বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদি পর্ব

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদি পর্ব
দে'জ পাবলিশিং সংস্করণের প্রচ্ছদ
লেখকনীহাররঞ্জন রায়
দেশভারত
ভাষাবাংলা
প্রকাশকদি বুক এম্পোরিঅম
প্রকাশনার তারিখ
১৯৪৯
মিডিয়া ধরনমুদ্রিত গ্রন্থ
পুরস্কাররবীন্দ্র পুরস্কার

বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদি পর্ব নীহাররঞ্জন রায়ের লেখা একটি প্রাচীন বাংলার ইতিহাস বিষয়ক বই। এটি ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে দি বুক এম্পোরিঅম প্রকাশনা দ্বারা প্রকাশিত হয়। বইয়ের বিষয় বাঙালি জাতি ও বাঙালির বাসভূমি "বঙ্গ" সম্পৃক্ত ইতিহাস, বিশেষ করে অতীতের সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক জীবন।[১]

নীহাররঞ্জন রায় ছিলেন বাঙালি ইতিহাসবিদ, সাহিত্য সমালোচক ও শিল্পকলা-গবেষক, এবং বাঙালি জাতির ইতিহাসের প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। তিনি বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একজন বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন, এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ১৩৪৬ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের আহ্বানে অধরচন্দ্র বক্তৃতামালায় বাঙালি জাতির ইতিহাস বিষয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন; অধিবেশনের সভাপতি যদুনাথ সরকার তাঁকে বাঙালি জাতির একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার অহবান আহ্বান করেন। লেখক বইটির পনেরোটি অধ্যায়ের মধ্যে দশটি অধ্যায় কারাগারে বন্দী অবস্থায় রচনা করেছিলেন।

নীহাররঞ্জন রায় ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদি পর্ব-এর লেখক হিসাবে রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হন,[২] যা পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার।

পটভূমি[সম্পাদনা]

বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক ১৩৪৬ বঙ্গাব্দে আয়োজিত অধরাচন্দ্র বক্তৃতমালায় নীহাররঞ্জন রায়কে ভারতের ইতিহাসের কোন একটি দিক বা পর্ব সম্পর্কে তিনটি বক্তৃতা প্রদানের জন্য আহ্বান করা হয়েছিল। তিন দিনব্যাপী আয়োজিত বক্তৃতা সভায় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার। তিনি অধিবেশনে সভাপতির মন্তব্যে নীহাররঞ্জন রায়ের প্রশংসা করেন, এবং বাঙ্গালীয় ইতিহাস সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ বই লেখার আহ্বান করেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত পত্রিকায় নীহাররঞ্জন রায়ের বক্তব্যসমূহ প্রকাশিত ও প্রশংসিত হয়। কিন্তু উক্ত সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বাংলার ইতিহাস সম্পর্কিত একটি বইয়ের প্রথম খণ্ড রচনা ও সম্পাদনাধীন ছিল, যে কারণে তিনি একই বিষয়ে নতুন একটি বই লিখতে আগ্রহী ছিলেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ১৩৪৯ বঙ্গাব্দে বাংলার ইতিহাস সম্পর্কিত বই "হিস্ট্রি অব বেঙ্গল" শিরোনামে রমেশচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। নীহাররঞ্জন রায় বইটির প্রশংসা করেন, পাশাপাশি তিনি বাঙালির আদি পর্ব (প্রারম্ভিক সময়) রচনার আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

উৎপাদন[সম্পাদনা]

বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদি পর্ব-এর লেখক নীহাররঞ্জন রায়ের চিত্র

নীহাররঞ্জন রায় ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফলে তিনি ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ পুলিশের দ্বারা কারাগারে বন্দী হন। বন্দী হওয়ার পূর্বেই তিনি বইটি লেখার জন্য চিন্তা ভাবনা করেছিলেন। লেখকের কথায় কারাগারে বন্দী থাকার সময় তিনি অবসর সময় লাভ করেন এবং এই অবসর সময়ে তিনি গ্রন্থ রচনা শুরু করেন। তবে কারাবাসে থাকাকালীন সময়ে গ্রন্থ রচনা সম্পূর্ণ করতে পারেননি; গ্রন্থের ১৫টি অধ্যায়ের মতো দশটি অধ্যায়ে কারাবাস থাকাকালীন সময়ে সম্পূর্ণ করেন। নীহাররঞ্জন রায় ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। তিনি তাঁর বন্ধুর বীরেন্দ্রনাথ ঘোষের সহযোগিতায় দি বুক এম্পোরিঅম থেকে বইটি প্রকাশের প্রক্রিয়া শুরু করেন। তিনি বইয়ের দশটি অধ্যায়ের ছাপা কাজ চলাকালী সময়ে বাকি পাঁচটি অধ্যায় লেখা চালিয়ে যান। তবে এই সময়ে প্রতক্ষ্য সংগ্রাম দিবসে কলকাতা দাঙ্গা শুরু হয়, ফলে সম্পূর্ণ একটি বছর ছাপার কাজ বন্ধ থাকে। অবশেষে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে বই ছাপার কাজ সম্পূর্ণ ও প্রকাশিত হয়।[৩]

লেখক বইটি রচনায় সময়কাল সম্পর্কে বলেছিলেন – এ-গ্রন্থরচনা যখন আরম্ভ করিয়াছিলাম তখন বাঙলাদেশ অখন্ড এবং বৃহৎ ভারতবর্ষের সঙ্গে অচ্ছেদ্য সম্বন্ধে যুক্ত; আজ গ্রন্থরচনা যখন শেষ হইল, রাষ্ট্রবিজ্ঞাতার ইচ্ছায় ও কুটকৌশলে দেশ তখন দ্বিখন্ডিত এবং ভারতবর্ষের সঙ্গে তাহার অনাদিকালের নাড়ীর সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন[৪]

বিষয়বস্তু[সম্পাদনা]

বইটি তার বিষয়বস্তুকে ১৫ টি অধ্যায়ে ধারন করে:

প্রথম অধ্যায়: ইতিহাসের যুক্তি[সম্পাদনা]

এই অধ্যায়ে, লেখক নীহাররঞ্জন রায় বইয়ের নাম কেন "বাঙ্গালীর ইতিহাস" রেখেছেন সেই বিষয়ে যুক্তি দিয়েছেন। তিনি বাঙালির ইতিহাস-এর মূল অর্থ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, যে তাঁর এই গ্রন্থ রচনার পূর্ববর্তী ৫০ বছরে বাংলার ইতিহাস সম্পর্কিত বিভিন্ন রচনা ও গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এই বিষয়ে ঐতিহাসিক ও পণ্ডিতগণ বহু গবেষণামূলক বিষয়বস্তু প্রকাশ করেছেন। তিনি আরও জানিয়েছেন এই সময়ের লেখকগণ বা ঐতিহাসিকগণ মূলত বাংলায় শাসনকারী রাজাদের রাজত্ব ও তাদের রাজবংশ ভিত্তিক ইতিহাস রচনা করেছেন। এরপর জানিয়েছেন যে তিনি তাঁর গ্রন্থে মূলত বাঙালির সমাজ জীবনের ইতিহাস তুলে ধরেছেন, এবং তাঁর মতে এই সমাজ জীবনের ইতিহাসই হল বাঙালির ইতিহাস।[৫][৬]

দ্বিতীয় অধ্যায়: বাঙালীর ইতিহাসের গোড়ার কথা[সম্পাদনা]

এই অধ্যায়ে বাঙালি জাতির গঠন বা নির্মাণ ও প্রারম্ভিক সময়ে বাঙালি জাতির বিকাশের বিষয়ে বলা হয়েছে। বাঙালি জাতি একটি সংকর জাতি বা গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয়েছে, এই সংকর জাতি কোন কোন জাতির সংমিশ্রনে গঠিত হয়েছিল সে বিষয়ে এই অধ্যায় বলা হয়েছে। যে সকল জাতির সমন্বয়ে বাঙালির গঠিত হয়েছিল সে সকল জাতিসমূহ পৃথিবীর কোন কোন অংশ থেকে এসেছিল তা উল্লেখ করা হয়েছে। লেখক দ্বারা বাঙালি জাতির গঠনে আর্য ও অনার্য জনগোষ্ঠীর অবদান সম্পর্কে ধারণা প্রধান করেছেন।

প্রাচীন বাঙালি সমাজের বর্ণ বিন্যাস এবং সমাজে বর্ণগুলির অবস্থান ও প্রভাবের বর্ণনা করেছেন। সেইসঙ্গে লেখক উল্লেখ করেছেন কোন কোন নৃগোষ্ঠী থেকে বর্ণগুলি উৎপন্ন হয়েছিল।

তৃতীয় অধ্যায়: দেশ-পরিচয়[সম্পাদনা]

এই অধ্যায়ে বাঙালি জাতির আবাসভূমি বর্ণনা করা হয়েছে। পূর্ব সীমানা, পশ্চিম সীমানা, উত্তর সীমানা ও দক্ষিণ সীমানা সহ বাঙালির আবাসভূমির সীমানা নির্দেশিত হয়েছে। বাংলায় প্রবাহিত গুরুত্বপূর্ণ নদ-নদীগুলির বর্ণনা করা হয়েছে। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে যে সকল জনপথ ও রাজ্য প্রাচীনকাল গড়ে উঠেছিল, তাদের সম্পর্কে তথ্য প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও সমুদ্রপথ ও স্থলপথের মাধ্যমে বহিঃবিশ্বের সঙ্গে বাংলার গড়ে ওঠা যোগাযোগ ব্যবস্থা উল্লেখ করা হয়েছে; সেই সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলার প্রাচীন জনপদ গুলির নামকরণের বিষয়ে।

চতুর্থ অধ্যায়: ধন-সম্বল[সম্পাদনা]

এই অধ্যায় বাংলার সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। অধ্যায়টি বাংলার কৃষি কাজ ও তার উৎপাদনের তথ্যের সঙ্গে শুরু হয়। বিভিন্ন পশুপাখি উল্লেখ করা হয়েছে, এদের মধ্যে বেশকিছু পশু সামরিক বাহিনীতে ব্যবহৃত হতো। মূল্যবান পাথর ও খনিজ দ্রব্যের তথ্য দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে প্রাচীন বাংলার কোথায় কোথায় হীরক খনি ছিল। শেষে বাংলার ব্যবসা বাণিজ্য ও সমুদ্র-বাণিজ্যের উল্লেখ করা হয়েছে, সেই সঙ্গে সমুদ্র-বাণিজ্যের জন্য ব্যবহৃত কিছু সমুদ্র বন্দর ও জনপদের উল্লেখ করা হয়েছে।

পঞ্চম অধ্যায়: ভূমি-বিন্যাস[সম্পাদনা]

এই অধ্যায়ে বাংলার ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে। প্রাচীন বাংলায় ভূমিদান, ভূমি ক্রয় ও বিক্রয়ের রীতি, ভূমির প্রকারভেদ এবং ভূমির মাপ ও মূল্যের বিষয়ে তথ্য প্রদান করা হয়েছে। শেষে উল্লেখ করা হয়েছে ভূমির মালিকানা এবং রাজা ও প্রজার ভূমির প্রতি অধিকার, এছাড়াও খাস জমি সংক্রান্ত তথ্য প্রদান করা হয়েছে।

একাদশ অধ্যায়: দৈনন্দিন জীবন[সম্পাদনা]

এই অধ্যায়ে লেখক নীহাররঞ্জন রায় তৎকালীন বাঙালিদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের বর্ণনা করেছেন। বর্ণনায় উঠে এসেছে খাদ্যাভ্যাস, শিকার ও ক্রীড়া, বস্ত্র পরিধানভঙ্গী, অলংকরণ, গ্রামীণ জীবনাদর্শ, অন্ত্যজ বর্ণের জীবনযাত্রা এবং নারীসমাজ। এই অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে আদিকাল থেকেই বাঙালির প্রধান খাদ্য ছিল ভাত। অস্ট্রিক ভাষাগোষ্ঠীর আদি-অস্ট্রেলীয়া জনগোষ্ঠীর সভ্যতা ও সংস্কৃতি থেকে ভাত আহারের অভ্যাস অর্জন করেছিল বাঙালি জাতি। লেখক বাঙালির খাদ্যাভাসে মাছ-মাংস, তরকারি ও ফলমূলের উল্লেখ করেছেন। রাজা ও সমান্তরাদের মধ্যে শিকার ছিল উল্লেখযোগ্য ক্রীড়া, এবং মহিলাদের মধ্যে ছিল কড়ি খেলা, বাঘ বন্দী খেলাষোলঘর খেলা উল্লেখযোগ্য। তৎকালীন বাঙালি সমাজে অলংকরণের ব্যবহার ছিল, নারী ও পুরুষ উভয়ই কন্ঠহার ও মেখলার মত অলঙ্কার ব্যবহার করত।[৭][৮]

প্রকাশনা[সম্পাদনা]

বইটির প্রকাশক সংস্থা ছিল বুক এমপি। সংস্থাটি ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বইটি প্রকাশ করে। তবে বইটির প্রথম সংস্করণ দ্রুত নিঃশেষিত হয়ে যায়। সংস্থাটি ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম সংস্করণের পুনর্মুদ্রণ (দ্বিতীয় সংস্করণ) প্রকাশ করে।[৯] প্রথম পুনর্মুদ্রণের ২,২০০ টি কপি এক বছরের মধ্যে নিঃশেষিত হয়ে যায়।[১০]

পশ্চিমবঙ্গ নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে বইটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ করে। এই সংস্করণে বইটির দুটি খন্ডে প্রকাশ করা হয়েছিল।[৯] সংস্করণটিতে মোট ১০ হাজার কপি বই প্রকাশ করা হয়।[১০] সর্বশেষ দে'জ পাবলিশিং ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে একটি নতুন সংস্করণ প্রকাশ করে।[৯]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. চক্রবর্তী, রণবীর (১৮ নভেম্বর ২০১৮)। "বাঙ্গালীর ইতিহাস"www.anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২৬ নভেম্বর ২০২৩ 
  2. রায় ১৯৯৩, পৃ. ৭৬২।
  3. রায় ২০২২, পৃ. ২৫।
  4. রায় ২০২২, পৃ. ২৬।
  5. রায় ২০২২, পৃ. ৩১।
  6. রায় ২০২২, পৃ. ৪১–৬২।
  7. রায় ২০২২, পৃ. ৩৫–৩৬।
  8. রায় ২০২২, পৃ. ৫৬৯–৬০৭।
  9. রায় ২০২২, পৃ. ৫।
  10. রায় ২০২২, পৃ. ১৭।

গ্রন্থপঞ্জি[সম্পাদনা]