খয়রাবিড়া

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

খয়রাবিড়া
Dark-branded bushbrown
ডানা বন্ধ অবস্থায়
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ: প্রাণীজগৎ
পর্ব: সন্ধিপদী
শ্রেণী: পতঙ্গ
বর্গ: লেপিডোপ্টেরা
পরিবার: Nymphalidae
গণ: Mycalesis
প্রজাতি: M. mineus
দ্বিপদী নাম
Mycalesis mineus
(Linnaeus, 1758)

খয়রাবিড়া[১] (বৈজ্ঞানিক নাম: Mycalesis mineus (Linnaeus)) প্রজাতি নিমফ্যালিডি (Nymphalidae) গোত্র ও 'স্যাটিরিনি' (Satyrinae) উপ-গোত্রের অন্তর্ভুক্ত প্রজাপতি।

আকার[সম্পাদনা]

খয়রাবিড়া প্রসারিত অবস্থায় ডানার আকার ৪৫-৫০ মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের হয়।[২]

বিস্তৃতি[সম্পাদনা]

ভারত (ভারতীয় উপ-দ্বীপ মুম্বাই পর্যন্ত, মধ্য প্রদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গ, হিমাচল প্রদেশ থেকে অরুণাচল প্রদেশউত্তর-পূর্ব ভারত), নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, মালয় এবং চীন সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এর বিভিন্ন অঞ্চলে এদের পাওয়া যায়।[২][৩]

বর্ণনা:[সম্পাদনা]

প্রজাপতির দেহাংশের পরিচয় বিশদ জানার জন্য প্রজাপতির দেহ এবং ডানার অংশের নির্দেশিকা দেখুন:

বিভিন্ন বুশব্রাউন প্রজাতির সনাক্তকরণ ও পৃথকীকরণ বেশ ঝামেলার বিষয়। প্রথমত, শুষ্ক ঋতুরূপে এদের একটির থেকে অপরটিকে আলাদা করা খুবই দুষ্কর, কারণ এই সময় চক্ষুবিন্দুগুলির (Ocilleus) প্রায় কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চক্ষুবিন্দুগুলি অস্পষ্ট ফোঁটার আকার ধারণ করে; অনেকক্ষেত্রে আবার ফোঁটাগুলিও অদৃশ্য হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, আর্দ্র ঋতুরূপেও প্রায়শই একই প্রজাতির চক্ষুবিন্দুর সংখ্যা ও আকৃতির হেরফের ঘটে। বিভিন্ন বুশব্রাউন প্রজাতিকে সাধারণ দর্শনে ও চটজলদি চিনে ফেলার উপায়গুলো চক্ষুবিন্দুগুলির বিন্যাসের ভিত্তিতেই তৈরী।[৪]

জংলাবিড়া (Mycalesis perseus) প্রজাতির থেকে খয়রাবিড়া প্রজাতিকে আলাদা করা যায় পিছনের ডানার নিম্নতলের চক্ষুবিন্দুগুলির সারির বিন্যাস থেকে খয়রাবিড়া-এর ক্ষেত্রে একেবারে ভুমিকোন থেকে হিসাব করলে পরপর ৫ টি চক্ষুবিন্দু (ocelli) একই সরলরেখায় থাকে। কিন্তু জংলাবিড়া এর ক্ষেত্রে একদম নিচ থেকে ৪ নং চক্ষুবিন্দুটি সামান্য বাইরের দিক ঘেঁষে অবস্থিত। 'চোখ'- চিহ্ন ছাড়াও বুশব্রাউনদের নিজেদের মধ্যে প্রায়শ আলাদা করা হয় পুরুষটির ডানায় গন্ধরোঁয়ার উপস্থিতি এবং ব্র্যান্ড বা গন্ধতিলকের রং ও মাপ থেকে।তাঁতরাবিরা-এর (Mycalesis visala) ডানায় গন্ধতিলকটি লম্বা চুরুটের মতো, হালকা হলুদ বেশ বড় মাপের ও পাশের দিকে ডিসকাল সাদা রেখা অবধি বিস্তৃত। সেই তুলনায়, তাঁতরাবিরা (Mycalesis mineus)-এর গন্ধতিলকটি ছোট, হালকা পীতাভ বর্ণের। ফনা অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল এবং মিনা হরিবল এই গন্ধতিলকের রং স্যামন পিঙ্ক এবং সামান্য খয়েরী যুক্ত বলে উল্লেখ করেছেন।[৪]

আর্দ্র ঋতুরূপ:[সম্পাদনা]

ডানার উপরিতল কালচে বা কালচে বাদামি বা বাদামি-খয়েরী। সামনের ডানায় ২ নং শিরামধ্যে (inter-space) একটি সাদা তারাবিন্দু যুক্ত (single-pupled) কালচে খয়েরী বা কালো চক্ষুবিন্দু (ocelli) বর্তমান যেটি একটি ফ্যাকাশে চারকোনা অঞ্চলের মধ্যে ঘেরা। চারকোনা অঞ্চলটির দুপাশ-অর্থাৎ ডানার বাইরের ও ভিতরের দিকে থাকা দুটি সীমা স্পষ্ট সরলরেখা দ্বারা চিহ্নিত এবং উপর ও নিচ ক্রমশ গাঢ় হয়ে ডানার বাকি অংশের সাথে মিশে গেছে। কিছুকিছু নমুনাতে কদাচিৎ ৫ নং শিরামধ্যে অনুরূপ একটি ছোট চক্ষুবিন্দু লক্ষ্য করা যায়। পিছনের গোলাকৃতি ডানা সাধারণত চক্ষুবিন্দু হীন, তবে মাঝেমধ্যে কোনো কোনো নমুনাতে ডানার মধ্যভাগের সামান্য বাইরের দিকে দু-তিনটি অস্পষ্ট চক্ষুবিন্দু চোখে পড়তে পারে ।উভয় ডানাতেই শীর্ষভাগ (apex) থেকে টরনাস পর্যন্ত বিস্তৃত সরু ফ্যাকাশে সাদা টার্মিনাল ও সাব-টার্মিনাল রেখা বিদ্যমান। সিলিয়া বা প্রান্ত-রোঁয়া ফ্যাকাশে সাদা।

ডানার নিম্নতলের বর্ণ উপরিতলের অনুরূপ। উভয় ডানাতেই কোস্টার নিচ থেকে টরনাসের উপর পর্যন্ত বিস্তৃত একটি সাদা সরু ডিসকাল রেখা বর্তমান যার ভিতরের কিনারা সুস্পষ্ট ও বহিঃকিনারা অস্পষ্ট। ডানা বন্ধ অবস্থায় বসে থাকার সময় সামনের ও পিছনের ডানার সাদা রেখা দুটি মিলে একটি টানা রেখা তৈরী হয় সামনের ডানার কোস্টার নিচ থেকে পিছনের ডানার টরনাসের উপর পর্যন্ত। টার্মিনাল ও সাব-টার্মিনাল রেখা দুটি উপরিতলেরই অনুরূপ। সামনের ডানায় ২-৪টি ও পিছনের ডানায় সাধারণত ৭ টি (কখনো ৫ টি) ছোট-বড় পোস্ট-ডিসকাল চক্ষুবিন্দু বর্তমান; প্রি-এপিক্যাল চক্ষুবিন্দুদুটি কোনোকোনো নমুনাতে অদৃশ্য থাকে। সমস্ত চক্ষুবিন্দুগুলি সাদা তারা-রন্ধ্র যুক্ত ও কালো এবং ধূসর-হলুদ বলয়াবৃত ।উভয় ডানাতেই চক্ষুবিন্দুর সারি ভিতরদিকে ও বাইরেরদিকে ময়লাটে সাদা সরু একাধিক আঁকাবাঁকা রেখার বেষ্টনীতে আবদ্ধ। টার্মিনাল ও সাব-টার্মিনাল রেখা ফ্য্যকাশে সাদা বা ঈষৎ গোলাপি সাদা ও আঁকাবাঁকা। পুরুষের ডানায় গন্ধরোঁয়া ও গন্ধতিলক দুই-ই দেখা যায়।

স্ত্রী-পুরুষ প্রকার অনুরূপ। শুঙ্গ বাদামি, কালো ডোরাযুক্ত; শীর্ষভাগ কালো বা কালচে বাদামি ও তার নিচে খানিক হলুদের ছাপযুক্ত। মাথা, বক্ষদেশ ও উদর উভয়পৃষ্ঠেই বাদামি বা কালচে বাদামি।[৫]

শুষ্ক ঋতুরূপ:[সম্পাদনা]

শুষ্করূপে ডানার উপরিতল আর্দ্র ঋতুরূপের অনুরূপ, তবে অধিকতর ফ্যাকাশে ।তবে সামনের ডানার মধ্যবর্তী চক্ষুবিন্দুটি সাধারণত ক্ষুদ্রতর ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে লুপ্ত। ডানার নিম্নতল বাদামি, কমবেশি হালকা বেগুনির ছোঁয়া যুক্ত ও কালচে বাদামি ছোটছোট তির্যক সরু দাগে ছাওয়া। ডিসকাল রেখাটি খুবই অস্পষ্ট;- কখনো কালো ছোট দাগ দ্বারা চিহ্নিত, আবার কখনো লালচে-হলুদ অস্পষ্ট বন্ধনী দ্বারা সীমায়িত (bordered)। চক্ষুবিন্দুগুলি মিলিয়ে গিয়ে ক্ষুদ্র কালো বিন্দুর আকার ধারণ করে। স্ত্রী ও পুরুষ প্রকার অনুরূপ।[৫][৬]

আচরণ[সম্পাদনা]

সুলভ দর্শন এই প্রজাতির উড়ান ধীর, দুর্বল ও ঝাঁকি দিয়ে ওড়ার প্রবণতা যুক্ত। এরা মাটির কাছাকাছি নীচ দিয়ে ওড়ে। ওপর-নীচ ডানা ঝাঁকি দেবার ভঙ্গিতে ওড়ে। এদের স্বভাব ও পছন্দের বাসভূমি জংলাবিড়া প্রজাতির অনুরূপ। এই প্রজাতি গাছপালা ছাওয়া ঝোপঝাড়ের আশেপাশে অবস্থান করে। অন্যান্য ঝোপঝাড় পূর্ণ অংশেও জংলা পরিবেশে এদের দেখা যেতে পারে, তবে উন্মুক্ত স্থানে এদের দর্শন মেলে না। এরা পাতা, ডাল বা গাছের কান্ডে বসে রোদ পোহায় সকালের দিকে। মুখ্যত ডানা বন্ধ অবস্থাতেই এই প্রজাতিকে রোদ পোহাতে দেখা যায়, ডানা মেলে খুবই কম বসে। পশু-পাখির বিষ্ঠা, অতিপক্ক ও পচা ফল, ভিজেমাটি বা পাথরের ভিজে ছোপে বসে খ্যাদ্যরস আহরণ করতে এদের প্রায়ই চোখে পড়ে। ইহারা মূলত সকাল, পড়ন্ত বিকেল ও সন্ধ্যার সময় সক্রিয় হয়। পার্বত্য জঙ্গল ও সমতলের জংলা জায়গা-উভয় পরিবেশেই এই প্রজাতির দর্শন মেলে প্রায় সারা বছরই। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে ১৫০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত জংলা পরিবেশে এদের বিচরণ চোখে পরে।[৭]

বৈশিষ্ট্য[সম্পাদনা]

ডিম[সম্পাদনা]

ডিম ময়লাটে সাদা, অর্ধস্বচ্ছ (লিচুর শাঁসের মতন রং)।পাতার নিচের পিঠে ডিম পারে।[৮]

শূককীট[সম্পাদনা]

শুককীট প্রথম দিকে সবুজ এবং গায়ে খুব সুক্ষ রোঁয়া ও অর্বুদ যুক্ত। শরীর সামনে পেছনে সরু ও লেজ দু'ভাগে ভাগ করা। মাথা কালো ও দুটি কাঁটাওয়ালা (spine) খুব ছোট শিং যুক্ত। ধীরে ধীরে শুককীটের গায়ে খয়েরীর ভাব আসতে থাকে; শেষ দশায় (instar) রং মোটামুটি হালকা খয়েরী-শুকনো ঘাসের মতো যদিও সবুজের আভা একেবারে মুছে যায় না। পিঠের উপর ও পাশের দিকে তুলনায় গাঢ় রঙের তির্যক অনেকগুলি রেখা পরস্পর কাটাকুটি করে অনেকটা বরফির মতো ছক তৈরী করেছে।[৯][১০]

শুককীট খাওয়া শুরু করে ঘাসের ফলকের ধার থেকে;- কখনো পুরোটা খেয়ে শেষ না করে অন্য ঘাসে চলে যায়, আবার কখনো প্রায় পুরো ঘাসটাই মুড়িয়ে খেয়ে ফেলে। পাতার নিচের তলে পাতার শিরার সাথে শরীর মিলিয়ে বসে থেকে দিনের বেলায়। রাতের বেলায় আহার শুরু করে।[৮]

আহার্য উদ্ভিদ[সম্পাদনা]

মূককীট[সম্পাদনা]

মুককীট ঘাসরঙা সবুজ ও আকৃতি অনেকটা কাঁচা আমের মতো। বক্ষদেশে পিঠের দিকে একটা ঢিবির মতো অংশ আছে এবং উদরও পিঠের দিকে বেশ স্ফীত। ঘাসের ডাঁটির গায়ে মুককীটটি ঝুলে থাকে।[৮]

জীবনচক্রের চিত্রশালা[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. A Pictorial Guide Butterflies of Gorumara National Park (2013 সংস্করণ)। Department of Forests Government of West Bengal। পৃষ্ঠা ১৯৬। 
  2. Isaac, Kehimkar (২০০৮)। The book of Indian Butterflies (ইংরেজি ভাষায়) (1st সংস্করণ)। নতুন দিল্লি: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস। পৃষ্ঠা ৩৪০। আইএসবিএন 978 019569620 2 
  3. R.K., Varshney; Smetacek, Peter (২০১৫)। A Synoptic Catalogue of the Butterflies of India। New Delhi: Butterfly Research Centre, Bhimtal & Indinov Publishing, New Delhi। পৃষ্ঠা 174। আইএসবিএন 978-81-929826-4-9ডিওআই:10.13140/RG.2.1.3966.2164 
  4. Wynter-Blyth, M.A. (1957) Butterflies of the Indian Region, pg ৮৫.
  5. Bingham, Charles Thomas (১৯০৫)। Fauna of British India. Butterflies Vol. 1। পৃষ্ঠা 58। |}}
  6. Moore, Frederic (১৮৯০–১৮৯২)। Lepidoptera Indica. Vol. I। London: Lovell Reeve and Co.। পৃষ্ঠা 183–187। |}}
  7. Kunte, Krushnamegh (২০১৩)। Butterflies of The Garo Hills। Dehradun: Samrakshan Trust, Titli Trust and Indian Foundation of Butterflies। পৃষ্ঠা ১৩১। 
  8. দাশগুপ্ত, যুধাজিৎ (২০০৬)। পশ্চিমবঙ্গের প্রজাপ্রতি (১ম সংস্করণ সংস্করণ)। কলকাতা: আনন্দ। পৃষ্ঠা ১২৩। আইএসবিএন 81-7756-558-3 
  9. Life History of Dark Brand Bush Brown, Butterflies of Singapore
  10. "Mycalesis Hübner, 1818" at Markku Savela's Lepidoptera and Some Other Life Forms