মোমাল রানো

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

মোমাল রানো অথবা মুমাল রানো (সিন্ধি: لمومل راڻو) সিন্ধি লোককাহিনী এবং রাজস্থানি লোককাহিনীতে বর্ণীত মোমাল এবং রানো চরিত্র কেন্দ্রিক প্রণয়ধর্মী উপাখ্যান। এটি একটি বহুমুখী গল্প যাতে রোমাঞ্চ, যাদু, স্কিমস, সৌন্দর্য, প্রেম, বিচ্ছেদের অগ্নিপরীক্ষা এবং সর্বোপরি প্রণয়ধর্মী ট্র্যাজেডির সমন্বয় ঘটেছে। গল্পটি শাহ আব্দুল লতিফ ভিট্টাই রচিত গাঞ্জ বা শাহ জো রোসালো নামক কবিতা সমগ্রে উল্লেখিত রয়েছে। উক্ত কবিতা সমগ্রে ওমর মারুই, সোহনি মেহর, সাসুই পুনহুন, নূরী জাম তামাচি, সোরথ রায় দিয়াচলিলান চানেসার গল্পগুলোও উপস্থিত। এই সাতটি গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেন নারী; তাই মোমাল সহ সকলেই সিন্ধি সাহিত্যে সাংস্কৃতিক আইকন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত এবং একত্রে শাহ আবদুল লতিফ ভট্টাইয়ের সাত নায়িকা (ست سوروميون) নামে পরিচিত। পূর্বে শাহ আবদুল লতিফ ভিট্টাই ছাড়া শাহ ইনাত রিজভীর মতো আরও বেশ কয়েকজন কবি এই গল্পটি নিয়ে লিখেছেন এবং কবি লতিফের মৃত্যুর পরে কবি তাজাল বেওয়াস এবং শায়খ আয়াজের (কয়েকটি উদ্ধৃতি হিসাবে) ও একই কাহিনী নিয়ে কাজ করছেন; তারা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গল্পের কাহিনী প্রসারিত করেছিলেন। গল্পটি শাহ জো রিসালোতেও উল্লেখ করা হয়েছে এবং পাকিস্তানের সিন্ধুর সাতটি জনপ্রিয় বিয়োগান্ত উপন্যাসের একটি। বাকি ছয়টি হল উমার মারভি, সোহনি মহিওয়াল, শাসি পুন্নুহ, নূরী জাম তামাচি, সরাথ রাই দিয়াচ এবং লিলান চানেসার[১][২]

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট[সম্পাদনা]

গল্পটি রাজস্থান, ভারতের পাশাপাশি সিন্ধু, পাকিস্তান এর ভৌগোলিক বেল্টে ঘটেছে বলে মনে করা হয়। গল্পের প্রসঙ্গে রাজস্থানের ভৌগোলিক জুড়ে থাকা যে অঞ্চলটির কথা উল্লেখিত আছে তা মুলত হ'ল জয়সালমির জেলার লোদ্রাবা বা লোধ্রুভা; অপর দিকে সিন্ধু অঞ্চলের অংশটি ঘোটকি জেলায় মোমাল জি মারি (মোমলের ম্যানশন) এবং তার বাবার বাড়ি হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। এই গল্পটি সম্ভবত চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, উমরকোটের (বর্তমানে পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশের দক্ষিণ-পূর্বের একটি জেলা) রাজা হামির সোমো এর সময়ে ঘটেছিল।

গল্প[সম্পাদনা]

অমরকোটের রাজা হামির সোমোরো তাঁর মন্ত্রী পরিষদের সদস্য রানো মহেন্দ্রা, সিনহরো ধামচান্নি এবং দৌনরো ভটায়নি সহ অমরকোটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিকার করতে যেতেন এবং মাঝে মাঝে দু:সাহসিকভাবে তাদের ছোট্ট দেশের সীমানাও অতিক্রম করে ফেলতেন। একবার শিকারের সময়, এই চারজন এমন একজন ব্যক্তির মুখোমুখি হয়েছিল যিনি দুর্ঘটনাক্রমে তাদের সামনে এসে পড়েছিলেন। লোকটির কাছে তাদের পরিচয় এবং উদ্দেশ্য গোপন করে রাখা হয়। কিন্তু লোকটি তার সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা তাঁদেরকে খুলে বলে। তিনি কাশ্মীররের নিকটবর্তী অঞ্চলের রাজপুত্র ছিলেন, যিনি মোমালের সৌন্দর্য এবং মনোহর কিংবদন্তি শুনেছিলেন এবং এতটাই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন যে তাকে পাওয়ার চেষ্টায় নিয়োজিত হন, কিন্তু যখন তিনি মোমালের অঞ্চলে পৌঁছেছিলেন তখন তিনি কেবল তার মোহময় সৌন্দর্যের কাছেই পরাজিত হননি বরং তার মহিলা চাকরেরা / বোনদের দ্বারা চালিত কৌশলগুলি তার সম্পদ এবং জিনিসপত্র রাজপুত্রকেই ছিনতাই করে নেয় এবং একাধিক ধাঁধাতে তাকে এতটাই বিভ্রান্ত করে ফেলে যে তিনি নিজের জীবন বাঁচাতে পালিয়ে বেড়ান। এই রাজপুত্রের কাহিনীটি সেই চার সঙ্গীর আগ্রহ জন্মাবার জন্য যথেষ্ট ছিল। তারা মোমলের অবস্থান সম্পর্কে রাজপুত্রের কাছ থেকে তথ্য আহরণ করে এবং আরেকটি অ্যাডভেঞ্চার করার সিদ্ধান্ত নেয়। মোমলের অবস্থান ছিল উমরকোটের উত্তর-পূর্বে লোধ্রুবার কাছে। তিনি তার সাত (কিছু ঐতিহাসিক বলেছেন নয়) বোনদের সাথে কাক মহল নামে পরিচিত একটি প্রাসাদে (কাকের প্রাসাদ)থাকতেন, যার মধ্যে সুমাল ও নাতির নামে সর্বাধিক বিখ্যাত (কেউ কেউ তাকে বোনের চেয়ে মোমলের দাস হিসাবে বিবেচনা করেছেন। এটি নানা রকম গোলকধাঁধার এবং বিভ্রম সৃষ্টিকারী একটি যাদুকরী প্রাসাদ ছিল। কিংবদন্তি ছিল যে, যে কেউ মোমলকে পাবার জন্য সকল বাধা অতিক্রম করবে এবং অক্ষত অবস্থায় প্রাসাদে পৌঁছাতে মোমল তাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবে। ইতিহাস অনুসারে, মোমল এবং তার বোন / চাকরদের কাছে আসা প্রায় প্রত্যেকের তাদের জীবন সহ সমস্ত কিছুই ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল, কাশ্মীরের রাজপুত্রের মতো কয়েকজনকে বাদ দিয়ে যে তাঁর ধ্বংসের গল্প বর্ণনা করছিল। মোমল ছিল অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারিণী, সোমাল তার বুদ্ধিমত্তার জন্য বিখ্যাত ছিল, অন্যদিকে নাতির তার ধূর্ততার জন্য পরিচিত ছিল। তাঁদের এই গুণ দ্বারা শিকারকে মোহিত এবং কব্জা করার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালাত। চ্যালেঞ্জকারীদের জন্য তাদের ডিজাইন করা ধাঁধাগুলির সমাধান কোন সহজ কাজ ছিল না। রানো মহেন্দ্রাই একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন যিনি সফলভাবে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় প্রাসাদে পৌঁছান। মোমাল মুগ্ধ হয়ে তার স্ত্রী হিসাবে নিজেকে সপে দেয়। অতপর রাজা হামির ও অন্যান্য দুই মন্ত্রীর সাথে রানো মহেন্দ্রা কাকের প্রাসাদ ছেড়ে উমরকোটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। রানো এবং মোমাল দীর্ঘদিন একে অপরের সাথে দেখা করতে থাকে এবং তাদের প্রেমের কাহিনী উভয় পক্ষের অনুভূতির গভীরতা অর্জন করে। যাইহোক, রাজা হামির রানো সম্পর্কে ঈর্ষা অনুভব করতেন, কারণ তিনি জানতেন রানো বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী মহিলাকে নিজের করে নিতে পেরেছে। তিনি রানোর মোমালের সাথে দেখা করার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। রানো তার মন্ত্রী হওয়ার কারণে তার রাজ বন্ধুর নির্দেশ মেনে চলতে বাধ্য হয়। কিন্তু মোমলের প্রতি তার আবেগ তাকে তার থেকে দূরে থাকতে দেয়নি। সে কাজের পরে সন্ধ্যায় উটের পিঠে চড়ে লুধ্রুবার উদ্দেশ্যে রওনা হত এবং পরদিন সকালে উমরকোটে ফিরে আসত। দীর্ঘ দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও প্রায়শ এভাবে তার প্রেয়সীর সাক্ষাত লাভে বেরিয়ে পরতে থাকে। যেকোন ভাবে সে একদিন ধরা পড়ল এবং রাজা তাকে কারাবন্দীর আদেশ দিলেন। কিন্তু পুরানো বন্ধুত্বের কারণে রাজা মোমালের সাথে আর দেখা না করার শর্তে তাকে মুক্তি দেয়। কিন্তু শর্ত ভঙ্গ করে সে একই কাজ করতে থাকে। একবার রানো কাকের কাছে পৌঁছাতে পারল না, তাই মোমাল, তার প্রিয়জনের জন্য আবেগ এবং চরম অপেক্ষার কারণে, তার বোন সোমালকে রানোর পোশাকটি পরতে বলে যেভাবে রানো পরতেন এবং তার পাশে শুতে বলে। সে মুহুর্তে রানো প্রাসাদে উপস্থিত হয় এবং সোমালকে মোমালের প্রেমিক ভেবে ঘৃণার সাথে প্রাসাদ থেকে বের হয়ে যায় যাওয়ার সময় ভুলে নিজের ছড়িটি ফেলে যায়। মোমল ঘুম থেকে উঠে রানোর ছড়ি দেখতে পেল এবং বুঝতে পারল যে রানো তার ঘরে এসেছিল এবং তাকে সোমালের সাথে দেখেছিল, সোমালকে তার প্রেমিক ভেবে সে সম্ভবত চিরতরে চলে গেছে। সে অত্যন্ত ভেঙ্গে পড়ে। মোমল তার রানোর প্রত্যাবর্তনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। অবশেষে, তার ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেলে সে উমরকোটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। উমরকোটে পৌঁছে পুরুষের ছদ্মবেশে ধারণ করে রানোর সন্ধান করতে থাকে। অল্প সময়ের মধ্যে, রানো মোমলের সাক্ষাত ঘটে, ছদ্মবেশের আড়ালেও মোমলকে চিনতে পারে রানো। তাই সে তার থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা করে। মোমল তার ভুল ভাঙ্গার জন্য বারবার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু রানো তাকে ক্ষমা করে না। অত্যন্ত হতাশ হয়ে মোমাল রাগে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রানো যখন এটি জানতে পারে, তখন সে ও একই আগুনে ঝাপ দেয়, আগুনের শিখা প্রেমিকযুগলকে চিরতরে গ্রাস করে ফেলে।

ঐতিহাসিক সত্যতা[সম্পাদনা]

মোমাল-রানোর গল্পটি সত্য ঘটনা ও কথাসাহিত্য উভয়ের সংমিশ্রণ। কাহিনীর সাথে সম্পর্কিত জায়গাগুলির নামগুলি আসল এবং সিন্ধুরাজস্থান উভয়ই প্রদেশের সীমানার মধ্যে অবস্থিত। তবে, যাদুকরী ঘটনা-প্রবাহ, কাক প্রাসাদ, কীভাবে রানো প্রায় প্রতিদিনই উমরকোট থেকে লোধ্রুভাতে এত দ্রুত ভ্রমণ করতে পেরেছিল এসব ঘটনা এটিকে কিংবদন্তি করে তুলেছে।[১] মোমাল রানোর গল্পটিকেও ওর্ফেউসর কিংবদন্তির সাথে তুলনা করা হয়েছে।[৩] গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীটিতে সাইরেনস নামক সুন্দর তবে বিপজ্জনক প্রাণী, নাবিকদের তাদের মন্ত্রমুগ্ধ কণ্ঠ / সংগীত দ্বারা আকৃষ্ট করত এবং তাদের জাহাজগুলিকে তাদের দ্বীপের অ্যান্থোমায়সার পাথুরে উপকূলে ধ্বংসস্তূপের দিকে নিয়ে যেত, এরপর সমুদ্রযাত্রীদের লুট করে হত্যা করে ফেলত।[৪] কাক মহলে মোমল এবং তার চাকররা / বোন একই কাজ করত।[৫] রোনো মোমাল এবং তার জাদুকরী জগতকে পরাস্ত করেছিল।

রূপক তাৎপর্য[সম্পাদনা]

মোমাল ও রানোর ভালবাসা ঐশ্বরিক প্রেমের একটি রুপক প্রকাশ। দুই প্রেমিকের মধ্যে বিচ্ছেদ এবং আকাঙ্ক্ষা, ঐশ্বরিক ও মানব আত্মার বিচ্ছিন্নতার সাথে সমান্তরাল এবং মোমাল ও রানোর আগুনে এক হয়ে যাওয়া ঐশ্বরিক ও মানব আত্মার একে অপরের সাথে মিশে ও দ্রবীভূত করার নামান্তর। মানুষের আত্মা, আল্লাহর কাছে কামনা করে এবং নিখুঁত অতিশক্তিহীন আত্মত্যাগমূলক ভক্তি বিশ্ব বা সমাজের জন্য কিছুই পরোয়া করে না ঠিক যেন সুফীদের ঐশ্বরিক প্রেমের মত।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Sindhi Adabi Board Online Library (Folk_Litrature)"www.sindhiadabiboard.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-২৭ 
  2. "کٿوريءَ کيپَ کيتر ۾ (مزمل سائر) | سنڌ سلامت ڪتاب گهر"books.sindhsalamat.com (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২০-০৫-১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-২৭ 
  3. "کٿوريءَ کيپَ کيتر ۾ (مزمل سائر) | سنڌ سلامت ڪتاب گهر"books.sindhsalamat.com (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২০-০৫-১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-২৮ 
  4. "Siren | Definition, Legend, & History"Encyclopedia Britannica (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-২৮ 
  5. "MUSE INDIA, the literary eJournal"Literary Magazines (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৩-০৪-০৪। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-২৮ 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]