দৈহিক নকশা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
প্রাণীদের আধুনিক গোষ্ঠীগুলো তাদের দৈহিক কাঠামোর বিন্যাস অনুযায়ী গোষ্ঠীভুক্ত হতে পারে, তাই বলা হয় তারা বিভিন্ন দৈহিক নকশার অধিকারী।

একটি দৈহিক নকশা, Body plan, Bauplan (জার্মান বহুবচন Baupläne), অথবা Ground plan হল একটি প্রাণি পর্বের কতকগুলো সদস্যদের মধ্যে বিদ্যমান সাধারণ অঙ্গসংস্থানিক বৈশিষ্ট্যসমূহের একটি সেট।[১] মেরুদণ্ডীদের দৈহিক নকশা অনেকের মধ্যে একটি: অমেরুদণ্ডীরা অনেকগুলো পর্ব নিয়ে গঠিত।

এই শব্দটি, সাধারণত প্রাণীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। শব্দটি দ্বারা প্রতিসাম্য, খণ্ডকায়ন এবং উপাঙ্গের বিন্যাসের মতো বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত কারী একটি "নীলনকশা" বোঝায়। বিবর্তনীয় বিকাশমূলক জীববিজ্ঞান বিভিন্ন দৈহিক নকশার উৎস ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে।

দৈহিক নকশা ঐতিহাসিকভাবে ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণের এক ঝলকে বিকশিত হয়েছিল বলে বিবেচিত হয়, কিন্তু প্রাণী বিবর্তনের আরও সূক্ষ্ম বোধগম্যতা ইঙ্গিত দেয় যে দৈহিক নকশাগুলোর বিকাশ প্রারম্ভিক প্যালিওজোয়িক জুড়ে ধীরে ধীরে সংঘটিত হয়েছে।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

দৈহিক নকশাগুলোর আবিষ্কারের ইতিহাসকে মেরুদন্ডী প্রাণি কেন্দ্রিক একটি বিশ্বদর্শনের আন্দোলন হিসেবে দেখা যেতে পারে, মেরুদণ্ডী বা কর্ডেটদের অন্যতম একটি পর্বীয় দৈহিক নকশা হিসেবে দেখার জন্য। অগ্রণী প্রাণিবিদদের মধ্যে লিনিয়াস মেরুদণ্ডীদের বাইরে দুটি দৈহিক নকশা চিহ্নিত করেছিলেন; কুভিয়ার তিনটি; এবং হেকেল চারটি, পাশাপাশি আরও আটটি প্রোটিস্টা সহ মোট বারোটি। তুলনা করার জন্য, আধুনিক প্রাণিবিজ্ঞানীদের দ্বারা স্বীকৃত পর্বের সংখ্যা বেড়ে ছত্রিশে এসে দাঁড়িয়েছে।[১]

লিনিয়াস, ১৭৩৫[সম্পাদনা]

১৭৩৫ সালের তাঁর সিস্টেমা ন্যাচারাই বইতে, সুইডিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী লিনিয়াস প্রাণিদেরকে চতুষ্পদী, পাখি, "উভচর" (কচ্ছপ, গিরগিটি এবং সাপ সহ), মাছ, "পোকামাকড়" (কীট-পতঙ্গ, যাতে তিনি অন্তর্ভুক্ত করেন অ্যারাকনিড, ক্রাস্টাসিয়ান এবং সেন্টিপিডদের ) এবং "কৃমি" (ভার্মিস) তে শ্রেণীবদ্ধ করেন। লিনিয়াসের ভার্মিস কার্যকরভাবে অন্যান্য সমস্ত প্রাণী গোষ্ঠীদের অন্তর্ভুক্ত করেছিল, কেবল ফিতা কৃমি, কেঁচো বা জোঁকই নয় বরং মল্লাস্কা পর্বের প্রাণী, সামুদ্রিক অর্চিন এবং তারামাছ, জেলিফিশ, স্কুইডকাটলফিশ[২]

কুভিয়ার, ১৮১৭[সম্পাদনা]

হেকেলের Generelle Morphologie der Organismen (১৮৬৬) থেকে গৃহীত 'Monophyletischer Stambaum der Organismen', তিন শাখার সঙ্গে প্লান্টি, প্রোটিস্টা ,অ্যানিমালিয়া

ফরাসি প্রাণিবিজ্ঞানী জর্জেস কুভিয়ার, ১৮১৭ সালে তাঁর রচয়িত "প্রাণি জগৎ" (Le Règne Animal) বইতে, প্রাণী জগৎকে চারটি দৈহিক নকশায় বিভক্ত করার জন্য তুলনামূলক অ্যানাটমি এবং জীবাশ্ম বিজ্ঞান[৩] থেকে প্রমাণাদি সম্মিলিত করেন। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে প্রধান অঙ্গব্যবস্থা হিসাবে গ্রহণ করে যা রক্ত সঞ্চালন এবং পরিপাক তন্ত্রের মতো অন্য সবগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে, কুভিয়ার চারটি দৈহিক নকশা বা embranchements পৃথক করেনঃ[৪]

  1. একটি মস্তিষ্ক এবং সুষুম্না কাণ্ড বিশিষ্ট (অস্থি উপাদান দ্বারা বেষ্টিত)[৪]
  2. স্নায়ু তন্তু দ্বারা সংযুক্ত অঙ্গ বিশিষ্ট [৪]
  3. অন্ননালির নিচে দুটি গ্যাংলিয়ার সাথে একটি ব্যান্ড দ্বারা সংযুক্ত দুটি অনুদৈর্ঘ্য, অঙ্কীয় স্নায়ু রজ্জু বিশিষ্ট[৪]
  4. বিক্ষিপ্ত, স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান নয় এমন স্নায়ু তন্ত্র বিশিষ্ট [৪]

 : এই দৈহিক নকশা প্রাণীগুলো চার শাখাতে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়েছে, যথা- মেরুদন্ডী, মলাস্কা, আর্টিকুলাটা (পোকামাকড় এবং এনিলিড সহ) এবং জুওফাইট বা রেডিয়াটা।

হেকেল, ১৮৮৬[সম্পাদনা]

আর্নস্ট হেকেল, ১৮৮৬ সালের "জীবের সাধারণ অঙ্গসংস্থান" (Generelle Morphologie der Organismen) বইতে দৃঢ়ভাবে জানিয়েছিলেন যে উদ্ভিদ, প্রোটিস্টা এবং প্রাণীতে বিভক্ত সমস্ত জীবজন্তু হল মনোফাইলেটিক (একক বিবর্তনীয় উৎস থেকে আগত)। তাঁর প্রোটিস্টা মোনেরেস, প্রোটোপ্লাস্টস, ফ্ল্যাজেলেটস, ডায়াটমস, মিক্সোমাইসেটিস, মিক্সোসিসটোডস, রাইজোপডস এবং স্পঞ্জে বিভক্ত ছিল। তাঁর প্রাণীগুলি পৃথক পৃথক দৈহিক নকশা বিশিষ্ট বিভিন্ন দলে বিভক্ত ছিল: তিনি এদের নাম রেখেছিলেন পর্ব। হেকেলের প্রাণী পর্বগুলো ছিল সিলেনটারেটস, একাইনোডার্মস এবং (কুভিয়ারের অনুসরণ করে) আর্টিকুলেটস, মল্লাস্কাস এবং ভার্টিব্রেটস।[৫]

গোল্ড, ১৯৭৯[সম্পাদনা]

স্টিফেন জে গোল্ড এই ধারণাটি অনুসন্ধান করেছিলেন যে দৈহিক নকশা, যা তাদের স্থায়ী অবস্থার চিত্র তুলে ধরে, তার মাধ্যমে বিভিন্ন পর্ব অনুধাবন করা যেতে পারে। যাইহোক, পরে তিনি বিরতিযুক্ত ভারসাম্যের পক্ষে এই ধারণা ত্যাগ করেছিলেন।[৬]

উৎস[সম্পাদনা]

৩৬ টি দৈহিক নকশার মধ্যে ২০ টি ক্যামব্রিয়ান যুগে,[৭]"ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণে" উদ্ভূত হয়েছিল [৮] তবে, অনেক পর্বের সম্পূর্ণ দৈহিক নকশা অনেক পরে প্যালিওজোয়িক যুগে বা তারও পরে আবির্ভূত হয়।[৯]

দৈহিক নকশার বর্তমান পরিসীমা সমগ্র জীবনের সম্ভাব্য নিদর্শনগুলো থেকে অনেক দূরে: প্রাক-ক্যামব্রিয়ান এডিয়াকারান বায়োটায় অন্তর্ভুক্ত দৈহিক নকশা বর্তমানে জীবিত প্রাণীর মধ্যে পাওয়া যায় এমন কোনটার সাথেই মিল নেই, যদিও অসম্পর্কিত আধুনিক ট্যাক্সার সামগ্রিক বিন্যাস একেবারে অনুরূপ।[১০] তাই ধারণা করা হয় ক্যাম্ব্রিয়ান বিস্ফোরণটি এর পূর্বে বিদ্যমান দৈহিক নকশার পরিসীমাটিকে কমবেশি পুরোপুরি প্রতিস্থাপিত করেছে।[৭]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Valentine, James W. (২০০৪)। On the Origin of Phyla। পৃষ্ঠা 33। আইএসবিএন 978-0226845487 
  2. Linnaeus, Carolus (১৭৩৫)। Systema naturae, sive regna tria naturae systematice proposita per classes, ordines, genera, & species। Haak। পৃষ্ঠা 1–12। 
  3. Reiss, John (২০০৯)। Not by Design: Retiring Darwin's Watchmaker। University of California Press। পৃষ্ঠা 108। আইএসবিএন 978-0-520-94440-4 
  4. De Wit, Hendrik Cornelius Dirk De Wit. Histoire du Développement de la Biologie, Volume III, Presses Polytechniques et Universitaires Romandes, Lausanne, 1994, p. 94-96. আইএসবিএন ২-৮৮০৭৪-২৬৪-১
  5. Haeckel, Ernst. Generelle Morphologie der Organismen : allgemeine Grundzüge der organischen Formen-Wissenschaft, mechanisch begründet durch die von Charles Darwin reformirte Descendenz-Theorie. (1866) Berlin
  6. Bowler, Peter J. (2009). Evolution: the History of an Idea. California, p. 364.
  7. Erwin, Douglas; Valentine, James (১৯৯৭)। "Recent fossil finds and new insights into animal development are providing fresh perspectives on the riddle of the explosion of animals during the Early Cambrian" 
  8. Erwin, D. H. (১৯৯৯)। "The Origin of Bodyplans": 617–629। ডিওআই:10.1093/icb/39.3.617অবাধে প্রবেশযোগ্য 
  9. Budd, G. E.; Jensen, S. (২০০০)। "A critical reappraisal of the fossil record of the bilaterian phyla": 253–95। ডিওআই:10.1111/j.1469-185X.1999.tb00046.xপিএমআইডি 10881389 
  10. Antcliffe, J. B.; Brasier, M. D. (২০০৭)। "Charnia and sea pens are poles apart": 49–51। ডিওআই:10.1144/0016-76492006-080 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]