হেরাক্লিয়ন

স্থানাঙ্ক: ৩১°১৮′১৫″ উত্তর ৩০°০৬′০২″ পূর্ব / ৩১.৩০৪১৭° উত্তর ৩০.১০০৫৬° পূর্ব / 31.30417; 30.10056
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
হেরাক্লিয়ন
নীল নদের ব-দ্বীপ এলাকার মানচিত্রে প্রাচীন শহর হেরাক্লিয়ন নগরের অবস্থান
হেরাক্লিয়ন মিশর-এ অবস্থিত
হেরাক্লিয়ন
মিশরে অবস্থান
অবস্থানবর্তমান মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরের নিকটবর্তী এলাকায়
স্থানাঙ্ক৩১°১৮′১৫″ উত্তর ৩০°০৬′০২″ পূর্ব / ৩১.৩০৪১৭° উত্তর ৩০.১০০৫৬° পূর্ব / 31.30417; 30.10056

হেরাক্লিয়ন (গ্রিক: Ἡράκλειον) বা থনিস (Θῶνις) হলো প্রাচীন মিশরের একটি বিলুপ্ত শহর।[১] ভূমধ্যসাগরের পাদদেশে গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস কর্তৃক বিবৃত নগরী হেরাক্লিয়ন ছিলো প্রাচীন মিশরের অন্যতম প্রধান বন্দর নগরী।[২] খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ - ৩৩১ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে[৩] (অর্থাৎ, আলেকজান্দ্রিয়া বন্দর প্রতিষ্ঠার আগে পর্যন্ত[৪]) এই বন্দর ছিল মিশরের গ্রিসের সাথে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত প্রধান বন্দর। মিশরীয়রা নিজেরা এই শহরকে থনিস[১][২][৪] অথবা তাহোনে বলে অভিহিত করত। দ্বিতীয় শব্দটির অর্থ হল গ্রিক সমুদ্রের প্রবেশদ্বার। ১৮৯৯ সালে নাউক্রেটিসে প্রাপ্ত একটি ফলকে তখনও পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত এই শহরটিকে নামেই অভিহিত করা হয়েছে।[৩] বন্দর ছাড়াও এ' শহর মিশরীয় দেবতা আমন'এর সুবিশাল মন্দিরের জন্যও বিখ্যাত ছিল।[১][৪] ২০০০-১ খ্রিষ্টাব্দে সমুদ্রের তলদেশ থেকে অতীতের হারিয়ে যাওয়া এই শহর ও বন্দরের ধ্বংসাবশেষ পুনরাবিষ্কার করা সম্ভব হয়।[৪]

নীল নদের বদ্বীপ অঞ্চলে বর্তমান আলেকজান্দ্রিয়া নগরের ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) উত্তরপূর্ব দিকে এই প্রাচীন বন্দর নগরীর অবস্থান ছিল। এর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে যে অংশে, তা এখন আবু কির উপসাগরে তীরভূমি থেকে প্রায় ৬.৫ কিলোমিটার সমুদ্রের অভ্যন্তরে প্রায় ১০ মিটার বা ৩০ ফিট জলের তলে অবস্থিত।[৪][৫]

ভৌগোলিক অবস্থান[সম্পাদনা]

ঐতিহাসিক শহর ও বন্দর হেরাক্লিয়নের বর্তমান অবস্থান নীল নদের মোহনায় আবু কির উপসাগরের মধ্যে তীরভূমি থেকে ৬.৫ কিলোমিটার অভ্যন্তরে ১০ মিটার জলের তলায়। গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসস্ট্রাবো বর্ণিত এই শহরটি আক্ষরিক অর্থেই দীর্ঘসময় বিস্মৃতির গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ২০০০-১ খ্রিষ্টাব্দে ইউরোপিয়ান ইন্সটিটিউট অব আন্ডারওয়াটার আর্কিওলজি (Institut européen pour l’archéologie sous-marine বা IEASM) দলের নেতৃত্বে এই শহরের ধ্বংসাবশেষ পুনরাবিষ্কৃত হয়।[৪][৬]

শহরটি বেশ কয়েকটি ছোট ছোট দ্বীপের উপর গঠিত হয়েছিল। এই দ্বীপগুলি ছোট ছোট খাল দ্বারা পরস্পরের থেকে পৃথক ছিল। শহরের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত ছিল হেরাক্লেস বা আমন'এর বিশাল মন্দিরটি। পূর্বদিকে ছিল সমুদ্রবন্দর। খুব কাছাকাছি অন্তত দশটি প্রাচীন জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে এই বন্দরের অবস্থান সম্পর্কে অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া যায়। অন্যদিকে শহরের উত্তর দিক সম্ভবত মূলত বসবাসের অঞ্চল হিসেবে ব্যবহৃত হত।[৩]

বিশেষজ্ঞদের আরও ধারণা, এই সমুদ্রবন্দরটি সম্ভবত খালপথে দেশের অভ্যন্তরের সাথেও যুক্ত ছিল। সেক্ষেত্রে এই বন্দর একাদিক্রমে দু' ধরনের বন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হত। দেশের অভ্যন্তর থেকে নদী ও খালপথে পণ্য এই বন্দরে আনীত হত ও সেখান থেকে সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে তা বিদেশে যেতে পারত। আবার বিদেশ থাকে আগত পণ্যও একইভাবে এই বন্দরের সাহায্যে দেশের অভ্যন্তরে পৌঁছে যেতে পারত।[৩] খননস্থল থেকে মেলা ৭০০রও বেশি নোঙর ও ৬০ টি জাহাজের ভগ্নাবশেষ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, আদতে বন্দর হিসেবে এই বন্দর ছিল কতখানি বড় ও ব্যস্ত।[৭]

পূর্বোল্লেখ[সম্পাদনা]

২০০০-১ খ্রিষ্টাব্দের আগে প্রাচীন এই গুরুত্বপূর্ণ বন্দরশহরের কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উদ্ধার না হলেও বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থে ও ফলকে বারেবারে এর উল্লেখ পাওয়া গিয়েছিল। এগুলির মধ্যে কিছু উল্লেখকে পৌরাণিক বা কাল্পনিক বলে অভিহিত করা গেলেও, অনেকগুলিই যথেষ্ট ঐতিহাসিক তথ্যসমৃদ্ধ। নিচে এর মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ তুলে ধরা হল:

পৌরাণিক উল্লেখ[সম্পাদনা]

গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের লেখায় হেরাক্লিওনের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। তার মতে হেলেনকে নিয়ে স্পার্টা থেকে পালানোর সময়ে ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস প্রথমে নীল নদের মোহনায় অবস্থিত এই বন্দরে আসে। এখানে মিশরের রাজা প্রোতেউস'এর নির্দেশে তাদের আটক করা হয় ও রাজধানী মেমফিসের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়।[৮] আরেক উপকথা অনুযায়ী মেনেলাউস ও হেলেন এখানে মিশরীয় অভিজাত থন ও তার স্ত্রী পলিডামনার সাহচর্যে বেশ কিছুদিন বসবাস করেন।[৯] খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর গ্রিক কবি নিকান্ডারের কবিতাতেও পাওয়া যায়, মেনেলাউসের জাহাজের এক নাবিক ক্যানোপাসকে থনিসের সমুদ্রতীরে সাপে কামড়েছিল।[৭] আবার গ্রিক পৌরাণিক নায়ক হেরাক্লেস (হারকিউলিস) নিজেও নাকি এই শহরে এসেছিলেন; তার থেকেই গ্রিকদের কাছে এই শহর হেরাক্লিয়ন বলে পরিচিত হয়।

প্রাচীন উল্লেখ[সম্পাদনা]

তবে এই শহরের উল্লেখ আমরা শুধুমাত্র নানা উপকথা ও পুরাণেই পাই না, বিভিন্ন ঐতিহাসিক লেখাপত্র ও ফলকেও এর নামোল্লেখ চোখে পড়ে। গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের ইতিহাস (History) -এর উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। কিন্তু এখানে যা উল্লেখ্য, তা হল হেরোডোটাসের দাবি অনুযায়ী প্যারিস ও হেলেনের এখানে আগমন ও পরবর্তী ঘটনার অনুসন্ধানকল্পে তিনি নিজেও এখানে আসেন ও মেমফিসের পুরোহিতদের সাক্ষাতকার নেন। সেখানেও তিনি সমসাময়িক একটি শহর হিসেবেই হেরাক্লিওনের উল্লেখ করেন ও বলেন যে এই সমুদ্র তীরবর্তী শহরে হেরাক্লিসের একটি মন্দির ছিল।[১০] এছাড়া আরও দুই প্রাচীন গ্রিক ঐতিহাসিক দেওদোরাস (১.১৯.৪) ও স্ট্রাবোর (১৭.১.১৬) লেখাতেও আমরা এই বন্দর-শহরের উল্লেখ পাই।

আবার নাউক্রেটিসে প্রাপ্ত একটি ফলকে আমরা একটি ডিক্রির (ফারাও প্রথম নেকতানেবোর ডিক্রি) কথা জানতে পারি, যেখানে বলা হয়েছে যে হেরাক্লিয়ন/থনিসের জলপথ ব্যবহারের জন্য সংগৃহীত শুল্ক ও করের ১০% দেবী নেইথের মন্দিরের পুরোহিতদের সেবায় ব্যবহৃত হবে।[১১] ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে আবিষ্কৃত এই ফলকটির একটি জোড়াও বর্তমানে (২০০১ খ্রিষ্টাব্দে) পুনরাবিষ্কৃত হেরাক্লিয়নের প্রত্নস্থলে সমুদ্রের তলদেশ থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। ফারাও তৃতীয় টলেমির সম্মানে রচিত কানোপাসের শিলালিপিতেও (২৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) আমরা এই শহর এবং তার জীবনযাত্রা, ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান, জলের উপর জাঁকজমকপূর্ণ শোভাযাত্রা, প্রভৃতির বিস্তৃত উল্লেখ পেয়ে থাকি।[৭]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "সাগরতলে হারিয়ে যাওয়া মিশরীয় নগর!"বাংলা ট্রিবিউন অনলাইন। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ২০ নভেম্বর ২০১৭ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  2. "সাগরতলে নগর!"দৈনিক যুগান্তর অনলাইন। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ২০ নভেম্বর ২০১৭ 
  3. Herakleion: Die Auferstehung der Götter Geo-epoche. (জার্মান), সংগৃহীত ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৭।
  4. Frank Goddio. "SUNKEN CIVILIZATIONS: Thonis-Heracleion: From Legend to Reality" ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৯ জুলাই ২০১৭ তারিখে সংগৃহীত ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৭।
  5. "Heracleion Photos: Lost Egyptian City Revealed After 1,200 Years Under Sea". The Huffington Post. ২৯ এপ্রিল, ২০১৩।
  6. Exclusif: Premières images de la découverte de la mythique Heracleion (Egypte) ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৭ মে ২০১৬ তারিখে Eddenya. (ফরাসি) সংগৃহীত ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৭।
  7. Dalya Alberge (2 August 2015). "Ancient Egyptian underwater treasures to be exhibited for the first time". The Guardian. সংগৃহীত ৪ জানুয়ারি, ২০১৮।
  8. Herodotus, The Histries with an English translation by A. D. Godley. Cambridge. Harvard University Press. 1920. B. - 2. Ch - 112 - 20. সংগৃহীত ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৭।
  9. Ethnika kat' epitomen.Stephanus of Byzantium. p - 320 -1. (গ্রিক)
  10. The Histries with an English translation by A. D. Godley. Cambridge. Harvard University Press. 1920. B. - 2. Ch - 113. সংগৃহীত ৩ জানুয়ারি, ২০১৮।
  11. Villing, Alexandra. [www.britishmuseum.org/research/online_research_catalogues/ng/naukratis_greeks_in_egypt/introduction/naukratis_a_city_and_port.aspx Naukratis: a city and trading port in Egypt,

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]