বারাসত বিদ্রোহ

স্থানাঙ্ক: ২২°৪৭′৩৮″ উত্তর ৮৮°৪৮′৫৯″ পূর্ব / ২২.৭৯৪০১৯° উত্তর ৮৮.৮১৬৪৭৪° পূর্ব / 22.794019; 88.816474
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বারাসাত বিদ্রোহ ১৮৩১
মূল যুদ্ধ: ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন

শিল্পীর কল্পনায় বাঁশের কেল্লা
তারিখনভেম্বর ১৩, ১৮৩১
অবস্থান২২°৪৭′৩৮″ উত্তর ৮৮°৪৮′৫৯″ পূর্ব / ২২.৭৯৪০১৯° উত্তর ৮৮.৮১৬৪৭৪° পূর্ব / 22.794019; 88.816474
ফলাফল বিদ্রোহ দমন, বাঁশের কেল্লার পতন
অধিকৃত
এলাকার
পরিবর্তন
তিতুমীর ও তার চল্লিশ জন সহচর শহীদ হন। তার বাহিনীর প্রধান মাসুম খাঁ বা গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেওয়া হয় এবং বাশেঁর কেল্লা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
বিবাদমান পক্ষ

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি

পূড়ার জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র দেব

গোবরডাঙ্গার জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়
তিতুমীর
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী

তিতুমীর

গোলাম মাসুম
কর্নেল হার্ডিং
শক্তি
৮৬,০০০ সাধারণ গ্রাম্য কৃষক আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশ বাহিনী

বিদ্রোহের কারণ[সম্পাদনা]

পূর্ব বাংলায় (আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ) যখন ফরায়েজি আন্দোলন গড়ে উঠে, প্রায় একই সময়ে পশ্চিম বাংলায়ও আরেকটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। তিতুমীরের নেতৃত্বে পরিচালিত ‘তরীকায়ে মোহাম্মদীয়া’ আন্দোলন ছিল উত্তর ভারতের সৈয়দ আহমদ শহীদের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত। এ আন্দোলনেরও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রচলিত কুসংস্কার এবং অনৈসলামিক রীতিনীতি দূর করে ইসলামের আদর্শে বাংলার মুসলিম সমাজকে নিয়ন্ত্রিত করা। কিন্তু কৃষক সম্প্রদায়কে সংগঠিত করার কারণে জমিদারদের সাথে সংঘাত সৃষ্টি হয় এবং শেষ পর্যন্ত এটি সরকার বিরোধী আন্দোলনের রূপ নেয়। মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার বাদুড়িয়া থানার হায়দার পুর গ্রামে জন্মগ্রহণ গ্রহণ করেন। বাল্যকালে তিনি গ্রামের এক মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেন এবং সে গ্রামের ব্যায়ামাগারে কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে একজন কুস্তিগির হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। কিছুদিন তিনি নদীয়ার এক জমিদারের লাঠিয়ালের চাকরি করেন। পরে মক্কা শরীফে হজ্জ করতে যান। সেখানে তিনি বিখ্যাত আলেম ও বিদ্রোহী নেতা সৈয়দ আহমদ শহীদের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন। ১৮২৭ সালে দেশে ফিরে তিতুমীর ধর্ম সংস্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ঐ যুগে বাংলার মুসলমানদের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবন নানা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। তিতুমীর মুসলমানদেরকে পীরের কাছে নত হওয়া, মাজার তৈরি করা, মৃতের উদ্দেশ্যে কিছু নিবেদন করা,মহররম অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া ইত্যাদি বন্ধ করার জন্য নির্দেশ দেন। হিন্দু বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি বসবাস করার ফলে মুসলমানদের সংস্কৃতি ও সমাজ জীবনে যে ভিন্ন প্রভাবের অনুপ্রবেশ ঘটে, সে সমস্ত দূর করে ইসলাম ধর্মের আদি বিশুদ্ধতা ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি প্রচেষ্টা চালান। অল্প সময়ের মধ্যে কয়েকশ মুসলমান তিতুমীরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। তারা দাঁড়ি রাখত এবং বিশেষ পোশাক পরত। তাঁর অনুসারীদের মধ্যে এমন গোঁড়ামী সৃষ্টি হয় যে,অন্য মুসলমানদের সঙ্গেও তাদের বিরোধ বাঁধে। তবে এর চেয়ে বেশি তীব্র হয়েছিল হিন্দু জমিদারদের প্রতিক্রিয়া। চব্বিশ পরগনা এবং নদীয়া জেলার বহু কৃষক ও তাঁতী তিতুমীরের আন্দোলনে সাড়া দেয়। মুসলমান প্রজাদের সংঘবদ্ধ হতে দেখে স্থানীয় হিন্দু জমিদারদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। তারা তিতুমীরের অনুসারীদের সংখ্যা বৃদ্ধির পথ বন্ধ করার উপায় খুঁজতে থাকে এবং প্রজাদের উপর অযথা উৎপীড়ন শুরু করে। তারাগুনিয়ার জমিদার রাম নারায়ণ, পূঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায় এবং আরো অনেকে তাদের জমিদারিতে মুসলমান রায়তদের প্রত্যেকের দাঁড়ি রাখার উপর আড়াই টাকা হারে কর ধার্য করেন। সরফরাজপুরের প্রজাগণ এই অন্যায় কর প্রদানে অস্বীকার করলে তাদের উপর নেমে আসে অমানবিক অত্যাচার ও নির্যাতন। তিতুমীর এ সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের কাছে সুবিচার চেয়ে সম্পূর্ণভাবে নিরাশ হন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে অত্যাচারের প্রতিকার না হওয়ায় অবশেষে তিনি সশস্ত্র প্রতিরোধের পথ বেছে নেন।

ঘটনাবলী[সম্পাদনা]

১৮৩১ সালের অক্টোবর মাসে তিতুমীর ও তাঁর সমর্থকরা তাদের প্রধান ঘাঁটি নারিকেলবাড়িয়া গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে একটি মজবুত বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করা হয়। গোলাম মাসুমের নেতৃত্বে গড়ে উঠে একটি সুদক্ষ লাঠিয়াল ও প্রতিরোধ বাহিনী। এবার তিতুমীরের অনুসারীরা জমিদারদের অন্যায়ের প্রতিকারের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। লাউঘাটায় এক সংঘর্ষে জমিদার দেবনাথ রায় নিহত হন। পার্শ্ববর্তী অনেকগুলো গ্রামের উপর তিতুমীরের বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। জমিদারদের প্ররোচনায় মুলাহাটির নীলকুঠির পক্ষ থেকে তিতুমীরের সমর্থকদের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নেয়ায় তাঁর বাহিনী নীলকুঠি আক্রমণ করে তা লুন্ঠন করে কুঠির তত্ত্বাবধায়ককে বন্দি করে নিয়ে যায়। ভীত সন্ত্রস্ত জমিদার ও নীলকররা ইংরেজ সরকারের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন পাঠায়। বৃটিশ সরকার শীঘ্রই তিতুমীরের বিরুদ্ধে বারাসতের ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে একদল সৈন্য পাঠায়। কিন্তু তারা শোচনীয় পরাজয়বরণ করে এবং তাদের ১৫ জন নিহত ও বহু আহত হয়। আলেকজান্ডারকে সহায়তা দানের অভিযোগে তিতুমীরের সমর্থকরা কয়েকটি নীলকুঠি লুণ্ঠন করে। কৃষ্ণনগরের ম্যাজিস্ট্রেট ৩০০ সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। কিন্তু এবারও ইংরেজ সৈন্যরা পরাজিত ও বিতাড়িত হয়।

তিতুমীর বর্তমান চব্বিশ পরগনা, নদীয়া এবং ফরিদপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিকার নিয়ে সেখানে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। নিজেকে 'বাদশাহ করে মৈনুদ্দিন নামে জনৈক ওয়াহাবীকে প্রধানমন্ত্রী ও তার ভাগ্নে গোলাম মাসুমকে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। স্থানীয় জমিদারদের নিজস্ব বাহিনী এবং ব্রিটিশ বাহিনী তিতুমীরের হাতে বেশ কয়েকবার পরাজয় বরণ করে। তন্মধ্যে বারাসত বিদ্রোহ অন্যতম। উইলিয়াম হান্টার বলেন, ঐ বিদ্রোহে প্রায় ৮৩ হাজার কৃষকসেনা তিতুমীরের পক্ষে যুদ্ধ করেন।[১]

অবশেষে ১৮৩১ সালের ১৩ নভেম্বর ব্রিটিশ সৈন্যরা তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তিতুমীর স্বাধীনতা ঘোষণা দিলেন, "ভাই সব, একটু পরেই ইংরেজ বাহিনী আমাদের কেল্লা আক্রমণ করবে। লড়াইতে হার-জিত আছেই, এতে আমাদের ভয় পেলে চলবে না। দেশের জন্য শহীদ হওয়ার মর্যাদা অনেক। তবে এই লড়াই আমাদের শেষ লড়াই নয়। আমাদের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েই এ দেশের মানুষ একদিন দেশ উদ্ধার করবে। আমরা যে লড়াই শুরু করলাম, এই পথ ধরেই একদিন দেশ স্বাধীন হবে।"[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] ১৪ নভেম্বর কর্নেল হার্ডিং-এর নেতৃত্বে ব্রিটিশ সৈন্যরা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তার অনুসারীদের আক্রমণ করে।[২] তাদের সাধারণ তলোয়ার ও হালকা অস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তার সৈন্যরা ব্রিটিশ সৈন্যদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে দাঁড়াতে পারে নি।

ফলাফল[সম্পাদনা]

তিতুমীর ও তার চল্লিশ জন সহচর শহীদ হন। তার বাহিনীর প্রধান মাসুম খাঁ বা গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেওয়া হয় এবং বাশেঁর কেল্লা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]