দেবী লক্ষ্মীর পাঁচালী
লক্ষ্মীকে নিয়ে বাংলার জনসমাজে বিভিন্ন জনপ্রিয় গল্প প্রচলিত আছে। এই গল্পগুলি পাঁচালির আকারে লক্ষ্মীপূজার দিন পাঠ করা হয়। একে লক্ষ্মীর পাঁচালি বলে। লক্ষ্মীর ব্রতকথাগুলির মধ্যে "বৃহস্পতিবারের ব্রতকথা" সবচেয়ে জনপ্রিয়। এছাড়াও "বারোমাসের পাঁচালি"-তেও লক্ষ্মীকে নিয়ে অনেক লৌকিক গল্পের উল্লেখ পাওয়া যায়।
শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর ব্রতকথা ও পাঁচালী | |
---|---|
বৃহস্পতিবারের ব্রতকথা | |
সম্পূর্ণ নাম | শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর ব্রতকথা ও পাঁচালী |
অপর নাম | বৃহস্পতিবারের ব্রতকথা |
রচয়িতা | জনৈক বরিশালবাসী |
Audience | বাঙালি হিন্দু সধবারা |
ভাষা | বাংলা |
রচনাকাল | খ্রিস্টীয় ১৮শ-১৯শ শতাব্দী |
রচনাস্থল | বরিশাল বিভাগ, বাংলাদেশ |
State of existence | বহুপঠিত |
Authenticity | জনৈক বরিশালবাসী |
পুথি | ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরি |
প্রধান পুথি | ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরি |
বর্গ | পাঁচালি সাহিত্য,লক্ষ্মীর ব্রতকথা |
Verse form | পাঁচালি বা পঞ্চপদী পংক্তিযুক্ত গীতিকবিতা |
বিষয় | লক্ষ্মীর ব্রতকথা, লক্ষ্মীদেবীর বৃহস্পতিবারের ব্রত ও পূজার প্রচলন সম্পর্কে একটি লৌকিক গল্প। |
Setting | শ্রীবিষ্ণুর বৈকুন্ঠ পুর, মর্ত্ত্যলোকের অবন্তীনগর বা অবন্তী ধাম, শ্রী নগর |
Period covered | মধ্যযুগীয় |
চরিত্র | লক্ষ্মী দেবী , প্রভু নারায়ণ, মুনিবর নারদ, ধনেশ্বর রায়, ধনেশ্বর রায়ের স্ত্রী, শ্রীনগরবাসী বণিক-তনয় |
'পাঁচালি' বা 'পাঁচালী'র অর্থ
[সম্পাদনা]"পাঁচালি" শব্দটির সাথে অসম, গুজরাট , বঙ্গদেশ ও রাজস্থানের ঐতিহাসিক সংযোগ রয়েছে।
"পাঁচালি" শব্দটির বহুমুখী অর্থ রয়েছে, পৌরাণিক দ্রৌপদী থেকে শুরু করে নৃত্যশৈলী ও
কাব্যিক লোককথা অবধি এর প্রসার। তবে প্রধানত পাঁচালি শব্দের দুটি অর্থ : (১) পুতুল নাচ এবং (২) পঞ্চপদী পংক্তিযুক্ত আখ্যানমূলক গীতিকবিতা।
পুতুল নাচ হিসেবে পাঁচালি
[সম্পাদনা]বিভিন্ন সংস্কৃতিতে, "পাঁচালি" প্রায়শই পুতুলনাচ এর সাথে যুক্ত থাকে । কালিকা পুরাণেও শিশুদের বিনোদনের অংশ হিসেবে "পাঁচালি বিহার" (পুতুল নাচ ) -এর বর্ণনা করা রয়েছে।
পঞ্চপদী পংক্তিযুক্ত গীতিকবিতা
[সম্পাদনা]বাংলা সঙ্গীত এবং কবিতায় "পাঁচালি" নামটি সম্ভবত এর গঠন থেকে এসেছে, যেখানে প্রতিটি পংক্তিতে গড়ে পাঁচটি শব্দ থাকে।
উদাহরণস্বরূপ-
"সাত কান্ড রামায়ণ, দেবেরা সৃজিত।
লোক বুঝাইতে কৈল, কৃত্তিবাস পণ্ডিত।।"
লক্ষ্মীবারের ব্রত ও পূজাবিধি
[সম্পাদনা]বাঙালি হিন্দুরা প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর সাপ্তাহিক পূজা করে থাকেন। এই পূজা সাধারণত বাড়ির সধবা স্ত্রীলোকেরাই করে থাকেন। লৌকিক বিশ্বাস অনুসারে প্রতি বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীপূজা করিলে নারীগণ বৈধব্য যন্ত্রণা পায় না এবং স্বামী-পুত্রাদি ও পরিজনবর্গ নিয়ে যাবজ্জীবন সুখস্বচ্ছন্দে কালাতিপাত করে।
ব্রতবিধি
[সম্পাদনা]প্রতি বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীপূজার কোন তিথি-নক্ষত্রের বিধিনিষেধ নাই। সন্ধ্যাকালে সধবা স্ত্রীলোক পূজার স্থান পরিষ্কার পূর্বক গৃহে ধূপ-ধুনা, প্রদীপাদি জ্বালাইয়া পবিত্র মনে পূজা করিবে। যথাবিধি ঘটস্থাপন পূর্বক গণপত্যাদি নানা দেবতার (গণেশাদি পঞ্চ দেবতা, আদিত্যাদি নবগ্রহ, ইন্দ্রাদি দশদিক্পাল) পূজা করিয়া একটি সচন্দন পুষ্প লইয়া "ওঁ শ্রীং লক্ষ্মৈ নমঃ” এই মন্ত্রে পুষ্পটি ঘটে দিয়া লক্ষ্মীদেবীর ধ্যান করিতে হয়। অনন্তর পুষ্পাঞ্জলি দিয়া গায়ত্রী মন্ত্র পাঠ ও প্রণাম করিবে। তৎপরে বিষ্ণু, কুবের ও ইন্দ্রের পুজা করিবে। প্রত্যেক নারীকেই হস্তে দূর্বা লইয়া ব্রতকথা শুনিতে বা পাঠ করিতে হয়। পূজান্তে ব্রতকথা পাঠের পর প্রসাদ বিতরণ ও এয়োতির সীমন্তে সিন্দুর দিয়া নিজেকে সিন্দুর পরিতে হয়।
পুজোর যোগাড়
[সম্পাদনা]ঘটস্থাপন
[সম্পাদনা]একটি ঘট বা ঘটিতে গঙ্গাজল পূর্ণ করিয়া (গঙ্গাজল অভাবে কূপজল হইলেও চলিবে) তাহাতে একটি আম্রশাখা, একটি ফল (সশীর্ষ, ডাব বা কলা) সিন্দুর ও ঘটের নীচে একটু মাটি এবং সামান্য ধান্য দিবে।
উপচার
[সম্পাদনা]পান, সুপারি ও সিন্দুরগোলা, নানারূপ ফল, আতপ চাউলের নৈবিদ্য ও মিষ্টান্ন যথাসাধ্য।
নিষেধ
[সম্পাদনা]লক্ষ্মীপূজায় ঘন্টা বাজাইতে নাই।
পূজাপদ্ধতি
[সম্পাদনা](১)
[সম্পাদনা]বিশুদ্ধ বস্ত্র পরিধানপূর্বক পূর্ব বা উত্তরমুখ বসিয়া 'নমো বিষ্ণু' বলিয়া তিনবার জলের ছিটা দিবে।
(২)
[সম্পাদনা]"নমো অপবিত্রঃ পবিত্রো বা সর্বাবস্থাং গতোহপি বা যঃ স্মরেৎ পুন্ডরীকাক্ষং স বাহ্যাভ্যন্তরঃ শুচি" এই মন্ত্রে যব, হরিতকী সামান্য জল হাতে করিয়া মাথায় জলের ছিটা দিবে।
(৩)
[সম্পাদনা]সঙ্কল্প:
[সম্পাদনা]"বিষ্ণুর্নমোহদ্য
অমুকে মাসি
অমুকে পক্ষে
অমুক তিথৌ
অমুক গোত্রা
শ্রীঅমুকী দেবী (বা দাসী)
শ্রীলক্ষ্মীপ্রীতিকামাঃ
পূজনমহং করিষ্যে"
--- মাস-পক্ষ-তিথি-গোত্র-নাম বলে সংকল্প করে মাটিতে ঘট রাখিবে।
(৪)
[সম্পাদনা]পরে ঘট ধরিয়া মন্ত্র বলিবে 'সর্বতীর্থোদ্ভবং বারি সর্বদেবী সমন্বিতং ইমং ঘটং সমারুহ্য তিষ্ট দেবী স্থিরা ভব'।
(৫)
[সম্পাদনা]কোশাতে জল রাখিয়া 'নমঃ গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরী সরস্বতি নৰ্ম্মদে সিন্ধুকাবেরি জলেহস্মিন সন্নিধিং কুরু। কুরুক্ষেত্রে গয়াগঙ্গা প্রভাস পুষ্করাণি চ, পুণ্যান্যেতানি তীর্থানি পূজাকালে ভবস্তিহ'।
(৬)
[সম্পাদনা]এই মন্ত্রে জল নাড়িবে এবং 'নমঃ' মন্ত্রে তিনবার আতপ চাউল ঐ জলে দিবে।
(৭)
[সম্পাদনা]ফুলে শ্বেত-চন্দনের ছিটা দিয়া "এতে গন্ধপুষ্পে নমো বিঘ্ননাশায় নমঃ” বলিয়া ঘটে দিবে।
(৮)
[সম্পাদনা]এইরূপে ক্রমে গণপত্যাদি নানা দেবতার স্মরণ করিবে:-
"এতে গন্ধপুষ্পে নমো শিবাদিপঞ্চদেবেভ্যো নমঃ,
এতে গন্ধপুষ্পে নমঃ আদিত্যাদি নবগ্রহেভ্যো নমঃ,
এতে গন্ধপুষ্পে নমো ইন্দ্রাদি-দশদিকপালেভ্যো নমঃ,
এতে গন্ধপুষ্পে নমো নারায়ণায় নমঃ।
এতে গন্ধপুষ্পে শ্রীগুরবে নমঃ,
এতে গন্ধপুষ্পে নমো সর্বেভ্যো দেবেভ্যো নমঃ,
এতে গন্ধপুষ্পে নমো সর্বাভ্যো দেবীভ্যো নমঃ।"
(৯)
[সম্পাদনা]হস্তে পুষ্প লইয়া দেবী লক্ষ্মীর ধ্যান করিবে ও ঐ পুষ্প নিজ মস্তকে দিবে। মন্ত্র যথাঃ- " নমঃ পশাক্ষমালিকাম্ভোজসৃণিভির্য্যাম্য সৌম্যয়োঃ। পদ্মাসনস্থাং ধ্যায়েচ্চ শ্রিয়ং ত্রৈলোক্যমাতরং। গৌরবর্ণাং সুরূপাঞ্চ সর্বালঙ্কারভূষিতাং। রৌক্লপদ্ম বাগ্রকরাং বরদাং দক্ষিণেনতু।"
(১০)
[সম্পাদনা]করজোড় করিয়া বলিবে "লক্ষ্মীদেবী ইহাগচ্ছ, ইহাগচ্ছ, ইহতিষ্ঠ, ইহতিষ্ঠ, ইহ সন্নিধেহি, অত্রাধিষ্ঠানং কুরু, মম পূজাং গৃহ্নাণ।"
(১১)
[সম্পাদনা]পরে জল লইয়া "এতৎ পাদ্যং নমঃ শ্রীলক্ষ্মীদেব্যৈ নমঃ" বলিয়া ঘটে দিবে।
(১২)
[সম্পাদনা]বিল্বপত্র, পুষ্প, চন্দন, আতপ চাউল, জলসহ কোশার উপরে রাখিয়া-"এষোহর্ঘ্য নমঃ শ্রীলক্ষ্মীদেব্যৈ নমঃ।"
(১৩)
[সম্পাদনা]জল লইয়া "ইদমাচমনীয়ং নমঃ শ্রীলক্ষ্মীদেব্যৈ নমঃ।"
(১৪)
[সম্পাদনা]চন্দন লইয়া "এষো গন্ধঃ নমঃ শ্রীলক্ষ্মীদেব্যৈ নমঃ।"
(১৫)
[সম্পাদনা]পুষ্পে শ্বেত-চন্দন লিপ্ত করিয়া "এতানি গন্ধপুষ্পানি নমঃ শ্রীং লক্ষ্মীদেব্যৈ নমঃ।"
(১৬)
[সম্পাদনা]চন্দনযুক্ত বিল্বপত্র লইয়া "এতানি গন্ধবিল্বপত্রাদি নমঃ শ্রীং লক্ষ্মীদেব্যৈ নমঃ।"
(১৭)
[সম্পাদনা]যথাসাধ্য নৈবিদ্য ও মিষ্টান্ন লইয়া: "এতৎ মিষ্টান্নং, এতানি ফলানি,(অভাবে- "এতৎ সোপকরণ) নৈবেদ্যং নমঃ শ্রীং লক্ষ্মীদেবৈ নমঃ।
(১৮)
[সম্পাদনা]"এতৎ পানীয় জলং নমঃ শ্রীলক্ষ্মীদেব্যৈ নমঃ” বলিয়া জল দিবে।
(১৯)
[সম্পাদনা]করযোড়ে বলিবে "মা আমি ভজন পূজন জানি না, দয়া করিয়া আমার সামান্য দ্রব্য গ্রহণ করুন।"
(২০)
[সম্পাদনা]পুনরায় জল লইয়া "পুনরাচমনীয়ং নমঃ শ্রীলক্ষ্মীদেব্যৈ নমঃ।"
(২১)
[সম্পাদনা]"এতৎ তাম্বুলং নমঃ শ্রীং লক্ষ্মীদেব্যৈ নমঃ" বলিয়া সাদা পান দিবে।
(২২)
[সম্পাদনা]সিন্দুর লইয়া-"এতৎ সিন্দুরং নমঃ শ্রীং লক্ষ্মীদেব্যৈ নমঃ” বলিয়া ঘটে ও নিজ কপালে দিবে।
(২৪)
[সম্পাদনা]তৎপরে কুবের ও ইন্দ্রের স্মরণ করিবে- "এতে গন্ধপুষ্পে নমঃ ইন্দ্রায় নমঃ,
এতে গন্ধপুষ্পে নমঃ কুবেরায় নমঃ।"
(২৪)
[সম্পাদনা]ইহার পরে প্রণাম করিয়া ব্রতকথা শুনিবে।
শ্রীলক্ষ্মীদেবীর মন্ত্রপাঠ
[সম্পাদনা]শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর স্তব
[সম্পাদনা]নমামি সর্বভূতানাং বরদাসি হরিপ্রিয়ে, যা গতিত্ত্বংপ্রপন্নানাং সা মে ভূয়াত্তদর্চ্চনাৎ।
শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর গায়ত্রী
[সম্পাদনা]"ওঁ মহালক্ষৈ বিদ্মহে মহাশ্রিয়ৈ ধীমহি তন্নো শ্রীঃ প্রচোদয়াৎ ওঁ"
"নমঃ ওঁ শংকরায় নমঃ" বলিয়া প্রণাম করিতে হয়।
শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র
[সম্পাদনা]লক্ষ্মীস্তুং সবর্বদেবানাং যথাসম্ভব-নিত্যশঃ।
স্থিরা ভব তথা দেবী মঙ্গ জন্মনি জন্মনি।
বন্দে বিষ্ণুপ্রিয়াং দেবীং দারিদ্র্য-দুঃখনাশিনীং।
ক্ষীরোদসম্ভবাং দেবীং বিষ্ণুবক্ষবিলাসিনীম।
শীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর প্রণাম
[সম্পাদনা]নমো বিশ্ববরূপস্য ভার্য্যাসি পদ্মে পদ্মালয়ে শুভে।
সর্বতঃ পাহিয়াং মহালক্ষ্মী নমোহস্তুতে।
নমো গণেশায় বাসুদেবায় লক্ষ্মীদেব্যৈ নমো নমঃ।
ব্রতকথার সারাংশ
[সম্পাদনা]"বৃহস্পতিবারের ব্রতকথা"-য় বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীর ব্রত ও পূজা প্রচলন সম্পর্কে একটি লৌকিক গল্পটি রয়েছে, তা এইরকম:
এক দোলপূর্ণিমার রাতে নারদ, বৈকুণ্ঠে লক্ষ্মী ও নারায়ণের কাছে গিয়ে মর্ত্যের অধিবাসীদের নানা দুঃখকষ্টের কথা বললেন। লক্ষ্মী মানুষের নিজেদের কুকর্মের ফলকেই এই সব দুঃখের কারণ বলে চিহ্নিত করলেন। কিন্তু নারদের অনুরোধে মানুষের দুঃখকষ্ট ঘোচাতে তিনি মর্ত্যলোকে লক্ষ্মীব্রত প্রচার করতে এলেন। অবন্তী নগরে ধনেশ্বর নামে এক ধনী বণিক বাস করতেন। তার মৃত্যুর পর তার ছেলেদের মধ্যে বিষয়সম্পত্তি ও অন্যান্য ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া চলছিল। ধনেশ্বরের বিধবা পত্নী সেই ঝগড়ায় অতিষ্ঠ হয়ে বনে আত্মহত্যা করতে এসেছিলেন। লক্ষ্মী তাকে লক্ষ্মীব্রত করার উপদেশ দিয়ে ফেরত পাঠালেন। ধনেশ্বরের স্ত্রী নিজের পুত্রবধূদের দিয়ে লক্ষ্মীব্রত করাতেই তাদের সংসারের সব দুঃখ ঘুচে গেল। ফলে লক্ষ্মীব্রতের কথা অবন্তী নগরে প্রচারিত হয়ে গেল। একদিন অবন্তীর সধবারা লক্ষ্মীপূজা করছেন, এমন সময় শ্রীনগরের এক যুবক বণিক এসে তাদের ব্রতকে ব্যঙ্গ করল। ফলে লক্ষ্মী তার উপর কুপিত হলেন। সেও সমস্ত ধনসম্পত্তি হারিয়ে অবন্তী নগরে ভিক্ষা করতে লাগল। তারপর একদিন সধবাদের লক্ষ্মীপূজা করতে দেখে সে অনুতপ্ত হয়ে লক্ষ্মীর কাছে ক্ষমা চাইল। লক্ষ্মী তাকে ক্ষমা করে তার সব ধনসম্পত্তি ফিরিয়ে দিলেন। এইভাবে সমাজে লক্ষ্মীব্রত প্রচলিত হল।[১]
শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর সম্পূর্ণ পাঁচালী
[সম্পাদনা]শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর মন্ত্রজপ
[সম্পাদনা]নারায়ণং নমষ্কৃত্যং নরঞ্চৈব নরোত্তমম্।
দেবীং সরস্বতীঞ্চৈব ততো জয় মুদীরয়েৎ।।
বন্দে বিষ্ণুপ্রিয়াং দেবীং দারিদ্র্য-দুঃখ-নাশিনীং।
ক্ষীরোদপুত্রীং কেশবকান্তাং বিষ্ণের্বক্ষোবিলাসিনীং।।
॥ শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর ব্রতকথা ও পাঁচালী প্রারম্ভ ॥
[সম্পাদনা]
দোল পূর্ণিমার নিশি নিৰ্ম্মল আকাশ।
মন্দ মন্দ বহিতেছে মলয় বাতাস ॥১॥
লক্ষ্মীদেবী বামে করি বসি নারায়ণ।
করিছেন নানা কথা সুখে আলাপন ॥২॥
হেনকালে বীণা করে এলো মুনিবর।
উপনীত হৈলা আসি বৈকুন্ঠ নগর ॥৩॥
ধীরে ধীরে যুগলেতে করিয়া প্রণতি।
কহিলা নারদ মুনি লক্ষ্মীদেবী প্রতি ॥৪॥
কি কারণে আজি হেথা লক্ষ্মী জিজ্ঞাসিলা।
পদে নতি পুনরায় ঋষি নিবেদিলা ॥৫॥
কেন মাগো নর-প্রতি তব অবিচার।
চঞ্চলা চপলা প্রায় ফেরো দ্বারে দ্বার ॥৬॥
ক্ষণকাল তরে তব নাহি কোথা স্থিতি।
সেই হেতু নর-নারী ভোগয়ে দুর্গতি ॥৭॥
সতত কুক্রিয়া রত নর-নারীগণ।
অসহ্য যাতনা পায় দেখি অনুক্ষণ ॥৮॥
অন্নাভাবে শীর্ণকায় বলহীন দেহ।
সেই কষ্টে আত্মহত্যা করিতেছে কেহ ॥৯॥
কেহ প্রিয় প্রাণাধিক পুত্র-কন্যাগণে।
করিতেছে পরিত্যাগ অন্নের কারণে ॥১০॥
বলো দেবী, প্রকাশিয়া কি পাপের ফলে।
ভীষণ দুর্ভিক্ষে সদা মর্ত্যবাসী জ্বলে ॥১১॥
এতেক শুনিয়া লক্ষ্মী দুঃখিত অন্তরে।
কহিলেন অতঃপর ক্ষুণ্ণ মনিবরে ॥১২॥
মর্ত্যবাসী দুঃখ পায় শোকের বিষয়।
দৃষ্কৃতির ফল উহা জানিবে নিশ্চয় ॥১৩॥
চঞ্চলা আমায় বলে কিসের লাগিয়া।
ইহার কারণ তবে শুন মন দিয়া ॥১৪॥
শাস্ত্র নাহি মানে দেখ যত নারী নর।
অশাস্ত্রকে শাস্ত্রজ্ঞান করে নিরন্তর ॥১৫॥
অনাচারে ভরাইল সকল সংসার।
অপবিত্র স্থানে থাকা দুষ্কর আমার ॥১৬॥
নিজধর্ম নিজশিক্ষা দিয়া বিসর্জন।
পরধর্ম পরশিক্ষা করিছে অর্জন ॥১৭॥
দিবা-নিদ্রা অনাচার ক্রোধ-অহঙ্কার।
আলস্য কলহ মিথ্যা ঘিরিছে সংসার ॥১৮॥
উচ্চহাসি কটুকথা কহে নারীগণ।
সন্ধ্যাকালে নিদ্রা যায় হয়ে অচেতন ॥১৯॥
রমণীভূষণ লজ্জা দিয়া বিসর্জন।
যথায় তথায় করে স্বেচ্ছায় গমন ॥২০॥
নাহি দেয় ধূপ-দীপ প্রতি সন্ধ্যাকালে।
সতীর সিন্দুর শোভা, নাহি পরে ভালে ॥২১॥
প্রভাতে দেয় না গোময়ের ছড়া।
ঘৃণা নাহি করে তারা এড়া বস্ত্র পরা ॥২২॥
লক্ষ্মী-স্বরূপিণী নারী করিয়া সৃজন।
পাঠায়েছি মর্ত্যলোকে সুখের কারণ ॥২৩॥
ক্ষণিকের সুখে তারা ভুলিয়া আমায়।
অকার্য্যে কু-কার্য্যে এবে সংসার মজায় ॥২৪॥
শ্বশুর-শাশুড়ী প্রতি নহে ভক্তিমতী।
কটুবাক্য কহে সদা তাঁহাদেরি প্রতি ॥২৫॥
পতির আত্মীয়গণে না করে আদর।
থাকিতে চাহয়ে সদা হ'য়ে স্বতন্তর ॥২৬॥
লজ্জা আদি গুণ যত রমণী-ভূষণ।
একে একে সব তারা করিছে বর্জন ॥২৭॥
অতিথি দেখিলে তারা রুষ্ট হয় মনে।
পতির অগ্রেতে খায় যত নারীগণে ॥২৮॥
স্বামীরে করয়ে না শুনে বচন।
ছাড়িয়াছে গৃহধর্ম ছেড়েছে রন্ধন ॥২৯॥
নারী সঙ্গে নরগণ সময় কাটায়।
মিথ্যা ছাড়া সত্যকথা কভু নাহি কয় ॥৩০॥
সতত উহারা মোরে করে জ্বালাতন।
চঞ্চলার প্রায় ফিরি তাই সে কারণ ॥৩১॥
ঈর্ষা-দ্বেষ হিংসাপূর্ণ তাদের হৃদয়।
পরশ্রীকাতর চিত্ত কুটিলতাময় ॥৩২॥
দেব-দ্বিজে ভক্তিহীন তুচ্ছ গুরুজন।
সদাই আপন সুখ করে অন্বেষণ ॥৩৩॥
রসনা তৃপ্তির লাগি অখাদ্য ভোজন।
তারি ফলে দেখ ঋষি কুষ্ঠে আক্রমণ ॥৩৪॥
প্রতি এইরূপ পাপের আগার।
অচলা হইয়া বল থাকি কি প্রকার ॥৩৫॥
তেয়াগি এসব দোষ হ'লে সদাচারী।
নিশ্চলা হইয়া থাকি আমি বিভাবরী ॥৩৬॥
এত শুনি মুনিবর ক্ষুণ্ণ মনে।
কেমনে প্রসন্না মাতা হবে নরগণে ॥৩৭॥
কেমনে পাইবে নারী তব পদছায়া।
ওগো দয়াময়ি তুমি না করিলে দয়া ॥৩৮॥
সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের তুমি অধিকারী।
জগৎ-প্রসূতি তুমি জগৎ-ঈশ্বরী ॥৩৯॥
কহ মাতঃ কৃপা করি ইহার বিধান।
মানবের দুঃখ হেরি কাঁদে মোর প্রাণ ॥৪০॥
নারদের বাক্যে লক্ষ্মীর দয়া উপজিল।
মধুর বচনে তাঁরে বিদায় করিল ॥৪১॥
নর নারী দুঃখ হেরি কাঁদিছে অন্তর।
প্রতিকার আমি বাছা করিব সত্বর ॥৪২॥
অতঃপর লক্ষ্মীদেবী ভাবে মনে মনে।
জগতের দুঃখনাশ করিব কেমনে ॥৪৩॥
কেমনে তাদের দুঃখ করিব মোচন।
উপদেশ দেহ, মোরে প্রভু নারায়ণ ॥৪৪॥
শুনিয়া লক্ষ্মীর বাণী কহে লক্ষ্মীপতি।
উতলা কি হেতু প্রিয়ে স্থির কর মতি ॥৪৫॥
মন দিয়া শুন সতী আমার বচন।
লক্ষ্মীব্রত নরলোকে কর প্রচারণ ॥৪৬॥
প্রতি গুরুবারে মিলি যত নারীগণে।
পূজিয়া শুনিবে কথা ভক্তিযুক্ত মনে ॥৪৭॥
বাড়িবে ঐশ্বর্য তাহে তোমার কৃপায়।
সর্ব্ব দুঃখ দূরে যাবে জানিবে নিশ্চয় ॥৪৮॥
নারায়ণ বাক্যে অতি হৃষ্ট মনে।
গমন করিলা মর্তে ব্রত প্রচারণে ॥৪৯॥
অবন্তী নগরে গিয়া হৈল উপনীত।
দেখিয়া হইল লক্ষ্মী বড়ই স্তম্ভিত ॥৫০॥
নগরের অধিপতি ধনেশ্বর রায়।
অপার ঐশ্বর্য তাঁর কুবেরের প্রায় ॥৫১॥
সোনার সংসার তাঁর শূণ্য হিংসা দ্বেষ।
পালিত সবারে সদা পাত্র নির্ব্বিশেষ ॥৫২॥
এক অন্নে সাত পুত্র রাখি ধনেশ্বর।
সসম্মানে যথাকালে গেলা লোকান্তর ॥৫৩॥
ভাৰ্য্যার কুহক-জালে সপ্ত সহোদর।
পৃথক হইলা সবে কিছু দিন পর ॥৫৪॥
হিংসা-দ্বেষ অলক্ষ্মীর যত সহচর।
একে একে সবে আসি প্রবেশিল ঘর ॥৫৫॥
এ সকল দোষ হেরি কুপিত অন্তরে।
লক্ষ্মীদেবী সেই গৃহ ত্যাজিলা সত্বরে ॥৫৬॥
বৃদ্ধা ধনেশ্বরী পত্নী নিজ ভাগ্যদোষে।
না পারি তিষ্ঠিতে আর বধূদের রোষে ॥৫৭॥
চলিলা বনেতে বৃদ্ধা ত্যজিতে জীবন।
অদৃষ্টের ফলে হয় এ হেন ঘটন ॥৫৮॥
অন্নাভাবে জীর্ণকায় মলিন বসন।
চলিতে শক্তি নাহি করিছে রোদন ॥৫৯॥
হেনকালে বৃদ্ধাবেশে দেবী নারায়ণী।
উপনীত পথিমধ্যে হইলা আপনি ॥৬০॥
সদয় হৃদয়া লক্ষ্মী জিজ্ঞাসে বৃদ্ধারে।
কি জন্য এসেছ তুমি এ ঘোর কান্তারে ॥৬১॥
কাহার তনয়া তুমি, কাহার ঘরণী।
কি হেতু মলিন মুখ কহ গো বাছনী ॥৬২॥
বৃদ্ধা বলে শোন মাতঃ! আমার কাহিনী।
পতিহীনা আমি এক মন্দ কপালিনী ॥৬৩॥
পিতা পতি ছিল মোর অতি ধনবান।
সর্বদা আমার গৃহে লক্ষ্মী-অধিষ্ঠান ॥৬৪॥
সোনার সংসার মোর ছিল ধনে জনে।
পুত্র, পুত্রবধূগণ সেবিত যতনে ॥৬৫॥
হইলে কাল সুখ-শান্তি যত।
গৃহ হ'তে ক্রমে ক্রমে হ'ল তিরোহিত ॥৬৬॥
সাতপুত্র সাতহাঁড়ি হ'য়েছে এখন।
সতত বধূরা মোর করে জ্বালাতন ॥৬৭॥
সহিতে না পারি আর তাদের তাড়না।
ত্যজিতে জীবন আমি করেছি বাসনা ॥৬৮॥
নারায়ণী বলে, শুন আমার বচন।
আত্মহত্যা মহাপাপ নরকে গমন ॥৬৯॥
যাও সতী, গৃহে ফিরে কর লক্ষ্মীব্রত।
অচিরে হইবে সুখ তব পূর্ব্বমত ॥৭০॥
গুরুবারে সন্ধ্যাকালে ল'য়ে বধূগণে।
করিবে লক্ষ্মীর ব্রত হ'য়ে একমনে ॥৭১॥
জলপূর্ণ ঘটে দিবে সিন্দুরের ফোঁটা।
আম্রের পল্লব দিবে তাহে এক গোটা ॥৭২॥
আসন সাজায়ে তাহে দিবে গুয়াপান।
সিন্দুর গুলিয়া দিবে ব্রতের বিধান ॥৭৩॥
ধূপ দীপ জ্বালাইয়া রাখিবে বামেতে।
শুনিতে বসিবে কথা দূর্ব্বা ল'য়ে হাতে ॥৭৪॥
মনেতে লক্ষ্মীর মূর্ত্তি করিয়া চিন্তন।
একমনে ব্রতকথা করিবে শ্রবণ ॥৭৫॥
কথা শেষে উলু দিয়া প্রণাম করিবে।
ভক্তিভরে এয়োগণে সিন্দুর পরাবে ॥৭৬॥
যে রমণী পূজা করে প্রতি গুরুবারে।
হইবে বিশুদ্ধমনা লক্ষ্মীদেবী বরে ॥৭৭॥
যেই গৃহে ব্রতকথা হয় বারোমাস।
সতত তাহার গৃহে করি যে নিবাস ॥৭৮॥
তারি গৃহে বাঁধা রব হইয়া অচলা।
পূর্ণ করি ভক্তবাঞ্ছা আমি যে কমলা ॥৭৯॥
গুরুবারে যদি হয় পূর্ণিমা উদিত।
যেবা নারী অনাহারে করে এই ব্রত ॥৮০॥
সকল বাসনা তার পূরণ হইবে।
পতি পুত্র ল'য়ে সুখে বারোমাস রবে ॥৮১॥
লক্ষ্মীর ভান্ডার যেবা স্থাপি নিজ ঘরে।
রাখিবে তন্ডুল তাহে এক মুঠা করে ॥৮২॥
সঞ্চয়ের পথ উহা জানিবে নিশ্চয়।
এর ফলে উপকার পাবে অসময় ॥৮৩॥
ছাড়ি অলসতা সূতা কাটিবে যতনে।
অন্ন-বস্ত্র কষ্ট যাবে মহাত্ম্য বচনে ॥৮৪॥
প্রসন্ন থাকিব আমি কহিলাম সার।
যাও গৃহে কর মাতা ব্রতের প্রচার ॥৮৫॥
এতেক কহিয়া লক্ষ্মী নিজ মূর্তি ধরি।
দিলা দরশন বৃদ্ধে দেবী কৃপা করি ॥৮৬॥
দেখিয়া হইলা বৃদ্ধা আনন্দে বিভোর।
প্রণাম করিলা সতী জুড়ি দুই কর ॥৮৭॥
প্রসন্ন হইয়া লক্ষ্মী দিলা তারে কোল।
শুধালেন আরো কত বলি মিষ্ট বোল ॥৮৮॥
লক্ষ্মী কহে ব্রত মোর কর সংসারে প্রচার।
অচিরে হইবে তব বৈভব অপার ॥৮৯॥
পুত্র, বধূগণ বশে থাকিবে তোমার।
পূর্ব্ববৎ শান্তিময় হইবে সংসার ॥৯০॥
এত কহি লক্ষ্মীদেবী হৈলা অদর্শন।
হৃষ্টচিত্তে বৃদ্ধা গৃহে করিলা গমন ॥৯১॥
আসিয়া বধূগণে বৃদ্ধা করিল বর্ণন।
যেরূপ ঘটিল বলে লক্ষ্মী দরশন ॥৯২॥
ব্রতের বিধান বৃদ্ধা বলিলা সবারে।
যে-সকল কথা লক্ষ্মী কহিলা তাহারে ॥৯৩॥
মিলি সব বধূগণ করে লক্ষ্মীব্রত।
হিংসা দ্বেষ স্বার্থভাব হৈল বিদুরিত ॥৯৪॥
ব্রতের ফলেতে মিলে সপ্ত সহোদর।
দূরে গেল দুঃখ কষ্ট, ঐশ্বর্য বিস্তর ॥৯৫॥
'মা লক্ষ্মী' করিলা তথা পুনরাগমন।
হইল গৃহ শান্তি নিকেতন ॥৯৬॥
দৈবযোগে একদিন সাধুর আলয়ে।
উপনীত এক নারী ব্রতের সময়ে ॥৯৭॥
ব্রতকথা শুনি তার ভক্তি উপজিল।
মনে মনে লক্ষ্মীব্রত মানস করিল ॥৯৮॥
পতি তার কুষ্টগ্রস্ত অক্ষম অর্জনে।
ভিক্ষা করি যাহা পায় খায় দুইজনে ॥৯৯॥
তাই নারী মনে মনে করিলা বাসনা।
পতিরে নীরোগ কর চরণে কামনা ॥১০০॥
গৃহে গিয়া সেই নারী করে লক্ষ্মীব্রত।
ভক্তিমনে এয়ো লৈয়া পূজে বিধিমত ॥১০১॥
দেবীর কৃপায় তার দুঃখ হৈল দূর।
পতি হৈল সুস্থ দেহ, ঐশ্বর্য প্রচুর ॥১০২॥
কালক্রমে শুভদিনে জন্মিল তনয়।
হইল সংসার তার সুখের আলয় ॥১০৩॥
এইরূপে লক্ষ্মীব্রত প্রতি ঘরে ঘরে।
ক্রমে প্রচারিত হৈল অবন্তী নগরে ॥১০৪॥
অবশেষে শুন এক অপূর্ব ব্যপার।
ব্রতের মাহাত্ম্য হৈল যেভাবে প্রচার ॥১০৫॥
একদিন গুরুবারে অবন্তী নগরে।
নারীগণ মিলি যত লক্ষ্মীব্রত করে ॥১০৬॥
শ্রীনগরবাসী এক বণিক তনয়।
দৈবযোগে সেই স্থানে উপনীত হয় ॥১০৭॥
অনেক সম্পত্তি তার ভাই পঞ্চ জন।
পরস্পর অনুগত রয় সর্বক্ষণ ॥১০৮॥
ব্রতের নিয়ম দেখি সাধুর তনয়।
বলে একি ব্রত, ইতে কিবা ফলোদয় ॥১০৯॥
সদাগর বাক্য শুনি বলে ব্রতীগণ।
করি লক্ষ্মীব্রত, যাতে মানস পূরণ ॥১১০॥
মন প্রাণ দিয়া যেবা করিবে পূজন।
সকল মনের আশা হইবে পূরণ ॥১১১॥
ইহা শুনি সদাগর বলে অহঙ্কারে।
যেজন অভাবে থাকে, সে পূজে উহারে ॥১১২॥
ধনজন সুখভোগ যা কিছু সম্ভবে।
সকল আমার আছে আর কিবা হবে ॥১১৩॥
কপালে না থাকে যদি লক্ষ্মী দিবে ধন।
হেন বাক্য কভু আমি না শুনি কখন ॥১১৪॥
গর্বিত বচন লক্ষ্মী সহিতে না পারে।
সেই দোষে লক্ষ্মীদেবী ছাড়িলা তাহারে ॥১১৫॥
এতেক কহিয়া বাণী লক্ষ্মী করি হেলা।
নানাদ্রব্যে পূর্ণতরী বাণিজ্যেতে গেলা ॥১১৬॥
দৈবযোগে লক্ষ্মী কোপে সেই সাধুজন।
তরীসহ জলমধ্যে হইলা মগন ॥১১৭॥
ইষ্টক আলয় আদি যাহা ছিল তার।
বজ্রাঘাতে দগ্ধ হয়ে হৈল ছারখার ॥১১৮॥
দূরে গেল ভ্রাতৃভাব হৈল ভিন্ন ভিন্ন।
সোনার সংসার তার হইল বিপন্ন ॥১১৯॥
ভিক্ষাজীবি হ'য়ে সবে ফিরে দ্বারে দ্বারে।
জঠর জ্বালায় গেলা দেশ-দেশান্তরে ॥১২০॥
পড়িয়া বিপাকে এবে সাধু মহাশয়।
দু'নয়নে অশ্রু ঝরে করে হায় হায় ॥১২১॥
কিবা দোষ দেখি বিধি করিলে এমন।
অধম সন্তান আমি অতি অভাজন ॥১২২॥
সাধুর দুর্দশা হেরি দয়া উপজিল।
করুণা হৃদয়া লক্ষ্মী সকলি ভুলিল ॥১২৩॥
দুঃখদূর তরে তারে করিয়া কৌশল।
পাঠায় অবন্তী ধামে করি ভিক্ষা ছল ॥১২৪॥
নানাদেশ ঘুরাইয়া আনি তারপর।
উপনীত করাইল অবন্তী নগরে ॥১২৫॥
হেরি তথা লক্ষ্মীব্রত করে নারীগণ।
স্মরণ হইল তার পূর্ব বিবরণ ॥১২৬॥
বুঝিল তখন কেন পড়িলা বিপাকে।
অহঙ্কার দোষে লক্ষ্মী ত্যজিলেন মোকে ॥১২৭॥
জোড়করে ভক্তিভরে হয়ে একমন।
করিছে লক্ষ্মীর স্তুতি সাধুর নন্দন ॥১২৮॥
ক্ষম মাতঃ এ দাসের যত অপরাধ।
তোমা হেলি মোর ঘটে ঘোর পরমাদ ॥১২৯॥
অজ্ঞান অধম আমি কর মোরে দয়া।
পড়িনু বিপাকে মাতঃ দেহ পদছায়া ॥১৩০॥
শ্রেষ্ঠ হতে শ্রেষ্ঠতরা পরমা প্রকৃতি।
কোপাদি বর্জ্জিতা তুমি মূর্তিমতী সতী ॥১৩১॥
সতীসাধ্বী রমণীর তুমি মা উপমা।
ভক্তিভরে দেবগণ সদা পূজে তোমা ॥১৩২॥
সুর-নর সকলেরই সম্পদরূপিণী।
জগৎ ঈশ্বরী তুমি ঐশ্বর্য্য দায়িনী ॥১৩৩॥
রাস-অধিষ্ঠাত্রী দেবী তুমি রাসেশ্বরী।
সকলেই তব অংশ যত আছে নারী ॥১৩৪॥
গোলোকে কমলা তুমি মাধবমোহিনী।
ক্ষীরোদ-সাগরে তুমি ক্ষীরোদনন্দিনী ॥১৩৫॥
মহালক্ষ্মী তুমি মাগো, ত্রিদিব মন্ডলে।
গৃহলক্ষ্মীরূপে তুমি বিরাজ ভূতলে ॥১৩৬॥
তুমি গো তুলসী, গঙ্গা পতিতপাবনী।
সাবিত্রী বিরিঞ্চিপুরে বেদের জননী ॥১৩৭॥
কৃষ্ণ প্রাণেশ্বরী তুমি কৃষ্ণ প্রাণাধিকা।
তুমি আপনি ছিলে দ্বাপরে রাধিকা ॥১৩৮॥
বৃন্দাবন মাঝে তুমি বৃন্দা গোপনারী।
নন্দালয়ে ছিলে তুমি হ'য়ে গোপেশ্বরী ॥১৩৯॥
বিরাজ চম্পক বনে চম্পক ঈশ্বরী।
শতশৃঙ্গ শৈলে তুমি শোভিতা সুন্দরী ॥১৪০॥
বিকশিত পদ্মবনে তুমি পদ্মাবতী।
মালতী-কুসুমকুঞ্জে তুমি মা মালতী ॥১৪১॥
কুন্দদন্ত নাম ধর তুমি কুন্দবনে।
তুমি গো সুশীলা সতী কেতকী কাননে ॥১৪২॥
তুমি মা কদম্ব মালী কদম্ব কাননে।
বন অধিষ্ঠাত্রী দেবী তুমি বনে বনে ॥১৪৩॥
রাজলক্ষ্মী তুমি মা রহ ঘরে ঘরে।
সকলের গৃহলক্ষ্মী তুমি মা রহ ঘরে ঘরে ॥১৪৪॥
দীনজনে রাজ্য পায় তব কৃপাবলে।
দয়া কর এবে মোরে, ওগো 'মা' কমলে ॥১৪৫॥
দয়াময়ী ক্ষেমঙ্করী অধমতারিণী।
অপরাধ ক্ষমা কর দারিদ্রনাশিনী ॥১৪৬॥
অন্নদা বরদা মাতঃ বিপদ নাশিনী।
দয়া কর এবে মোরে মাধব-ঘরণী ॥১৪৭॥
এইরূপে স্তব করি ভক্তিযুক্ত মনে।
একাগ্র হৈয়া সাধু প্রণমে সেস্থানে ॥১৪৮॥
ব্রত অন্তে সাধুবর করিলা প্রণাম।
ব্রতের সঙ্কল্প করি আসে নিজধাম ॥১৪৯॥
বলে সাধু গৃহিণীরে লক্ষ্মীব্রত সার।
সবে মিলি কর ইহা প্রতি গুরুবার ॥১৫০॥
সাধুর বাক্যেতে তুষ্টা হ'য়ে বধূগণ।
ভক্তি মনে করে তারা ব্রত আচরণ ॥১৫১॥
ভক্তাধীনা নারায়ণী হইয়া সদয়।
নাশিলা সাধুর ছিল যত বিঘ্নভয় ॥১৫২॥
দেবীর কৃপায় পুনঃ হয় ধনজন।
দরিদ্রতা দূরে গিয়া নিরাপদ হন ॥১৫৩॥
সপ্ত তরী উঠে ভাসি জলের উপর।
আনন্দে পূর্ণিত হ'ল সাধুর অন্তর ॥১৫৪॥
মিলিল ভ্রাতারা পুনঃ আর বধূগণ।
সাধুর সংসার হ'ল শান্তি নিকেতন ॥১৫৫॥
এইরূপে মর্তলোকে ব্রতের প্রচার।
মনে রেখো পৃথিবীতে লক্ষ্মীব্রত সার ॥১৫৬॥
এই ব্রত যে রমণী করে একমনে।
লক্ষ্মীর কৃপায় তেই বাড়ে ধনে জনে ॥১৫৭॥
অপুত্রের পুত্র হয় নির্ধনের ধন।
ইহলোকে সুখ, অন্তে বৈকুন্ঠ গমন ॥১৫৮॥
লক্ষ্মীর ব্রতের কথা বড়ই মধুর।
যাহার প্রভাবে সব দুঃখ হয় দূর ॥১৫৯॥
যেবা পড়ে, যেবা শুনে, যেবা রাখে ঘরে।
লক্ষ্মীর বরেতে তার মনোবাঞ্ছা পুরে ॥১৬০॥
ব্রত করি স্তব পাঠ যেই জন করে।
অভাব রহে না তার লক্ষ্মীদেবী বরে ॥১৬১॥
লক্ষ্মীর ব্রতের কথাহৈল সমাপন।
ভক্তিভরে বর যাচ যাহা লয় মন ॥১৬২॥
সিঁথির সিন্দুর দাও সব এয়ো মিলে।
এ হুলুধ্বনি দাও সবে অন্য কথা ভুলে ॥১৬৩॥
লক্ষ্মীর ব্রতের কথা বড় মধুময়।
প্রণাম করিয়া যাও যে যার আলয় ॥১৬৪॥
জোড় করি দুই হাত ভক্তিযুক্তমনে।
প্রণাম করহ এবে যে থাকে যেখানে ॥১৬৫॥
প্রণমামি লক্ষ্মীদেবী বিষ্ণুর ঘরণী।
ক্ষীরোদসম্ভবা দেবী জগৎপালিনী ॥১৬৬॥
অগতির গতি মাতঃ তুমি নারায়ণী।
দয়াময়ী জগন্মাতা বিপদনাশিনী ॥১৬৭॥
ভকত-বৎসলা দেবী সত্যস্বরূপিণী।
হরিপ্রিয়ে পদ্মাসনে ভূ-ভার-হারিণী ॥১৬৮॥
চঞ্চলা কমলা মাগো ত্রিলোক তারিণী।
প্রণমামি কৃপাময়ী মাধব-রঞ্জিনী ॥১৬৯॥
ভবারাধ্যা তুমি মাতঃ দারিদ্রনাশিনী।
কৃপা কর নিবারণে ত্রিতাপহারিণী ॥১৭০॥
॥ শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর ব্রতকথা ও পাঁচালী সমাপ্ত ॥
শ্রীশ্রীলক্ষ্মীমাতার আবাহন গীত
[সম্পাদনা]এসো মা লক্ষ্মী, বসো মা লক্ষ্মী,
উড়ায়ে কনক-অঞ্চলখানি।
দু'হাতে বিতরি করুণাসিদ্ধি,
দারিদ্র, দুঃখ-পাপ-নাশিনী ।।
থাকো মা, গৃহেতে হইয়া অচলা,
পূজিব তোমার চরণ কমলা।
তোমারি কৃপায় লভিব সকলি,
অকুলে তীর 'মা' (ওমা) তারিণী।
এসো মা, কমলা হ'য়ো না নিদয়া,
নিবারণে মাগো দেহ পদছায়া।।
পাই যেন তব অপার করুণা,
তুমি মোরে মাগো ছেড়ে যেও না,
তোমারি ও দু'টি চরণ স্পর্শে
হৃদয় জাগিবে শক্তি হর্ষে,
রাখিব তোমারে সবারি শীর্ষে,
পূজিব চরণ কমলখানি।
আমা পানে চাও, করুণা নয়নে,
দাও মাগো শান্তি, তাপিত পরাণে,
শেষের দিনে রেখো মা চরণে,
এ ভব পারের ওই তরণী।।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর ব্রতকথা ও পাঁচালী", মেয়েদের ব্রতকথা, কালীকিশোর বিদ্যাবিনোদ সম্পাদিত, অক্ষয় লাইব্রেরি, কলকাতা, ২০১১, পৃ. ১৮৬-৯১