ব্যবহারকারী:মামুন ইকবাল/বনু ইসরাইল

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

بسم الله الرحمن الرحيم

بنو اسرائيل আরবি

বনু ইসরাইল

আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজিদের অনেক জায়গায় বনি ইসরাইলদের নিয়ে আলোচনা করেছেন। সূরা ‌‌বনী-ঈসরাইল নামে অনেক বড় আলাদা স্বতন্ত্র একটি সুরা নাজিল করেছেন। বনি ইসরাইলদের দান করেছেন অসংখ্য নিয়ামাত, যার উল্লেখ রয়েছে কুরআনে।

বনু ইসরাইলের পরিচয়[সম্পাদনা]

সংক্ষেপে বনি ইসরাইলের ঐতিহাসিক পরিচয় তুলে ধরা হলো- [১]

আল্লাহ তাআলার প্রিয় নবি হজরত ইবরাহিম আ: বসবাস ছিল ইরাক সিরিয়া ও হিজাজে। তাঁর ঔরস থেকে সুপ্রসিদ্ধ দুটি বংশ ধারা নেমে এসেছে। যার প্রথমটি মিসরীয় স্ত্রী হজরত হাজেরার গর্ভে জন্মগ্রহণকারী হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম এর মাধ্যমে, যা বনি ইসমাইল নামে পরিচিতি। আর দ্বিতীয়টি ইরাকি স্ত্রী হজরত সারার গর্ভে জন্মগ্রহণকারী হজরত ইসহাকের পুত্র হজরত ইয়াকুব ওরফে হজরত ইসরাইলের মাধ্যমে। এ জাতি বনি ইসরাইল নামে পরিচিত। আর তৃতীয় স্ত্রী কাতুরার মাধ্যমে একটি বংশ ধারাও ছিল যা ব্যাপক পরিচিতি পায়নি।

হজরত ইব্রাহিম এর পৈত্রিক নিবাস ছিল ইরাক। তাঁর পৌত্র হজরত ইয়াকুবের ছেলে হজরত ইউসুফ ঘটনাচক্রে কুদরাতিভাবে মিসরে গমন করেন। একপর্যায়ে তিনি মিসরের শাসনকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হন। মিসরের দুঃসময়ে সফল শাসক হিসেবে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দেশে। হজরত ইউসুফ আ: এর পিতা হজরত ইয়াকুব আ: মিসরে নিয়ে আসেন। সে সুবাধে সেখানেই বনি ইসরাইলিরা অবস্থান করতে থাকে। সুদীর্ঘ চারশত বছর বনি ইসরাইলিরা মিসরে শাসনকার্য পরিচালনা করে।

পরবর্তীতে মিসরের শাসনভার চলে যায় ফিরাউনদের হাতে। এ ফিরাউন নামক মিসরের শাসকরা ছিল জালিম। বনি ইসরাইলদের উপর তারা নিয়মিত কঠোর অত্যাচার-নির্যাতন চালাতো। ফিরাউন নামধারী সর্বশেষ শাসক এক দুঃস্বপ্ন দেখে। স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানার পর বনি ইসরাইলীদের বিরুদ্ধে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে ফিরাউন। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যদি বনি ইসরাইলিদের ঘরে কোনো পুত্র সন্তান জন্ম নেয় তবে তাকে তৎক্ষনাৎ হত্যা করা হবে। কারণ তার এ বিশ্বাস জন্মেছিল যে, বনি ইসরাইলের কোনো সাহসী সন্তানের হাতেই তার পতন ঘটবে। এ অনিবার্য পতন ঠেকাতেই ফিরাউন এমন পাশবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল।

আল্লাহর মহাকুদরত এ ফিরাউনের ঘরেই লালিত-পালিত হন বনি ইসরাইলের সন্তান পয়গাম্বর মুসা । কালের আবর্তে এক সময় মুসা ফিরাউনের মুখোমুখি হন। নির্যাতিত বিন ইসরাইলিদের ফিরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্ত করতে সবাইকে সংঘঠিত করেন। নিরাপত্তার জন্য তাদের নিয়ে হিজরত করেন। খবর পেয়ে ফিরাউন বনি ইসরাইল সম্প্রদায়কে পিছন থেকে ধাওয়া করেন। মুসা আঃ আল্লাহর কুদরাতে লোহিত সাগর পাড়ি জমান। আর ফিরাউন সৈন্য-সামন্তসহ মুসার পিছু নিলে সমুদ্রের মধ্যে দলবলসহ সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়। অবশেষে মুসা আঃ মিসরের একটি দ্বীপ ভূমি সিনাই অঞ্চলে বনি ইসরাইলদেরকে নিয়ে আশ্রয় নেয়। এখানেই শুরু হয় বনি ইসরাইলদের কাল যাপন।

পরিশেষে... বনি ইসরাইলদের উত্থান বহু শতাব্দী ধরে অব্যাহত ছিল এবং তাঁরাই পৃথিবীতে তাওহিদের পতাকাবাহী ছিলেন। হজরত ইয়াকুব আঃ থেকে শুরু করে হজরত ইসা আঃ পর্যন্ত প্রায় চার হাজার নবি-রাসুল বনি ইসরাইল কাওমে প্রেরিত হয়েছেন। বহু নামি-দামি বাদশা, সেনাপতি ও রাষ্ট্র নায়ক বারবার জন্ম নিয়েছেন। এবং তাদের জন্য হিদায়েতের আলো নিয়ে এসেছেন অসংখ্য নবি-রাসুল। যারা স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে ইরাক-মিসর-হিজাজ এবং সর্বশেষ ইয়াছরিব তথা মদিনার পাশ্ববর্তী অঞ্চলে আবাদ এবং বসতি করেছিল। আর বনি ইসরাইল হলো তাদের বংশীয় পরিচয়। ধর্ম মতে তারা ছিল ইয়াহুদি কিতাবি।

শেষ নবি ও রাসুল আগমনের পূর্ব পর্যন্ত বিকৃত হলেও তাওরাত তাদের মাঝে বিদ্যমান ছিল। ওহি ও নবুয়তের ধারা এবং শান্তি ও শাস্তির পুরষ্কার বিষয়ে তারা বিশ্বাসী ছিল। ফলে শেষ সময়ের মানুষরাও জাগতিক-ধর্মীয় উভয় ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদেরকে শেষ ভরসা মনে করতো।

এমনকি আরবের মুশরিক সম্প্রদায়ও বনি ইসরাইলিদের রীতি, চরিত্র, ধর্ম ও আক্বিদা বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত ছিল এবং বহু ক্ষেত্রে তারা তাদেরকেই আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করতো। সর্বোপরি তাদের ধর্মগ্রন্থ যদিও বিকৃত ছিলো তথাপিও শেষ নবি ও রাসুলের আগমন সংবাদও তাদের বর্ণনা ও কল্পকাহিনীতে উঠে এসেছিল। যার অপেক্ষায় ছিল গোটা আরব ভুখণ্ড।

বনি ইসরাইল কারা[সম্পাদনা]

বনি ইসরাইল কারা- এটা জানতে হলে প্রথমে আমাদের ইবরাহিম .আ:(Abraham) এর ব্যাপারে জানতে হবে। ইব্রাহিম আ. কে বলা হয় ' Father of faith ' একেশ্বরবাদী হিসেবে দাবি করা তিনটি প্রধান ধর্ম - ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলাম ; সবগুলোতেই তিনি স্বীকৃত ও সম্মানিত।

সবাই তাকে নিজেদের ধর্মের অনুসারী হিসেবে দাবি করে। ।[২] . . ইব্রাহিম আঃ এর দুইজন স্ত্রী ছিলেন। যার মাধ্যমে ইবরাহিম এর দুটি বংশধারার সৃষ্টি হয়।

   ইসমাইল আঃ . এর দ্বারা (বিবি হাজেরার গর্ভ থেকে)
   ইসহাক আ: . এর দ্বারা (বিবি সারাহর গর্ভ থেকে)

. প্রথম বংশধারা :- ইবরাহিম আ:→ইসমাইল আ:→...(মাঝে কেও নবী মনোনীত হয়নি এই বংশে)...→ মুহাম্মদস: . দ্বিতীয় বংশধারা :- ইবরাহিম আ: {Abraham} → ইসহাক আ: {Isaac} → ইয়াকুব আঃ {Jacob}(ইসরাইল আ:) → ইউসুফ আ: {Joseph} → মুসা আঃ {Moses} → দাউদ আঃ {David} → সুলাইমান আঃ{Solomon} → ঈসা আঃ{Jesus} (মাঝে আরও নবী পাঠানো হয়েছিল এই বংশধারায়) . এখানে দেখতে পাচ্ছি, বনি ইসরাইল মুলত ইয়াকুব আঃ . এর বংশধর। কারণ ইয়াকুব এর আরেক নাম ছিল ইসরাইল । . ইয়াকুব আঃ. এর ছিল ১২জন পুত্র। বংশানুক্রমে ইয়াকুব আঃ. শাম দেশে হয় এবং সেটাই বনি ইসরায়েলের দাবিকৃত আবাসভূমি হয়। তবে মিশরে তারা কিভাবে গেল?কীভাবে মুসা আ. মিশরে অবস্থান করছিল? ইউসুফ আ: . মাধ্যমে। . - মুসাআ: . এর মিশর ত্যাগ ও ফিরাউনের পতন - Palestine এর পথে বনি ইসরাইলের যাত্রা . . ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা প্রমাণ করে চাওয়া কথা গুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে -



' ইহুদিরা জেরুজালেমকে পবিত্র ভুমি মনে করে এবং স্বয়ং ইশ্বর তাদের এখানে ফিরে আসার অধিকার দিয়েছেন। . - নির্বাসনের ৪০ বছর - বনি ইসরাইলের জেরুজালেম প্রবেশ . . . সুলাইমান আ. এর মৃত্যুর পর উনার বিশাল রাজত্ব মুলত ২ভাগে ভাগ হয়ে যায়। উত্তর অংশের নাম ছিল ইসরাইল (Israel) দক্ষিন অংশের নাম ছিল জুডাহ(Judah),আরবিতে যার নাম ইয়াহুদ। . আগেই বলেছিলাম ইয়াকুব আ. এর ১২ জন ছেলে ছিল, যাদের থেকে ১২টি গোত্রের সৃষ্টি। আল্লাহর ইচ্ছায় আসিবীয়রা ইসরাইলে আক্রমণ করে এবং তাদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এই ১০টি গোত্রের আর কোন নাম-নিশানাই খুঁজে পাওয়া যায় না।

- বনি ইসরাইল থেকে ইহুদি হয়ে যাওয়া . আসিবীয়রা যখন ১০টি গোত্রের নাম নিশানা মুছে দেয় তখন বাকি ছিল জুডাহ রাজ্য যা ব্যাবিলনীয়দের আক্রমনের শিকার হয় ৫৮৭ খ্রিষ্টপূর্বে এবং তাদেরকে ব্যাবিলনে নির্বাসিত করা হয় দাস হিসেবে। এই নির্বাসনের পর থেকেই মুলত পরিচয়ের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন সাধিত হয়। কিন্তু যখন থেকে তারা নিজেদের ইহুদি হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করল,তখন তা ছিল একটা জাতিগত বা গোত্রীয় পরিচয়। . আল্লাহর আসমানী কিতাব পাঠানোর এবং তাওহীদের বাণী প্রচার করার দায়িত্ব প্রত্যর্পণের মাধ্যমে বনি ইসরাইলের লোকদের যে বিশাল সম্মান এবং অনুগ্রহ দান করেছিলেন, সেটাকে তারা একটা 'জাতিগত' তথা পৈত্রিক সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছিল--যা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যায়। তারা এটাকে জন্মপরিচয় অর্থ্যাৎ গোত্রের নামের সাথে জুড়ে দিয়েছিল --- ইহুদি! তারা মনে করত, এবং আজও মনে করে, তারা আল্লাহ কতৃক মনোনীত জাতি (Chosen People)। তাদের লেখা দেখুন,কাকে ইহুদি হিসেবে অভিহিত করেছে -- ' এখানে উল্লেখ্য যে,আপনার ইহুদি হওয়া না হওয়া আপনার বিশ্বাস কিংবা কাজের উপর নির্ভর করছে না। অইহুদি পরিবারে জন্ম নেওয়া কেউ যদি ইহুদিদের বিশ্বাস এবং রীতিনীতি পালন করে; তবুও সে একজন অইহুদি হিসেবে বিবেচিত হবে। এমনকি ইহুদিবাদের উদারমনা সংস্কারকরাও তাকে অইহুদিই বলবে। অপরদিকে একজন ইহুদি মায়ের সন্তান যদি নাস্তিকও হয়, যদি কখনো ইহুদি ধর্মপর রীতিনীতি পালন নাও করে ;তবু সে একজন ইহুদি হিসেবেই বিবেচিত হবে।এমনকি অত্যন্ত গোড়া ইহুদিদের চোখেও সে ইহুদি থাকবে। সে হিসেবে ইহুদিবাদ অনেকটা জাতীয়তাবাদের মতোই,ধর্মের মতো নয়। আর ইহুদি হওয়া অনেকটা নাগরিকত্বের মত । - ইহুদি এবং খৃষ্টান : এক উম্মাহর বিভাজনের পটভূমি। .


বনী ইসরাইলদের মর্যাদা[সম্পাদনা]

  • বনি ইসরাইলদের প্রতি আল্লাহ তাআলার নিয়ামাতসমূহের উল্লেখের উদ্দেশ্য হলো- তাদেরকে কুরআন এবং নবী মোহাম্মদের সা: উপর ঈমান আনার জন্য অনুপ্রাণিত করা। আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলকে সে যুগের সবার উপরে তাদেরকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। তাদের প্রতি নিয়ামাত প্রদানের কথা, উচ্চ মর্যাদার কথা শ্রবণে তাঁরা আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কুরআন এবং শেষ নবির উপর ঈমান আনবে। কিন্তু তারা এ কর্তব্য পালনে হয়েছে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। আল্লাহ বলেন- [৩]

হে বনী-ইসরাঈলগণ! আমি যে নিয়ামাত তোমাদেরকে দান করেছি, তা তোমরা স্মরণ কর আর (স্মরণ কর) সে বিষয়টি যে, আমি সমগ্র বিশ্ববাসীর উপর তোমাদেরকে উচ্চমর্যাদা দান করেছি। সূরা আল-বাকারা : আয়াত ৪৭) [৪] অত্র আয়াতে নবী মুহাম্মদ সময়কার ইয়াহুদিরা উদ্দেশ্য। সে সময়কার বনি ইসরাইলদেরকে আল্লাহ তাআলা জানাচ্ছেন যে, তোমাদের পূর্বপুরুষদের অসংখ্য নিয়ামাত দান করা হয়েছে, তোমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্য থেকে অসংখ্য নবি-রাসুল পাঠানো হয়েছে, তোমাদের পূর্বপুরুষদের দীর্ঘদিন যাবত রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করা হয়েছে।

এমন কি সে যুগের শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে তোমাদের উচ্চ মর্যাদা দান করা হয়েছে। তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ ফজিলত দান করা হয়েছিল। যার প্রমাণ কুরআনের এসেছে- ‘যখন মূসা স্বীয় সম্প্রদায়কে বললেনঃ# হে আমার সম্প্রদায়, তোমাদের প্রতি আল্লাহর নেয়ামত স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদের মধ্যে পয়গম্বর সৃষ্টি করেছেন, তোমাদেরকে রাজ্যাধিপতি করেছেন এবং তোমাদেরকে এমন জিনিস দিয়েছেন, যা বিশ্বজগতের কাউকে দেননি ‘ (সূরা আল-মায়িদাহ : আয়াত ২০)

[৫]

বনি ইসরাইলের মধ্যে পৌত্তলিক ধ্যানধারণার অনুপ্রবেশ[সম্পাদনা]

  1. ১৩৮.'[৬] আমি বনি ইসরাইলকে সাগর পার করিয়ে দিয়েছি (ফেরাউনের বাহিনীকে ডুবিয়ে মারার পর)। অতঃপর সমুদ্রের ওপারে তারা এমন একটি জাতির কাছে এসে পৌঁছল, যারা মূর্তিপূজায় লিপ্ত ছিল। তারা বলল, 'হে মুসা, এদের যেমন দেবতা আছে, তেমনি আমাদের জন্যও কোনো দেবতা বানিয়ে দাও।' মুসা আঃ বলল, 'তোমরা তো দেখছি একেবারেই এক মূর্খ জাতি।'

[৭]

  1. ১৩৯.[৮] 'এই (মূর্তিপূজারি) লোকেরা যা কিছু নিয়ে নিয়োজিত আছে, তা তো ধ্বংস হয়ে যাবে এবং এরা যা করছে সবই ভুল।'
  2. ১৪০. [৯] (মুসাআ: তাদের আরো বলল), 'আমি কি তোমাদের জন্য আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো মাবুদের অনুসন্ধান করব? অথচ তিনিই তোমাদের গোটা বিশ্বজগতের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।'
  1. ১৪১. [১০]আর সে সময়ের কথা স্মরণ করো, যখন আমি তোমাদের ফেরাউনের লোকদের কবল থেকে উদ্ধার করেছিলাম, যারা তোমাদের মর্মান্তিক শাস্তি দিত। তারা তোমাদের পুত্রসন্তানদের হত্যা করত আর কন্যাসন্তানদের জীবিত রাখত। এর মধ্যে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে ছিল এক মহাপরীক্ষা। (সূরা আল-আরাফ আয়াত : ১৩৮-১৪১)

তাফসির : ফেরাউনের কবল থেকে উদ্ধার, বনি ইসরাইলের তথা ইহুদিদের বিজয় ও কৃতকার্যতা লাভের পরও তাদের ঔদ্ধত্য, মূর্খতা ও দুষ্কর্মের বিবরণ দেওয়া হয়েছে আলোচ্য আয়াতগুলোতে। এর উদ্দেশ্য হলো নবী মুহাম্মদ-কে সান্ত্বনা দেওয়া যে পূর্ববর্তী নবী-রাসুলরাও নিজ উম্মতের দ্বারা ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। বনি ইসরাইলের মধ্যে পৌত্তলিক ধ্যানধারণার অনুপ্রবেশ

বনি ইসরাইল সম্প্রদায় মুসার নেতৃত্বে সদলবলে মিসর থেকে বের হয়ে গিয়ে যখন নিজেদের আপন ভূমির সন্ধান করছিল, তখন তারা যে অঞ্চলের ওপর দিয়ে যাচ্ছিল, সেখানে এক জাতির দেখা পেল, যারা ছিল মূর্তিপূজারি। তারা মাটি দিয়ে দেবতার মূর্তি বানিয়ে এর পূজা করে। এটা দেখে মুসার সম্প্রদায়ের অনেকেও আবদার করতে লাগল যে তারা এ রকম মূর্তিপূজা করতে চায়। তাদের জন্যও যেন মুসা একজন দেবতার সন্ধান করে। মুসা আঃ তাদের এ জন্য ধিক্কার দিয়েছেন। বলেছেন, এটা তোমাদের অজ্ঞতা ও মূর্খতার পরিচায়ক। আর যাদের রীতিনীতি তোমরা পছন্দ করছ, তারা আসলে ভ্রান্তপথে ও ক্ষয়িষ্ণু অবস্থানে আছে। তাদের সব আমল বরবাদ হয়ে গেছে। তারা মিথ্যার অনুগামী। তাদের রীতিনীতিতে আকৃষ্ট হওয়া তোমাদের উচিত নয়। এভাবেই বনি ইসরাইলের মধ্যে পৌত্তলিক ধ্যানধারণার অনুপ্রবেশ ঘটে।

একত্ববাদের দাওয়াত[সম্পাদনা]

অতঃপর হজরত মুসাআ: বনি ইসরাইল জাতিকে একত্ববাদের ওপর দৃঢ়চিত্ত হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন। পৃথিবীতে তাদের মানবজাতির অন্যান্য গোষ্ঠীর ওপর শ্রেষ্ঠত্বদানের কথাটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কেননা বনি ইসরাইলকে আল্লাহ তাআলা বিশেষ বিশেষ কিছু নিয়ামত দান করেছেন, যা অন্যদের দেওয়া হয়নি। আর তখন যারা হজরত মুস-এর ওপর ইমান এনেছিল, তারা অন্যদের তুলনায় অধিক মর্যাদাসম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। শেষ আয়াতে ফেরাউন কর্তৃক বনি ইসরাইলের ওপর নির্মম অত্যাচারের কাহিনী স্মরণ করানো হয়েছে। তারা বনি ইসরাইলদের মর্মান্তিক শাস্তি দিত। তাদের পুত্রসন্তানদের হত্যা করত আর কন্যাসন্তানদের জীবিত রাখত। উদ্দেশ্য ছিল বনি ইসরাইলের বংশবিস্তার রোধ করা। আশ্চর্য হলো, এহেন অত্যাচার থেকে মুক্ত হয়ে হেঁটে লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে ফেরাউনের জাতির সাগরে ডুবে মরার দৃশ্য নিজ চোখে দেখেও বনি ইসরাইল জাতি তাওহিদ ও একত্ববাদের শিক্ষা থেকে দূরে সরে গিয়েছিল।

(তাফসিরে মা'আরেফুল কোরআন ও ইবনে কাছির অবলম্বনে)

যে কারনে বনি ইসরাঈল ৪০ বছর যাবত দিকভ্রান্ত হয়ে ঘুরেছিল[সম্পাদনা]

শামে প্রবেশের নির্দেশ : ঘটনাটি মুসার যুগের। ফেরাউন ও তার সৈন্যবাহিনী যখন সমুদ্রে নিমজ্জিত হয় এবং মুসাআ: ও তাঁর সমপ্রদায় বনি ইসরাঈল ফেরাউনের দাসত্ব থেকে মুক্তিলাভ করে, তখন মহান আল্লাহ তাদের কিছু নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তাদের পৈতৃক দেশ শামকেও তাদের অধিকারে প্রত্যার্পণ করতে চান। আর তাই মুসাআ: -এর মাধ্যমে তাদেরকে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে পবিত্র ভূমি শাম (বর্তমান সিরিয়া, ফিলিস্তিন তথা বাইতুল মুকাদ্দাস) এলাকায় প্রবেশ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে তাদের আগাম সুসংবাদও দেওয়া হয় যে এ যুদ্ধে তারাই বিজয়ী হবে। কারণ আল্লাহ তাআলা এ পবিত্র ভূমির আধিপত্য তাদের ভাগ্যে লিখে দিয়েছেন, যা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। [১১] বনি ইসরাইলের অবাধ্যতা : বনি ইসরাঈল প্রকৃতিগত বক্রতার কারণে আল্লাহর সরাসরি সাহায্য ফেরাউনের সাগরডুবি ও তাদের মিসর অধিকার ইত্যাদি স্বচক্ষে দেখেও এ ক্ষেত্রে অঙ্গীকার পালনের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে সক্ষম হলো না।

[১২] তারা যুদ্ধ সম্পর্কিত আল্লাহ তাআলার নির্দেশের বিরুদ্ধে অন্যায় জেদ ধরে বসে থাকে। তারা মহান আল্লাহকে ভয় না করে সামান্য কিছু মানুষকে ভয় করে। পবিত্র কোরআনে তাদের 'বক্তব্যগুলো তুলে ধরা হয়েছে।     ইরশাদ [১৩]‘ হয়েছে, ‘তারা বলল, হে মুসা, নিশ্চয়ই সেখানে এক দুর্দান্ত সমপ্রদায় আছে এবং তারা সে স্থান থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত আমরা কখনো সেখানে কিছুতেই প্রবেশ করব না। অতঃপর তারা সেখান থেকে বের হয়ে গেলে তবে নিশ্চয় আমরা সেখানে প্রবেশ করব। যারা ভয় করত তাদের মধ্যে দুজন, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছিলেন, তারা বলল, তোমরা তাদের মোকাবেলা করে দরজায় প্রবেশ করো, প্রবেশ করলেই তোমরা জয়ী হবে এবং আল্লাহর ওপরই তোমরা নির্ভর করো যদি তোমরা মুমিন হও।  
[১৪]

জাহান্নামের_আগুনে তারা বলল, ‘হে মুসা, তারা যতক্ষণ সেখানে থাকবে ততক্ষণ আমরা সেখানে কখনো প্রবেশ করব না; কাজেই তুমি আর তোমার রব গিয়ে যুদ্ধ করো। নিশ্চয়ই আমরা এখানেই বসে থাকব। (সূরা আল-মায়িদাহ আয়াত : ২২-২৪) অবাধ্যতার কঠিন শাস্তি : পরিণতিতে মহান আল্লাহ তাদের শাস্তি দেন। তারা ৪০ বছর পর্যন্ত একটি সীমাবদ্ধ এলাকায় অবরুদ্ধ ও বন্দি হয়ে রইল। বাহ্যত তাদের চারপাশে কোনো বাধার প্রাচীর ছিল না এবং তাদের হাত-পা শিকলে বাধা ছিল না; বরং তারা ছিল উন্মুক্ত প্রান্তরে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তাদের সেই শাস্তির বর্ণনাও স্পষ্টভাবে দিয়েছেন।[১৫] ইরশাদ হয়েছে, তিনি বলেন, ‘হে আমার রব, আমি ও আমার ভাই ছাড়া আর কারো ওপর আমার অধিকার নেই। সুতরাং আপনি আমাদের ও অবাধ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ করে দিন। তিনি (আল্লাহ) বলেন[১৬], যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার জন্য তাদের এই শাস্তি দেওয়া হয়েছিল যে তারা ৪০ বছর যাবৎ দিন-রাত সকাল-সন্ধ্যা তিহ ময়দানে উদ্দেশ্যহীনভাবে ভবঘুরে জীবন যাপন করবে।’ (সূরা আল-মায়িদাহ আয়াত : ২৫-২৬)

নতুন নবীর আগমন ও মুক্তি লাভ : তারা স্বদেশে অর্থাৎ মিসর ফিরে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পথও চলত; কিন্তু তারা নিজেদের সেখানেই দেখতে পেত, যেখান থেকে সকালে রওনা হয়েছিল। ইত্যবসরে মুসাআ: ও হারুন আঃ এর মৃত্যু হয়ে যায় এবং বনি ইসরাঈল তিহ প্রান্তরেই উদ্ভ্রান্তের মতো ঘোরাফেরা করতে থাকে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদের হিদায়াতের জন্য অন্য একজন নবী প্রেরণ করলেন। ৪০ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর বনী ইসরাঈলের অবশিষ্ট বংশধর তৎকালীন নবীর নেতৃত্বে শাম দেশের সে এলাকা তথা সিরিয়া ও বায়তুল মুকাদ্দাসের জন্য জিহাদের সংকল্প গ্রহণ করে এবং আল্লাহ তাআলার ওয়াদাও পূর্ণতা লাভ করে। ইবনে কাসীর

এভাবেই যারা মহান আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামত ভোগ করেও তাঁর ওপর আস্থা রাখে না, তাদের জীবন উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়ে, হতাশা, ব্যর্থতা, গুনাহ ও দুঃখের অদৃশ্য বৃত্তে তারা আটকে পড়ে, দুনিয়ার সব শান্তির উপকরণ দিয়েও তাদের আত্মিক শান্তি অর্জন হয়।

বনি ইসরাইলের সঙ্গে আল্লাহর প্রতিজ্ঞা[সম্পাদনা]

বনি ইসরাইলের সঙ্গে আল্লাহর প্রতিজ্ঞা কুরআন মাজিদে আল্লাহ উম্মাতে মুহাম্মাদিরসা: কল্যাণে পৃথিবীর আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত সব কিছুই সবিস্তর আলোচনা করেছেন। ‌যা বান্দার জন্য পথ ও পাথেয় হবে। [১৭]সেপৃথিবীতে মোহাম্মদের আগমনের পূর্বে বনি ইসরাইলদের থেকে ওয়াদা নেয়া হয়েছিল যে, আখেরি পয়গাম্বর আসলে তাঁর উপর ঈমান আনয়ন করবে এবং তার আনুগত্য করবে। সে কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই আল্লাহ তাআলা বলেন-হে বনী-ইসরাইলগণ, তোমরা স্মরণ কর আমার সে অনুগ্রহ যা আমি তোমাদের প্রতি করেছি এবং তোমরা পূরণ কর আমার সাথে কৃত প্রতিজ্ঞা, তাহলে আমি তোমাদেরকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণ করব। আর ভয় কর আমাকেই। (সূরা আল বাকারা : আয়াত ৪০) [১৮]অত্র আয়াতে ইসরাইল (অর্থ আবদুল্লাহ বা আল্লাহর বান্দা) ছিল ইয়াকুব আঃ উপাধি। ইয়াহুদিদেরকে বনি ইসরাইল তথা হজরত ইয়াকুব সন্তান বলা হতো। হজরত ইয়াকুব আঃ হতে হজরত ইসা পর্যন্ত বনি ইসরাইলে চার হাজার নবির আবির্ভাব হয়েছিল। তাই আবর জাহানের সবার দৃষ্টি ছিল তাদের প্রতি এ জন্য যে, তারা মুহাম্মাদ এর দাওয়াত গ্রহণ করে, নাকি প্রত্যাখ্যান করে। এ জন্য তাদেরকে দেয়া নিয়ামাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে আল্লাহ উক্ত আয়াত নাজিল করেন।বনি ইসরাইলকে যে সকল নিয়ামাত দ্বারা সাহায্য করা হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল- ফিরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্তি প্রদান, সমুদ্র বিদীর্ণ, মেঘমালার ছায়াদান, আসমানের বরকতি খাদ্য মান্না-সালওয়া প্রদানসহ অসংখ্য নিয়ামাত। যা তাদের প্রতি আল্লাহ একান্ত অনুগ্রহ। অত্র আয়াতে তাদেরকে সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।তাদের কাছ থেকে এ মর্মে অঙ্গীকারও গ্রহণ করা হয়েছিল যে, মুহাম্মদের আগমনে তারা তাঁর উপর ঈমান আনয়ন করবে। যার বিনিময় তাদের দেয়া হবে জান্নাত। আর সকল বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।

যারা আকাশ থেকে আসা খাবার খেয়েছে[সম্পাদনা]

আল্লাহ তাআলা অসীম ক্ষমতার মালিক। তিনি যা ইচ্ছা করতে পারেন। কিন্তু যুগে যুগে কপট অন্তরের অধিকারী মানুষ তা বিশ্বাস করে না। তাই তারা তাদের নবীর কাছে নানা বিষয়ের আবেদন করেছে। এমনকি তারা আসমানি খাদ্যের আবেদনও করেছে। যেমন—হজরত ঈসার আঃ জাতি ইহুদিরা এমন দাবি তুলেছিল। #ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন হাওয়ারিরা বলল, হে মরিয়ম তনয় ঈসা! তোমার পালনকর্তা কি আমাদের জন্য আকাশ থেকে খাদ্যভর্তি খাঞ্চা অবতরণ করতে সক্ষম? সে ঈসা বলল, আল্লাহকে ভয় করো, যদি তোমরা মুমিন হও।’ (সূরা আল-মায়িদাহ আয়াত : ১১২)[১৯] অর্থাৎ আল্লাহর কুদরতের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ কোরো না।

  <[২০]

হাওয়ারিদের ঈসারঅনুসারী দাবির পরিপ্রেক্ষিতে# হজরত ঈসা আঃ . দোয়া করেন : ‘হে আল্লাহ, আমাদের পালনকর্তা! আমাদের প্রতি আকাশ থেকে খাদ্যভর্তি খাঞ্চা অবতরণ করুন।’ (সূরা আল-মায়িদাহ আয়াত : ১১৪) [২১] হজরত ঈসার দোয়ার জবাবে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি সে খাঞ্চা তোমাদের প্রতি অবতরণ করব। কিন্তু যে ব্যক্তি এর পরেও অকৃতজ্ঞ হবে, আমি তাকে এমন শাস্তি দেব, যে শাস্তি বিশ্বজগতের অন্য কাউকে দেব না।’ (সূরা আল মায়িদাহ আয়াত : ১১৫)[২২] আসমানি দস্তরখান প্রসঙ্গে বিভিন্ন বর্ণনা

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন, হজরত ঈসা বনি ইসরাইলের উদ্দেশে বলেন, তোমরা ৩০ দিন রোজা রাখো। অতঃপর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো। তিনি তোমাদের যা চাও তা দান করবেন। ৩০ দিন রোজা রাখার পর তারা বলল, হে ঈসা! আমরা যদি কারো কাজ করতাম, আমাদের পারিশ্রমিক দিত, আমাদের খাওয়াত। আমরা রোজা রেখেছি, উপবাস রয়েছি। আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, যাতে তিনি আমাদের জন্য আসমান থেকে খাদ্যভর্তি খাঞ্চা নাজিল করেন। অতঃপর ফেরেশতা খাদ্যভর্তি একটি খাঞ্চা নিয়ে হাজির হন। তাতে ছিল সাতটি রুটি, সাতটি মাছ। তা তাদের সামনে রাখা হয়। অতঃপর তারা সবাই সেখান থেকে ভক্ষণ করে।

হজরত সালমান ফারসি থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন ঈসার সঙ্গীরা তাঁর কাছে আসমানি খাবার প্রার্থনা করে, তখন তিনি পশমের বস্ত্র খুলে কালো রঙের পায়জামা পরিধান করেন। অতঃপর পায়ের সঙ্গে পা, গোড়ালির সঙ্গে গোড়ালি ও পদদ্বয়ের বৃদ্ধাঙ্গুলিগুলো একত্রিত করে দাঁড়ান। অতঃপর ডান হাত বাঁ হাতের ওপর রাখেন। তারপর মাথা নিচু করে বিনম্র হয়ে ক্রন্দন করে অশ্রু দিয়ে দাড়ি মোবারক সিক্ত করে দোয়া করেন—হে আল্লাহ! আমাদের রব! আমাদের প্রতি আকাশ থেকে খাদ্যভর্তি খাঞ্চা অবতরণ করুন। অতঃপর দুটি মেঘ খণ্ডের মাঝে গোলাকার রক্তিম বর্ণের একটি দস্তরখান অবতীর্ণ হয়। মানুষ তা প্রত্যক্ষ করেছে। হজরত ঈসা তখন দোয়া করেন, হে আল্লাহ! একে রহমত হিসেবে নির্ধারণ করুন। আমার রবের পরীক্ষার বিষয় করবেন না। আল্লাহ তাআলা তাঁর দোয়া কবুল করেন। অতঃপর রুমাল দিয়ে আবৃত খাঞ্চা হজরত ঈসার সামনে অবতীর্ণ হয়। তিনি তখন সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। হাওয়ারিও তাঁর সঙ্গে সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। তাঁরা তাতে এমন সুগন্ধি অনুভব করেন, যা এর আগে কখনো অনুভব করেননি। হজরত ঈসা বলেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অধিক আবেদ ও পুণ্যবান, সে তা খোলো। আমরা তা থেকে খাব ও আল্লাহর প্রশংসা করব। (তাফসীরে কুরতুবী) ঈসার সঙ্গীরা বলল, হে রুহুল্লাহ! আপনিই এর অধিক হকদার। হজরত ঈসা তখন অজুু করে নামাজ পড়েন ও দীর্ঘ মোনাজাত করেন। অতঃপর বসে খাঞ্চাটি খোলেন। এ খাঞ্চা অবতীর্ণের দিবসটি ছিল শনিবার। তাই ইহুদিরা এ দিনকে ঈদের দিন মনে করে।

খাঞ্চায় যেসব জিনিস ছিল তা হলো—

১. কাঁটাহীন তৈলাক্ত একটি ভুনা মাছ।

২. মাছের চতুর্দিকে ছিল বিভিন্ন ধরনের সবজি।

৩. মাছের মাথার কাছে ছিল লবণ ও ঝোল।

৪. লেজের কাছে ছিল পাঁচটি রুটি।

প্রতিটি রুটির একটিতে ছিল পাঁচটি আনার, আরেকটিতে খেজুর, অন্যটিতে জাইতুন। সালাবি (রহ.) বলেন, একটিতে ছিল জাইতুন, আরেকটিতে মধু, আরেকটিতে ডিম, আরেকটিতে ছিল পনির, আরেকটিতে গোশত।

(তাফসিরে কুরতুবি)

মান্না ও সালওয়া

হজরত মুসার জাতি ছিল অত্যন্ত দুষ্ট স্বভাবের। তারা আল্লাহ তাআলার কথা মানত না। আল্লাহ তাআলা যখন হজরত মুসা -কে আমালেকা সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেন, তখন তিনি বনি ইসরাইলের ১২ গোত্রের ১২ জন নেতাকে আমালেকা সম্প্রদায়ের রণাঙ্গনের অবস্থা দেখার জন্য প্রেরণ করেন। বায়তুল মাকদাসের অদূরে শহরের বাইরে আমালেকা সম্প্রদায়ের এ ব্যক্তির সঙ্গে তাদের দেখা হয়। সে একাই ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে তাদের বাদশাহর কাছে নিয়ে গিয়ে বলে, এরা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছে। রাজদরবারে নানা পরামর্শের পর তাদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়, যাতে তারা স্বজাতির কাছে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমালেকা জাতির শৌর্য-বীর্যের কথা বর্ণনা করতে পারে। ফলে আক্রমণ করা তো দূরের কথা, এদের দিকে মুখ করার দুঃসাহসও না দেখায়।

বনি ইসরাইলের ১২ জন সর্দার আমালেকা গোত্রের কয়েদখানা থেকে মুক্ত হয়ে ইউশা বিন নুন ও কালিব বিন ইউকান্না ছাড়া অন্যরা সবাই স্বজাতির কাছে সব বলে দেয়, অথচ তাদের সব কথা মুসার কাছে বলতে বলেছিলেন।# তারা মুসা (আ.)-কে গিয়ে বলল, ‘আপনি ও আপনার পালনকর্তা যান ও উভয়ে যুদ্ধ করুন। আমরা এখানে বসলাম।’ (সূরা আল-মায়িদাহ আয়াত : ২৪) [২৩] আল্লাহ তাআলা তাদের এ উক্তির ফলে অসন্তুষ্ট হয়ে ময়দানে ‘তিহ’ (সিনাই উপত্যকায়) যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেই স্থানটি ছিল উদ্ভিদ, বৃক্ষলতা ও পানিবিহীন এক শুষ্ক মরুভূমি। তারা ‘তিহ’ ময়দানে একত্রিত হয়ে আবেদন করে। হে মুসা! সেখানে আমাদের আহারের ব্যবস্থা কিভাবে হবে? তখন আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য মান্না ও সালওয়া নামের আসমানি খাদ্যের ব্যবস্থা করেন।# ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমাদের জন্য মান্না ও সালওয়া অবতীর্ণ করেছি।’ (সূরা আল-বাকারা আয়াত : ৫৭)[২৪]

মান্না ও সালওয়া কী?

মান্না হলো এমন খাদ্য, যা রাতে কুয়াশার মতো পড়ে জমে যেত ও সুস্বাদু খাদ্যে পরিণত হতো। কারো কারো মতে, মান্না হলো ডুমুর। কারো কারো মতে, আঠালো সুমিষ্ট বস্তু। কারো মতে মধু, কারো মতে সুমিষ্ট পানীয়। কারো মতে, পাতলা রুটি।

সালওয়া ছিল এক ধরনের পাখি, যা সূর্যাস্তের পর ঝাঁকে ঝাঁকে এসে ধরা দিত। তারা এদের গোশত ভক্ষণ করত।

কেন এ খাবার আসা বন্ধ হয়?

ইহুদিদের আসমানি খাদ্য জমা করে রাখতে নিষেধ করা হয়েছিল, কিন্তু তারা জমা করে রাখত। আবার একসময় তারা মান্না ও সালওয়ার পরিবর্তে পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাকার খাবার দেওয়ার জন্য দাবি জানায়। এতে তারা বিনা পরিশ্রমের আসমানি খাদ্য হারায় ও আল্লাহর শাস্তির উপযোগী হয়।

মায়েদা বা খাঞ্চার অবতরণ ও মান্না-সালওয়ার অবতরণ আল্লাহ তাআলার মহান কুদরতের একটি বড় নিদর্শন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "বনি ইসরাইলের পরিচয়"jagonews24.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭ 
  2. "বনি ইসরাইল কারা"spread bangla। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭ 
  3. "বনি ইসরাইলের মর্যাদা"jsgonews24.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭ 
  4. "সূরা আল বাকারা, আয়াত 47"tanzil.net। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭ 
  5. "সূরা আল মায়িদাহ, আয়াত 20"tanzil.net। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭ 
  6. "সূরা আল আরাফ, আয়াত 138"tanzil.net। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭ 
  7. "বনি ইসরাইলদের মাঝে পৌত্তলিক ধ্যান-ধারণার অনুপ্রবেশ"kalerkantho.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭ 
  8. "সূরা আল আরাফ , আয়াত 139"tanzil.net। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭ 
  9. "সূরা আল আরাফ, আয়াত 140"tanzil.net। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭ 
  10. "সূরা আল আরাফ, আয়াত 140"tanzil.net। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭ 
  11. "যে কারণে বনী-ইসরাইল ৪০ বছর ঘুরেছিল"kalerkantho.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭ 
  12. "সূরা আল মায়িদাহ, আয়াত 22"tanzil.net। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭ 
  13. "সূরা আল মায়িদাহ, আয়াত 23"tanzil.net। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭ 
  14. "সূরা আল মায়িদাহ, আয়াত 24"tanzil.net। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭ 
  15. "সূরা আল মায়িদাহ, আয়াত 25"tanzil.net। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭ 
  16. "সূরা আল মায়িদাহ, আয়াত 26"tanzil.net। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭ 
  17. "বনি ইসরাইলের সঙ্গে আল্লাহর প্রতিজ্ঞা"jagonews24.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭ 
  18. "সূরা আল বাকারা, আয়াত 40"tanzil.net। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭ 
  19. "সূরা আল মায়িদাহ আয়াত 112"tanzil.net। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭ 
  20. "যারা আকাশ থেকে আসা খাবার খেয়েছে"kalerkantho.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭ 
  21. "সূরা আল মায়িদাহ, আয়াত 114"tanzil.net। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭ 
  22. "সূরা আল, মায়িদাহ আয়াত 138"tanzil.net। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭ 
  23. "সূরা আল মায়িদাহ, আয়াত 24"tanzil.net। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭ 
  24. "সূরা আল বাকারা, আয়াত 57"tanzil.net। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭