হেমাঙ্গ বিশ্বাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
১৯৮০ সালে হেমাঙ্গ বিশ্বাস

হেমাঙ্গ বিশ্বাস (জন্ম: ১৪ ডিসেম্বর ১৯১২ - মৃত্যূ: ২২ নভেম্বর ১৯৮৭[১]) একজন ভারতীয় গায়ক, গীতিকার, সুরকার এবং বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী। তিনি বাংলা ও অসমীয়া ভাষায় নিজ সৃষ্টিকর্মে সৃজন করেছেন। মূলত লোকসঙ্গীতকে কেন্দ্র করে গণসঙ্গীত সৃষ্টির ক্ষেত্রে তার অবদান উল্লেখযোগ্য, তিনি ভাটিয়ালি গানে নতুন মাত্রা সংযোজন করেছিলেন।

প্রথম জীবন[সম্পাদনা]

হেমাঙ্গ বিশ্বাস বর্তমান বাংলাদেশের সিলেটের মিরাশির বাসিন্দা ছিলেন। হবিগঞ্জ হাইস্কুল থেকে পাশ করার পর তিনি শ্রীহট্ট মুরারিচাঁদ কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে কারাবন্দী থাকাকালে তিনি যক্ষারোগে আক্রান্ত হন। তারপর যাদবপুর হাসপাতালে কিছুকাল চিকিৎসাধীন থাকেন এবং সেই কারণে তিনি মুক্তি পান। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তেলেঙ্গানা আন্দোলনের সময়ে তিনি গ্রেফতার হন এবং তিন বছর বন্দী থাকেন। ১৯৫৩ সালের এপ্রিল মাসে বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত আইপিটি-এর সপ্তম সর্বভারতীয় সন্মেলনে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নেতৃত্বে অসমের ৪০ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন।

কর্মজীবন[সম্পাদনা]

১৯৩৮-৩৯ খ্রিষ্টাব্দে বিনয় রায়, নিরঞ্জন সেন, দেবব্রত বিশ্বাস প্রমুখের সাথে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা আই.পি.টি.এ (ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন) গঠন করেন। পঞ্চাশের দশকে এই সংঘের শেষ অবধি তিনি এর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন।

১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার প্রগতিশীল লেখক শিল্পীদের আমন্ত্রনে তিনি প্রথম কলকাতায় আসেন সঙ্গীত পরিবেশন করতে। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে তার উদ্যোগে এবং জ্যোতিপ্রকাশ আগরওয়ালের সহযোগিতায় সিলেট গণনাট্য সংঘ তৈরি হয়। স্বাধীনতার আগে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের গানের সুরকারদের মধ্যে তিনিই ছিলেন প্রধান। সেই সময়ে তার গান তোমার কাস্তেটারে দিও জোরে শান, কিষাণ ভাই তোর সোনার ধানে বর্গী নামে প্রভৃতি আসাম ও বাংলায় সাড়া ফেলেছিল। আসামে তার সহযোগী ছিলেন নগেন কাকতি, বিনোদবিহারী চক্রবর্তী, সাহিত্যিক অশোকবিজয় রাহা, সেতারবাদক কুমুদ গোস্বামী প্রভৃতি। ১৯৫৬ সালে চিনে যান চিকিৎসার জন্য। আড়াই বছর থাকেন এবং খুব কাছ থেকে দেখেন চিনের সাংস্কৃতিক আন্দোলন। ১৯৬১ সালে স্থায়ীভাবে চলে আসেন কলকাতা এবং সেই সময়েই চাকরি নেন সোভিয়েত কনস্যুলেটের সোভিয়েত দেশ পত্রিকার সম্পাদকীয় দপ্তরে। কাজ করার সময় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতপার্থক্য হলে তিনি কাজ ত্যাগ করেন। চীন-ভারত মৈত্রীর ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল। দুবার তিনি চিনে গিয়েছিলেন। চীনা ভাষায় তার অনেক গান আছে।

জ্যোতি প্রসাদ, মঘাই ওজা, বিষ্ণু প্রসাদ রাভা, ফণী শর্মা, লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়া, ভূপেন হাজরিকা ইত্যাদি অসমের জাতীয় সংস্কৃতির সন্মানীয় ব্যক্তিদের হেমা‌ঙ্গ বিশ্বাস মূল্যায়ন করে গেছেন এবং বঙ্গীয় সমাজের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় করে দিয়েছেন।

১৯৭১ সালে মাস সিঙ্গার্স নামে নিজের দল গঠন করে জীবনের শেষ দিকেও তিনি গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে বেরিয়েছেন। তিনি কল্লোল, তীর, লাললণ্ঠন প্রভৃতি নাটকের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। লাললন্ঠন নাটকে তিনি বিভিন্ন চীনা সুর ব্যবহার করেছিলেন। রাশিয়ান গানও অনুবাদ করেন। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগীত 'ইন্টারন্যাশনাল' ও রাশিয়ান সুরে তার গাওয়া ‘ভেদী অনশন মৃত্যু তুষার তুফান’ গানটি 'In the call of comrade Lenin' এর ভাবানুবাদ। এটি কমিউনিস্ট কর্মীদের কাছে অতীব জনপ্রিয় হয়।

তার রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য :

  • শঙ্খচিলের গান
  • জন হেনরীর গান
  • মাউন্টব্যাটেন মঙ্গলকাব্য
  • বাঁচব বাঁচব রে আমরা
  • মশাল জ্বালো
  • সেলাম চাচা
  • আমি যে দেখেছি সেই দেশ

হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান এবং শঙ্খচিলের গান তার গানের সঙ্কলন।

বাংলাঅসমীয়া ভাষায় তার লিখিত কিছু লোকসঙ্গীত শিক্ষামূলক বই

  • কুল খুরার চোতাল
  • আকৌ চীন চাই আহিলো
  • জীবন শিল্পী জ্যোতি প্রসাদ
  • লোকসঙ্গীত সমীক্ষা বাংলা ও আসাম
  • উজান গাঙ বাইয়া
  • হেমাঙ্গ বিশ্বাস রচনাবলী (প্রকাশক: অসম প্রকাশন পরিষদ) সন ২০০৮।


হিরোশিমায় আণবিক বোমা বর্ষণ নিয়ে- শঙ্খচিল, প্রহসনের স্বাধীনতা নিয়ে- আজাদী হয়নি আজও তোর, মাউন্টব্যাটন মঙ্গলকাব্য, মাও সেতুং স্মরণে- আরও বসন্ত-বহু বসন্ত তোমার নামে আসুক, নোঙর ছাড়িয়া নাও-এর দে দুঃখী নাইয়া, বেহুলার ভেলায় যায় ভেসে যায়, তোর মরা গাঙ্গে আইলো এবার বান, জালিয়ানওয়ালাবাগের-জালালাবাদের এসেছে আদেশ (সুর দেবব্রত বিশ্বাস), পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে- হায় হায় ঘোর কলিকাল আইলো আকাল, খাদ্য আন্দোলনের শহীদদের নিয়ে- গুলিবিদ্ধ গান যে আমার খুঁজে খুঁজে মরে, মুক্তির শিবিরে হাঁকে বিউগল, এই সমাধিতলে কত প্রাণপ্রদীপ জ্বলে, উদয়ের পথের যাত্রী, মন কান্দেরে পদ্মার চরের লাইগ্যা, পদ্মা কও-কও আমারে, লর্ড মাউন্ট ব্যাটনের ভারত ত্যাগের প্রাক্কালে- শুন শুন শুন সবে শুন মন দিয়া, রুশ বিপ্লবের সময়কার রেডগার্ড বাহিনীর গানের বঙ্গানুবাদ- ভেদি অনশন মৃত্যু তুষার তুফান, আমরা যুগের স্বপ্ন ওরে, এ মাটির এই ধূলিকণায়, কারাগারে বন্দি, এ ছাড়াও অসংখ্য গণজাগরণের গান হেমাঙ্গ বিশ্বাস গেয়েছেন। আমাদের জাতীয়তাবাদী এবং মানবমুক্তি আন্দোলন-সংগ্রামে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের অনেক গান আমাদের এখানে গাওয়া হয়েছিল এবং এখনও গাওয়া হয়ে থাকে।

রাষ্ট্র বদলের অভিপ্রায়ে সারাটি জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। সেই রাষ্ট্র তাকে নিপীড়ন করেছে- কারারুদ্ধ করেছে সেই রাষ্ট্র তাকে স্বীকৃতি দেবে- সৃজনশীলতার মর্যাদা দেবে, তেমন ভাবনা নিতান্তই অবান্তর। প্রচলিত অর্থে হেমাঙ্গ বিশ্বাস অনেকের মতো জনপ্রিয় হয়তো ছিলেন না। মিডিয়ার প্রচারণা পাননি। সেটা তার লক্ষ্যও ছিল না। বিদ্যমান ব্যবস্থা ভাঙাই ছিল তার স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষা। সঙ্গত কারণে রাষ্ট্রের প্রচার যন্ত্র তাকে এক রকম বর্জনই করেছিল। প্রচলিত পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। তাই প্রচলিত ব্যবস্থা তাকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং দেয়ার কথাও নয়। এ বিষয়ে তিনি যথার্থ সচেতন ছিলেন। হালকা-পাতলা গড়নের মানুষটির মেরুদণ্ড ছিল অসম্ভব দৃঢ় এবং শক্ত। আত্মসমর্পণের মানসিকতা ছিল না। গণনাট্য সংঘের অনেকে ভোল পাল্টে ব্যক্তিগত প্রচার-প্রতিষ্ঠায় কলকাতা-মুম্বাই ছোটাছুটি করলেও হেমাঙ্গ বিশ্বাস নীতি-আদর্শ বিসর্জন দিয়ে সেটি করেননি। আমৃত্যু অটল ছিলেন মতাদর্শে-অঙ্গিকারে। তাই কারও সঙ্গে তার তুলনা চলে না। তিনি গান রচনা করেছেন, সুর দিয়েছেন এবং গেয়েছেনও। সব কিছুর মূলে ছিল রাজনীতি। সমাজ বিপ্লবের রাজনীতি। সেই রাজনৈতিক মতাদর্শ আমৃত্যু ধারণ করেছেন। বিচ্যুত হয়ে প্রচলিত প্রতিষ্ঠার পিছু ছোটেননি। সেখানেই তিনি অনন্য এবং দৃষ্টান্তস্বরূপ। তার নীতিনিষ্ঠ বর্ণাঢ্য জীবনাচার আমাদের জন্য শিক্ষার এবং প্রেরণারও।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. হরিদাস ঠাকুর; হবিগঞ্জের জালালি কইতর হেমাঙ্গ বিশ্বাস শ্রমিক কারিগর শিল্পী; রায়প্রকাশ, ময়মনসিংহ; ১৪ ডিসেম্বর, ২০১২; পৃষ্ঠা_২২-২৮

পাদটিকা[সম্পাদনা]

  • সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান - সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু, দ্বিতীয় খণ্ড - সাহিত্য সংসদ
  • আধুনিক বাংলা গান, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত