মেদিনীপুর জেলা বিভাজন
মেদিনীপুর জেলা বিভাজন ছিল পশ্চিমবঙ্গের পূর্বতন জেলা মেদিনীপুরের বিভাজন। ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি উক্ত জেলাটিকে পূর্ব মেদিনীপুর ও পশ্চিম মেদিনীপুর নামে দু’টি জেলায় বিভক্ত করা হয়। বিভাজনের আগে অবিভক্ত জেলাটির লোকসংখ্যা ছিল ৯৭ লক্ষ। আয়তন বিচারে জেলাটি ছিল ভারতের বৃহত্তম জেলা। সুইডেন সহ একাধিক দেশের লোকসংখ্যা অবিভক্ত মেদিনীপুর অপেক্ষা কম ছিল।[১] বিভাজনের পর অবিভক্ত জেলার মেদিনীপুর সদর, খড়গপুর, ঝাড়গ্রাম ও ঘাটাল মহকুমাগুলিকে নিয়ে গঠিত হয় ‘পশ্চিম মেদিনীপুর’ জেলা। অবিভক্ত মেদিনীপুরের সদর মেদিনীপুর এই জেলার সদরে পরিণত হয়।[১] অন্যদিকে তমলুক, কাঁথি ও হলদিয়া মহকুমাগুলি নিয়ে গঠিত হয় ‘পূর্ব মেদিনীপুর’ জেলা। এই জেলার সদর শহরের মর্যাদা লাভ করে তমলুক।[২] সেই সঙ্গে কাঁথি মহকুমাটিকে ভেঙে এগরা মহকুমা গঠন করা হয়।[১]
বিভাজনের পূর্বপ্রচেষ্টা
[সম্পাদনা]১৯১৫ সালে ব্রিটিশ রাজত্বে প্রথম বার মেদিনীপুর জেলাকে দ্বিখণ্ডিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল।[৩] সেই সময় এই জেলা ছিল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বা ‘কালেকটর’ শাসিত জেলা। বিভাজনের উদ্দেশ্য ছিল এই বিরাট জেলার প্রশাসনকে সহজতর করা। বাংলা সরকার ১৯০৭ সালে জেলাভাগের একটি কথা তুলেছিল, কিন্তু সেই সময় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করায় এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত করা হয়নি।[৩] মেদিনীপুর সেই সময় ছিল বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র। তাই ব্রিটিশ সরকার মনে করেছিল, জেলাটিকে ভাগ করে দিলে এখানকার প্রশাসনকে আরও শক্তিশালী করে তোলা যাবে। এজন্য মেদিনীপুর ভেঙে নতুন ‘হিজলি জেলা’ গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়।[৩] ১৯১৫ সালের ২৬ জানুয়ারি জেলা বিভাজনের ঘোষণা করা হলে, স্থানীয় জমিদারেরা জেলাভাগের বিরোধিতা শুরু করেন। তাঁদের ভয় ছিল, তাঁদের জমিদারি দুই জেলার মধ্যেই প্রসারিত হলে তাঁদের দু’বার করে রাজস্ব দিতে হবে। অন্যদিকে আইনজীবীদের ভয় ছিল, হিজলিতে নতুন জেলা আদালত স্থাপিত হলে তাঁদের ব্যবসা মার খাবে।[৩] মেদিনীপুর বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি উপেন্দ্রনাথ মাইতি জেলাভাগ সম্পর্কে মন্তব্য করেন, এই প্রস্তাব অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অবাস্তব; বরং জেলার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থাগ্রহণ জেলা প্রশাসনের আশু কর্তব্য বলে তিনি মতপ্রকাশ করেছিলেন।[৩] বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদী ব্যারিস্টার ও রাজনীতিবিদ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল প্রথম দিকে জেলাভাগ সমর্থন করেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, তাঁর নিজের শহর কাঁথিকে জেলার সদর করা হবে। কিন্তু হিজলিকে জেলাসদর ঘোষণা করা হলে তিনি জেলাভাগের বিরোধিতা করেন।[৩] ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একাধিক সদস্য মেদিনীপুর জেলাভাগের বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁদের মনে হয়েছিল, শাসকশ্রেণী অবিভক্ত জেলার রাজনৈতিক ঐক্য নষ্ট করতে চাইছেন। ১৯২১ সাল পর্যন্ত তাঁরা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা চালিয়ে যান। শেষে শেষোক্ত বছরে আর্থিক কারণে জেলাভাগের পরিকল্পনাটি বাতিল হয়ে যায়।[৩]
২০০২ সালের বিভাজন
[সম্পাদনা]স্বাধীন ভারতে একাধিকবার সরকার মেদিনীপুর জেলাকে দ্বিখণ্ডিত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। অবশেষে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য জেলাভাগের রূপরেখা চূড়ান্ত করে বিভাজনের তারিখটি নির্দিষ্ট করে দেন।[৪] জেলাভাগের প্রতিক্রিয়া এক এক শহরে এক এক রকম হয়েছিল। মেদিনীপুর শহরের অধিবাসীরা এই সিদ্ধান্তে হতাশ হয়েছিলেন। তাঁরা শহরের গুরুত্বহানির আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। অন্যদিকে নতুন জেলার সদর তমলুকে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে কুচকাওয়াজ ও উৎসব শুরু হয়ে যায়।[১][২][৪][৫] প্রধান বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেস এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের একাংশ এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিল।[৫] তাঁরা মনে করেছিলেন, জেলা বিভক্ত হলে প্রশাসনিক সুযোগসুবিধাগুলি আরও সহজে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারবে এবং চিকিৎসা ও শিক্ষাপরিষেবার মান উন্নত হবে।[৫] বিরোধীদের বক্তব্য ছিল পশ্চিম মেদিনীপুরের সম্পদগত সীমাবদ্ধতার জন্য সেখানে নকশাল তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে পারে।[১][৫] জেলা বিভক্ত হওয়ার অব্যবহিত পরেই তমলুকে নতুন প্রশাসনিক ভবনগুলি গড়ে ওঠে[১] এবং একজন নতুন জেলাশাসক ও পুলিশ সুপার নিযুক্ত হন।[৪]
পাদটীকা
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ Staff reporter (২০০২-০১-০১)। "Abasheshe Medinipur bhenge noya jela aaj (in Bengali)"। ২০০৭-১০-০৮ তারিখে মূল (HTML) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-১০-১৩।
- ↑ ক খ Acharya, Prasun (২০০২-০১-০২)। "Medinipur bhenge Buddher ashash hotabe jonojuddhoke (in Bengali)"। ২০০৭-১০-০৮ তারিখে মূল (HTML) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-১০-১৩।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ Chakrabarty, Bidyut (১৯৯৭)। Local Politics and Indian Nationalism: Midnapur (1919-1944)। New Delhi: Manohar। পৃষ্ঠা 72–76।
- ↑ ক খ গ Jana, Naresh (২০০১-১২-৩১)। "Tamluk readies for giant's partition"। ২০১২-০৫-০১ তারিখে মূল (HTML) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-১০-১৩।
- ↑ ক খ গ ঘ Telegraph editorial (২০০২-০১-০৩)। "Divide and rule"। ২০০৮-১১-১২ তারিখে মূল (HTML) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-১০-১৩।
টেমপ্লেট:Paschim Medinipur topics টেমপ্লেট:Purba Medinipur topics