সুন্দরবনের জনবসতি অঞ্চল

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
পুকুর ও ধানখেতসহ সুন্দরবনে বাড়ি, ২০১০।

সুন্দরবনের জনবসতি অঞ্চল বলতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর চব্বিশ পরগনাদক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় সুন্দরবনের জঙ্গল পরিষ্কার করে গড়ে ওঠা জনবসতিকে বোজানো হয়েছে।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ডিসট্রিক্ট হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট অনুযায়ী সুন্দরবনে ১০২টি বদ্বীপ বর্তমান, যার মধ্যে ৫৪টিতে জনবসতি আছে এবং বাকি ৪৮টি দ্বীপ সংরক্ষিত অরণ্য। এলাকার ২৫,৫০০ বর্গকিলোমিটার (৯,৮০০ বর্গমাইল) আয়তনের জনসংখ্যা প্রায় ৩৯ লক্ষ, যা এলাকার মোট জনসংখ্যার ৪০%।[১]

ইতিহাস[সম্পাদনা]

সুন্দরবনে গ্রাম, ১৮৩৯ সালের এক নকশার আদলে ফ্রেডারিক পিটার লেয়ার্ডের চিত্র

সুন্দরবন অঞ্চলের ইতিহাস খুব স্পষ্ট নয়। পণ্ডিতেরা একমত যে পঞ্চাদশ-ষোড়শ শতক পর্যন্ত ভারতীয় সুন্দরবনের আরও সুগম ও কম ভয়ঙ্কর অংশে জনবসতি ছিল। তারপর থেকে, ভূতাত্ত্বিক ও পাতসংস্থানের ফলে পদ্মা নদী, গঙ্গা নদীর মূল প্রবাহে পরিণত হয়েছিল। তখনই বর্তমান ভারতীয় সুন্দরবনে মিষ্ট জলের অভাব লক্ষ্য করা গিয়েছিল। ব্রিটিশদের আসার আগে থেকেই সেখানে মুবাররা গাজী নামক এক ফকির ছিলেন, যিনি হুগলি নদীর অরণ্যাবৃত পশ্চিম পাড়কে ধানক্ষেতে পরিণত করেছিলেন। অরণ্যটি ছিল সুন্দরবন মিষ্ট জলাভূমি, যা বর্তমানে প্রায় নিশ্চিহ্ন। ষোড়শ শতকের শুরুতে পর্তুগিজরা বাংলায় এসেছিল। বাংলার দক্ষিণ অংশটি পর্তুগিজ জলদস্যুদের হাতে চলে গিয়েছিল। আরাকানের জলদস্যুও ছিল সেখানে। এলাকাটি জনমানবহীন হয়ে গিয়ে অরণ্যের আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছিল।[২]

১৭৫৭ সালে মীর জাফরব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে চুক্তির ফলে ব্রিটিশরা চব্বিশ পরগনার জমিদারি অধিকার কায়েম করেছিল। কলকাতার চারিদিকের এলাকা ছিল অনুর্ব‌র ভূমি এবং সুন্দরবনের পশ্চিম সীমানা প্রায় ১১ কিলোমিটার (৭ মাইল) দূরে। ব্রিটিশরা সুন্দরবনে কৃষিকাজ করাতে আগ্রহী ছিল এবং একে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে পরিণত করেছিল। অরণ্যের কথা একবারও ভাবা হয়নি। সুন্দরবনের পুনরুদ্ধার করার অর্থ এলাকার সমীক্ষা ও মানচিত্র প্রস্তুত করা, যা ১৮১০ সালে শুরু হয়েছিল। লেফটেন্যান্ট ডব্লিউই মরিসন ও তাঁর ভাই ক্যাপ্টেন হিউ মরিসন এক দশক ধরে কাজ করেছিলেন এবং বেস মেটারিয়াল প্রস্তুত করেছিলেন যার ভিত্তিতে ঐ এলাকার পরবর্তী মানচিত্র প্রস্তুত হয়েছিল। পরবর্তীকালে, এনসাইন প্রিন্সেপ এলাকাটির মানচিত্র তৈরি করেছিলেন। যেহেতু সুন্দরবনের এলাকাগুলির কোনো নাম ছিল না, তিনি সেগুলিকে "লট" বলে অভিহিত করেছিলেন। ১৮৩০-এর দশকে উইলিয়াম ড্যাম্পাইয়ার এবং লেফটেন্যান্ট হজেস সমগ্র এলাকার মানচিত্র তৈরি করেছিলেন এবং লটগুলিকে ১ থেকে ২৩৬ পর্যন্ত পুনঃসংখ্যায়ন করেছিলেন। প্রিন্সেপ রেখা ও ড্যাম্পাইয়ার-হজেস রেখা সুন্দরবনের দূরতম সীমা হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।[২]

অরণ্য পরিষ্কার[সম্পাদনা]

সুন্দরবনের বর্তমান জনবসতিগুলি ১৭৭১ সালে তৎকালীন কালেক্টর জেনারেল ক্লড রাসেলের পরিকল্পনা থেকে জাত, যেখানে সম্ভাব্য জমিদারকে ইজারা দেওয়ার জন্য অরণ্যকে বিভিন্ন প্লটে বিভাজিত করা হয়েছিল। যশোর জেলার তৎকালীন জেলাশাসক টিলম্যান হেঙ্কেল ১৭৮১ সাল থেকে অরণ্য পরিষ্কার কার্যত শুরু করেছিলেন। এক শতাব্দীর মধ্যে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার হিঙ্গলগঞ্জ, হাসনাবাদ, সন্দেশখালি ১, সন্দেশখালি ২, মিনাখাঁহাড়োয়া সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার ক্যানিং ১, ক্যানিং ২, জয়নগর ২, মথুরাপুর ১, মথুরাপুর ২সাগর সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের সম্পূর্ণ বা বেশিরভাগ অংশ অরণ্য পরিষ্কার। এর ফলে কাকদ্বীপ, নামখানা, পাথরপ্রতিমা, বাসন্তী, কুলতলিগোসাবা সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের বেশিরভাগ জনবসতির জন্য পরিষ্কার করা হয়েছে। ১৯৫১ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা বহু শরণার্থীরা এই এলাকায় এসেছিল।[১]

১৮৩০-এর দশক থেকেই অরণ্য সংরক্ষণের ধারণা এলেও সুন্দরবনের আয়তন অনেকটাই কমে গিয়েছে। এক অনুমান অনুযায়ী উনিশ শতকে সুন্দরবনের আয়তন ছিল ১৭,০০০ বর্গকিলোমিটার (৬,৫৫০ বর্গমাইল), যা বর্তমানে দাঁড়াল ১০,২১৭ বর্গকিলোমিটার (৩,৯৪৫ বর্গমাইল), যার মধ্যে ৫,৯৫৫ বর্গকিলোমিটার (২,২৯৯ বর্গমাইল) বাংলাদেশে ও ৪,২৬২ বর্গকিলোমিটার (১,৬৪৬ বর্গমাইল) ভারতে।

বর্তমান পরিস্থিতি[সম্পাদনা]

২০০৯ সালে প্রকাশিত দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ডিসট্রিক্ট হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট অনুযায়ী, সুন্দরবন অঞ্চলের দারিদ্র্য অনেক বেশি এবং এর ১৩টি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের দারিদ্র্যের হার ৩০%-এর বেশি এবং আটটি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের ৪০%-এর বেশি জনসংখ্যা দারিদ্র্যসীমার নিচে। জীবনের মানের দিক থেকে সুন্দরবন অঞ্চল সবচেয়ে পিছিয়ে। ২০০৫ সালের গ্রাম্য পরিবারের সমীক্ষা অনুযায়ী দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার পরিবার এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে দারিদ্র্যের হারের অনুপাত ৩৪.১১%, যা রাজ্য ও জাতীয় দারিদ্র্য অনুপাতের তুলনায় অনেক বেশি।[৩] উত্তর চব্বিশ পরগনার ডিসট্রিক্ট হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট অনুযায়ী, হাসনাবাদ ও সন্দেশখালি ২ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক বাদে সেখানকার আর্থিক অবস্থা একইরকমভাবে বেহাল। হাসনাবাদ ও সন্দেশখালি ২ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের ৩০%-এর কম জনসংখ্যা দারিদ্র্যসীমার নিচে।[৪]

বৈদ্যুতিক সংযোগ প্রায় নেই বললেই চলে এবং নদী ছাড়া অন্য কোনো পরিবহন বা যোগাযোগ মাধ্যম নেই। প্রায় ৯৫% জনসংখ্যা বৃষ্টিপাতনির্ভর কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল।[১]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "District Human Development Report: South 24 Parganas"Chapter 9: Sundarbans and the Remote Islanders, p 290-311। Development & Planning Department, Government of West Bengal, 2009। ৫ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ নভেম্বর ২০১৯ 
  2. Chacraverti, Santanu। "The Sundarbans Fishers" (পিডিএফ)। International Collective in Support of Fishworkers। ৩ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯ 
  3. "District Human Development Report: South 24 Parganas"Pages 42-43, Chapter 3.8: Poverty Scenario in South 24 Parganas। Department of Planning and Statistics, Government of West Bengal। ৫ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯ 
  4. "District Human Development Report: North 24 Parganas" (পিডিএফ)Page 259, Table 11.2.2। Development & Planning Department, Government of West Bengal, 2010। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯