হিরোশিমা শান্তি স্মৃতিসৌধ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
হিরোশিমা শান্তি স্মৃতিসৌধ
(গেনবাকু গম্বুজ)
ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান
হিরোশিমা প্রিফেকচারাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রমোশন হলের ধ্বংসাবশেষ
মানদণ্ডসংস্কৃতি: ৬
সূত্র৭৭৫
তালিকাভুক্তকরণ১৯৯৬ (২০তম সভা)

হিরোশিমা শান্তি স্মৃতিসৌধ (広島平和記念碑, হিরোশিমা হেইয়া কিনেনহি), সাধারণভাবে যা ‘’’পারমাণবিক বোমা গম্বুজ’’’ অথবা এটম-বোমা গম্বুজ (原爆ドーム, গেনবাকু গম্বুজ), নামে পরিচিত। এটি জাপানের হিরোশিমায় অবস্থিত হিরোশিমা শান্তি স্মৃতি উদ্যানের একটি অংশ এবং ১৯৯৬ সালে এটি ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের স্বীকৃতি পায়। ধ্বংসাবশেষটি ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণে নিহত ব্যক্তিদের স্মৃতি বহন করে। ৭০০০০ এর বেশি সংখ্যক মানুষ তাৎক্ষনিকভাবে মারা যায় এবং অন্য ৭০০০০ মানুষ তেজস্ক্রিয়তা জনিত ভয়াবহ অসুস্থতার শিকার হয়।[১]

ইতিহাস[সম্পাদনা]

পন্য প্রদর্শনী হলের নকশার মূল স্থপতি ছিলেন চেক প্রজাতন্ত্রের স্থপতি জ্যান লেটজেল। এই নকশার অন্তর্ভুক্ত ছিল একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের গম্বুজ যা ছিল দালানের সর্বোচ্চ স্থানে। নির্মাণ কাজ ১৯১৫ সালে শেষ হয় এবং নাম দেয়া হয় “হিরোশিমা প্রিফেকচারাল কমার্শিয়াল এক্সিভিশন” (এইচএমআই)।[১] ঐ সালেরই আগস্ট মাসে এটি আনুষ্ঠানিক ভাবে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ১৯২১ সালে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় “হিরোশিমা প্রিফেকচারাল প্রোডাক্টস এক্সিভিশন হল”। আবার ১৯৩৩ সালে নামকরণ করা হয় “হিরোশিমা প্রিফেকচারাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রমোশন হল”। আইওই সেতুর নিকটে একটি বিশাল বাণিজ্যিক জেলায় দালানটি অবস্থিত। প্রথম দিকে এটি চিত্রকলা ও শিক্ষামূলক প্রদর্শনীর জন্য ব্যবহার হত।[২]

বোমার উপকেন্দ্রে টিকে থাকা একমাত্র অবকাঠামো ছিল দালানটি।[৩] দালানের চূড়ায় গম্বুজের ধাতব কাঠামো বেরিয়ে আসায় এটি গেনবাকু ("একটি বোমা") গম্বুজ নামে পরিচিতি পায়। অবকাঠামোটি অন্যান্য ধ্বংসাবশেষের সাথে ধ্বংস নেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও দালানের অধিকাংশ অংশ অক্ষত থাকায় ধ্বংস করার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছিল। গম্বুজটি একটি বিতর্কের বিষয় হয়ে দাড়ায়। স্থানীয়দের একদল চাচ্ছিল এটিকে ধ্বংস করা হোক, আরেকদল চাচ্ছিল এটিকে বোমার আঘাতের স্মৃতি এবং শান্তির প্রতীক হিসেবে সংরক্ষণ করা হোক।[৪] অবশেষে, যখন হিরোশিমার পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু হয়, তখন ভবনটির ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণ করা হয়।[৩]

১৯৫০ থেকে ১৯৬৪ সালের মধ্যে গম্বুজের চারপাশে হিরোশিমা শান্তি স্মৃতি উদ্যান প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৬৬ সালে হিরোশিমা নগর কাউন্সিল গেনবাকু গম্বুজ স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং অবকাঠামোটির আনুষ্ঠানিক নাম দেয়া হয় হিরোশিমা শান্তি স্মৃতিসৌধ। তখন থেকে স্মৃতিস্তম্ভটি উদ্যানের মূল কাঠামো হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে।[৩]

১৯৪৫ সালের অক্টোবর মাসে ধ্বংসলীলার মধ্যে গেনবাকু গম্বুজ। ছবি তুলেছেন শিগো হায়াশি, একাডেমিক জরিপ দলের দুইজন ফটোগ্রাফারের একজন। [৫]

পারমাণবিক বোমার আক্রমণ[সম্পাদনা]

১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকাল ৮:১৫-তে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর বি-২৯ বোমারু বিমান ইনোলা গে এর মাধ্যমে বিশ্বের ইতিহাসে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথম ব্যবহার হওয়া পারমাণবিক বোমা লিটল বয় নিক্ষেপ করা হয়। বোমাটির শক্তি জাপানের হিরোশিমা নগর পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলে।[৬]

১৯৪৫ সালের ২৫ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় কুশলী বিমান বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল কার্ল স্প্যাটজ জাপানের কিছু চিহ্নিত শহরে একটি “বিশেষ বোমা” হামলার নির্দেশ পান।[৭] সর্বপ্রথম লক্ষ্য ছিল হিরোশিমা নগরী, যেখানে দক্ষিণ হো'শুউতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল, জাপানিজ সেকেন্ড জেনারেল আর্মির সদরদপ্তর ছিল এবং এর ৪০০০০ সামরিক কর্মকর্তা শহরটিতে অবস্থান করছিল।[৭] বোমাটি গোপনে প্রস্তুত করে ইনোলা গে বম্বার(বোমারু বিমানে) উঠানো হয়। এটি ইউরেনিয়াম এর ২৩৫ আইসোটোপের খণ্ড দিয়ে তৈরি যা একশ কেজি দস্তা দিয়ে আবৃত। লিটল বয় যে শক্তি ধারণ করেছিল তা ১২,৫০০ টন টিএনটির শক্তির সমতুল্য। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট স্থানীয় সকাল ৮ টা বেজে ১৫ মিনিট ১৭ সেকেন্ডে বিমানটি শহরের উপর বোমাটি নিক্ষেপ করে এবং এর ৪৩ সেকেন্ড পর হিরোশিমা শহরের উপর পরিকল্পিত গন্তব্যস্থল থেকে ২৪০ মিটার দূরে লিটল বয় বিস্ফোরিত হয়। বোমাটি পরিকল্পিত লক্ষ্যস্থল আইওই সেতুর পরিবর্তে বোমাটি শিমা হাসপাতালের উপরে বিস্ফোরিত হয়; যা গেনবাকু গম্বুজের খুব কাছে অবস্থিত। বোমাটি সরাসরি গেনবাকু গম্বুজ বিশিষ্ট দালানের প্রায় মাথার উপর দিয়ে বিস্ফোরিত হওয়ায় দালানের অধিকাংশ কাঠামোই টিকে থাকে।[৮] দালানের উলম্ব খিলানগুলো বিস্ফোরণের প্রায় উলম্বভাবে নিম্নগামী শক্তি সহ্য করতে সক্ষম হয় এবং দালানের বহিঃস্থ দেয়ালের বেশ খানিকটা কংক্রিট ও ইট টিকে থাকে। মূল লক্ষ্য অর্থাৎ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের ইংরেজি ‘’টি( T)’’ আকৃতির আইওই সেতু থেকে সামান্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গম্বুজ থেকে আনুভূমিক ১৫০ মিটার দূরত্বে এবং উলম্ব তলে ৬০০ মিটার দূরত্বে বোমাটি বিস্ফোরিত হয়। গম্বুজটি বোমার বিস্ফোরণের উপকেন্দ্র থেকে ৬০০ মিটার দূরে অবস্থিত।[৮] দালানটির ভেতরে অবস্থানকারী সকলেই সাথে সাথে মারা যান।[৯][১০]

সংরক্ষণ[সম্পাদনা]

যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আবহাওয়া ও দূষণজনিত ক্ষতি হতে থাকে গেনবাকু গম্বুজে। ১৯৬৬ সালে হিরোশিমা নগর কাউন্সিল ঘোষণা দেয় যে তাঁরা ঐ কাঠামোটি নামহীন ভাবে সংরক্ষণ করবেন যা বর্তমানে “গেনবাকু গম্বুজ” নামে পরিচিত। হিরোশিমার প্রথম জনপ্রিয় নির্বাচিত নগরপাল শিনজো হামাই (১৯০৫ – ১৯৬৮) সংরক্ষণ কার্যক্রমের জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। একবার টোকিও ভ্রমণে হামাই সরাসরি রাজধানীর রাস্তায় রাস্তায় অর্থ সংগ্রহ করেন। গেনবাকু গম্বুজের সংরক্ষণ কার্যক্রমের ১৯৬৭ সালে সমাপ্ত হয়।[১][১১] ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণের জন্য গেনবাকু গম্বুজ এর উপর দুইটি ছোট সংরক্ষণ প্রকল্প হয়েছিল, উল্লেখযোগ্যভাবে অক্টোবর ১৯৮৯ থেকে মার্চ ১৯৯০ এর মধ্যে। [১]

১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট বোমা হামলার পর যেভাবে দাড়িয়েছিল আজও সেভাবেই দাড়িয়ে আছে গেনবাকু গম্বুজ। কাঠামোটি ধরে রাখতে ধ্বংসাবশেষে সামান্য পরিবর্তন হয়েছে।[৩]

ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী অঞ্চল[সম্পাদনা]

১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসে বিশ্বের সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণের কনভেনশনের ভিত্তিতে গেনবাকু গম্বুজকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।[১] একটি ভয়ংকর শক্তি (পারমাণবিক বোমা) থেকে রক্ষা পাওয়া, একটি জনগোষ্ঠীর উপর পারমাণবিক অস্ত্রের প্রথম ব্যবহার এবং একে শান্তির একটি প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করায় এটিকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।[৩]

ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির চীনা ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি এই স্মৃতিস্তম্ভকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী অঞ্চলের স্বীকৃতি দিতে আপত্তি করে। চীনের অভিমত ছিল যে এই স্মৃতিস্তম্ভ একটি বিষয়কে আড়াল করবে যে যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি প্রানহানি হয়েছিল জাপানী আগ্রাসনের শিকার রাষ্ট্রগুলোতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অভিমত দেয় যে যুদ্ধক্ষেত্রতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ ইতিহাসের মূল উপাদানগুলো বাদ দিয়ে দিতে পারে। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ইউনেস্কোর সিদ্ধান্ত থেকে নিজেদের পৃথক করে নেয়। [১২]

ছবিঘর[সম্পাদনা]

হিরোশিমা শান্তি স্মৃতিউদ্যানের ১৮০° দৃশ্য। ছবির কেন্দ্রের বামে গেনবাকু গম্বুজ দেখা যাচ্ছে। বোমার মূল লক্ষ্য ছিল "T"-আকৃতির আইওই সেতু দেখা যাচ্ছে ছবির বামদিকে

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "原爆ドーム" [A-Bomb Dome]। Nihon Daihyakka Zensho (Nipponika) (Japanese ভাষায়)। Tokyo: Shogakukan। ২০১২। ওসিএলসি 153301537। ২০০৭-০৮-২৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০৯-১৮ 
  2. Logan, William (২০০৮)। Places of Pain and Shame: Dealing with 'Difficult Heritage'। Routledge। 
  3. UNESCO। "Hiroshima Peace Memorial (Genbaku Dome)" 
  4. Hiroshima Peace Museum
  5. "Let's look at the Special Exhibit : Hiroshima on October 5, 1945"। Hiroshima Peace Memorial Museum। সংগ্রহের তারিখ ১৫ আগস্ট ২০১০ 
  6. Schofield, John and Cocroft, Wayne (eds.) (২০০৯)। A Fearsome Heritage: Diverse Legacies of the Cold War। Left Coast Press। 
  7. Van Rhyn, Mark E.। "Hiroshima, Bombing of"। PBS। ১১ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ মার্চ ২০১৩ 
  8. Ide, Kanako (Winter ২০০৭)। "A Symbol of Peace and Peace Education: The Genbaku Dome in Hiroshima"Journal of Aesthetic Education। 4। 41: 12–23। সংগ্রহের তারিখ ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ 
  9. Hiroshima Prefectural Industrial Promotion Hall Memorial Plaque
  10. Milam, Michael C. (জুলাই–আগস্ট ২০১০)। "Hiroshima and Nagasaki"। Humanist। Buffalo, N.Y.: American Humanist Association and the American Ethical Union। 70 (4): 32–35। 
  11. "浜井信三" [Shinzo Hamai]। Nihon Jinmei Daijiten (Japanese ভাষায়)। Tokyo: Shogakukan। ২০১২। ২০০৭-০৮-২৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-১০-২৩ 
  12. WH Committee: Report of the 20th Session, Merida 1996

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]