বৈমানিক শাস্ত্র

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বৈমানিক শাস্ত্রে উল্লেখিত "শকুন বিমান"-এর এক নকশা, যা ডানা ও লেজওয়ালা এক পাখির মতো উড়বে বলে দাবি করা হয়।[১]

বৈমানিক শাস্ত্র (সংস্কৃত: वैमानिक शास्त्र, ৱয়মানিক্অ শাস্ত্র, উচ্চারিত [ʋɐjmaːnɪkɐ ʃaːstɾɐ], আক্ষ.'বিমান বিষয়ক শাস্ত্র') সংস্কৃত ভাষায় রচিত বিংশ শতাব্দীর এক গ্রন্থ, যা দাবি করে যে প্রাচীন ভারতীয় মহাকাব্যে উল্লেখিত বিমানগুলো আদতে আধুনিক উড়ন্ত যান ছিল।

১৯৫২ সালে জি. আর. জোসিয়ার এই গ্রন্থের অস্তিত্বের কথা প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর দাবি যে পণ্ডিত সুব্বারায় শাস্ত্রী (১৮৬৬–১৯৪০) ১৯১৮ ও ১৯২৩-এর মধ্যে এটি রচনা করেছিলেন। ১৯৫৯ সালে এর হিন্দি অনুবাদ এবং ১৯৭৩ সালে মূল সংস্কৃত রচনাসহ তার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। এর ২,০০০টি শ্লোক ৮টি অধ্যায় জুড়ে বিন্যস্ত এবং পণ্ডিত সুব্বারায় শাস্ত্রীর দাবি অনুযায়ী ভরদ্বাজ মুনি তাঁকে এই গ্রন্থটি দিয়েছিলেন।[২]

১৯৭৪ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান সংস্থায় এরোনটিকাল ও মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং গবেষকগণ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে ঐ রচনায় লেখকের বিমান চালনা নিয়ে জ্ঞানের সম্পূর্ণ অভাব প্রকাশিত হয়েছে। "রুক্ম বিমান" নিয়ে আলোচনার সময় এই গবেষণাটি উল্লেখ করেছিল যে যদি নকশা ও রচনায় বর্ণিত যানটি রুক্ম বিমান হয় তাহলে এটি স্পষ্টত অসম্ভব।[৩]

উৎপত্তি ও প্রকাশনা[সম্পাদনা]

১৯৫২ সালে জি. আর. জোসিয়ার এই গ্রন্থের অস্তিত্বের কথা প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর দাবি যে পণ্ডিত সুব্বারায় শাস্ত্রী (১৮৬৬–১৯৪০) ১৯১৮ ও ১৯২৩-এর মধ্যে এটি রচনা করেছিলেন। এর ২,০০০টি শ্লোক ৮টি অধ্যায় জুড়ে বিন্যস্ত এবং পণ্ডিত সুব্বারায় শাস্ত্রীর দাবি অনুযায়ী ভরদ্বাজ মুনি তাঁকে এই গ্রন্থটি দিয়েছিলেন।[৪] ১৯৪৪ সালে বরোদার রাজকীয় সংস্কৃত লাইব্রেরিতে এর পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছিল।[৫] ১৯৫৯ সালে এটি হিন্দি ভাষায়[৬] এবং ১৯৭৩ সালে জি. আর. জোসিয়ার Vymanika Shastra শিরোনামে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন।[৭] জোসিয়ারের সংস্করণে টি. কে. এল্লাপ্পা অঙ্কিত নকশা যোগ করা হয়েছিল, যিনি বেঙ্গালুরুর এক স্থানীয় প্রকৌশল কলেজের এক ড্রাফটসম্যান ছিলেন। তিনি পণ্ডিত সুব্বারায় শাস্ত্রীর নির্দেশে এই নকশাগুলো এঁকেছিলেন, যা ১৯৫৯-এর সংস্করণে পাওয়া যায়নি।[১]

কাঠামো ও বিষয়বস্তু[সম্পাদনা]

রুক্ম বিমানের এক নকশা।

বিমান চালনার কোনো আধুনিক সন্দর্ভ বিমানের গঠন নিয়ে আলোচনার আগে উড়ানের প্রাথমিক ধারণা নিয়ে আলোচনা দিয়ে শুরু হয়। কিন্তু বৈমানিক শাস্ত্র এক পরিমাণগত আলোচনা দিয়ে শুরু হয়, যেন কোনো নির্দিষ্ট বিমান নিয়ে আলোচনা করেছে। এটি যেসব বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করেছে তার মধ্যে বিমানের সংজ্ঞা, বিমান চালক, আকাশপথ, খাদ্য, বস্ত্র, ধাতু, ধাতু উৎপাদন, দর্পণ ও যুদ্ধক্ষেত্রে তার ব্যবহার, বিভিন্নরকম যন্ত্র, "মান্ত্রিক", "তান্ত্রিক" ও "ক্রিতক"-এর মতো বিমান এবং "শকুন", "সুন্দর", "রুক্ম" ও "ত্রিপুরা" এই চার বিমানের বিশদ বর্ণনা। সমগ্র রচনাটিকে যন্ত্র সর্বস্ব নামক এক বৃহত্তর রচনার এক ছোট অংশ (এক-চল্লিশাংশ) হিসেবে দাবি করা হয়, যা "সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ"-এর জন্য ভরদ্বাজ ও অন্যান্য মুনি এটি রচনা করেছিলেন।[১]

মূল্যায়ন[সম্পাদনা]

১৯৭৪ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান সংস্থার গবেষকেরা এটি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন যে বৈমানিক শাস্ত্রে বর্ণিত বায়ুর চেয়ে ভারী বিমান বায়ুগতীয়ভাবে সম্ভব নয়। লেখকগণ মন্তব্য করেছেন যে রচনাটিতে আলোচিত উড়ানের নীতিমালার বেশিরভাগই ভুল, এবং কিছুক্ষেত্রে নিউটনের গতিসূত্রদের বিঘ্নিত করছে।[৮] তাঁদের গবেষণার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বৈমানিক শাস্ত্রে উল্লেখিত বিমানগুলো কোনো বাস্তব কিছুর অভিব্যক্তি নয়, বরং এগুলো বিভিন্ন উপাদানের ত্রুটিপূর্ণ মিশ্রণ। তাঁদের মতে, এই গ্রন্থে উল্লেখিত কোনো বিমানের ওড়ার ক্ষমতা বা বৈশিষ্ট্য নেই; ওড়ার দৃষ্টিভঙ্গিতে এদের জ্যামিতি ভয়ঙ্কর এবং গ্রন্থে উল্লেখিত চালনা নীতি বিমানদের উড়তে সাহায্য না করে প্রতিহত করে। তাঁরা আরও যোগ করেছেন যে এই গ্রন্থের লেখা ও চিত্র পরস্পরের সঙ্গে সঙ্গত নয়; এর চিত্রগুলো আধুনিক যন্ত্রকৌশলের জ্ঞানকে চিহ্নিত করে, কারণ এর চিত্রকর এল্লাপ্পা এক স্থানীয় প্রকৌশল কলেজের ছাত্র ছিলেন; কিন্তু এর লেখা নিজেই অসম্পূর্ণ এবং দ্ব্যর্থতাপূর্ণ।[৩]

বিতর্ক[সম্পাদনা]

জানুয়ারি ২০১৫-এ মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয়তে সংগঠিত ১০২তম ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে প্রাচীন বিজ্ঞানের উপর এক অধিবেশন আয়োজন করেছিল। সেখানে বৈমানিক শাস্ত্রের উপর এক বক্তৃতা অন্তর্গত ছিল। বিমানচালক আনন্দ জে. বোডাস এবং সংস্কৃতে এমএ ও এম টেক ডিগ্রিধারী অমেয় যাদব এই বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আলোচনার সময় বোডাস বলেছিলেন যে বৈদিক যুগের বিমান কেবল এক দেশ থেকে অন্য দেশে নয়, এমনকি "এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে" উড়তে পারত। তাঁর মতে, তখনকার সময়ে বিমানগুলো আকারে অনেক বড় ছিল, এবং তারা ডানদিকে, বাঁদিকে ও পিছনদিকে চলাচল করতে পারত, যার তুলনায় আধুনিক বিমানগুলো কেবল সামনের দিকে চলাচল করে। নাসা বিজ্ঞানী রামপ্রসাদ গান্ধীরমন এই বক্তৃতাকে বাতিল করার জন্য অনলাইনে আবেদন করেছিলেন, কারণ এটি এক অপবিজ্ঞানের প্রদর্শন।[৯][১০]

ব্রায়ান রেগালের সিউডোসাইন্স: অ্য ক্রিটিকাল এনসাইক্লোপিডিয়া রচনার মতো অপবিজ্ঞান-বিষয়ক রচনায় বৈমানিক শাস্ত্র এবং সেখানে বর্ণিত বিমানের কথা উঠে এসেছে।[১১][১২] রেগালের মতে, বৈমানিক শাস্ত্রে বর্ণিত বিমান হচ্ছে প্রাচীন সংস্কৃতির উপাদানকে সমসাময়িক বর্ণনার সঙ্গে মানানসই করার অন্যতম প্রচেষ্টা এবং গভীর পর্যবেক্ষণের মধ্যে আনলে এটি অর্থহীন হয়ে পড়ে।[১২]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

গ্রন্থপঞ্জি[সম্পাদনা]

  • Childress, David Hatcher (১৯৯১)। Vimana Aircraft of Ancient India। Adventures Unlimited Press। আইএসবিএন 0-932813-12-7 
  • Kanjilal, Dileep Kumar (১৯৮৫)। Vimana in Ancient India : Aeroplanes Or Flying Machines in Ancient India। Sanskrit Pustak Bhandar। 
  • Mukunda, H. S.; Deshpande, S. M.; Nagendra, H. R.; Prabhu, A.; Govindraju, S. P. (১৯৭৪)। "A critical study of the work "Vyamanika Shastra"" (পিডিএফ)Scientific Opinion: 5–12। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৯-০৩  অজানা প্যারামিটার |name-list-style= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
  • Parivrajaka, Swami Brahmamuni (১৯৫৯)। Brihad Vimana Shastra। New Delhi: Sarvadeshik Arya Pratinidhi Sabha, Dayanand Bhavan। 
  • Shastry, Subbaraya; Josyer, G. R. (১৯৭৩)। Vymaanika Shaastra - Aeronautics by Maharshi Bharadwaaja। Mysore: Coronation Press। 
  • Regal, Brian (২০০৯)। Pseudoscience: A Critical Encyclopedia। ABC-CLIO। আইএসবিএন 9780313355080