শর্তহীন বিধান
ইমানুয়েল কাণ্টের "শর্তহীন বিধান" ধারণাটি তার নীতি-শাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কাণ্টের মতে, মানুষের নৈতিক আচরণ শর্তসাপেক্ষ ও শর্তহীন বিধানে বিভক্ত। শর্তসাপেক্ষ বিধান তখনই কার্যকরী হয়, যখন কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্য থাকে। উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন পিতা তার সন্তানকে শুধুমাত্র ভবিষ্যতে তার কাছ থেকে লাভের আশা নিয়ে ভালোবাসে, তাহলে এটি শর্তসাপেক্ষ ভালবাসা, কারণ তার ভালবাসা একটি ভবিষ্যৎ ফলাফলের উপর নির্ভরশীল।
অন্যদিকে, কাণ্টের মতে, আদর্শ নৈতিক জীবন শর্তহীন বিধানের উপর ভিত্তি করে হতে হবে, যেখানে কাজের উদ্দেশ্য কোনো নির্দিষ্ট ফলাফল নয়, বরং কাজটিই মূল উদ্দেশ্য। অর্থাৎ, পিতা যদি কোনো প্রতিদানের আশা ছাড়াই শুধুমাত্র সন্তানের প্রতি ভালোবাসা দেখান, তাহলে সেটি শর্তহীন ভালবাসা হবে, যা নিজেই একটি লক্ষ্য। এই ধরনের ভালবাসা কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির উপায় নয়, বরং নিজেই এক আদর্শ আচরণ।
কাণ্ট মনে করেন, একজন ব্যক্তি যখন সমাজে তার আচরণ নির্ধারণ করবে, তখন তার আচরণ এমন হতে হবে যা সবার জন্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে। অর্থাৎ, ব্যক্তির নৈতিক আচরণ শুধু তার নিজের জন্যই নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রযোজ্য হবে। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি যদি চুরি করে, তাহলে তাকে এটা বিবেচনা করতে হবে যে, তার মতো অন্যরাও যদি চুরি করতে থাকে, তবে সমাজে কী ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। এর মাধ্যমে সে তার আচরণের অযৌক্তিকতা বুঝতে পারবে এবং সেই আচরণ পরিত্যাগ করবে।
তবে, কাণ্টের এই আদর্শ সমাজের ধারণা সমালোচনার মুখে পড়েছে। তার শর্তহীন বিধানের মাধ্যমে একটি আদর্শ ইউটোপিয়া বা কল্পলোকের চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন, যেখানে প্রত্যেকেই শর্তহীন বিধান দ্বারা পরিচালিত হবে। বাস্তব জগতে, ব্যক্তিরা কেন স্বার্থপর হয় এবং অন্যের অধিকার স্বীকার করতে চায় না, এই বিষয়ে কাণ্ট কোনো গভীর বিশ্লেষণ দেননি। এর ফলে, শর্তহীন বিধান অনেকের মতে একটি অবাস্তব ধারণা হয়ে দাঁড়ায়। সমাজের বাস্তব অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের বিবেচনা ছাড়া কেবলমাত্র নৈতিক আদর্শের উপর ভিত্তি করে ব্যক্তির আচরণের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় বলে অনেকে মনে করেন।