আরম্ভতে গায়ন-বায়নের জোরাগাওয়া পর্বটি অতি গুরুত্বপূর্ণ।[২]

ভাওনার দিন কীর্তনঘর, নামঘর, নাটঘর বা উন্মুক্ত মঞ্চ পরিষ্কার করে, কলাপুলি রুইয়ে সাজিয়ে পরিয়ে সুন্দর পরিবেশ গড়ে তোলা হয়। সূত্রধার প্রবেশের আগে নয় গাছি বাতি ‘অগ্নিগড়’’ প্রবেশ পথে দুজন ধরে রাখে এবং আঁড়-কাপড় ধরে সূত্রের প্রবেশের সাথে সাথে মহতা জ্বালিয়ে (সূত্রধারের আগে একটি এবং পরে একটি) কীর্তন বা রভাঘর খালি করে রাখে। তেমনভাবে কৃষ্ণ, রাম বা বিশেষ রাজার প্রবেশেও আঁড়-কাপড় ধরে। বাতি, মহতা বা আঁড়িয়াগুলি মিঠাতেল দ্বারা জ্বালানো হয়।[২]

অগ্নিগড়ের নয় গাছি বাতি হল নয় ধরনের ভক্তির প্রতীক। কখনো কখনো রাজা-মন্ত্রীর প্রবেশে ফুলঝুরি জ্বালানো হয়। সেইগুলি য-খার, বগরীর এঙার, বাহক তিতার এঙার গুড়ো করে তৈরি করা হত।[২]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Dilip Ranjan Barthakur (২০০৩)। The Music And Musical Instruments Of North Eastern India। Mittal Publications। পৃষ্ঠা 11–। আইএসবিএন 978-81-7099-881-5। সংগ্রহের তারিখ ১৯ ডিসেম্বর ২০১২ 
  2. ভাওনা: লোহিত চন্দ্র দেবগোস্বামী, রামধনু, দৈনিক আসাম, ২৬ মে’ ২০১২
  3. গোলাপ মহন্ত (জানুয়ারি, ২০০৩)। ভাওনা দর্পন। যোরহাট জেলা: সংকলন কোষ সমিতি, ন-আলি ঢেকিয়াজুলি; যোরহাট জেলা। পৃষ্ঠা ৪০, ৪১ পৃষ্ঠা।  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  4. <biographical/শিরোনাম= মহাপুরুষ শ্রীমন্ত শংকরদেব।author link= নবীন চন্দ্র শর্মা।
  5. S. Gajrani (১ সেপ্টেম্বর ২০০৪)। History, Religion & Culture of India। Gyan Publishing House। পৃষ্ঠা 113–। আইএসবিএন 978-81-8205-065-5। সংগ্রহের তারিখ ২০ ডিসেম্বর ২০১২