বিষয়বস্তুতে চলুন

সামাজিক স্তরবিন্যাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

সামাজিক স্তরবিন্যাস হলো এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে অর্থ, সম্পদ, মেধা, বংশ, শিক্ষা, বয়স, পেশা, লিঙ্গ, ক্ষমতা ইত্যাদির ভিত্তিতে সমাজের বিদ্যমান জনসংখ্যাকে বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত করা হয়। জন্মসূত্রে সকল মানুষ সমান এমন মানবতাবাদী দর্শন পৃথিবীতে চালু থাকলেও বিশ্বের ইতিহাসের দিকে তাকালে এমন কোন সমাজ পাওয়া যাবেনা যেখানে মানুষে মানুষে পার্থক্য নেই। সামাজিক স্তরবিন্যাস সর্বজনীন। সব যুগে সব কালে সব সমাজই স্তরায়িত।

সংজ্ঞা

[সম্পাদনা]
সামাজিক স্তরবিন্যাস

সামাজিক স্তরবিন্যাস সমাজবিজ্ঞানের একটি মৌল প্রত্যয়। স্তরবিন্যাস এর ইংরেজি প্রতিশব্দ stratification যা মৃত্তিকা বিজ্ঞান হতে নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন জৈবিক ও অজৈবিক উপাদানের উপর ভিত্তি করেই সামাজিক স্তরবিন্যাস করা হয়ে থাকে। সামাজিক স্তরবিন্যাসের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের জনক কার্ল মার্ক্স বলেছেন, সামাজিক স্তরবিন্যাস হচ্ছে সমাজের মানুষের বিভাজন। এ বিভাজনের ভিত্তি হচ্ছে সমাজে বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থা।সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েভার বলেছেন, সামাজিক স্তরবিন্যাস তথা সমাজের মানুষের বিভাজনের ভিত্তি হচ্ছে সম্পত্তি, ক্ষমতা ও মর্যাদা। মালভিন টিউমিন এর মতে,সামাজিক স্তরবিন্যাস হচ্ছে এমন এক সামাজিক ব্যবস্থা যাতে একটি সামাজিক গোষ্ঠী বা সমাজ শক্তি, সম্পত্তি, সামাজিক মূল্য ও মানসিক তুষ্টির তাররম্যের ভিত্তিতে ঊর্ধ্বার্ধ রীতিতে শ্রেণিবদ্ধ হয়।

চারটি চিহ্নিতকরণ নীতি

[সম্পাদনা]

সামাজিক স্তরবিন্যাসকে চারটি গুরুত্বপূর্ণ নীতির মাধ্যমে চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত, সামাজিক স্তরবিন্যাসকে ব্যক্তির চেয়ে সমাজের সম্পত্তি হিসাবেই বেশি সংজ্ঞায়িত করা হয়। দ্বিতীয়ত, সামাজিক স্তরবিন্যাস এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে বর্তায়। তৃতীয়ত, সামাজিক স্তরবিন্যাস সর্বজনীন (প্রতিটি সমাজে পাওয়া যায়) তবে আপেক্ষিক (সময় এবং স্থানানুসারে পৃথক হয়)।চতুর্থত, সামাজিক স্তরবিন্যাসের সাথে কেবলমাত্র বৈষম্যই নয়, সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে গুণাঢ্য বিশ্বাস ও মনোভাব জড়িত।

সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রকারভেদ

[সম্পাদনা]

আধুনিক পশ্চিমা সমাজে তিনটি শ্রেণির মাধ্যমে সামাজিক স্তরবিন্যাসকে সঙ্গায়িত করা হয়। এই তিনটি শ্রেণি হলো:

আবার এই তিন শ্রেণি আবার কয়েকটি উপশ্রেণিতে বিভক্ত।[]

সমাজবিজ্ঞানী T.B.Bottomore তার ' Sociology ' গ্রন্থে সামাজিক স্তরবিন্যাসের চারটি ধরনের কথা উল্লেখ করেছেন।এগুলি হলো:

  • দাসপ্রথা (Slavery)
  • এস্টেট প্রথা (Estate)
  • জাতিবর্ণ প্রথা (Caste)
  • শ্রেণি বা মর্যাদা গোষ্ঠী (Class and status group)

দাসপ্রথা

[সম্পাদনা]

সামজিক স্তরবিন্যাসের প্রাচীন রূপ হলো দাসপ্রথা।পৃথিবীর সর্বত প্রাচীন দাসপ্রথার উপর ভিত্তি করে সভ্যতার বিকাশ ঘটে।প্রত্যেক দাসের একজন প্রভু বা মালিক ছিল। দাসপ্রথা ছিল এমন এক স্তরবিন্যাস যেখানে দাসরা তাদের প্রভুর সম্পত্তি বলে পরিগণিতে হতো। দাসদের অবস্থা ছিল নিম্নমানের।তারা যেকোন কাজ করতে বাধ্য ছিল। তাদের কোন অধিকার ছিলনা। সমাজে তাদের ঘৃণার চোখে দেখা হতো। সামাজিক স্তরবিন্যাসের নিকৃষ্ট অবস্থা ছিল দাসযুগে। সাধারণত দুই ধরনের দাসপ্রথার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়-

এস্টেট প্রথা

[সম্পাদনা]

মধ্যযুগের ইউরোপীয় সামন্তসমাজের স্তরবিন্যাস এস্টেট প্রথা নামে পরিচিত। মধ্যযুগে ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্স তিনটি এস্টেটে বিভক্ত ছিল-

প্রথম দুই এস্টেটের জনসংখ্যা ছিল ফ্রান্সের জনসংখ্যার ৫ ভাগ আর তৃতীয় সম্প্রদায় ছিল মোট জনসংখ্যার ৯৫ ভাগ। কিন্তু সংখ্যালঘু ৫ ভাগ মানুষ সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করত এবং তারা কর দিত না। সমস্ত করের বোঝা বহন করতে হতো সংখ্যাগরিষ্ঠ তৃতীয় সম্প্রদায়কে।

জাতিবর্ণ প্রথা

[সম্পাদনা]

জাতিবর্ণ ব্যবস্থা হল এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে সমাজের সদস্যদের পেশার ভিত্তিতে নানা গোষ্ঠীতে ভাগ করা হয়েছে। এটি সামাজিক স্তরবিন্যাসের বদ্ধ রূপ যেখানে প্রতিটি জাতিবর্ণ একেকটি অন্তগোত্র বিবাহভিত্তিক যার সদস্যরা জন্মসূত্রে নিজ জাতির সদস্যপদ লাভ করে এবং যে যে বর্ণে জন্মগ্রহণ করে তাকে সে বর্ণেই থাকতে হয়।তাদের পেশা নির্ধারিত হয় জন্মসূত্রে।জাতিবর্ণের উৎকৃষ্ট উদাহরণ ভারতীয় হিন্দু সমাজে দেখা যায়। নৈতিক আচরণভেদ, গায়ের রঙ ও পেশার ভিত্তিতে হিন্দু ধর্মে বর্ণভেদের সৃষ্টি হয়েছে। ইংরেজি Caste শব্দ থেকে বর্ণভেদের উৎপত্তি। Caste শব্দটি পর্তুগীজ Castu শব্দ থেকে গৃহীত হয়েছে। এর অর্থ শ্রেণি বা রঙ। তাই প্রচলিত সাধারণ অর্থে বর্ণভেদ বলতে বুঝায় হিন্দু ধর্মীয় সমাজের স্তর বিভাগ।

গুণ এবং কর্মের ভিত্তিতে ভারতীয় হিন্দু সমাজ ৪ টি বর্ণে বিভক্ত ছিল যার প্রত্যেকটি কয়েকটি উপবর্ণে বিভক্ত ছিল-

মর্যাদা গোষ্ঠী

[সম্পাদনা]

মর্জাদা গোষ্টী ধারনাটি প্রথম আনের প্রাচীন রোমান সম্রাট।তিনি সমাজের মানুষদের মধ্য থেকে অস্ত্র চালনায় পারদর্শী ব্যাক্তিদের নিয়ে বিশেষ মর্যাদার শ্রেণী তৈরী করেন

সামাজিক স্তরবিন্যাস সম্পর্কিত মতবাদ

[সম্পাদনা]

সামাজিক স্তরবিন্যাস হলো সমাজের মানুষকে উঁচু নিচু শ্রেণিতে স্তরায়িতকরণ।সামাজিক স্তরবিন্যাস সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন তত্ত্ব দিয়েছেন। কতিপয় সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন স্তরবিহীন সমাজ কল্পনা করা যায়না। আবার কতিপয় সমাজবিজ্ঞানী দেখিয়েছেন শ্রেণি শোষণের অবসানের মাধ্যমে স্তরবিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রধান দুটি তত্ত্ব হলো-

  • দ্বন্দ্বমূলক তত্ত্ব
  • ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব

দ্বন্দ্বমূলক তত্ত্ব

[সম্পাদনা]

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদঐতিহাসিক বস্তুবাদের জন্য পৃথিবীতে স্মরণীয় হয়ে আছেন কার্ল মার্ক্স। মার্ক্সীয় দৃষ্টিকোণ হতে প্রতিটি সমাজ অর্থনীতির ভিত্তিতে দুটি পরস্পর শ্রেণিতে বিভক্ত।একটি উৎপাদনের উপায়ের মালিক আর অন্যটি উৎপাদনের উপায়ের মালিকানা হতে বঞ্চিত। কার্ল মার্ক্স ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ভিতিতে মানব সমাজকে ৫ ভাগে বিভক্ত করেছেন।যথা:

  • আদিম সাম্যবাদী সমাজ
  • দাস সমাজ
  • সামন্তবাদী সমাজ
  • পুঁজিবাদী সমাজ
  • সমাজতান্ত্রিক সমাজ []

মার্ক্সের মতে পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিপতিরা অধিক মুনাফা লাভের জন্য বেশি পরিমাণে শ্রমিক খাটাতে থাকে। এ সমাজে শ্রমিকরা অধিক শ্রম দেয় কিন্তু তাদের ন্যায্য মজুরি পায়না। এক পর্যায়ে তারা উৎপাদনের উপায় থেকে এবং উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে শ্রেণি বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে। দুই শ্রেণির দ্বন্দ্ব যখন চরম আকার ধারণ করে তখন শ্রমিক শ্রেণি অভ্যুত্থান ঘটায় এবং সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করে পুঁজিবাদের শ্রেণি শোষণের পরাজয় ঘটায়।ফলে প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক সমাজ। সমাজতন্ত্রের সর্বোচ্চ ধাপ হলো সাম্য যেখানে প্রত্যেকে সমান সুযোগ ও অধিকার নিয়ে সমাজে বসবাস করে। ফলে এই সমাজে কোন স্তরবিন্যাস থাকেনা।

ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব

[সম্পাদনা]

ক্রিয়াবাদী সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে ডেভিস ও মুর অন্যতম।ক্রিয়াবাদীরা মনে করেন সামাজিক স্তরবিন্যাস শ্বাশ্বত ও চিরন্তন।স্তরবিহীন কোন সমাজ লক্ষ্য করা যায়না। প্রতিটি দেশে প্রতিটি সমাজে স্তরবিন্যাস লক্ষ্য করা যায়।

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Saunders, Peter (১৯৯০)। Social Class and Stratification। Routledge। আইএসবিএন 978-0-415-04125-6 
  2. "Marxist Stage Theory"learneconomicsonline.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৮-১০