স্থিতিস্থাপকতা (পদার্থবিজ্ঞান)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

স্থিতিস্থাপকতা পদার্থ তথা বস্তুর একটি ভৌত ধর্ম। বল প্রয়োগের কারণে বিকৃত হয়ে যাওয়া কোন বস্তুর বল সরিয়ে নেয়ার পর আদি অবস্থায় ফিরে যেতে পারার সক্ষমতা তথা ধর্মকে পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় স্থিতিস্থাপকতা (ইংরেজি ভাষায়: Elasticity) বলা হয়। যে সকল বস্তুর এই গুণ আছে তাদের স্থিতিস্থাপক বস্তু (ইংরেজি ভাষায়: Elastic) বলে।[১]

বিজ্ঞানী রবার্ট হুক ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কার করেন যে, অধিকাংশ স্থিতিস্থাপক বস্তুর সামান্য বিকৃতি ঘটানো হলে তা রৈখিক স্থিতিস্থাপকতা প্রদর্শন করে। অর্থাৎ বলপ্রয়োগজনিত বিকৃতির জন্য বস্তুর ওপর প্রয়োগকৃত বল সরাসরি বিকৃতির পরিমাণের সমানুপাতিক হয়। এই ধ্রুব নীতিকে বর্তমানে হুকের সূত্র বলা হয়। গাণিতিকভাবে বলা যায়, কোন বস্তুর উপর F বল প্রয়োগের ফলে বস্তুটির x সরণ ঘটলে,

যেখানে k একটি ধ্রুবক যাকে হার বা স্প্রিং ধ্রুবক বলা হয়। বল এবং সরণের পরিবর্তে স্থিতিস্থাপকতার সূত্রকে পীড়ন (stress, ) এবং প্রলম্বনের (strain, ) মধ্যবর্তী সম্পর্ক হিসেবেও প্রকাশ করা যায়,

যেখানে E আরেকটি ধ্রুবক যাকে স্থিতিস্থাপকতার গুণাঙ্ক বা ইয়ং-এর গুণাঙ্ক বলা হয়।

স্থিতিস্থাপকতার বিবিধ অনুষঙ্গ[সম্পাদনা]

স্থিতিস্থাপকতার সীমা[সম্পাদনা]

সর্বোচ্চ যে পরিমাণ বল প্রয়োগ করলে বস্তু সর্বাংশে তার আদি অবস্থায় ফিরে যেতে পারে, তাকে স্থিতিস্থাপকতার সীমা বলে। স্থিতিস্থাপকতার সীমা অতিক্রমী বল প্রয়োগের ফলে বস্তু সর্বাংশে তার আদি অবস্থায় ফিরে যেতে পারে না।

পূর্ণ স্থিতিস্থাপক বস্তু[সম্পাদনা]

Modes deformation cropped প্রয়োগকৃত বল সরিয়ে নেওয়া হলে কোন বস্তু যদি সর্বাংশে তার আদি অবস্থায় ফিরে যেতে সক্ষম হয়, তবে সেই বস্তুকে পূর্ণ স্থিতিস্থাপক বস্তু বলে।

অবসিত স্থিতিস্থাপকতা (Elastic Fatigue)[সম্পাদনা]

কোন তারের ওপর উপর্যুপরি পীড়নের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটানো হলে তারটির স্থিতিস্থাপকতা হ্রাস পায়। এর ফলে বল অপসারণের সাথে সাথে বস্তু তারটি আদি অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হয় না; সাময়িক বিলম্ব ঘটে। বস্তুর এই অবস্থাকে অবসিত স্থিতিস্থাপকতা (Elastic Fatigue) বলে। একে স্থিতিস্থাপক ক্লান্তিও বলা হয়।

তখন অসহ ভারের চেয়ে কম ভারে এমনকি স্থিতিস্থাপকতা সীমার মধ্যে বল প্রয়োগেও তারটি ছিঁড়ে যেতে পারে।

পূর্ণ নমনীয় (প্লাস্টিক) বস্তু[সম্পাদনা]

বল প্রয়োগ করে কোন বস্তুকে বিকৃত করা হলে, বল অপসারণের পরেও যদি বস্তুটি ঐ বিকৃত অবস্থা সম্পূর্ণ ভাবে বজায় রাখে, তবে তাকে পূর্ণ নমনীয় (প্লাস্টিক) বস্তু বলে।

পূর্ণ দৃঢ় বস্তু[সম্পাদনা]

বল প্রয়োগ করেও যদি কোন বস্তুকে বিকৃত করা না যায়, তবে তাকে পূর্ণ দৃঢ় বস্তু বলে। পূর্ণ দৃঢ় বস্তু বাস্তবে পাওয়া যায় না। বস্তু যত শক্তই হোক না কেন প্রযুক্ত বলের পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে কোন এক পর্যায়ে বস্তুর বিকৃতি ঘটে। ধরি কোনো বস্তুর পীড়ন,x

  বস্তুটির বিকৃতি, y

যেহেতু হুকের সূত্রমতে,

   (পীড়ন/বিকৃতি)= স্থিতিস্থাপক গুনাঙ্ক
  আর পূর্ণদৃঢ় বস্তুর বিকৃতির মান 0 বলে 
    y=0
  সুতরাং, স্থিতিস্থাপক গুনাঙ্ক = (x/0)
                      = অসীম 
 প্রকৃতপক্ষে পূর্ণদৃঢ় বস্তু পাওয়া যায় না।


স্থিতিস্থাপক ক্লান্তি[সম্পাদনা]

কোনো বস্তু বা তারের ওপর ক্রমাগত পীড়নের হ্রাস-বৃদ্ধি করলে স্থিতিস্থাপক ধর্ম হ্রাস পায়। এর ফলে বল অপসারণের সাথে সাথে বস্তু আগের অবস্থা ফিরে পায় না,কিছুটা দেরি হয়।বস্তুর এই অবস্থাকে স্থিতিস্থাপক ক্লান্তি বলে।

স্থিতিস্থাপকতার বিভিন্ন গুণাঙ্ক (Elastic Moduli)[সম্পাদনা]

হুকের সূত্র অনুযায়ী স্থিতিসাধক সীমার মধ্যে কোন বস্তুর পীড়ন ও বিকৃতির অনুপাত একটি ধ্রুবক সংখ্যা। এই ধ্রুবকই বস্তুর উপাদানের স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক।

সংজ্ঞার্থ[সম্পাদনা]

স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে কোন বস্তুর পীড়ন ও বিকৃতির অনুপাত একটি ধ্রুব সংখ্যা। এই ধ্রুব সংখ্যাকে বস্তুর উপাদানের স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক বলে।

অতএব স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক, E = পীড়ন/বিকৃতি

রাশি[সম্পাদনা]

পীড়ন ও বিকৃতি উভয়েই স্কেলার রাশি বলে স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক একটি স্কেলার রাশি

মাত্রা[সম্পাদনা]

যেহেতু বিকৃতির কোন মাত্রা নেই, সুতরাং স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্কের মাত্রা হবে পীড়নের মাত্রা অর্থাৎ বল/ক্ষেত্রফল।

অতএব [E] = [ML-1T-2]

একক[সম্পাদনা]

যেহেতু বিকৃতির কোন একক নেই, সুতরাং স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্কের একক হবে পীড়নের একক অর্থাৎ বল/ক্ষেত্রফল। এস. আই পদ্ধতিতে স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্কের একক N/m² বা Pa (পাস্কাল)।

ইয়ং গুণাঙ্ক বা দৈর্ঘ্য গুণাঙ্ক(Young's modulus)[সম্পাদনা]

স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে বস্তুর অনুদৈর্ঘ্য পীড়ন ও অনুদৈর্ঘ্য বিকৃতির অনুপাত একটি ধ্রুবক সংখ্যা। এই ধ্রুব সংখ্যাকে বস্তুর উপাদানের দৈর্ঘ্য গুণাঙ্ক বা ইয়ং গুণাঙ্ক বলে। একে Y দ্বারা প্রকাশ করা হয়।

ইয়ং গুণাঙ্ক, Y= অনুদৈর্ঘ্য পীড়ন / অনুদৈর্ঘ্য বিকৃতি

  • ইয়ং গুণাঙ্ক একটি স্কেলার রাশি।

Y- এর মাত্রাঃ যেহেতু বিকৃতির কোন মাত্রা নেই, সুতরাং Y- এর মাত্রা পীড়নের মাত্রার অনুরূপ হবে। অর্থাৎ, [Y] = [ML-1T-2]

Y- এর এককঃ বিকৃতির কোন একক না থাকায় Y- এর এককও পীড়নের এককের অনুরূপ হবে। সুতরাং এস. আই পদ্ধতিতে ইয়ং গুণাঙ্কের একক N/m² বা Pa।

আয়তন গুণাঙ্ক(Bulk modulus)[সম্পাদনা]

স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে বস্তুর আয়তন পীড়ন ও আয়তন বিকৃতির অনুপাত একটি ধ্রুব সংখ্যা। এই ধ্রুব সংখ্যাকে বস্তুর উপাদানের আয়তন গুণাঙ্ক বলে।

আয়তন গুণাঙ্ককে B দ্বারা প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ, আয়তন গুণাঙ্ক, B= আয়তন পীড়ন/আয়তন বিকৃতি

মাত্রা ও এককঃ আয়তন গুণাঙ্ক মাত্রা ও একক ইয়ং গুণাঙ্ক মাত্রা ইয়ং গুণাঙ্ক মাত্রা ও এককের অনুরূপ।

দৃঢ়তা গুণাঙ্ক বা ব্যবর্তন গুণাঙ্ক বা মোচড় গুণাঙ্ক (Modulus of rigidity)[সম্পাদনা]

স্থিতিসাধক সীমার মধ্যে বস্তুর কৃন্তন পীড়ন ও কৃন্তন বিকৃতির অনুপাত একটি ধ্রুব সংখ্যা। এই ধ্রুব সংখ্যাকে বস্তুর উপাদানের দৃঢ়তা গুণাঙ্ক বলে।

দৃঢ়তা গুণাঙ্ককে n বা দ্বারা প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ, দৃঢ়তার গুণাঙ্ক, n = ব্যবর্তন পীড়ন/ব্যবর্তন বিকৃতি

মাত্রা ও এককঃ দৃঢ়তার গুণাঙ্ক মাত্রা ও একক ইয়ং গুণাঙ্ক মাত্রা ইয়ং গুণাঙ্ক মাত্রা ও এককের অনুরূপ

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. দেবনাথ, দ্বৈপায়ন (ডিসেম্বর ১৩, ২০১৪)। "স্কুলের পদার্থবিদ্যাঃ মেকানিক্স লেকচার ৯ (চাপ, আর্কিমিডিসের সূত্র, স্থিতিস্থাপকতা)" (bangla ভাষায়)। ২০১৬-১২-০৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-১২-০১