প্রযুক্তিগত অদ্বৈতলগ্ন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

প্রযুক্তিগত অদ্বৈতলগ্ন বলতে ভবিষ্যতে সম্ভাব্য হিসেবে অনুমিত একটি অনন্যপূর্ব, অদ্বিতীয় লগ্ন বা মুহূর্তকে বোঝায়, যখন প্রযুক্তিগত প্রবৃদ্ধি ও উন্নতি এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে যে তা আর মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না (অনিয়ন্ত্রণযোগ্য) এবং সেটিকে পেছনে ফিরিয়ে আনা আর সম্ভব হবে না (অপ্রত্যাবর্তনীয়), এবং এর ফলে মানব সভ্যতায় অভাবিত পরিবর্তন আসবে।[১][২] একে ইংরেজি পরিভাষায় "টেকনোলজিকাল সিংগুলারিটি" (Technological singularity) বা সংক্ষেপে "সিংগুলারিটি" (Singularity) নামে ডাকা হয়।[৩] এই অনুমিতির সবচেয়ে জনপ্রিয় সংস্করণটি হল আই জে গুডের বুদ্ধিমত্তা বিস্ফোরণ প্রতিমান, যা অনুযায়ী একটি উন্নীতকরণযোগ্য বুদ্ধিমান কারক শেষ পর্যন্ত স্ব-উন্নয়ন চক্রগুলির একটি "পলায়নী বিক্রিয়া"তে প্রবেশ করবে, যেখানে প্রতিটি নতুন ও অধিকতর বুদ্ধিমান প্রজন্ম উত্তরোত্তর দ্রুততার সাথে আবির্ভূত হতে থাকবে, ফলে এক ধরনের বুদ্ধিমত্তার "বিস্ফোরণ" ঘটে একটি শক্তিশালী অতি-বুদ্ধিমত্তার জন্ম হবে, যেটি গুণগতভাবে সমগ্র মানব বুদ্ধিমত্তাকে অবলীলায় অতিক্রম করে যাবে[৪]

প্রযুক্তিগত পরিপ্রেক্ষিতে এরকম অদ্বৈতলগ্নের ধারণাটির প্রথম উল্লেখকারী ব্যক্তিটি হলেন বিংশ শতাব্দীর হাংগেরীয়-মার্কিন গণিতবিদ জন ভন নিউম্যান[৫] স্তানিসলাভ উলাম ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ভন নিউম্যানের সাথে একটি আলোচনা সম্পর্কে লেখেন যে আলোচনাটির কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল "প্রযুক্তির ত্বরণশীল প্রগতি ও এর ফলে মানব জীবনযাপনের পন্থায় একাধিক পরিবর্তন, যা মানবজাতির ইতিহাসে এমন কোনও মৌলিক, অদ্বৈতলগ্নের আবির্ভাবের আভাস দেয়, যে লগ্নের পরে আমরা মানব কর্মকাণ্ড বলতে যা জানি, তা আর অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়।"[৬] পরবর্তীতে আরও অনেক লেখক এই দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সহমত প্রকাশ করেছেন।[২][৭]

১৯৮৩ সালে মার্কিন গণিতবিদ, পরিগণক (কম্পিউটার) বিজ্ঞানী ও কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যিক ভার্নর ভিঞ্জি প্রযুক্তিগত অদ্বৈতলগ্ন ধারণাটিকে ও এটির ইংরেজি পরিভাষা "সিংগুলারিটি" শব্দটিকে ইংরেজিভাষী বিশ্বে জনপ্রিয় করতে সাহায্য করেন। তিনি ঐ বছর একটি নিবন্ধে দাবি করেন যে, যে মুহূর্তে বা লগ্নে মানুষেরা তাদের নিজের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সৃষ্টি করবে, সেই লগ্নে এমন একটি প্রযুক্তিগত ও সামাজিক অবস্থান্তর ঘটবে, যার সাথে জ্যোতির্বিজ্ঞানে আলোচিত "কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রে অবস্থিত গ্রন্থিবদ্ধ স্থানকালের" (অর্থাৎ মহাকর্ষীয় অদ্বৈত অবস্থানের) সাদৃশ্য আছে।[৮] ভিঞ্জ ১৯৯৩ সালে দ্য কামিং টেকনোলজিকাল সিংগুলারিটি (The Coming Technological Singularity) শিরোনামের আরেকটি প্রবন্ধে[৪][৭] লেখেন যে এই লগ্নটি পৃথিবীতে মানবযুগের সমাপ্তি ঘোষণা করবে, কেননা নতুন অতিবুদ্ধিমত্তাটি অব্যাহতভাবে নিজের উন্নতিসাধন করতে থাকবে এবং প্রযুক্তিগতভাবে এমন হারে অগ্রসর হবে, যা মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব হবে না। তিনি আরও লেখেন যে ২০০৫ থেকে ২০৩০-এর মধ্যে এ ব্যাপারটি ঘটলে তিনি অবাক হবেন না।[৪] অদ্বৈতলগ্নের ধারণাটিকে জনসমক্ষে প্রচারের আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ অবদানকারী হল রে কুর্জওয়াইল রচিত দ্য সিংগুলারিটি ইজ নিয়ার (The Singularity Is Near) গ্রন্থটি, যেখানে ২০৪৫ সালের আগে এই লগ্নের আবির্ভাবের ভবিষ্যৎবাণী করা হয়।[৭]

প্রয়াত স্টিভেন হকিংসহ বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী এ বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে কৃত্রিম অতিবুদ্ধিমত্তা (Artificial superintelligence বা ASI) মানবজাতির বিলুপ্তির কারণ হতে পারে।[৯][১০] অদ্বৈতলগ্নের পরিণাম ও এর সম্ভাব্য উপকারিতা বা ক্ষতির বিষয়ে তীব্র তর্ক-বিতর্ক চলমান আছে।

বিশিষ্ট প্রযুক্তিবিদ ও উচ্চশিক্ষায়তনিক ব্যক্তিত্বেরা প্রযুক্তিগত অদ্বৈতলগ্ন ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিস্ফোরণ সম্ভাব্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এদের মধ্যে আছেন পল অ্যালেন,[১১] জেফ হকিন্স,[১২] জন হ্যারি হল্যান্ড, জ্যারন ল্যানিয়ার, স্টিভেন পিংকার,[১২] থিওডোর মডিস,[১৩]গর্ডন মুর[১২] একটি দাবি অনুযায়ী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রবৃদ্ধির হার খুব সম্ভবত সময়ের সাথে সাথে মন্থর হয়ে আসবে, ত্বরণশীল হবে না, কেননা অতীতের মানবনির্মিত প্রযুক্তিগুলিতেও এই ব্যাপারটিই পরিলক্ষিত হয়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Collection of sources defining "singularity""singularitysymposium.com। ১৭ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ এপ্রিল ২০১৯ 
  2. Eden, Amnon H.; Moor, James H.; Søraker, Johnny H.; Steinhart, Eric, সম্পাদকগণ (২০১২)। Singularity Hypotheses: A Scientific and Philosophical Assessment। The Frontiers Collection। Dordrecht: Springer। পৃষ্ঠা 1–2। আইএসবিএন 9783642325601ডিওআই:10.1007/978-3-642-32560-1 
  3. Cadwalladr, Carole (২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)। "Are the robots about to rise? Google's new director of engineering thinks so…"The Guardian। সংগ্রহের তারিখ ৮ মে ২০২২ 
  4. Vinge, Vernor. "The Coming Technological Singularity: How to Survive in the Post-Human Era" ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০১৮-০৪-১০ তারিখে, in Vision-21: Interdisciplinary Science and Engineering in the Era of Cyberspace, G. A. Landis, ed., NASA Publication CP-10129, pp. 11–22, 1993.
  5. The Technological Singularity by Murray Shanahan, (MIT Press, 2015), p. 233.
  6. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; ulam1958 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  7. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; chalmers2010 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  8. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; dooling2008-88 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  9. Sparkes, Matthew (১৩ জানুয়ারি ২০১৫)। "Top scientists call for caution over artificial intelligence"The Telegraph (UK)। ৭ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ এপ্রিল ২০১৫ 
  10. "Hawking: AI could end human race"। BBC। ২ ডিসেম্বর ২০১৪। ৩০ অক্টোবর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ নভেম্বর ২০১৭ 
  11. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; Allen2011 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  12. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; ieee-lumi নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  13. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; modis2012 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি

উৎসপঞ্জি[সম্পাদনা]

আরও পড়ুন[সম্পাদনা]

  • Krüger, Oliver, Virtual Immortality. God, Evolution, and the Singularity in Post- and Transhumanism., Bielefeld: transcript 2021. আইএসবিএন ৯৭৮-৩-৮৩৭৬-৫০৫৯-৪
  • Marcus, Gary, "Am I Human?: Researchers need new ways to distinguish artificial intelligence from the natural kind", Scientific American, vol. 316, no. 3 (March 2017), pp. 58–63. Multiple tests of artificial-intelligence efficacy are needed because, "just as there is no single test of athletic prowess, there cannot be one ultimate test of intelligence." One such test, a "Construction Challenge", would test perception and physical action—"two important elements of intelligent behavior that were entirely absent from the original Turing test." Another proposal has been to give machines the same standardized tests of science and other disciplines that schoolchildren take. A so far insuperable stumbling block to artificial intelligence is an incapacity for reliable disambiguation. "[V]irtually every sentence [that people generate] is ambiguous, often in multiple ways." A prominent example is known as the "pronoun disambiguation problem": a machine has no way of determining to whom or what a pronoun in a sentence—such as "he", "she" or "it"—refers.
  • Scaruffi, Piero, "Intelligence is not Artificial" (2016) for a critique of the singularity movement and its similarities to religious cults.

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]