লঘুস্তরায়ণ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ক্যালিফোর্নিয়ার সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালা (লঘুস্তরায়ণ দ্বারা গঠিত), আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে দেখা যায়। এই স্থানে ভূত্বকীয় পাতের নীচে প্রাপ্ত ঘন উপকরণের একটি বড় অংশ সরানো হলে, ভূত্বক এবং অশ্মমণ্ডলের অবশিষ্ট অংশ দ্রুত উত্থিত হয়ে এই পর্বতশ্রেণীর সৃষ্টি করেছে।

ভূগতিবিদ্যায়, লঘুস্তরায়ণ হল, ভূত্বকীয় পাতে সংযুক্ত নিম্নতম অশ্মমণ্ডলের অংশ ঐ পাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ডুবে যাওয়া (ভিত্তিকরণ)।

কার্য প্রণালী[সম্পাদনা]

পৃথিবীর বহির্ত্বক অংশটি দুটি ভাগে বিভক্ত, ওপরেরটি হল অশ্মমণ্ডল স্তর এবং নিচেরটি অ্যাস্থেনোস্ফিয়ার স্তর। অশ্মমণ্ডল স্তরটি দুটি অংশ দ্বারা গঠিত, ওপরেরটি ভূত্বকীয় অশ্মমণ্ডল এবং নিচেরটি, ম্যান্টল অশ্মমণ্ডল। ভূত্বকীয় অশ্মমণ্ডল অস্থিতিশীল যান্ত্রিক ভারসাম্যতে রয়েছে কারণ অন্তর্নিহিত ম্যান্টল অশ্মমণ্ডলের ঘনত্ব নীচের অ্যাস্থেনোস্ফিয়ারের ঘনত্বের থেকে বেশি।।[১] তাপীয় প্রসারণ / সংকোচন, গঠন এবং পর্যায় পরিবর্তনের মাধ্যমে ঘনত্বের পার্থক্য ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।[২] নিচের মহাদেশীয় ভূত্বক এবং ম্যান্টল অশ্মমণ্ডলের ঋণাত্মক প্লবতা থেকে ঘটেছে লঘুস্তরায়ণ।[৩]

নিম্ন মহাদেশীয় ভূত্বক এবং ম্যান্টল অশ্মমণ্ডল যখন উপরের মহাদেশীয় ভূত্বক থেকে বিচ্ছিন্ন হয় তখন লঘুস্তরায়ণ হয়। এটি হওয়ার জন্য দুটি শর্ত পূরণ করা দরকার:

  • নিম্ন অশ্মমণ্ডলের ঘনত্ব অবশ্যই অ্যাস্থেনোস্ফিয়ারের চেয়ে বেশি হতে হবে।
  • হাল্কা কম ঘনত্বের অ্যাস্থেনোস্ফিয়ারের ভূত্বকের সাথে যোগাযোগ তৈরি হতে হবে এবং সেটি ঘন নিম্ন অশ্মমণ্ডলকে প্রতিস্থাপিত করবে।

ভূত্বকের নীচের অংশে মেফিক গ্রানুলাইট শিলা থেকে আরও ঘন একলোজাইট শিলায় রূপান্তরই নিম্ন অশ্মমণ্ডলের ঋণাত্মক প্লবতার জন্য দায়ী প্রধান প্রক্রিয়া।[৩] নিম্ন ভূত্বকে বিপরীতমুখী ঘনত্বে রূপান্তর চলতে থাকে, যার ফলে উপরি ভূত্বক ভেঙে ম্যান্টলে ঢুকে যায়। [৪] ম্যান্টলের উচ্চ তাপমাত্রায় ঘনত্ব বিপরীতমুখী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এই ঘটনা চাপ পরিবেশ, আগ্নেয়গিরি গর্তের সীমানা এবং মহাদেশীয় অঞ্চলের সম্প্রসারণ এই ঘটমান বিষয়গুলিকে সীমাবদ্ধ করে।[৪]

নিম্ন ভূত্বক কে স্পর্শ না করা অবধি অ্যাস্থেনোস্ফিয়ারের উত্থান চলতে থাকে, এর ফলে নিম্ন ভূত্বক এবং অশ্মমণ্ডলীয় ম্যান্টল ভাঙতে শুরু করে। ধ্বসে পড়া, ফাটল বা প্লুম ক্ষয়ের ফলে অন্তর্নিহিত অ্যাস্থেনোস্ফিয়ারের অনুপ্রবেশ সহজ হয়ে যায়।[১] কম ঘনত্বের উত্তপ্ত অ্যাথেনোস্ফিয়ারের উত্থান এবং উচ্চ ঘনত্বের, ঠান্ডা অশ্মমণ্ডল প্রতিস্থাপিত হবার সাথে সাথে লঘুস্তরায়ণের চালিকা স্থিতি শক্তি মুক্ত হয়। [২] নিম্ন ভূত্বক এবং অশ্মমণ্ডলীয় ম্যান্টলের পৃথকীকরণ নিয়ন্ত্রিত হয় উপরের মহাদেশীয় ভূত্বকের কার্যকর সান্দ্রতা দ্বারা। এই প্রক্রিয়াগুলি বেশি ঘটে ছেদ, অস্বাভাবিক গরম শিলার পরিচলনের ফলে ক্ষয়ীভবন, ভূত্বকীয় পাতের অভিঘাত ইত্যাদি ক্ষেত্রে; বা যেখানে পরিচলনীয় অস্থিতিশীলতার পরিবেশে ঘটে থাকে সেই সব ক্ষেত্রে।[১]

পরিচলনীয় অস্থিরতা লঘুস্তরায়ণকে সহজতর করে। পরিচলন সহজেই নিম্ন ভূত্বককে মূল অংশ থেকে পৃথক করে দিতে পারে বা অন্য ভাবে বললে, একটি রেলেহ-টেলর অস্থিরতা তৈরি হয়। স্থানীয় অঞ্চলে অসাম্যের কারণে, অশ্মমন্ডলের ভিত্তিমূল ভেঙে নিচে চলে যায়। অশ্মমন্ডলের ছেড়ে চলে যাওয়ার জায়গাটি উত্থিত অ্যাস্থেনোস্ফিয়ার পূর্ণ করে।[৫]

লঘুস্তরায়ণের অন্যান্য কারণ[সম্পাদনা]

লঘুস্তরায়ণ চলতে থাকলে, আরও অ্যাস্থেনোস্ফিয়ার উত্থিত হয় ডুবন্ত অশ্মমণ্ডলকে প্রতিস্থাপিত করার জন্য। এই প্রক্রিয়াটির ফলে তিনটি পৃথক পরিবর্তন ঘটে যা লঘুস্তরায়ণন প্রক্রিয়াতে প্রভাব ফেলতে পারে।[১]

  • ১। উত্থিত অ্যাস্থেনোস্ফিয়ারের সান্দ্রতা যদি অশ্মমণ্ডল ম্যান্টলের চেয়ে বেশি হয় তবে লঘুস্তরায়ণ বন্ধ হয়ে যায়।
  • ২। অ্যাস্থেনোস্ফিয়ারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবাহের ফলে সিল স্তরের উপরে এবং নীচে দুটি ঠান্ডা, শক্ত সীমানা স্তর তৈরি হয়। এটি নিম্নতম ভূত্বকের অংশের বেধকে হ্রাস করে।
  • ৩। অশ্মমণ্ডলের অবনমনের ফলে নিম্ন ভূত্বকের অংশের বেধের অংশ বেড়ে যায়।

অ্যাস্থেনস্ফিয়ারের জমাট বাধা বজায় থাকলে (২) প্রক্রিয়াটি স্থিতিশীল, তবে যদি অবনমন হয় এবং তার ফলে নিম্ন অশ্মমণ্ডলের বিচ্ছিন্নতা প্রাধান্য পায় (৩) প্রক্রিয়াটি অস্থিতিশীল। প্রক্রিয়া (২) এবং (৩) একে অপরের বিপরীতমুখী।[১]

ভূতাত্ত্বিক প্রভাব[সম্পাদনা]

অশ্মমণ্ডলের লঘুস্তরায়ণের দুটি বড় ভূতাত্ত্বিক প্রভাব রয়েছে। প্রথমত, যেহেতু ঘন উপাদানের একটি বড় অংশ সরে যায়, ভূত্বক এবং অশ্মমণ্ডলের অবশিষ্ট অংশের দ্রুত উত্থান হয় এবং এর ফলে পর্বতমালা গঠিত হয়। দ্বিতীয়ত, উত্তপ্ত ম্যান্টল পদার্থের প্রবাহ পাতলা অশ্মমণ্ডলের ভূমিতলে চলে আসে এবং প্রায়ই দেখা যায় গলে গিয়ে নতুন পর্যায়ে অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়। অতীতে কিছু আগ্নেয়গিরির অঞ্চলে, অগ্ন্যুৎপাতের জন্য অস্বাভাবিক গরম শিলার পরিচলনকে দায়ী করা হত, সেগুলি হতে পারে লঘুস্তরায়ণের জন্য ঘটেছিল। [৬]

ভূত্বক পাত প্রক্রিয়া সম্পর্কিত[সম্পাদনা]

অভিসৃতি অঞ্চলগুলিতে (যেখানে দুটি বিরাজমান প্রবাহ মিলিত হয়), বিশেষত যেখানে মহাদেশীয়-মহাদেশীয় সংঘর্ষ হয়, সেখানে লঘুস্তরায়ণ দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, লঘুস্তরায়ণ তিব্বতীয় মালভূমিতে দেখা যায়, যেটি এশিয়ার ভূত্বক পাতের সাথে ভারতের ভূত্বকের পাতের সংঘর্ষ থেকে তৈরি হয়েছে। যে পর্যবেক্ষণগুলি থেকে লঘুস্তরায়ণ হয়েছিল বোঝা যায়, তার মধ্যে আছে হঠাৎ ম্যাফিক অগ্ন্যুৎপাত এবং ত্বরিত গতিতে ভূত্বকের উত্থান।[৩]

সম্প্রসারণের ক্ষেত্রগুলিও লঘুস্তরায়ণের সাথে জড়িত। নিম্ন অশ্মমণ্ডলে নেতিবাচক প্লবতার ফলে সংঘর্ষের পরিবেশ এবং প্রসারণ দুটিই হয়। একটি পার্বত্য বলয়ের ধ্বসের সময়, নিচের পুরু মূল ভূত্বকও অদৃশ্য হয়ে যায়। এই অন্তর্ধানের পিছনের প্রক্রিয়াগুলি পরিষ্কার নয়। উচ্চ তাপের স্পন্দনের ফলে উৎপন্ন গ্রানাইটীয় প্লুটন এই অদৃশ্য হওয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। লঘুস্তরায়ণ হল তাপ স্পন্দনের সম্ভাব্য উৎস।[৩]

ধসে পড়া পর্বত বলয়ের ভূত্বক পাতের বিকাশ তীব্রভাবে বিতর্কিত। কেউ কেউ বলেন যে লঘুস্তরায়ণের ফলে ভূত্বক পুরু হওয়া, উত্তাপকরণ এবং অগ্ন্যুৎপাতের পাশাপাশি একটি দ্বিতীয় উত্থান ঘটে। আবার কেউ কেউ যুক্তি দেন যে, লঘুস্তরায়ণ ভূত্বকের পতন এবং পাতলা হওয়ার কারণ। কিছু গবেষক বলেছেন যে পশ্চিম আমেরিকার সিয়েরা নেভাদা (ক্যালিফোর্নিয়া), অববাহিকা এবং রেঞ্জ প্রদেশ এবং কলোরাডো মালভূমি এর উদাহরণ।[৩]

ভূতাত্ত্বিক উদাহরণ[সম্পাদনা]

অশ্মমণ্ডলের লঘুস্তরায়ণের প্রভাবগুলির একটি উদাহরণ সিয়েরা নেভাদা (মার্কিন), অববাহিকা এবং রেঞ্জ প্রদেশ ও পশ্চিম আমেরিকার কলোরাডো মালভূমিতে দেখা যায়।[৩] ১ কোটি বছর পূর্বে অববাহিকা এবং রেঞ্জ প্রদেশে ভূত্বক সম্প্রসারণের সময়, অ্যাস্থেনোস্ফিয়ারের উত্থানে অশ্মমণ্ডল স্তরটি পাতলা হয়ে যায়। উষ্ণতর অ্যাস্থেনোস্ফিয়ারের উত্থানের ফলে যে উত্তাপ তৈরি হয় তাতে ভূত্বকে নিম্ন-সান্দ্রতা অঞ্চল তৈরি হয় এবং অববাহিকা এবং রেঞ্জের পার্শ্বদেশ লঘুস্তরায়ণ ঘটে। উচ্চ ঘনত্বসম্পন্ন নিম্ন অশ্মমণ্ডলের ধ্বংসের ফলে ক্যালিফোর্নিয়ায় সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালা এবং কলোরাডো মালভূমির পার্শ্বদেশ উত্থান ঘটেছে। এই অঞ্চলের ভূত্বকের মধ্যে পাওয়া ইকলোজিট জেনোলিথ শিলা, নিম্ন ভূত্বকের ঘনত্বের বিপরীতক্রমের সাথে যুক্ত রূপান্তরিত পর্যায়ের পরিবর্তনকে সমর্থন করে।[৩] সম্ভবত সিয়েরা নেভাদা (মার্কিন) পৃথিবীর একমাত্র জায়গা যেখানে বর্তমানে ভূত্বকের থেকে ঘন উপাদান অপসারিত হচ্ছে।[৪]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Bird, P. (1979). Continental delamination and the Colorado Plateau. Journal of Geophysical Research: Solid Earth (1978–2012), 84(B13), 7561-7571.
  2. Kay, R. W., & Mahlburg Kay, S. (1993). Delamination and delamination
  3. Meissner, R., & Mooney, W. (1998). Weakness of the lower continental crust: a condition for delamination, uplift, and escape. Tectonophysics, 296(1), 47-60.
  4. Rollinson, H. R. (2009). Early Earth systems: a geochemical approach. John Wiley & Sons.
  5. Nielsen, S. B., Paulsen, G. E., Hansen, D. L., Gemmer, L., Clausen, O. R., Jacobsen, B. H., ... & Gallagher, K. (2002). Paleocene initiation of Cenozoic uplift in Norway. Geological Society, London, Special Publications, 196(1), 45-65.
  6. Foulger, G. R. (2011). Plates vs plumes: A geological controversy. John Wiley & Sons.