রেকর্ড (ছোটগল্প)
রেকর্ড (ছোটগল্প) নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচিত একটা ভিন্ন স্বাদের, ভিন্ন মাত্রার ছোটগল্প। এ'গল্পে গল্পকার অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধের ব্যঞ্জনাকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। এ গল্পটিকে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম শ্রেণির রচনা বলা না গেলেও গল্পে গল্পকথক ও তাঁর পত্নীর রেকর্ডের অজ্ঞাত অথচ পরিচিত বলে মনে হওয়া সুরের রহস্য উন্মোচনের কাহিনি পাঠককে রুদ্ধশ্বাস চিত্তে অপেক্ষমাণ রেখেছে। কল্লোল পরবর্তী যুগের অত্যন্ত শক্তিশালী এই গল্পকার ছোটগল্পকে যে দৃষ্টিতে দেখেছেন তা এইভাবে ব্যক্ত করেছেন-
" ছোটগল্প গড়ে উঠেছে দুটি জিনিসের মিশ্রণে। লেখকের নিজস্ব একটি জগৎ-জীবন মানববোধ আছেই - profound হোক আর না-ই হোক , তা-ই হল তাঁর দর্শন। আর জীবন থেকে নিজস্ব-প্রবণতা অনুযায়ী যেসব উপকরণ তিনি আহরণ করে নিচ্ছেন, তারা সেই দর্শনের দ্বারা বিরঞ্জিত হয়ে, শিল্প হয়ে উঠেছে। তাই একালের ভালো গল্প কেবল কৌতূহল-সৃষ্টির জন্যে ঘটনা নির্মাণ করছে না, কোনো বিশেষ বক্তব্য প্রচারের জন্য গল্পকে বাহন করছে না (বক্তব্য তো লেখকের জীবন-দৃষ্টি থেকে স্বয়ং প্রকটিত হবে), আসলে তার একটিমাত্রই প্রবণতাঃ তা বস্তুনির্ভর হয়েও বাস্তবাতীত, তা দুরাচারী, তা প্রতীকী।"[১]
আসলে তিনি ছোটগল্পের প্রতীকধর্মীতার উপর জোর দিতে চেয়েছেন। বাইরের উপকরণকে গ্রহণ করে স্বতন্ত্র ভাবে তার জন্মান্তর ঘটানোর মধ্য দিয়ে ছোটোগল্পের সৃষ্টি। এখানে রচয়িতার মনোভূমিরই প্রাধান্য। পক্ষান্তরে কখনও গল্পের বস্তুভূমিও লেখককে আকর্ষণ করতে পারে সেক্ষেত্রে তাকে প্রাধান্য দিতে দেখা গেছে গল্পকার একটা গল্প মিশিয়ে দিয়েছেন তার সঙ্গে। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় প্রথম প্রকরণের উদাহরণ হিসাবে মোপাসাঁর 'ল্য ওরলা' এবং দ্বিতীয় প্রকরণের উদাহরণ হিসাবে ভিক্তর য়ুগোর 'লে ত্রাভাইয়ের দ্য লা মেয়ার' (যারা সমুদ্রে কাজ করে) গল্পদুটির উল্লেখ করেছেন। বাংলা গল্পে প্রথম প্রকরণের উদাহরণ হলো- তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'শ্মশানঘাট' এবং দ্বিতীয় প্রকরণের উদাহরণ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'কালচিতি'। তাই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্তঃ
" ঘটনা, চরিত্র, বিষয়- অবলম্বন যা-ই হোক, তাঁকে একটি নিজস্ব জীবন-বোধিতে, একটি দর্শনে, একটি স্বগত-ভাবলোকে পৌঁছে দেওয়াই ছোটগল্পের কাজ।"[১]
গল্পের বিষয়বস্তু
[সম্পাদনা]কোলকাতার বউবাজার ও শিয়ালদহের মোড়ে সেকেন্ডহ্যান্ড মার্কেট বা ব্যবহৃত জিনিসপত্রের একটি বাজার রয়েছে যার চলতি নাম 'চোরাবাজার'। এখানে সস্তায় জুতো থেকে শুরু করে ইলেকট্রিক সরঞ্জাম, এমনকি আসবাবপত্র পর্যন্ত মেলে। গল্পকথক একদিন সেখানে বুককেসের সন্ধানে গিয়েছিলেন, কিন্তু মনোমত জিনিস না পাওয়ায় ফিরে আসছিলেন। এমন সময় একটি পুরানো গ্রামোফোন রেকর্ডের দোকানে স্তূপাকৃতি পুরানো রেকর্ড দেখে সেখানে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। অতীতে তিনি এ'ধরনের দোকান থেকে আশাতীত কম দামে রবীন্দ্রকণ্ঠের রেকর্ড, রাধিকা গোস্বামী বা দিলীপকুমারের গানের রেকর্ড কিনেছেন। খুঁজতে খুঁজতে আজ তিনি এমন একটি রেকর্ড পেলেন যার লেবেলে চিহ্নিত ভাষা গল্পকথকের অপরিচিত কিন্তু তাঁর অনুরোধে দোকানদার যখন সেটি বাজালেন তখন তাঁর কাছে এর সুর যেন চেনা চেনা মনে হলো। কিন্তু দোকানের মালিককে প্রশ্ন করেও এর ভাষা বা প্রাপ্তির উৎস সম্পর্কে কোনো তথ্যই তিনি জানতে পারেন নি।
বাড়িতে এসে তিনি রেকর্ডটি বাজালে নূতন অধ্যাপনাকর্মে নিযুক্তা তাঁর স্ত্রী করুণা প্রথমে বিরক্তি প্রকাশ করলেও গানটি শোনার পর তিনিও যথারীতি জানালেন এর সুর তার কাছে যেন চেনা চেনা। রেকর্ডটির সেই সুর সারা সন্ধ্যা গল্পকথক ও তাঁর স্ত্রীকে আচ্ছন্ন করে রাখলো ; মজার বিষয় হলো খুব চেনা মনে হলেও দু-জনের কেউই সুরটা ধরতে পারলেন না। রাত্রে খাওয়ার সময় তাঁর স্ত্রী করুণা জানালেন সুরটা তিনি ধরতে পেরেছেন, এ'সুরের মধ্যে খাসিয়া বা নাগাদের ঢাকের শব্দের মতো তীব্র স্রোতোবেগ অনুভূত হয়। গল্পকথকেরও মনে হলো মানভূমের ছৌ-নাচের গুরু গুরু নাগরার আওয়াজের কথা। তাঁর আরও মনে হলো , বিয়াল্লিশের আগস্ট আন্দোলনের সময় বালুরঘাটের অন্ধকার সাঁওতাল গ্রামগুলি থেকে এমনিভাবেই নাগরা-টিকারার রোল ধ্বনিত হয়েছিলো। ইতিমধ্যে গল্পকথকের স্ত্রীর এক সহপাঠিনী বন্ধু আইভি এলেন যিনি ইউরোপ থেকে পাশ্চাত্য সঙ্গীত শিক্ষা করেছেন। পাশ্চাত্য সঙ্গীতে পারদর্শিনী আইভি প্রথমে কিছুই ধরতে পারলেন না, পরে জানালেন সেটি সুইৎজারল্যান্ডের বিবাহোৎসবের গান। কিন্তু গল্পকথক ও তাঁর স্ত্রী আইভির কথাটাকে স্বীকার করতে পারলেন না। সেদিন রাতে গল্পকথক তার বাড়ির অনতিদূরে এক সার্কাস দলের তাঁবু থেকে বাঘের গর্জন শুনতে পেলেন আর তৎক্ষণাৎ তাঁর ঐ বিদেশী রেকর্ডের কথা মনে পড়লো; বাঘের ক্রুদ্ধ গর্জনের সঙ্গে কোথায় যেন তিনি এর একটা মিল খুঁজে পেলেন।
শেষ পর্যন্ত গল্পকথকের এক ভূপর্যটক বন্ধু রহস্যের সমাধান করলেন। তিনি রেকর্ডটি শুনেই চমকে উঠে সেটি কোথায় পাওয়া গেছে তা জানতে চাইলেন। এর প্রাপ্তিস্থান কোলকাতা শুনে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন-
" এ কলকাতায় এল কী করে তাই ভাবছি। এ রেকর্ড গোপনে তৈরি হয়েছিল- গোপনে বিক্রি আর বিলি হয়েছিল সামান্য সংখ্যায়। কিন্তু এদের প্রত্যেকটি শিল্পীই নাৎসি রাইফেলের গুলিতে প্রাণ দিয়েছে।"
গল্পকথক ও তাঁর স্ত্রী আরও জানতে চাইলে ইউরোপের একটি ছোট দেশের নাম করলেন ভূপর্যটক বন্ধু। নাৎসিদের অধিকারের সময় এই রেকর্ডটি ছিলো সেখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের গান। হিটলারের গোয়েন্দারা দাবি করেছিলো এর প্রত্যেকটি কপি অরিজিনাল- এর প্রত্যেকটি শিল্পীকে তারা লিকুইডেট করেছে। অথচ এই রেকর্ড পাওয়া গেল কলকাতার বাজারে।
ঠিক সেই সময় রাস্তা দিয়ে একটি ছাত্র-শোভাযাত্রা যাচ্ছিল, তার দূরাগত প্রতিবাদী ধ্বনিটা সহসা বন্যার মতো প্রবল বেগে ভেঙে পড়লো, আর সেই সঙ্গে লাঠি আর টিয়ার গ্যাস চলতে লাগলো। গল্পকথকের মনে হলো, তিনি যেন শুনছেন দূর থেকে ভেসে আসছে প্রাণের বন্যা আর ক্রোধের ঝোড়ো গর্জন। তখন সুরটাকে চিনতে তাঁর আর বাকি রইল না। ব্রহ্মপুত্রের বর্ষামাদল, নাগা পাহাড়ের ঢাক, ছৌ-নাচের নাগরা, বালুরঘাটের রাত্রি কাঁপানো টিকারার আওয়াজ, সার্কাসের তাঁবুর বাঘের গর্জন, আর আজকের এই ঘা-খাওয়া মিছিল সব একসাথে মিশে ওই সুরটাকে সৃষ্টি করেছে। দেশে দেশে, যুগে যুগে এ এক চিরন্তন প্রতিরোধের সুর। গল্পকথকের স্ত্রী করুণার দু-চোখে তখন অজস্র ঘৃণার আগুন উদগীরিত হচ্ছে। তিনি ধীরে ধীরে বললেন-
"এ রেকর্ডকে কেউ ভেঙে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি, কেউ পারবেও না।"[২]
চরিত্র
[সম্পাদনা]- গল্পের কথক যার চিন্তনে একটি রেকর্ডের সুর চিরন্তন প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছে।
- গল্পকথকের অধ্যাপিকা স্ত্রী করুণা।
- গল্পকথকের স্ত্রী করুণার বান্ধবী আইভি যিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীত শিক্ষার জন্য ইউরোপে গিয়েছিলেন।
- এবং গল্পকথকের জনৈক ভূপর্যটক বন্ধু যিনি রেকর্ডের সুর ও ভাষা রহস্যের উন্মোচন করেন।
ছোটগল্প রেকর্ডের শ্রেণি নির্ণয়
[সম্পাদনা]'রেকর্ড' ছোটগল্পটি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম সারির গল্প বলে স্বীকার করা যায় না, কেননা মানবজীবন সম্পর্কে কোনো গভীর কথা বা কোনো অসাধারণ চরিত্র বিশ্লেষণ এ'গল্পে অনুপস্থিত। গল্পটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কোনো সামাজিক সত্য প্রতিষ্ঠিত করা বা কোনো তত্ত্ব প্রতিপাদন করা এর উদ্দেশ্য নয়, যদিও মানবজীবনের প্রতিবাদী শক্তির তত্ত্ব এতে পরিবেশিত হয়েছে। তাই গল্পটির শ্রেণি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এর অন্তিম বক্তব্যবিষয়ের অভিমুখই লক্ষ্যণীয়।
গল্পটি চরিত্রকেন্দ্রিক নয়, চরিত্রের সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম দিকগুলির চিত্রায়ন না ঘটলেও লেখক এখানে গল্পকথকের মাধ্যমে প্রতিবাদী শক্তির তত্ত্বও পরিবেশন করেছেন। গল্পকথকের স্ত্রী করুণার বান্ধবী আইভি চরিত্রটি অল্প কথার আঁচড়ে চমৎকার ফুটেছে; তার ব্যবহার, চালচলনে তথাকথিত উচ্চসমাজের কৃত্রিমতা ও আত্মম্ভরিতাই প্রকাশ পেয়েছে এবং গল্পকথক সচেতনভাবেই তাকে ব্যঙ্গ করেছেন। সঙ্গত কারণে আইভি কোনো পূর্ণাঙ্গ চরিত্ররূপে ফুটে ওঠেনি। এ'গল্পের ফলকথা তাই লৌকিক ও ব্যবহারিক অর্থ-তাৎপর্যকে অতিক্রম করে এমন এক বিস্তৃতি প্রাপ্ত হয়েছে যেখানে মানবচরিত্রের গভীরতম মহত্ত্ব ভাবের আশ্রয়ে লালিত হয়। সুতরাং গল্পটি ভাবাত্মক যাকে অবলম্বন করে এক দার্শনিক ভাবনার উত্তাপ উপলব্ধ হয়। রেকর্ডটির সুর শোনার পর থেকে গল্পকথক ও তাঁর পত্নীর মনোজগতে এক অদ্ভুত ভাবের বিমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়, যেখানে প্রবলতা, গভীরতা, গাম্ভীর্য ও সংগ্রামী অনুভূতির সহাবস্থান ছিলো।
ব্রহ্মপুত্রনদের বর্ষামাদল, নাগা পাহাড়ের ঢাক, ছৌ-নাচের নাগরা, বালুরঘাটের রাত্রি-কাঁপানো টিকারার আওয়াজ, সার্কাসের বাঘের ডাক- সব একসঙ্গে মিলে গল্পকথকের ভাবরসে জারিত হয়ে ঐ সুর সৃষ্টি করেছিলো। গল্পের প্রয়োজনে কিছু ঘটনার বিন্যাস ঘটেছে সত্য- কিন্তু তার পরিণাম ঘটনাগত নয়, তা ভাবাশ্রয়ী। আর সেই ভাবের প্রতিষ্ঠায় নাৎসি -বিরোধী আত্মবিসর্জনকারী প্রতিবাদী সুরের সাথে কলকাতার রাস্তায় আক্রান্ত ছাত্রদের প্রতিবাদী সুর এক সরলরেখায় মিশে যায়; তখন পাঠকচিত্তে এক গভীর মানবিক অনুভূতির সার্বজনীন রসবেদনের উপলব্ধি ঘটে। আর গল্পকথক সেই অনুভূতির গভীরে প্রবেশ করে গল্পের উপসংহার করেন -
" দেশে দেশে কালে কালে এ সুর এক। জানতুম, আমরাও এ সুরকে জানতুম। ঘুমন্ত রক্তের মধ্যে তলিয়ে ছিল বলে এতদিন চিনতে পারিনি।"[৩]
স্ত্রী করুণার মুখেও উচ্চারিত হলো-
"এ রেকর্ডকে কেউ ভেঙে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি, কেউ পারবেও না।"[৩]
গ্রন্থপঞ্জি
[সম্পাদনা]- 'কালের পুত্তলিকা' - অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়,
- 'ছোটগল্পের বিচিত্র কথা' - ডঃ সরোজমোহন মিত্র,
- আমার কালের কয়েকজন কথাশিল্পী - জগদীশ ভট্টাচার্য,
- বাছাই গল্প: নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় - সম্পা. বারিদবরণ ঘোষ. কোলকাতা।
- নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী. সংগৃহীত ৩ ডিসেম্বর, ২০১৫।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ 'ছোটগল্পের সীমারেখা' ফাল্গুন, ১৩৭৬, মার্চ ১৯৫৯
- ↑ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড; ১০, শ্যামাচরণ দে স্ট্রীট, কলিকাতা- ১২, প্রথম প্রকাশ, রথযাত্রা- ১৩৫৯
- ↑ ক খ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, অষ্টম খণ্ড, সম্পা. আশাদেবী, অরিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড; ১০, শ্যামাচরণ দে স্ট্রীট, কলিকাতা- ১২, প্রথম প্রকাশ, ভাদ্র- ১৩৯১, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ভাদ্র-১৩৯৯