বাংলার দুর্গাপ্রতিমার ধ্রুপদী শিল্পরীতি
বাংলার দুর্গাপ্রতিমার ধ্রুপদী শিল্পরীতি | |
---|---|
পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বাংলাদেশ ও আসাম নিয়ে প্রাচীন বঙ্গদেশে গঠিত। বাংলা হাজার হাজার বছরের শক্তি উপাসনার পীঠস্থান। বঙ্গদেশে শক্তি উপাসনায় অন্যতম প্রধান আরাধ্যা দেবী হলেন মহিষাসুরমর্দিনী। তার বাৎসরিক পূজানুষ্ঠান বাংলার হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব এবং ধ্রুপদী বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম উপাদানও বটে। এই দুর্গোৎসবকে ঘিরে বাংলার মৃৎশিল্প বিকশিত হয়েছে।
প্রকারভেদ
[সম্পাদনা]বাংলার দুর্গা প্রতিমা তৈরির প্রাচীন রীতিকে মূলত দুটি ভাবে ভাগ করা হয়েছে। একটি হলো "বিষ্ণুপুর রীতির প্রতিমা" ও অন্যটি হল "কংসনারায়ণ রীতির প্রতিমা"। বাৎসরিক শারদীয়া পুজোর সময় পাথরের মূর্তির পরিবর্তে কাদা মাটি দিয়ে মূর্তি নির্মানের রীতি আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছরের পূর্বে সূচনা হয়েছে। বাংলার প্রতিমা শিল্পে কাদামাটির ব্যবহারের পথিকৃৎ ছিলেন বাংলার দুই রাজা। একজন হলেন পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের মল্লরাজা জগৎমল্ল, অপর জন পূর্ববঙ্গের( বর্তমানে বাংলাদেশ) রাজশাহীর তাহেরপুরের কংসনারায়ণ। তারা দুই জন দুটি পৃথক ধ্রুপদী বাংলা রীতির মৃৎপ্রতিমা নির্মাণ শুরু করেন। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে এই দুই ধ্রুপদী রীতির প্রতিমা শিল্পের প্রচলন রয়েছে।
বিষ্ণুপুর রীতির প্রতিমা
[সম্পাদনা]রাজা জগৎমল্ল সর্বপ্রথম এই রীতির সূচনা করেন।তিনি ৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে মৃন্ময়ী মাতা, বিষ্ণুপুরর প্রতিমা নির্মাণ করে মন্দির স্থাপনের সময় এই রীতি উদ্ভাবন করেন। বর্তমানে বিষ্ণুপুর এর মৃন্ময়ী মাতার প্রতিমা ছাড়াও বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা রাজবাড়ী গুলি এই রীতির অনুসরণে প্রতিমা নির্মাণ করেন। তবে কংসনারায়ণ রীতি অপেক্ষা এটি কম জনপ্রিয়। শুধুমাত্র বাঁকুড়া জেলা ও রাঢ় বাংলার হাতে গোনা কিছু পরিবারে এই রীতি অনুসৃত হয়। এই প্রতিমার কাঠামোর দুর্গা মূর্তির উপরের দিকে থাকে গণেশ ও কার্তিক এবং নিচে থাকে লক্ষী ও সরস্বতী। প্রতিমার পেছনে পটে আঁকা কোনো চালি থাকে না। পরিবর্তে মহাদেব তার দুই অনুচর নন্দী ও ভিঙ্গির সাথে সশরীরে প্রতিমার কাঠামোর উপরে অবস্থান করেন। রাঢ় দেশের বহু স্থানে সমগ্র দুর্গা মূর্তির পরিবর্তে শুধু মায়ের মুখ থাকে।[১]
কংসনারায়ণ রীতির প্রতিমা
[সম্পাদনা]কংসনারায়ণ এর বহুকাল আগে থেকেই বঙ্গদেশে দুর্গাপুজোর প্রচলন থাকলেও , কংসনারায়ন বিপুল অর্থ প্রায় ৮ লক্ষ টাকা ব্যয়ে বঙ্গদেশে যে দুর্গোৎসবের সূচনা করে তা বাঙালি সমাজে কিংবদন্তি তৈরি করেছিলো। কাজেই কংসনারায়ণ রীতি সমগ্র বঙ্গদেশে ছড়িয়ে পড়ে। নদিয়া রাজ কৃষ্ণচন্দ্র এই রীতিকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে। এই রীতির প্রধান বৈশিষ্ট হলো একচালার দুর্গাপ্রতিমার চালি উপরের দিকে লক্ষ্মী ও সরস্বতী এবং নিচে গণেশ ও কার্তিকের অবস্থান। প্রতিমার পেছনে অর্ধ চন্দ্রাকার চালি তথা চালচিত্রের ব্যবহার। যে চালিতে মূলত দশমহাবিদ্যা ও মহাদেবের অবস্থান। এই ধরনের চালিকে বাংলা চালি বলা হয়। প্রতিমার মুখের আদলে থাকে অভিনবত্ব। দেবী প্রতিমায় থাকতো টানাটানা চোখ ও টিয়াপাখির ঠোঁটের মত বাঁকানো নাক। দেবীর দুই গাল সামান্য চাপা । এই ধরনের মুখের আদলকে বলা হয় বাংলা মুখ । দেবী প্রতিমার বর্ন গাঢ় হলুদ। এই ধরনের প্রতিমা এখন কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ জমিদার ও রাজবাড়ীগুলির দুর্গা প্রতিমা এই ধ্রুপদী রীতি অনুসরণ করেই নির্মাণ করা হয়। তবে সাবেকি রীতির প্রতিমা নির্মাণে স্থান ও সময় ভেদে কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়।[২] কিছু কিছু রাজবাড়ীর নিজস্ব রীতি থাকে। যেমন বাংলা চালির পরিবর্তে মার্কিনি চালি অধিক ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও কংসনারায়ণ রীতিতে টানাচৌরি চালি , মঠচৌরি চালির ব্যবহার দেখা যায়।
দুই প্রতিমা নির্মাণ রীতির তুলনা
[সম্পাদনা]বিষ্ণুপুর রীতি কংসনারায়ণ অপেক্ষা অধিকতর প্রাচীন হলেও কংসনারায়ন রীতি বঙ্গদেশে অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে। রাজা কংসনারায়ণ বিপুল অর্থ ব্যায়ে জাকজমক করে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন, ফলস্বরূপ তৎকালীন সমগ্র বঙ্গ সহ বঙ্গের বাহিরে পুজোর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার স্থানীয় জমিদার ও রাজাদের কাছে বিষ্ণুপুর অপেক্ষা কংসনারায়ণের পুজো অধিক পরিচিতি লাভ করার দারুন বাংলার রাজা ও জমিদাররা কংসনারায়ণ ঘরানাকে অনুসরণ করতে থাকেন।
চিত্র
[সম্পাদনা]-
ধ্রূপদী দুর্গা
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "রাজশাহীর তাহেরপুরে বাংলার প্রথম দুর্গাপুজোর স্থানটি এখন অবহেলায়"।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ "রাজা কংসের হাতে ৮০০ বছর আগে শুরু হয় পুজো"। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬। Authors list-এ
|প্রথমাংশ1=
এর|শেষাংশ1=
নেই (সাহায্য)