আল-জাররাহ ইবনে আবদুল্লাহ

এটি একটি ভালো নিবন্ধ। আরও তথ্যের জন্য এখানে ক্লিক করুন।
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

আল-জাররাহ ইবনে আবদুল্লাহ আল-হাকামি
ডাকনাম"ইসলামের বীর", "সিরীয়দের ঘোড়সওয়ার"
মৃত্যু৯ ডিসেম্বর ৭৩০
আরদাবিল
সেবা/শাখাউমাইয়া খিলাফত
কার্যকাল৬৯৬-এর পূর্ব থেকে – ৭৩০
যুদ্ধআরব-খাজার যুদ্ধ

আবু উকবা আল-জাররাহ ইবনে আবদুল্লাহ আল-হাকামী (আরবি: أبو عقبة الجراح بن عبد الله الحكمي) ছিলেন হাকামী গোত্রের একজন আরব অভিজাত ও সেনাপতি। ৮ম শতাব্দীর প্রথম দিকে বিভিন্ন সময় তিনি বসরা, সিস্তান, খোরাসান, আর্মেনিয়াআজারবাইজানের গভর্নরের দায়িত্বপালন করেছেন। জীবদ্দশায় তিনি একজন কিংবদন্তিসম যোদ্ধা ছিলেন। ককেসাস রণাঙ্গণে খাজারদের বিরুদ্ধে অভিযানে অংশ নেয়ার কারণে তিনি বেশি পরিচিত। খাজারদের বিরুদ্ধে আরদাবিলের যুদ্ধে তিনি শহীদ হন।

প্রথম জীবন[সম্পাদনা]

আল-বালাজুরির মতে, আল-জাররাহ জুন্দ আল-উরদুনে জন্মগ্রহণ করেন এবং সম্ভবত ৬৯৬ খ্রিষ্টাব্দে সুফিয়ান ইবনুল আবরাদ আল-কালবি ও আবদুর রহমান ইবনে হাবিব আল-হাকামিকে ইরাকে অণুসরণ করেন।[১] ৭০১ খ্রিষ্টাব্দে ইবনে আল-আশআসের বিদ্রোহের সময় তার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।[১]

৭০৬ খ্রিষ্টাব্দে বা তার কয়েক বছর পরে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের অধীনে তাকে বসরার গভর্নর নিয়োগ দেয়া হয়। ৭১৫ খ্রিষ্টাব্দে হাজ্জাজের স্থলে ইয়াজিদ ইবনুল মুহাল্লাব নিয়োগ পাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন।[১][২] ইয়াজিদ খোরাসানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার পূর্বে আল-জাররাহকে তার ডেপুটি হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। ৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে খলিফা দ্বিতীয় উমর (শাসনকাল ৭১৭-৭২০) আল-জাররাহকে ইয়াজিদের উত্তরসূরি হিসেবে খোরাসানসিস্তানের গভর্নর নিয়োগ দেন।[১][২] ৭১৯ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ/এপ্রিল পর্যন্ত আল-জাররাহ খোরাসানে ছিলেন। এসময় স্থানীয় নওমুসলিমদের প্রতি দুর্ব্যবহারের অভিযোগে তাকে পদচ্যুত করা হয়। এরপর তার ডেপুটি আবদুর রহমান ইবনে নুয়াইম আল-গামিদি তার স্থলাভিষিক্ত হন।[৩] খোরাসানে আব্বাসীয় প্রতিনিধিদের দ্বারা গোপন প্রচারকার্য শুরু হওয়ার ঘটনা তার শাসনামলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা[৪] ৭২০ খ্রিষ্টাব্দে ইরাকে ফিরে আসার পর ইয়াজিদ ইবনুল মুহাল্লাবের বিদ্রোহ দমনের জন্য তিনি মাসলামা ইবনে আবদুল মালিকের সাথে একসঙ্গে লড়াই করেছেন বলে অণুমিত হয়।[১][৫]

ককেসাসে দায়িত্বপালন[সম্পাদনা]

ককেসাস অঞ্চলের মানচিত্র, ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ

৭২১/২২ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় আরব-খাজার যুদ্ধের মূল অংশ ককেসাসে শুরু হয়। সেই বছরের শীতে ৩০,০০০ খাজার আর্মেনিয়া আক্রমণ করে। ৭২২ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি/মার্চে মারজ আল-হিজারাতে স্থানীয় গভর্নর মিলাক ইবনে সাফফার আল-বাহরানির বাহিনী তাদের হাতে পরাজিত হয়। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে খলিফা দ্বিতীয় ইয়াজিদ (শাসনকাল ৭২০-৭২৪ খ্রিষ্টাব্দ) আল-জাররাহকে খাজারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে ২৫,০০০ সিরীয় সৈনিকসহ আর্মেনিয়া প্রেরণ করেন। আল-জাররাহ খাজারদের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। তিনি কাস্পিয়ান সাগরের পশ্চিম উপকূলে লড়াই করে দারবান্দ পুনরুদ্ধার করেন এবং খাজারদের রাজধানী বালানজারের দিকে অগ্রসর হন। খাজাররা মালগাড়ি বসিয়ে শহর রক্ষার চেষ্টা করে। কিন্তু আরবরা এই প্রতিরোধ ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয় এবং ৭২২ বা ৭২৩ খ্রিষ্টাব্দের ২১ আগস্ট শহরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বালানজারের অধিকাংশ বাসিন্দা নিহত বা বন্দী হয়। তবে অল্প সংখ্যক বাসিন্দা উত্তরে পালিয়ে যায়। আরবরা ওয়াবান্দার শহরও দখল করে নেয় এবং সামান্দার শহরের (বর্তমান কিজলিয়ারের নিকটে) দিকে অগ্রসর হয়।[২][৬][৭]

এসকল সাফল্য সত্ত্বেও আরবরা চূড়ান্ত বিজয় লাভ করেনি। খাজারদের মূল বাহিনী অক্ষত থাকে এবং হুমকি হিসেবে রয়ে যায়। অন্যান্য যাযাবর বাহিনীর মত এরাও রসদের জন্য কোনো শহরের উপর নির্ভরশীল ছিল না। বাহিনীর পশ্চাতভাগ অরক্ষিত ছিল বিধায় আল-জাররাহ সামান্দার দখলের চেষ্টা ত্যাগ করে ককেসাসের দক্ষিণে ওয়ার্ত‌হান ফিরে আসেন। এখানে থেকে তিনি খলিফা ইয়াজিদের কাছে সাহায্য চান। খলিফা সহায়তা দেওয়ার ইচ্ছাপোষণ করলেও তাতে সক্ষম হন নাই। ৭২৩ খ্রিষ্টাব্দে আল-জাররাহর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তৎকালীন সূত্রে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে তিনি উত্তরে আরো একটি অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এমন হতে পারে যা বালানজার অভিযানের প্রকৃত তারিখ হতে পারে। এরপর খাজাররা ককেসাসের দক্ষিণে আক্রমণ করে। কিন্তু ৭২৪ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে কয়েকদিনব্যাপী যুদ্ধের পর আল-জাররাহ সাইরাসআরাক্সেস নদীর মধ্যবর্তী স্থানে খাজারদের পরাজিত করেন।[৬][৮] আল-জাররাহ তিবলিসি জয় করে সাফল্য বজায় রাখেন। এখানকার অধিবাসীরা খারাজ প্রদানে সম্মত হয়। এই অভিযানের ফলে ককেসিয়ান ইবেরিয়াআলানস মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে আসে। ফলে দারিয়াল গিরিপথ অতিক্রম করা প্রথম মুসলিম কমান্ডার হিসেবে আল-জাররাহ গণ্য হন। এই অভিযানের ফলে দারিয়ালের মধ্য দিয়ে মুসলিমদের পার্শ্বভাগের উপর সম্ভাব্য খাজার হামলা থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায় এবং মুসলিমরা খাজার অঞ্চলে দ্বিতীয় অভিযানের সুযোগ পায়।[৯]

৭২৫ খ্রিষ্টাব্দে নতুন খলিফা হিশাম ইবনে আবদুল মালিক (শাসনকাল ৭২৪-৭৪৩) তার ভাই মাসলামা ইবনে আবদুল মালিককে আল-জাররাহর স্থলাভিষিক্ত করেন।[৬][১০]

ককেসাসে প্রত্যাবর্তন ও মৃত্যু[সম্পাদনা]

৭২৯ খ্রিষ্টাব্দে মাসলামাকে পুনরায় আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। মাসলামার সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও তার অভিযান সফল হয়নি। এসময় আরবরা ট্রান্সককেসিয়ার নিয়ন্ত্রণ হারায়। এসময় আরবরা প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ নেয়। আল-জাররাহ খাজারদের আক্রমণ থেকে আজারবাইজান রক্ষা করেন।[১১]

৭৩০ খ্রিষ্টাব্দে আল-জাররাহ আক্রমণাত্মক কৌশলে ফিরে আসেন। আরব সূত্রগুলোর তথ্য অনুযায়ী তিনি ভোলগার তীরে খাজার রাজধানী আল-বাইদা পর্যন্ত পৌঁছান। তবে আধুনিক ইতিহাসবিদরা এটি অসম্ভব হিসেবে গণ্য করেন। শীঘ্রই তিনি খাজার সেনাপতি থারমাচের হাত থেকে আরান রক্ষার জন্য বারদা ফিরে আসেন।[৬][১২] খাজাররা দারিয়াল গিরিপথ নাকি কাস্পিয়ান ফটক দিয়ে অগ্রসর হয় তা স্পষ্ট জানা যায় না। তবে তারা আরব বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে অগ্রসর হয় এবং আরদাবিল অবরোধ করে। এখানে ৩০,০০০ মুসলিম সৈনিক ও তাদের পরিবার অবস্থান করছিল। এই বাহিনীর সংবাদ পাওয়ার পর আল-জাররাহ বারদা থেকে পিছু হটে আরদাবিলের উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসেন। শহরের বাইরে তিন দিনের যুদ্ধের পর আরবরা পরাজিত হয় এবং আল-জাররাহ যুদ্ধে নিহত হন।[১৩][১৪] আল-জাররাহর ভাই আল-হাজ্জাজ এরপর নেতৃত্ব পান। তবে তিনি আরদাবিল রক্ষা ও মসুলের দিকে খাজারদের অভিযান থামাতে ব্যর্থ হন।[১৫][১৬] সুদক্ষ সেনাপতি সাইদ ইবনে আমর আল-হারাশি এরপর দায়িত্ব পান। শীঘ্রই তিনি আক্রমণকারীদের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। মারওয়ান ইবনে মুহাম্মদের (পরবর্তীতে খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ান) নেতৃত্বে এই যুদ্ধ ৭৩৭ খ্রিষ্টাব্দে আরবদের বিজয়ের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়।[১৭][১৮]

আল-জাররাহর মৃত্যু মুসলিম বিশ্বে শোক বয়ে আনে। জীবদ্দশায় কিংবদন্তিসম মর্যাদা লাভ করায় সৈনিকরা বিশেষ করে মর্মাহত হয়। বলা হয় যে, তিনি এত দীর্ঘ ছিলেন যে যখন তিনি দামেস্ক জামে মসজিদে প্রবেশ করতেন তখন তার মাথা বাতি থেকে ঝুলন্ত মনে হত এবং "ইসলামের বীর" (বাতাল আল-ইসলাম) ও "সিরীয়দের ঘোড়সওয়ার" (ফারিস আহল আল-শাম) নাম দ্বারা তার সামরিক প্রশংসা করা হত।[১][২]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. ক্রোন ১৯৮০, পৃ. ১৩২।
  2. ডানলপ ১৯৯১, পৃ. ৪৮২।
  3. পাওয়ারস ১৯৮৯, পৃ. ৮১–৮৭।
  4. পাওয়ারস ১৯৮৯, পৃ. ৮৭–৮৮।
  5. পাওয়ারস ১৯৮৯, পৃ. ১৪৫–১৪৬।
  6. ব্রুক ২০০৬, পৃ. ১২৭।
  7. ব্ল্যাংকইনশিপ ১৯৯৪, পৃ. ১২১–১২২।
  8. ব্ল্যাংকইনশিপ ১৯৯৪, পৃ. ১২২।
  9. ব্ল্যাংকইনশিপ ১৯৯৪, পৃ. ১২২–১২৩।
  10. ব্ল্যাংকইনশিপ ১৯৯৪, পৃ. ১২৩।
  11. ব্ল্যাংকইনশিপ ১৯৯৪, পৃ. ১২৫, ১৪৯।
  12. ব্ল্যাংকইনশিপ ১৯৯৪, পৃ. ১৪৯।
  13. ব্ল্যাংকইনশিপ ১৯৯৪, পৃ. ১৪৯–১৫০।
  14. ব্রুক ২০০৬, পৃ. ১২৭–১২৮।
  15. ব্ল্যাংকইনশিপ ১৯৯৪, পৃ. ১৫০।
  16. ব্রুক ২০০৬, পৃ. ১২৮।
  17. ব্ল্যাংকইনশিপ ১৯৯৪, পৃ. ১৫০–১৫৪, ১৭০–১৭৪।
  18. ব্রুক ২০০৬, পৃ. ১২৮–১২৯।

উৎস[সম্পাদনা]

পূর্বসূরী
ইয়াজিদ ইবনুল মুহাল্লাব
খোরাসানসিস্তানের আমির
৭১৭–৭১৯
উত্তরসূরী
আবদুর রহমান ইবনে নুয়াইম আল-গামিদি
পূর্বসূরী
মিলাক ইবনে সাফফার আল-বাহরানি
আর্মি‌নিয়াআজারবাইজানের গভর্নর
৭২২–৭২৫
উত্তরসূরী
মাসলামা ইবনে আবদুল মালিক
পূর্বসূরী
মাসলামা ইবনে আবদুল মালিক
আর্মি‌নিয়াআজারবাইজানের গভর্নর
৭২৯–৭৩০
উত্তরসূরী
সাইদ ইবনে আমর আল-হারাশি