হরিদ্বারে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের হরিদ্বারে হিন্দু তপস্বীদের একটি ধর্ম সংসদ (ধর্মীয় সমাবেশ) ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে ঘৃণামূলক বক্তৃতা দেওয়া হয়েছিল এবং বক্তারা হিন্দু ধর্ম রক্ষার নামে মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে গণহত্যার আহ্বান জানিয়েছিল।[১][২][৩] ঘৃণামূলক ঘটনার মুখে সরকারের উদাসীনতা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক নেতা, সুশীল সমাজের কর্মী, ছাত্র, শিক্ষাবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারক সহ ভারতীয় সমাজের বিস্তৃত অংশের দ্বারা নিন্দা করা হয়।

ঘটনা[সম্পাদনা]

গাজিয়াবাদের দাসনা দেবী মন্দিরের পুরোহিত ও জুনা আখড়ার প্রধান নরসিংহনন্দ হরিদ্বার ধর্ম সংসদের (ধর্মীয় সমাবেশ) আয়োজন করেছিল।[৩] সমাবেশটি ২০২১ সালের ১৭ই-১৯শে ডিসেম্বরের মধ্যে তিন দিন ধরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।[৩]

সম্মেলনের থিম ছিল- ইসলামিক ভারত মে সনাতন কা ভবিষ্য ("ইসলামিক ভারতে সনাতনের (ধর্ম) ভবিষ্যত")। এটিকে দ্য ওয়্যার দ্বারা একটি "অদ্ভুত বিষয়" হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল, কারণ এই সমাবেশ ব্যতীত অন্য কেউ ভারতকে "ইসলামি" বলে বিশ্বাস করেনি।[৪]

বক্তাদের প্রায় সকলেই গেরুয়া-পরিহিত হিন্দু তপস্বী (পুরুষ হলে সাধু ও মহিলা হলে সাধ্বী বলা হয়) ছিল। তাদের অনেকেই আখড়ার প্রধানও ছিল (শারীরিক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, যা সাধারণত তপস্বী আদেশের সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত হয়)।

উইলিয়াম হারম্যান তার লেখা দ্য মিলিটেন্ট এসেটিক ট্রেডিশন্স অব ইন্ডিয়া অ্যান্ড শ্রীলঙ্কা-এ উল্লেখ করেছে যে অন্তত সপ্তম শতাব্দী থেকে জঙ্গী তপস্বীরা হিন্দু সভ্যতার একটি দৃঢ়তা।[ক] ব্রিটিশদের দ্বারা তাদের ১৮-১৯ শতকে নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছিল।[খ] হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) এবং এর ধর্মীয় শাখা বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) ১৯৬০-এর দশকে তপস্বী আদেশের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন শুরু করে। ভিএইচপি-এর একশো সদস্য ১৯৮০-এর দশকে "সংস্কৃতি রক্ষার" নামে হরিদ্বারে তপস্বী আদেশে দীক্ষিত হন।[গ]

বক্তৃতা[সম্পাদনা]

সমাবেশে, বহু বক্তা সংখ্যালঘুদের হত্যার আহ্বান জানায় এবং তারা তাদের ধর্মীয় স্থানে হামলারও আহ্বান জানায়।[৩]

একজন প্রাক্তন আরএসএস প্রচারক যিনি তপস্বী ও হরিদ্বারে হিন্দু রক্ষা সেনা নামে একটি সংগঠন পরিচালনাকারী প্রবোধানন্দ গিরি,[৫] রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতার কথা উল্লেখ করে হিন্দুদের মিয়ানমারে ঘটনাকে অনুকরণ করতে বলেছিলেন।[৬] তিনি এটিকে সাফাই অভিযান ("পরিচ্ছন্নতা অভিযান") নামে অভিহিত করেছেন, যা স্পষ্টতই জাতিগত নির্মূলকে বোঝায়।[১][৭] প্রবোধানন্দ গিরি তার ফেসবুক পেজে ছবি দেখিয়ে নিজেকে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন।[২] পরের দিন এনডিটিভি নিউজের সাথে কথা বলার সময়, তিনি তার রাখা বক্তব্যের পক্ষে সমর্থন করেন এবং জোর দিয়ে উল্লেখে করেন যে তিনি পুলিশকে ভয় পান না।[১]

নিরঞ্জনী আখড়ার প্রধান ও হিন্দু মহাসভার সাধারণ সম্পাদক সাধ্বী অন্নপূর্ণা (পূর্ব নাম পূজা শকুন পান্ডে) প্রকাশ্যে মুসলমানদের হত্যার আহ্বান জানান। "যদি আমাদের মধ্যে ১০০ জন তাদের মধ্যেকার দুই মিলিয়নকে হত্যা করতে প্রস্তুত হয়, তাহলে আমরা জয়ী হব এবং ভারতকে একটি হিন্দু দেশে পরিণত করব," তিনি বলেন, হিন্দুদের হত্যা করতে প্রস্তুত থাকতে ও জেলে যেতে ইচ্ছুক হতে বলেন।[৮] এনডিটিভি নিউজের সাথে আলাপকালে তিনি আরও বলেন যে তিনি পুলিশকে ভয় পান না।[১]

স্বামী আনন্দ স্বরূপ নামে অন্য একজন বক্তা, যিনি শাম্ভবী ধামের প্রধান, লোকদের হরিদ্বারে ক্রিসমাস উদযাপন করা থেকে বিরত থাকতে বলেন।[৯] তিনি হরিদ্বার থেকে মুসলিম বিক্রেতাদের নিষিদ্ধ করারও আহ্বান জানান।[২] তিনি বলেছিলেন যে সরকারকে ধর্ম সংসদের রায় মেনে চলতে হবে, কারণ এটি "ঈশ্বরের বাণী"। অন্যথায়, এটি ১৮৫৭ সালের যুদ্ধের মতো একটি যুদ্ধ পরিচালনা করবে, যা ব্রিটিশ ভারতীয় সরকারের বিরুদ্ধে ১৮৫৭ সালের ভারতীয় বিদ্রোহের উল্লেখ ছিল।[২]

প্রতিক্রিয়া[সম্পাদনা]

আভ্যন্তরীণ[সম্পাদনা]

ধর্ম সংসদের সভায় দেওয়া বক্তৃতার ভিডিও ক্লিপ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। এটিকে নৌবাহিনীর প্রাক্তন প্রধান অ্যাডমিরাল অরুণ প্রকাশ ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য স্পষ্ট হুমকি হিসেবে বর্ণনা করেছেন; অরুণ প্রকাশের বর্ণনার সঙ্গে প্রাক্তন সেনাপ্রধান জেনারেল বেদ প্রকাশ মালিক সম্মত হন এবং জরুরি পদক্ষেপের আহ্বান জানান।[১০] তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র সাকেত গোখলে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেন; ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মুখপাত্র শামা মুহাম্মাদও একই ধরনের পথ অনুসরণ করেছেন।[১১]

বিজেপির সদস্যরা এবং দলের সমর্থকরা মুসলিম নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসির একটি ক্লিপ করা ভিডিও শেয়ার করে, ভিডিওতে দেখা যায় যে আসাদউদ্দিন ওয়াইসি হিন্দুদের গণহত্যার আহ্বান জানিয়েছে। অভিযোগ করা হয় যে ক্লিপ করা ভিডিও শেয়ারের উদ্দেশ্য হরিদ্বারের ঘৃণাত্মক বক্তৃতা থেকে মনোযোগ সরানোর প্রয়াস ছিল।[১১]

আন্তর্জাতিক[সম্পাদনা]

৮ই জানুয়ারি #StopIndianMuslimGenocide হ্যাশট্যাগ দিয়ে বিশ্বজুড়ে ভারতীয় প্রবাসীরা একটি 'টুইটার ঝড়' তৈরি করেছে। বিশ্বব্যাপী ভারতীয় প্রবাসীদের দ্বারা জারি করা একটি প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়, "[তারা] কেবল দাঁড়িয়ে আমাদের সহ ভারতীয়দের মানবতা অস্বীকারকে দেখবে না"। সারা বিশ্ব থেকে ২৮ টির মতো প্রবাসী গোষ্ঠী বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে।[১২]

৫৭ টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে এবং ভারতের হরিদ্বার ঘৃণাত্মক বক্তৃতা ও হিজাব বিতর্কের প্রতিক্রিয়ায় মুসলমানদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ভারতকে জানায়। মন্তব্যের জন্য ওআইসিকে ভারত নিন্দা জানিয়ে বলে যে সংস্থাটির সাম্প্রদায়িক মানসিকতা রয়েছে এবং ভারতের বিরুদ্ধে তাদের ঘৃণ্য প্রচারণাকে এগিয়ে নিতে স্বার্থান্বেষী স্বার্থ দ্বারা হাইজ্যাক করা হয়েছে।[১৩]

আইন-শৃঙ্খলা[সম্পাদনা]

উত্তরাখণ্ড পুলিশ ২৩শে ডিসেম্বর জিতেন্দ্র নারায়ণ ত্যাগী ও অজ্ঞাত "অন্যদের" বিরুদ্ধে "ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে ঘৃণা প্রচারের" জন্য একটি এফআইআর নথিভুক্ত করে। জিতেন্দ্র নারায়ণ ত্যাগী (পূর্বে ওয়াসিম রিজভি) হলেন সাম্প্রতিককালে ইয়াতি নরসিংহনন্দ দ্বারা হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনগণ প্রশ্ন তুলেছিল কেন পুলিশ কোনও বক্তার বিরুদ্ধে মামলা নথিভুক্ত করেনি, কিন্তু শুধুমাত্র জিতেন্দ্র নারায়ণ ত্যাগীর নাম মামলা দিয়েছে।[৬][১৪]

ফলাফল[সম্পাদনা]

ধর্ম সংসদের একদিন আগে ২০২২ সালের ২৭শে মে সুপ্রিম কোর্ট উত্তরাখণ্ড সরকারকে এই অনুষ্ঠানে কোনও ঘৃণাত্মক বক্তব্য না দেওয়া হয় তা নিশ্চিত করতে বলেছিল।[১৫][১৬] অনুষ্ঠানটি করার অনুমতি প্রদানে উত্তরাখণ্ড পুলিশ অস্বীকার করে এবং একটি এফআইআর দায়ের করে। শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে ব্যাপক পুলিশ মোতায়েন করা হয়ে ছিল।[১৭]

টীকা[সম্পাদনা]

  1. Harman, William (২০১৩), "The militant ascetic traditions of India and Sri Lanka", P. Pratap Kumar, Contemporary Hinduism, Routledge, পৃষ্ঠা 245–, আইএসবিএন 9781315729589 
    • (p.248) "We know that armed ascetics are mentioned in the seventh-century Sanskrit drama Harṣacaritra, and in the eleventh-century Sanskrit comedy Prabhodhacandrodaya ... "
    • (p.249) "The first historically verifiable account of militant ascetic violence seems to have occurred in 1567 when the Emperor Akbar accidentally became embroiled in an impending skirmish between two Hindu ascetic groups armed to the teeth."
  2. van der Veer, Peter (ফেব্রুয়ারি ২০০৭), "Warrior Ascetics and Indian Empires by William R. Pinch (book review)", American Historical Review : "Gradually, however, with the expansion of British control, the ascetics became marginalized. An important element of their marginalization was the application of British-Indian civil law to the inheritances of ascetics who had both celibate descendants and natural offspring."
  3. Jha, Dhirendra K. (১ এপ্রিল ২০১৯), "An Unholy Quest: The RSS's attempts to engulf the sadhu class", The Caravan : "A report published in Organiser, on 1 August 1982, indicates that at least part of the phenomenon was planned. Titled "Haridwar Makes History," the report talked of the VHP getting a hundred of its men initiated as "sanyasins" by "seven local historic akharas" of Haridwar, as part of its newly launched project called the Sanskriti Raksha Yojna—"culture-protection plan".

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Hate Speech-Givers In Haridwar Tell NDTV "Neither Regrets Nor Fear", NDTV, 23 December 2021.
  2. Hindutva Leaders at Haridwar Event Call for Muslim Genocide, The Wire, 22 December 2021.
  3. Grover, Samarth (২০২১-১২-২২)। "Narsinghanand Organises 3-Day Hate Speech Conclave in Haridwar"TheQuint 
  4. "A Hate-Filled Call to Arms and Violence at Haridwar", The Wire, 24 December 2021.
  5. Jha, Dhirendra K. (১ এপ্রিল ২০১৯), "An Unholy Quest: The RSS's attempts to engulf the sadhu class", The Caravan 
  6. Haridwar: Police case after outrage in India over anti-Muslim hate speech, BBC News, 24 December 2021.
  7. Barkha Dutt, Don't normalise hate speeches, mob violence, Hindustan Times, 24 December 2021. প্রোকুয়েস্ট ২৬১৩২৪০১৬৬
  8. Sameer Yasir, As Hindu Extremists Call for Killing of Muslims, India's Leaders Keep Silent, The New York Times, 24 December 2021.
  9. Haridwar hate speeches: ABP, Republic skip issue in prime time debates, Newslaundry, 24 December 2021.
  10. 'National Security': 2 Ex-Service Chiefs, Others Demand Action Against Communal Haridwar Event, The Wire, 23 December 2021.
  11. PTI, Is India still a democracy? Oppn on Haridwar hate speeches, Rediff, 23 December 2021.
  12. 'Brink of an Impending Genocide': Indian Diaspora Demands Arrest of Haridwar Dharma Sansad Speakers, The Wire, 9 January 2022.
  13. "'Communal mindset': India skewers OIC over statement on Muslims in India"Hindustan Times 
  14. SC Agrees to Hear PIL on Hate Speeches at Haridwar Dharma Sansad, The Wire, 10 January 2022.
  15. Anand, Utkarsh (২০২২-০৪-২৭)। "Check hate speech at Dharma Sansad: Supreme Court"Hindustan Times। সংগ্রহের তারিখ ১ জুলাই ২০২২ 
  16. Anand, Utkarsh (২০২২-০৪-২৬)। Bhasin, Swati, সম্পাদক। "Top court pulls up Uttarakhand, says 'ensure no hate speech' at event tomorrow"Hindustan Times (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ১ জুলাই ২০২২ 
  17. "Uttarakhand Police deny permission to organise Dharma Sansad in Roorkee, files FIR against organisers"National Herald (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২২-০৪-২৭। সংগ্রহের তারিখ ১ জুলাই ২০২২