মির্জা সাহিবা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

মির্জা সাহিবা (পাঞ্জাবী: ਮਿਰਜ਼ਾ ਸਾਹਿਬਾਂ, مرزا صاحباں, 'mirzā sāhibāṁ') হচ্ছে পাঞ্জাবের পাঁচটি জনপ্রিয় বিয়োগান্ত উপন্যাসের মধ্যে একটি। বাকি চারটি হল হীর রাঞ্জা, সোনি মহিওয়াল, শাসি পুন্নুহলায়লী-মজনু। এছাড়া পাঞ্জাবে আরও পাঁচটি জনপ্রিয় লোককাহিনী রয়েছে, সেগুলো হল মোমাল রানো, উমর মারভী, লীলা চনেসার, নূরী জাম তামাচি, ধজ, এবং রোর কুমার। উল্লেখিত পাঁচটি উপন্যাস এবং সোরথ রাই দিয়াচ মূলত সিন্ধের, এবং সোহনি মহিওয়াল এবং সাসি পুন্নুহকে সাধারণত শাহ আবদুল লতিফ ভিত্তাইয়ের সাত রানী (সিন্ধি: ست صورميون) নামে পরিচিত।[১][২]

সারসংক্ষেপ[সম্পাদনা]

অনেক দিন আগে সিয়াল উপজাতির নিয়ন্ত্রণাধীন শহর খেয়া গ্রামে এক মহিলা একটি সন্তানের জন্ম দেয়। দুর্ভাগ্যক্রমে, মহিলাটি বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পর পরই মারা যান এবং শিশুটি মায়ের দুধ থেকে বঞ্চিত হয়। একই সময় আরেক মহিলা একটি কন্যা সন্তান জন্ম দেন। এই মহিলাটি ছোট ছেলে শিশুটির ভরন পোষণের দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নেন। তিনি নিজের মেয়েকে যেমন খাওয়াতেন তেমনি এই ছেলেকেও খাওয়াতেন। এভাবে এই দুই ছেলে ও মেয়ে পরস্পরের "দুধ ভাইবোন" হয়ে ওঠে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর ফাতেহ বিবি নামে মেয়েটি বিয়ে করে ফয়সালাবাদের নিকটবর্তী দানা আবাদ নামক গ্রামে যাত্রা করে। ফতেহ বিবি খারালদের সর্দার ওয়াঞ্জাল নামক এক ব্যক্তির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তাদের ঘরে মির্জা নামে একটি পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। এদিকে, ফতেহ বিবির দুধ ভাই, খেয়া খান শিয়াল জাটের সরদার বনে যায় এবং তার ঘরেও সাহিবা নামে এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। যখন বাচ্চাদের পাঠশালায় গমনের বয়স এসে পড়ে তখন মির্জার বাবা-মা সিদ্ধান্ত নেয় তাদের সন্তানকে "দুধ মামার" বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন যাতে সে সেখানে লেখাপড়া করতে পারে। সাহিবার বাবা তাকে এবং তার ফুফাত ভাই মির্জাকে একই সাথে কুরআন শিখতে পাঠিয়ে দেন। মির্জা প্রথমে খেয়াল করেননি যে তার “মামাতো বোন” সাহিবা যে এতটা সুন্দরী রমণী। তিনি খিওয়াতে পড়াশুনা করতে এসে প্রথমে তাকে লক্ষ্য করেননি কারণ তারা তখন বাচ্চা ছিল। দুটি শিশুর একসাথে বেড়ে উঠার সাথে সাথে দুজনের মধ্যে প্রেমের অনুভূতিগুলি প্রকাশ হতে শুরু করে। একদিন সাহসী যুবক মির্জা স্কুল থেকে ফিরে হাঁটতে হাঁটতে আলাদা পথ ধরল। সেই রাস্তায় একটা বাজার ছিল। বাজার থেকে সাহেবাকে তার পরিবারের জন্য কিছু সবজি কিনে দিল। রান্নার জন্য সবজি বাছাই করল তারা। বণিক যখন সবজি ওজন করতে শুরু করে, তখন সে তার ওজন বাড়িয়ে দেয়, কারণ তখন সে সাহিবার সৌন্দর্যে বিভর হয়ে যায়। মির্জাও তখন তার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে পড়ে এবং তার মনের ভিতর সাহিবার জন্য ভালবাসার অনুভূতি তীব্র হয়ে ওঠে। বড় হওয়ার সাথে সাথে মির্জা ঘোড়সওয়ার এবং তীরন্দাজ হিসাবে দক্ষ হয়ে উঠে। মির্জা এতটা দক্ষ ছিল যে তার ছোড়া প্রতিটি তীর যে লক্ষ্য ভেদের জন্য ছোড়া হত সেই লক্ষেই লাগত। অন্য দিকে সাহিবা দিনকে দিন আরও অপরূপ সুন্দরী হয়ে উঠতে থাকে। শীঘ্রই তাদের ভালোবাসা গভীর হতে শুরু করে। মির্জা তার সাহিবাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারত না। নিজেদের গড়া স্বপ্নের জগতে বিভর থাকে দুই যুগল।

একদা সাহিবা ভুল ভাবে পড়ার কারণে মৌলোভী তাকে চিম্মাক দিয়ে প্রহার করেন। চিম্মাকের আঘাত ছিল অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। দুঃখের বিষয়, মির্জা আর সাহিবার আনন্দময় ভালবাসার দিনগুলি স্থায়ী হয়নি। সাহিবার বাবা-মা তাদের প্রেমের বিষয়টি জানতে পেরে মির্জাকে তার বাবা-মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেন। কিছুদিনের মধ্যেই সাহিবার বাবা মা তাহির খান নামে এক ব্যক্তির সাথে সাহিবার বিয়ের ব্যবস্থা করেন। তিনিও একই শহরের অধিবাসী। মির্জা ফিরে যাওয়াতে সাহিবার পিতামাতা খুব সহজেই বিয়ের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেন। সাহিবা তার বন্ধু, কারমু নামে একজন ব্রাহ্মণের মাধ্যমে তার দুর্ভাগ্যজনক বিবাহের কথাটি তাঁর প্রিয়তম মির্জার কাছে প্রেরণ করে। এই কথা শোনামাত্র মির্জা ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। তার পরিবার তাকে থামানোর চেষ্টা করে কিন্তু সে তাদের কোন কথায় কানে তোলেনি। তাকে যে যেতেই হবে। মির্জা চলে যাওয়ার আগে তাঁর বাবা আর কোন উপায় নেই দেখে মির্যা'র কাছে গিয়ে তাকে বলে যে যাচ্ছ যখন সাহিবাকে সাথে নিয়েই ফিরবে, নইলে ব্যাপারটি অপমানজনক হবে। এই কথার মাধ্যমে মির্জার বাবা ছেলেকে তার ভালবাসা ফিরে পাবার জন্য উৎসাহিত করেন। "চল, আমার বাকী," বলে মির্জা তার ধনুক এবং তীর সজ্জিত হয়ে ঘোড়াটিকে খেয়া গ্রাম পানে ছুটিয়ে নিয়ে যান।

বিয়ের অনুষ্ঠান শুরুর কিছুক্ষণ আগেই মির্জা পৌঁছে যায়। চুপি চুপি সাহিবার ঘরে ঢুকে পড়ে। বিয়ের সাজে সাহিবাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে প্রশংসা করে মির্জা। আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে সে তার হাতটি ধরে তাকে ঘোড়ার পিঠে নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে না পৌছা পর্যন্ত ছুটতে থাকে।

একসময় ক্লান্ত হয়ে তারা গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, এসময় তার প্রিয়তমা সাহিবা মির্জাকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। এদিকে বিয়ের আসরে আসার জন্য সাহিবার ভাইয়েরা তাকে দরজার বাইরে থেকে ডাকতে থাকে। কিন্তু কোন সাড়া না পেয়ে তার বুঝতে পারে যে কোন বিপত্তি আছে। সাহিবাকে ঘরে না দেখতে পেয়ে তারা বুঝে যায় আসল ঘটনা। হবু বর সহ সাহিবার ভাইয়েরা তাকে ও মির্জাকে খুজতে বের হয়। সাহিবা যখন তার ঘুমন্ত প্রিয়তমকে দেখছিল তখন তার মধ্যে এই ভয়ুও কাজ করছিল যে শিগগিরই তারা তার ভাইদের হাতে ধরা পড়বে। সে কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। যদি তার ভাইয়েরা আসে এবং মির্জার ঘুম ভাঙ্গে তবে নিশ্চিত ভাবে মির্জার ছোড়া অবার্থ তীরের আঘাতে তারা মৃত্যু বরণ করবে। ভাইদের প্রতি করুনার কারণে সে মির্জার প্রতিটি তীরের অর্ধেক ভেঙ্গে ফেলে এই ভেবে যে এতে হয়ত তার ভাইয়েরা প্রানে বেঁচে যেতে পারে। কিছুক্ষণের মধ্যে সাহিবার ভাইয়েরা তাদেরকে গাছের নিচে খুজে পায়। সাহিবার এক ভাই মির্জাকে লক্ষ্য করে ধনুক ছুঁড়ে মারে। ধনুকটি মির্জার গলা ভেদ করে যায়। মির্জা তার ধনুকের জন্য হাত বাড়িয়ে দেখে যে তার ধনুকের তীর গুলো সবই অর্ধেক ভাঙ্গা। সে সাহিবার দিকে তাকিয়ে উত্তর খোঁজার আগেই আরেকটি তীর এসে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। সাহিবা তার দেহের উপরে ঝুকে পড়ে এবং একই সাথে যুগলের করুন মৃত্যু ঘটে।[৩]

জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে[সম্পাদনা]

মির্জা সাহিবার কাহিনী পাঞ্জাবি সংস্কৃতিতে অত্যন্ত জনপ্রিয়। কিংবদন্তি আলম লোহারের গাওয়া "মির্জা" শিরোনামের জনপ্রিয় গানটির একাধিক সংস্করণ প্রচলিত আছে। এই গল্পটি গানের রুপে আনার প্রথম প্রচেষ্টা করেন এবং ১৯৪১ সালে আলগোজা (ঝোরি) এবং চিমতার সাথে চরম গায়কি শক্তির সাথে গানটি পরিবেশনার একটি স্বতন্ত্র উপায় বের করেন।

বিভিন্ন লোকজ চলচিত্রে এই কাহিনি উঠে এসেছে। যেমন-

  • মির্জা জাট (১৯৮২) শহীদ হামেদ অভিনীত একটি পাকিস্তানি পাঞ্জাবি চলচ্চিত্র।[৪]
  • হিরো হিটলার ইন লাভ (২০১১), বাবু মান ও মৌনী রায় অভিনীত একটি ভারতীয় পাঞ্জাবি চলচ্চিত্র।
  • মির্জা - দ্য আনটোল্ড স্টোরি (২০১২), একটি ভারতীয় পাঞ্জাবি চলচ্চিত্র, মির্জা এবং সাহেবান গল্পের একটি আধুনিক উপস্থাপনা, যার শিরোনাম গানটি (প্রয়াত) আলম লোহারের পুত্র আরিফ লোহার গেয়েছেন।
  • মির্জা (২০১৬) রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা পরিচালিত একটি ভারতীয় হিন্দি চলচ্চিত্র যেখানে মূল কাহিনীটি নিবিড়ভাবে অনুসরণ করে তৈরি করা হয়েছে। হর্ষবর্ধন কাপুর মির্জার চরিত্রে এবং সায়ামি খের সাহিবা চরিত্রে অভিনয় করেছেন।[৫]
  • মির্জা জুলিয়েট (২০১৭), একটি ভারতীয় হিন্দি চলচ্চিত্র, মূল গল্পটির একটি আধুনিক পুনর্বিবেচনা।

মির্জা জাট (১৯৯২), গুগু গিল অভিনীত পাঞ্জাবি চলচ্চিত্র।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Love Legends In History of Punjab"punjabiworld.com। ২০১৯-০৩-২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০২-২৭ 
  2. "Lila Chanesar: Sindhi Literature: Shah Jo Risalo: Shah Latif: Historic Romance: Sindhi Love Story"web.archive.org। ২০১১-০৭-২১। Archived from the original on ২০১১-০৭-২১। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০২-২৭ 
  3. "کٿوريءَ کيپَ کيتر ۾ (مزمل سائر) | سنڌ سلامت ڪتاب گهر"books.sindhsalamat.com (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২০-০৫-১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-২৭ 
  4. "Mirza Jat (1982) - IMDb" 
  5. "WATCH: Harshvardhan Kapoor's 'Mirziya' logo trailer unveiled! - Times of India"The Times of India (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-২৭