বিষয়বস্তুতে চলুন

সৈয়দ মিরাণ শাহ তাতারী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
আরিফে রাব্বানী

সৈয়দ মিরাণ শাহ তাতারী

বোগদাদি কাদেরী
জন্ম১৮৩৬ ঈসায়ী
মৃত্যু৯ই পৌষ ১৩২৮ বাংলা,
২৪ই ডিসেম্বর ১৯২১ ঈসায়ী
সমাধিকচুয়া মাজার শরীফ, চাতলপাড় ইউনিয়ন, নাসিরনগর উপজেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বাংলাদেশ
পরিচিতির কারণপীর, সুফি
সন্তানসৈয়দ মুহাম্মদ ইমরান শাহ
আত্মীয়সৈয়দ মুহাম্মদ ইরফান শাহ রামপুরী (বড় নাতি) ও সৈয়দ মুহাম্মদ রায়হান শাহ রামপুরী (ছোট নাতি)

সৈয়দ মিরাণ শাহ তাতারী একজন সুফি, ধর্ম প্রচারক, সমাজ সংস্কারক। তিনি ১৮৩৬ সালে রাশিয়ার তাতারস্থান প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন।[১] তিনি কাদেরিয়া ত্বরিকার একজন সুফি। তার পুরো নাম সৈয়দ নাছিরুদ্দিন মুহাম্মদ মিরাণ শাহ তাতারী।

পরিবার[সম্পাদনা]

মিরাণ শাহ তাতারী এক সম্ভ্রান্ত সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষরা পূর্বে থেকেই পীরানে ছিলছিলার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাঁর বংশধারা গাউসুল আজম আব্দুল কাদের জিলানীর মাধ্যমে হজরত মুহাম্মদ (দ.) পর্যন্ত পৌঁছায়।[১]

প্রাথমিক জীবন[সম্পাদনা]

সৈয়দ মিরাণ শাহ তাতারী শৈশব অতিক্রম করে কৈশোরে পদার্পণ করতেই তিনার আব্বাজান ইন্তেকাল করেন এবং তিনি পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হন। পিতার অবর্তমানে তাঁর মনমানসিকতার পরিবর্তন আসতে থাকে। শিকার ও ভ্রমণে তিনি আসক্ত হয়ে পড়েন। স্নেহময়ী মাতা পুত্রের মনমানসিকতায় পরিবর্তন লক্ষ করে চিন্তিত হয়ে পড়েন। একদিন পুত্রকে অশ্রুসিক্ত নয়নে নিজের গতিধারাকে স্বীয় বংশীয় (পীরানের) ঐতিহ্যকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য বিশেষ উপদেশ প্রদান করেন। কিন্তু তাতে তেমন কোন পরিবর্তন পরিলক্ষিত না হওয়ায় কয়েকদিন পর মা জননী এক ডেগ (ছোট পাতিল) চাউল দ্বারা তাবারুক তৈরি করে তরিকায়ে আলিয়া কাদেরিয়ার নিয়মানুযায়ী ফাতেহা শরীফের আয়োজন করেন। গাউছুল আজম বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এর রওজা মোবারকের দিকে (মা- জননী) মোতাওয়াজ্জিহা হয়ে ফাতেহাশরীফ পাঠ করেন এবং গাউছুল আ'জম (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এর কাছে এই বলে নিবেদন করলেন যে, 'হে গাউছুল আ'জম (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)! আমি আমার ছেলে মিরান শাহকে মাতৃত্বের সমস্ত হক থেকে মুক্ত করে আপনার গোলামির জন্য আপনার দায়িত্বে দিয়ে দিলাম, আপনি আমার সন্তানকে গ্রহণ করুন এবং আপনার যা ইচ্ছে তার দ্বারা সেই কাজই করান। আমি তার ব্যাপারে আর কোন চিন্তা করব না।' এরপর থেকে তাঁর মনমানসিকতায় ও কাজকর্মের মধ্যে পরিবর্তন আসতে থাকে এবং গাউছুল আ'জমের সাথে গভীর আত্মিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।[২]

শিক্ষা জীবন[সম্পাদনা]

একদা সৈয়দ মিরাণ শাহ তাতারী শান্তশিষ্ট মনে শ্রদ্ধেয়া আম্মাজানসকাশে নিবেদন করলেন যে, আমি দ্বীনি শিক্ষার উদ্দেশ্যে হিন্দুস্থান যেতে চাই। আমাকে অনুমতি দিন। মা-জননী পুত্রের দ্বীনিশিক্ষা অর্জনের আগ্রহ দেখে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন এবং সন্তুষ্টচিত্তে হিন্দুস্থানে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করেন। শিক্ষার উদ্দেশ্যেই তিনি প্রথম হিন্দুস্থানে আগমন করেন।[৩]

স্বপ্নযোগে গাউছে পাকের দিদার লাভ এবং বায়াত গ্রহণ[সম্পাদনা]

সৈয়দ মিরাণ শাহ তাতারী দ্বীনিশিক্ষা সমাপ্তের পর সাধনায় ব্রত হয়ে একাধারে একযুগ তথা বারো বৎসর সিয়াম পালনের মত কঠিন রিয়াজতে আত্মনিয়োগ করেন। ১২ বৎসর পূর্ণ হওয়ার কয়েকমাস পূর্বে হযরত বড়পীর গাউছুল আ'জম (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এর খিদমতে হাজির হয়ে সিয়াম ভঙ্গ করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে বাগদাদ শরীফের দিকে সফর শুরু করেন। একদা সন্ধ্যায় বাগদাদশরীফ থেকে ১ মঞ্জিল দূরত্বে এক মুছাফিরখানায় রাত্রিযাপনের জন্য অবস্থান নেন। সে রাত্রে পর পর তিনবার স্বপ্নযোগে গাউছুল আ'জমের দীদার লাভে ধন্য হন। স্বপ্নে গাউছুল আ'জম (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন যে, 'তুমি আল্লাহপাকের নৈকট্যলাভের জন্য যে কঠোর সিয়াম সাধনা তথা সংযমের পরিচয় দিয়েছ তাতে আমি তোমার প্রতি আনন্দিত ও খুশি। তাই রোজা খুলে তুমি আমার দরবারে এসে হাজির হও।' অতপর তিনি সিয়াম খুলে বাকি পথটুকু অতিক্রম করে বাগদাদশরীফে গাউছুল আ'জম আব্দুল কাদের জিলানী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এর পবিত্র দরবারে হাজির হলেন। দরবারে গাউছিয়াতে সালাম পেশ করে নিজের জীবনের ইতিবৃত্ত সবিনয়ে নিবেদন করতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় গাউছুল আ'জম (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ভক্তের এই রূপ অবস্থা দর্শনে সকল গোপনীয়তা ছিন্ন করে চর্মচক্ষুর সামনে সাক্ষাৎ দিয়ে সৈয়দ মিরাণ শাহ তাতারী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) কে হাতে হাত রেখে বায়আত সূত্রে আবদ্ধ করেন। অতপর তরিকায়ে আলিয়া কাদেরিয়ার রীতি অনুযায়ী বায়আত করার এজাযত প্রদান করেন।[৪]

গাউছে পাকের নির্দেশে বাংলায় আগমন[সম্পাদনা]

গাউছুল আজম বড়পীর (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এর মাজারশরীফে অবস্থানকালে মোরাকাবার হালতে পুনরায় গাউছেপাকের সাক্ষাত লাভ করেন সৈয়দ মিরাণ শাহ তাতারীগাউছেপাক (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) তাকে পরম স্নেহে বললেন- 'বাবা মীরান তুমি যদিও আমার কাছে রূহানীভাবে বায়আত শাজরা ও এজাযত লাভ করেছ তথাপি তুমি জাহেরীভাবে আমার আওলাদ ও দরগাহশরীফের বর্তমান মোতাওয়াল্লী ও সাজ্জাদানশীন পীর সৈয়দ আব্দুর রহমান মাহদী আল কাদেরীর নিকট বায়আত ও এজাজত গ্রহণ করে তরিকায়ে আলিয়া কাদেরিয়ার প্রচার ও প্রসারের জন্য ছোবায়ে বাংলা অর্থাৎ বঙ্গ প্রদেশে রওয়ানা হও। তুমি মনে রেখ আল্লাহপাকের অপার রহমতে আমার ফয়েজ সদা সর্বদা তোমার সামেলে হাল (সর্বক্ষণ) থাকবে। আমি দোয়া করি আল্লাহপাক যেন তোমাকে যমানার কুতুব ও মুস্তাজিবুদ্দাওয়াত অলিয়ে কামেলের সুমহান দরজা দান করেন।'[২]

ইন্তেকাল[সম্পাদনা]

তিনি ১৩২৮ বাংলার ৯ই পৌষ, ২৪ই ডিসেম্বর ১৯২১ সালে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলার বাঙ্গালপাড়ায় ইন্তেকাল করেন।[৫] তার মাজার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগরের কচুয়া শরীফে অবস্থিত। প্রত্যেক বছর হাজার হাজার মানুষ স্থানটি পরিদর্শনে যান। প্রতিবছর ৫ই ফাল্গুন তার উরস পালিত হয়। এতে লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়।[৫]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল হাফেজ, শহিদ মিয়া কাদেরী (ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০০৯)। কারামতে সৈয়দ মিরান শাহ তাতারী। পৃষ্ঠা ১৫-২১। 
  2. আল্লামা সৈয়দ ইরফান শাহ, রামপুরী। ফয়ূজাতে আহমদিয়া। মুহাম্মদ রিয়াজুল করিম, আল কাদেরী কর্তৃক অনূদিত। পৃষ্ঠা ১০–১৫। 
  3. মুহাম্মদ মোহাইমিনুল হক, ইবনে জিয়াউল হক কাদেরী (২০১৯)। মিরানীয়া দরবার শরীফের ইতিকথা। পৃষ্ঠা ১৫–১৭। 
  4. আল্লামা সৈয়দ ইরফান শাহ, রামপুরী। ফয়ুজাতে আহমদিয়া। মুহাম্মদ রিয়াজুল করিম, আল কাদেরী কর্তৃক অনূদিত। পৃষ্ঠা ৪৫। 
  5. মুহাম্মদ মুহাইমিনুল হক, ইবনে জিয়াউল হক (ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৯)। মিরানীয়া দরবার শরীফের ইতিকথা। পৃষ্ঠা ১১–১৫।