গহনা বড়ি
গহনা বড়ি, ভাজার আগে ও পরে | |
প্রকার | বড়িজাতীয় খাবার |
---|---|
উৎপত্তিস্থল | ভারত |
অঞ্চল বা রাজ্য | পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ |
প্রস্তুতকারী | বহু শতাব্দী প্রাচীন একটি কুটির শিল্প যা সাধারণত বাড়ির মহিলারা প্রস্তুত করে থাকেন |
পরিবেশন | সাধারণ তাপমাত্রা |
প্রধান উপকরণ | বিউলির ডাল, পোস্ত ও বিভিন্ন ধরনের মশলা |
গহনা বড়ি পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় প্রস্তুত একটি অতি জনপ্রিয় খাদ্য। এটি নকশা বড়ি নামেও পরিচিত। এটি বিউলির ডাল, পোস্ত ও বিভিন্ন ধরনের মশলার মিশ্রণে প্রস্তুত এবং গহনার মত সূক্ষ্ম নকশা সমন্নিত অতি দৃষ্টিনন্দন একপ্রকার বড়িবিশেষ।[১] গহনা বড়ি বহু শতাব্দী প্রাচীন একটি কুটির শিল্প যা সাধারণত বাড়ির মহিলারা প্রস্তুত করে থাকেন। আধুনিক কালে বাংলা বিশিষ্ট মনিষীগণ এই শিল্পের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ২০১৬ সালে আই আই টি খড়গপুর গহনা বড়ির ভৌগোলিক উপদর্শন শংসাপত্রের আবেদন প্রক্রিয়া শুরু করেছে।[২]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]গহনা বড়ির ইতিহাস বহু শতাব্দী প্রাচীন। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আগমনের আগে গহনা বড়ি প্রস্তুতিতে পোস্তর প্রচলন ছিল না। পলাশীর যুদ্ধের পরে, ব্রিটিশরা বেআইনি আফিমের এক বিশাল বাজার আবিষ্কার করে চীনে। ব্রিটিশরা তখন বাংলার রাঢ় অঞ্চলের চাষীদের পোস্ত চাষে বাধ্য করে এবং তার থেকে বিপুল পরিমাণ আফিম নিষ্কাশন করে তা চীনে পাচার করতে শুরু করে। আফিম নিষ্কাশনের পর পোস্তর বীজ ফেলে দেওয়া হত। ক্রমে পোস্তর বীজ বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান ও মেদিনীপুর জেলার রান্নার উপাদান হয়ে ওঠে। মেদিনীপুরে গহনা বড়িতে পোস্ত দানার ব্যবহার শুরু হয়।[৩]
১৯৩০ সালে সেবা মাইতি নামে শান্তিনিকেতনের এক ছাত্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তার মা হিরন্ময়ী দেবী ও ঠাকুমা শরতকুমারী দেবীর তৈরী গহনা বড়ি উপহার দেন। রবীন্দ্রনাথ গহনা বড়ির শিল্পকলা দেখে এতটাই আকৃষ্ট হন যে তিনি গহনা বড়িগুলির আলোকচিত্র শান্তিনিকতনের কলা ভবনে সংরক্ষণ করার অনুমতি চেয়ে হিরণ্ময়ী দেবী ও শরতকুমারী দেবীকে চিঠি লেখেন।[৪] এর ফলে গহনা বড়ি চারুকলার নিদর্শন হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর গহনা বড়িকে শিল্প বলেই মনে করতেন, তাকে রান্না করা বা খাওয়াকে শিল্পকর্ম ধ্বংসের সামিল বলে মনে করতেন।[৪] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও একদা বলেছিলেন, গহনা বড়ি শুধুমাত্র দেখার জন্য, খাওয়ার জন্য নয়। তিনি গহনা বড়ির শিল্পকর্মের সাথে মধ্য এশিয়ার খোটানে আবিষ্কৃত প্রত্নতত্ত্বের শিল্পকর্মের সাদৃশ্য খুঁজে পান এবং গহনা বড়ির প্রদর্শনীর যথাযথ ব্যবস্থা করেন।[৪] নন্দলাল বসু গহনা বড়িকে বাংলা মায়ের গয়নার বাক্সের একটি রত্ন বলে বর্ণনা করেন। তিনি গহনা বড়ির উপর একটি বই প্রকাশ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।[৪]
১৯৫৪ সালে কল্যাণীতে অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ৫৯তম অধিবেশনে গহনা বড়ি প্রদর্শিত হয়।[৪] ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন বিভাগ আয়োজিত খাদ্য উৎসবে অংশগ্রহণ করেন তমলুকের গহনা বড়ি প্রস্তুতকারী মহিলারা।[৫] তারা কলকাতা ময়দানে হাজার হাজার কৌতূহলী নরনারীর সামনে গহনা বড়ি প্রস্তুত করে দেখান। আকাশবাণী, দূরদর্শন ও পত্রপত্রিকাগুলো গহনা বড়ির কথা প্রচার করে।[৫] ১৯৯৫ সালে গহনা বড়ির বিপণনের জন্য তমলুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পরবর্তীকালে পূর্ব মেদিনীপুরের কিছু কিছু গ্রামে এই প্রকার ব্যবসায়ভিত্তিক সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।[৫]
প্রস্তুত পদ্ধতি
[সম্পাদনা]গহনা বড়ির মূল উপকরণ বিউলি ডাল ও পোস্ত। বিউলি ডালকে অঞ্চলভেদে বিরিকলাইও বলা হয়। এছাড়া লাগে সামান্য তেল। রঙীন বা মশলাদার বড়ির জন্য প্রয়োজন বাড়তি উপকরণ। গহনা বড়ি সাধারণতঃ কাঁসার থালায় দেওয়া হয়। বড়ি দেওয়ার জন্য লাগে একটি মাঝারি আকারের রুমালের মত একটুকরো মোটা কাপড়, যার মাঝখানে থাকে একটি বৃত্তাকার ছিদ্র। ছিদ্রটিকে প্রকৃত বৃত্তাকার রাখার জন্য বৃত্তের পরিধি বরাবর সেলাই করে নেওয়া হয়। এই কাপড়কে পুঁটলি বলা হয়। কোনো কোনো জায়গায় ওই ছিদ্রের মধ্য দিয়ে গলিয়ে দেওয়া হয় একটি ধাতব চোঙ যাকে বলা হয় চোঙপুঁটুলী। এছাড়া লাগে একটি নারকেল পাতার একটি পরিষ্কার কাঠি।[৬]
গহনা বড়ি তৈরী হয় শীতকালে। কার্তিক মাসের পোড়া অষ্টমীর দিন বড়ি দেওয়ার শুভ সূচনা হয়। বড়ি দেওয়ার দিন বাড়ির মহিলারার স্নান করে, পরিষ্কার কাচা কাপড় পরে শুদ্ধ হয়ে গহনা বড়ির প্রস্তুতিতে হাত দেন। বড়ি দেওয়ার আগের দিন সন্ধ্যায় ভাঙা বিরিকলাই জলে ভেজাতে দেওয়া হয়। সারা রাত জলে ভেজার পর বিরিকলাইগুলো ফুলে ওঠে। পরের দিন ভোরবেলা বিরিকলাইগুলো ধুয়ে তার থেকে খোসাগুলো ছাড়িয়ে ফেলে দেওয়া হয় যাতে বড়ি কালো না হয়ে যায়। তারপরে বিরিকলাইগুলো শিলনোড়ায় মিহি করে বাঁটা হয়। এরপর বাঁটা বিরিকলাইকে একটা বড় গামলায় ফেটাতে হয়। যত বেশি এবং যত ভালো ফেটানো হবে বড়ি তত মুচমুচে ও সুস্বাদু হবে। ফেটানোর গুণমান যাচাই করার জন্য খানিকক্ষণ ফেটানোর পর একটু লেই জলে ফেলে দেখা হয় ডুবে যাচ্ছে কি না। যতক্ষণ না লেই জলে ভেসে থাকার মত হালকা হয় ততক্ষণ ফেটানো চালিয়ে যাওয়া হয়। ফেটানোর পর লেই হালকা হলেও যতক্ষণ না তা দিয়ে বড়ি দেওয়া হচ্ছে ততক্ষণ লেইকে অনবরত ফেটিয়ে যেতে হয়। সেই জন্য গহনা বড়ি দেওয়ার জন্য অন্ততপক্ষে দু'জন লাগে।
একটি কাপড় তেলে ভিজিয়ে সেই কাপড় আলতো করে বুলিয়ে নেওয়া হয় কাঁসার থালার উপর, এমনভাবে যে থালায় যে তেল বুলোনো আছে তা বোঝা না যায়। তারপর থালার উপর বিছিয়ে দেওয়া হয় পোস্তর একটি আস্তরণ যাতে থালাটি আর দেখা না যায়। এবার বড়ি দেওয়ার পালা। যিনি বড়ি দেন তার এক হাতে থাকে পুঁটলি ও আর এক হাতে কাঠি। তিনি পুঁটলিতে একটু করে লেই নিয়ে হাতের চাপে পুঁটলির ছিদ্র দিয়ে লেইয়ের একটি সরু ধারা নিঃসরণ করান। তারপর শৈল্পিক দক্ষতায় কাঁসার থালার উপর সৃষ্টি করেন অপূর্ব নকশা সমন্বিত বড়ি। এক একটি বড়ির প্যাঁচ শেষ হয়ে গেলে লেইয়ের ধারাটিকে অন্য হাতে ধরা কাঠি দিয়ে কেটে পরের বড়িটি দেওয়া শুরু করেন। এটি অত্যন্ত দক্ষ হাতে করতে হয় যাতে বড়ি দেওয়া হয়ে গেলে বোঝা না যায় বড়ির প্যাঁচের শুরু আর শেষটা কোথায়। বড়ি দেওয়ার সময় নকশায় সামান্য ত্রুটি হয়ে গেলে বা রেখা জুড়ে গেলে তা কাঠি দিয়ে ঠিক করে দেওয়া হয়। রঙীন বড়ির ক্ষেত্রে প্রত্যেকটা রঙের জন্য পৃথক পাত্রে লেই প্রস্তুত করা হয়, এবং প্রত্যেক রঙের জন্য পৃথক পুঁটলি ব্যবহার করা হয়।
বড়ি শোকানোর জন্য প্রয়োজন শীতের সকালের হালকা রোদ। কড়া রোদে বড়ি ভেঙে যায়। সেই জন্য রোদ জোরালো হলে বড়িগুলোকে হালকা আচ্ছাদন দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এক দিক ভালো করে শুকিয়ে গেলে বড়িগুলো উল্টে দেওয়া হয়। রোদে শুকিয়ে যাওয়ার পর বড়িগুলোকে কৌটোবন্দী করে ফেলা হয়।
বিবরণ
[সম্পাদনা]শিল্পীরা নকশার জন্য কোন মডেল বা স্কেচ ব্যবহার করেন না, পরম্পরাগতভাবে চলে আসা গয়নার নকশাই ব্যবহার করেন। বড়িগুলি আকৃতিতে সাধারণত বৃত্ত, বর্গক্ষেত্র, ত্রিভূজ ও উপবৃত্তের মত হয়। নকশায় থাকে মূলতঃ স্বর্ণালঙ্কারের প্রভাব। মুকুট, নেকলেস, দুল, টায়রা, বাজুবন্ধ, লকেট, কানপাশা, মাকড়ি, ঝরোখা ইত্যাদির নকশা ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও নানাবিধ জ্যামিতিক নকশা, বিভিন্ন ধরনের কল্কা, শাঁখ, পদ্মফুল ও বিভিন্ন বশুপাখি যেমন বিড়াল, টিয়া, কাকাতুয়া, ময়ূর, পেঁচা, হাঁস ও প্রজাপতি নকশায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "Gohona Bori"। দারিচা। দারিচা ফাউন্ডেশন। সংগ্রহের তারিখ ২০ আগস্ট ২০১৬।
- ↑ "IIT Kharagpur facilitating filing of GI application for 'Goyna Bori'"। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। ৩১ জুলাই ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ২০ আগস্ট ২০১৬।
- ↑ সেন, পৃথা (৩১ মার্চ ২০১৬)। "How British greed spurred the creation of one of Bengal's most loved dishes"। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস গ্রুপ। সংগ্রহের তারিখ ২১ আগস্ট ২০১৬।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ রায়, উৎসা (২০১৫)। Culinary Culture in Colonial India (ইংরেজি ভাষায়)। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস। পৃষ্ঠা 225–228। আইএসবিএন 9781107042810। সংগ্রহের তারিখ ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬।
- ↑ ক খ গ ভৌমিক, অরিন্দম। মেদিনীকথা - পূর্ব মেদিনীপুর, পর্যটন ও পুরাকীর্তি। পৃষ্ঠা 274। আইএসবিএন 9788193189238। সংগ্রহের তারিখ ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬।
- ↑ ধাড়া, কাকলি (২০০৭)। "গহনা বড়ি"। চক্রবর্তী, ডঃ বরুণকুমার। বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতি কোষ। কলকাতা: অপর্ণা বুক ডিস্ট্রবিউটার্স (প্রকাশন বিভাগ)। পৃষ্ঠা ১২০–১২২। আইএসবিএন 81-86036-13-X।