পুনথানম্ নাম্বুদিরি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
পুনথানম্ নাম্বুদিরি
পুনথানম্ নাম্বুদিরির মূর্তি, গুরুবায়ুর, কেরালা
ব্যক্তিগত তথ্য
জন্ম১৫৪৭ খ্রিস্টাব্দ
কিজহাট্টুর, পেরিন্থালামান্না মালাপ্পুরম জেলা, কেরালা
মৃত্যু১৬৪০ খ্রিস্টাব্দ
ধর্মহিন্দুধর্ম
যে জন্য পরিচিতকবি, বৈষ্ণবধর্ম (কৃষ্ণ)

পুনথানম নাম্বুদিরি (১৫৪৭ – ১৬৪০ ) ছিলেন একজন বিখ্যাত কবি এবং গুরুভায়ুরাপ্পানের ভক্ত। তিনি বর্তমান কেরালার ভারতের মালাপ্পুরম জেলায় কিজহাট্টুরে বাস করতেন। তার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ জ্ঞানাপ্পান ( মালয়ালমঃ "ঐশ্বরিক জ্ঞানের গান") এর জন্য তাকে স্মরণ করা হয়। মালায়ালম্ ভাষায় তাঁর অন্যান্য প্রধান কবিতা হল ভাষা কর্ণামৃতমকুমারহরণম্ বা সান্তনাগোপালম্ পানা । তাঁর অন্যান্য অবদানের মধ্যে রয়েছে সংস্কৃতে রাঘবিয়ম্ , বিষ্ণুবিলাসম্সীতারাঘবম্ এবং আধুনিক মালায়ালম ভাষায় বিষ্ণুগীতাপঞ্চতন্ত্রম্

অনেক স্তোত্র, প্রার্থনা গান যা আজও কেরালায় জনপ্রিয় তা পুনথানমের প্রতি আরোপিত।

জীবনের প্রথমার্ধ[সম্পাদনা]

পুনথানম্ ১৫৪৭ সালে মাসি মাসে অশ্বিনী দিনে মালাপুরম জেলার পেরিন্থালমান্নার কাছে কিজহাট্টুরে একটি নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। [১] তিনি বিশ বছর বয়সে বিয়ে করেন কিন্তু দীর্ঘদিন তাদের কোন সন্তান ছিল না। তিনি '[সন্তান গোপালম]' পাঠ করে গুরুবায়ুর ভগবানকে সন্তুষ্ট করলে একটি পুত্রের জন্ম হয়। তিনি একটি মঙ্গল সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেন। এতে পরিচিত সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু অন্নপ্রাশনম্ অনুষ্ঠানের এক ঘন্টা আগে শিশুটি মারা যায়। [২] শোকগ্রস্ত পুনথানম্ গুরুবায়ুরের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন এবং কুমারহরণম্ পুরাণ কাহিনী পাঠ করে প্রার্থনা শুরু করেন। বলা হয়, ভগ্ন হৃদয় পুন্থানমকে গুরুবায়ুরাপ্পান স্বয়ং সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। তিনি একটি শিশুরূপে এক মুহূর্তের জন্য তাঁর কোলে শুয়েছিলেন। তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নিজের পুত্র মনে করতে থাকেন ও জ্ঞান অর্জন করেন। জ্ঞানাপ্পানে তিনি লিখেছেন: "ছোট কৃষ্ণ যখন আমাদের হৃদয়ে নাচছেন, আমাদের কি নিজেদের ছোটদের দরকার আছে?" পুনথানম্ তার বাকি জীবন ভাগবতম্ পাঠ করে ও সরল মালায়ালম ভাষায় প্রভুর মহিমা গান করে অতিবাহিত করেছেন। তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা 'জ্ঞানাপ্পান' এই সময়ে রচিত হয়েছিল। [৩] তার বাড়ি পুন্থানম ইল্লম্ বর্তমানে গুরুবায়ুর দেবস্বমের অধীনে রয়েছে। [৪]

কিংবদন্তী[সম্পাদনা]

পুনথানমকে মনোগ্রাহী ভাগবত পাঠের জন্য মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা করত। উত্তর কেরালায় কোট্টিয়ুর নামে একটি মন্দির রয়েছে। মন্দিরের প্রধান দেবতা হলেন শিব। মন্দিরটি বছরে মাত্র কয়েকদিন খোলা রাখা হত। বছরের বাকি সময় ওই জায়গায় কোনো উৎসব ও কর্মকাণ্ড ছিল না। একবার পুনথানম্ কোট্টিয়ুর মন্দিরে পৌঁছে পবিত্র নদীতে স্নান করলেন। তিনি করুণাময় ভগবান শিবের উপাসনা করলেন, প্রফুল্ল অনুভব করলেন এবং সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করলেন। তিনি দেবতার সামনে প্রতিদিন ভাগবত পাঠ করতেন। তিনি "ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাণী রুক্মিণীকে উত্যক্ত করলেন" নামক শ্রীমদ্ভাগবতের ১০ম স্কন্ধের ৬০ অধ্যায়ের ভগবানের বিস্ময়কর লীলা মধুর কণ্ঠে পাঠ করছিলেন। একদা ভগবান তার প্রিয় স্ত্রী রানী রুক্মিণীকে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন।রুক্মিণী তাকে কতটুকু ভালোবাসেন তা রুক্মিনীর নিকট থেকে শুনতে চান। তিনি কৌতুকপূর্ণভাবে রুক্মিণীকে জিজ্ঞাসা করেন, কেন তিনি ভগবানকে বিবাহ করলেন। যদিও তার কাছে রাজা শিশুপাল, শাল্ব, জরাসন্ধ ইত্যাদি আরও বড় বড় বীররাজাদের সাথে বিবাহের প্রস্তাব এসেছিল। এই কথা শুনে রানী রুক্মিণী অজ্ঞান হয়ে যান এবং ভগবান তাকে সান্ত্বনা দেন। এটি হলো এই অধ্যায়ের সারাংশ। পুনথানম্ অধ্যায়ের এই অংশটি পড়া শেষ করলেন এবং অধ্যায়ের শেষে তা চিহ্নিত রাখলেন, যাতে তিনি পরে পরবর্তী অধ্যায় থেকে পাঠ চালিয়ে যেতে পারেন। পরের দিন, অবাক হয়ে, তিনি ভাগবতে একই অধ্যায়ের শুরুতে, পুস্তক-চিহ্নটি খুঁজে পেলেন।

পুনরায় পুনথানম্ একই অংশ দ্বিতীয়বার পাঠ করলেন।বাকি দিনগুলিতেও সেই একই ব্যাপার ঘটেছিল।পুনথানম্ ভাগবতের সেই একই অংশ বারবার পাঠ করছিলেন। মন্দির উন্মুক্ত থাকার শেষ দিন পুনথানম্ পাঠ শেষ করে অন্য ভক্তদের সাথে মন্দির থেকে ফিরে যাচ্ছিলেন।কিন্তু কোনোক্রমে মন্দিরে ভাগবতটি ফেলে যান। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ তার মনে পড়ল,তিনি ভাগবতটি সঙ্গে আনতে ভুলে গেছেন। তিনি দ্রুত মন্দিরে ফিরে গেলেন; নদী পেরিয়ে মন্দিরের প্রবেশদ্বারে পৌঁছলেন, কিন্তু মন্দির বন্ধ ছিল। সেখানে তিনি একাই ছিলেন। তিনি মন্দিরের অভ্যন্তরে কাউকে ভাগবতের সেই অধ্যায়,যা পুনথানম বারবার পাঠ করতেন; সেই একই অধ্যায় কাউকে বারবার পাঠ করতে শুনতে পেলেন। তিনি দরজার চাবির ছিদ্রের মধ্য দিয়ে তাকালেন এবং দেখলেন, স্বয়ং ভগবান শিব পুনথানমের ভাগবত পাঠ করছেন। মাতা পার্বতী ও তাঁদের সেবক অন্যান্য ভূতগণ তা শ্রবণ করছিলেন।ভক্তিতে তাদের চোখ জলে ভরে গেল। পুনথানম্ সেখানে নির্বিকার দাঁড়িয়ে ভগবান শিবের কন্ঠে পুরো ভাগবত কথা শ্রবণ করলেন। শেষে ভগবান শিব পার্বতী দেবীকে জিজ্ঞাসা করলেন, "তোমার কি আমার ভাগবত পাঠ পছন্দ হয়েছে"? পার্বতী উত্তর দিলেন, "হ্যাঁ, আপনার পাঠ চমৎকার ছিল, কিন্তু পুনথানমের মতো অত ভাল ছিল না"। ভগবান শিব উত্তর দিলেন, "হ্যাঁ।তা সত্যি। আমি পুনথানমের থেকেই ভাগবত শ্রবন করতে পছন্দ করি। এই কারণেই আমি প্রতিদিন একই বিষয়ের শুরুতে বারবার চিহ্নিত করে রাখতাম।” এই কথা শুনে পুনথানম বাইরে দাঁড়িয়ে কেঁপে উঠলেন এবং উচ্চস্বরে শ্রীকৃষ্ণের দিব্য নাম কীর্তন করলেন। তিনি আবার দেখলেন, ভগবান শিব ও মাতা পার্বতী তাঁর দৃষ্টির আড়ালে অন্তর্হিত হয়ে গেছেন।

আর এক কিংবদন্তিতে বলা হয়েছে, তিনি প্রতি মাসে ভগবান গুরুভায়ুরাপ্পানকে দর্শন করতে প্রায় ১০০ কিলোমিটার হেঁটে যেতেন। মন্দিরে যাওয়ার পথটি খুবই বিপদসংকুল ছিল। দিনের আলোতেও সেই পথ দিয়ে হাঁটা খুবই অনিরাপদ ছিল। একবার পুনথানম পথিমধ্যে বনের মধ্যে কিছু ডাকাত দ্বারা আক্রান্ত হয়।তার কাছে টাকা,আংটি যা কিছু ছিল সবই সে তাদের দিয়ে দিল, তবুও তারা তাকে ছাড়ল না। তারা তার ছোট ভাগবত বইটিও নিতে চাইল যেটি পুনথানম আঁকড়ে ধরে ছিল। ভাগবত বইটিই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র সম্বল,যা তিনি কারো সাথে ভাগ করতে চাননি। পুনথানম যখন বললেন, এটি শুধুমাত্র একটি বই ছাড়া আর কিছুই নয় , চোরেরা তাও আশ্বস্ত হল না। তখন তিনি চোখ বন্ধ করে ভগবানকে সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে লাগলেন। তখন সেই নির্জন স্থানটি ডাকাতদের গর্জন এবং পুনথানমের উচ্চারিত নারায়ণ মন্ত্রে গুঞ্জরিত হয়ে উঠল। আওয়াজ শুনে একজন লোক ঘোড়ায় চড়ে এসে সেই ডাকাতদের সাথে লড়াই করে, ডাকাতদের দ্বারা ছিনতাই কৃত পুনথানমের টাকা ও আংটি ফেরত দিল। তিনি নিজেকে জামোরিন রাজার মন্ত্রী হিসাবে পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি বনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। পুনথানম খুব খুশি হলেন; তিনি যুবক লোকটিকে ধন্যবাদ জানালেন। পুনথানম্ তাকে তার আংটিটি উপহার হিসেবে দিলেন। মন্ত্রী তার উপহার গ্রহণ করে মন্দিরে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সেই রাতে, গুরুবায়ুর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত একটি স্বপ্ন দেখলেন, যেখানে তাকে বলা হল, "তুমি বিগ্রহের হাতের আঙুলে একটি আংটি দেখতে পাবে।তা পুনথানামকে দিয়ে দিও, সে আগামীকাল এই মন্দিরে আসবে।" বেশ অলৌকিকভাবে, পরের দিন সকালে প্রধান পুরোহিত যখন পূজা করতে মন্দিরে গেলেন তখন তিনি দেবতার আঙুলে একটি আংটি দেখতে পেলেন। পুনথানম ভগবৎ দর্শনের জন্য অবিলম্বে গুরুবায়ুর মন্দিরে উপস্থিত হলেন। প্রধান পুরোহিত দেবতার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে পুনথানমকআংটিটি দিলেন এবং তাঁকে বললেন, কী ঘটেছে। পুনথানম তার নিজের আংটিটি দেখে বিস্মিত হলেন, তিনি এটি গতকাল জামোরিন মন্ত্রীকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। তখন তিনি বুঝতে পারলেন, আসলে তার প্রিয় ভগবান গুরুভায়ুরাপ্পান নিজেই ব্যক্তিগতভাবে একজন মন্ত্রীর ছদ্মবেশে তাকে ডাকাতদের কবল থেকে উদ্ধার করতে এসেছিলেন।

জীবনাবসান[সম্পাদনা]

কিংবদন্তি অনুসারে, ১৬৪০ সালে পুনথানম্ তাঁর পার্থিব দেহ ত্যাগ করেন। যখন তিনি তার প্রভুর ধামের উদ্দেশ্যে তার প্রস্থানের ঘোষণা দেন, তখন তিনি কোন এক ব্যক্তিকে তার সাথে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানান। সমস্ত গ্রামবাসী তার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছিল। শেষ পর্যন্ত, শুধুমাত্র একজন দাসী যে তার অসুস্থ স্ত্রীর দেখাশোনা করত এই যাত্রায় তার সাথে যোগ দেয়। [২] [৫]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. I K K Menon (১৯৯৫)। Folk Tales of Kerala। Publications Division Ministry of Information & Broadcasting Government of India। পৃষ্ঠা 194–। আইএসবিএন 978-81-230-2188-1 
  2. "Devotee the Lord loved"The Hindu। ২০ জুলাই ২০১২। 
  3. "Guruvayur Devaswom"www.guruvayurdevaswom.org। ২০০৫-০২-১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  4. "Steps to develop Poonthanam Illam"The Hindu। ১৪ জুলাই ২০০৬। ৩০ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  5. "To lovers of Krishna, in Tamil"The Hindu। ১৯ জুলাই ২০১২।