বঙ্গীয় শব্দকোষ
বঙ্গীয় শব্দকোষ একটি বাংলা অভিধান। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত এবং অধ্যাপক শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক সঙ্কলিত এই অভিধান ১৩৪১ বঙ্গাব্দে কলকাতায় প্রথম প্রকাশিত হয় ও বিশ্বকোষ প্রেস থেকে মুদ্রিত হয়। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লিখিত বিবৃতি অনুসারে আনুমানিক ১৩১১ বঙ্গাব্দে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাংলা ভাষায় একটি অভিধান প্রণয়নের জন্য অনুরোধ করেন।[১] সেই সময় তিনি কবিরই নির্দেশে ছাত্রদের পাঠার্থ সংস্কৃতপ্রবেশ গ্রন্থের রচনাকার্যে ব্যাপৃত ছিলেন। সেই কারণে পরে অর্থাৎ ১৩১২ বঙ্গাব্দে সংস্কৃতপ্রবেশ সমাপ্ত করে রবীন্দ্রনাথের অনুমতিক্রমে তিনি অভিধানরচনায় আত্মনিয়োগ করেন।
সূচনা
[সম্পাদনা]গ্রন্থের সূচনালগ্নে সঙ্কলয়িতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কোন অভিজ্ঞ আভিধানিকেরই সাহায্যলাভ করেননি। কোন পথপ্রদর্শক না থাকা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ স্বচেষ্টায় এবং পরিশ্রমে তিনি এই বিশাল শব্দকোষগ্রন্থ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। গ্রন্থের ভূমিকায় শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই লিখেছেন:
“ | তখন অভিধান-রচনার অনুরূপ উপকরণসঞ্চয়ের নিমিত্ত প্রস্তুত হইলাম এবং অধ্যাপনার অবসানে নানা বাঙলা পুস্তক পাঠ করিয়া প্রয়োজনীয় বিষয় সংগ্রহ করিতে লাগিলাম। আশ্রমের গ্রন্থাগারে যে সকল প্রাচীন বাঙলা গ্রন্থ ছিল, প্রথমে তাহা হইতেই অনেক শব্দ সংগৃহীত হইল। এই সময়ে প্রাচীন ও আধুনিক প্রায় পঞ্চাশখানি গদ্য-পদ্য গ্রন্থ দেখিয়াষিলাম। তদ্ভিন্ন সেই সময়ে প্রকাশিত বাঙলাভাষার অভিধান, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা সমুহে প্রকাশিত প্রাদেশিক শব্দমালা ও বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কৃত শব্দসংগ্রহ হইতে অনেক শব্দ সঞ্চিত হইয়াছিল। প্রাকৃতব্যাকরণ হইতেও অনেক বাঙলা শব্দের মূল সংস্কৃত শব্দ ও তদ্ভব শব্দও কিছু লিপিবদ্ধ করিয়াছিলাম। ইহাতে আমার প্রায় দুই বৎসর অতীত হয়। ১৩১৪ সালের ১৬ চৈত্র আমার শব্দ-সংগ্রহের সমাপ্তির দিন। | ” |
এরপর সঙ্কলয়িতা সংগৃহীত শব্দসকল প্রায় দুই বছর কাল অতিবাহিত করে বর্ণানুক্রমে নিবদ্ধ করেন। ১৩১৭ সালের বৈশাখের প্রারম্ভেই তার শব্দানুক্রমিকা সমাপ্ত হয়। পরে তিনি বাংলা শব্দের সঙ্গে বর্ণানুক্রমে সংস্কৃত শব্দ সংযোজিত করে শব্দের ব্যুৎপত্তি ও শিষ্টপ্রয়োগ সহ অর্থ লিখতে আরম্ভ করেন। এখান থেকেই প্রকৃতপক্ষে অভিধানের মূল অবয়বের সূচনা। অভিধান-রচনা কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর ১৩১৮ সালে আষাঢ় মাসে আর্থিক অসঙ্গতির কারণে শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়কে কলকাতায় চাকুরি গ্রহণ করতে হয় এবং এর ফলে অভিধান প্রণয়ন ভীষণভাবে ব্যাহত হয়।তখন তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে সকল সমস্যা ব্যক্ত করেন। কবিবরের অনুরোধে মহারাজ মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী সঙ্কলয়িতাকে মাসিক পঞ্চাশ টাকা বৃত্তি প্রদান করতে স্বীকৃত হলেন। এর কয়েকদিন পরেই শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় কবির নির্দেশে শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনার কাজে পুনর্নিযুক্ত হলেন। তখন পুনরায় তিনি পূর্বমত শব্দকোষ রচনাকার্যে মনোনিবেশ করতে সক্ষম হলেন। এইভাবে ত্রয়েদশ বছর সুকঠিন পরিশ্রম করে ১১ মাঘ ১৩৩০ সালে শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় এই সুবৃহৎ অভিধান সমাপ্ত করেন।
প্রথম প্রকাশ
[সম্পাদনা]১৩৩০ সালের সঙ্কলয়িতা তার সমসাময়িক প্রসিদ্ধ কবি এবং সাহিত্যিকগণের নির্বাচিত সাতচল্লিশটি গ্রন্থ থেকে দ্বিতীয়বার শব্দসংগ্রহ ও সংযোজন করে চৈত্র মাসে পূর্বপ্রণীত পাণ্ডুলিপির সংস্কারসাধনে প্রবৃত্ত হন। এর অনতিকাল পরে বিশ্বভারতী তার সঙ্কলিত অভিধানটি প্রকাশের ইচ্ছাপ্রকাশ করেও অর্থাভাবে এই সুবৃহৎ গ্রন্থ মুদ্রণে অসমর্থ হয়। তখন সঙ্কলয়িতা শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের Post-Graduate Teaching in Arts –এর ব্যবস্থাপক সমিতির সভাপতির নিকট গ্রন্থ প্রকাশের জন্য আবেদন করেন। উক্ত সভাপতি মহাশয় এ বিষয়ে অভিমতপ্রকাশের জন্য অধ্যাপক ভাষাচার্য শ্রী সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে অনুরোধ করেন। শ্রী চট্টোপাধ্যায় যেহেতু পূর্বেই পাণ্ডুলিপিটি পাঠ করেছিলেন সেহেতু তিনি কালবিলম্ব না করেই সাগ্রহে অভিধানপ্রকাশবিষয়ে অনুমতি প্রদান করলেন। কিন্তু বিশ্বভারতীর মতই ব্যয়বাহুল্যের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় আর এ ব্যাপারে অগ্রসর হয়নি। ভাষাচার্য শ্রী সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের অশেষ প্রয়াস সত্ত্বেও সেই সময় গ্রন্থপ্রকাশ সম্ভব হল না। তখন অভিধানসঙ্কলয়িতা স্বয়ং স্ব-অর্থব্যয়ে ১৩৪০ সাল থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে এই অভিধানের ধারাবাহিক প্রকাশ আরম্ভ করেন। ১৩৫৩ সালে ১০৫ খণ্ডে এই মুদ্রণ পরিসম্পন্ন হয়। এর অনতিকালপরে ১০৫ খণ্ডের এই অভিধান পাঁচ ভাগে ক্রমে ক্রমে প্রচারিত হয়।
অভিধান প্রসঙ্গে বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ববর্গের অভিমত
[সম্পাদনা]নোবেলজয়ী কবি এবং শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একান্ত শুভানুধ্যায়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষার এই সম্পদ প্রসঙ্গে লিখেছেন,
“ | শান্তিনিকেতন-শিক্ষাভবনের সংস্কৃত অধ্যাপক শ্রীযুক্ত হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সুদীর্ঘকাল বাংলা অভিধান সঙ্কলন কার্য্যে নিযুক্ত আছেন। তাঁহার এই বহুবর্ষব্যাপী অক্লান্ত চিন্তা ও চেষ্টা আজ সম্পূর্ণতা লাভ করিয়া সর্ব্বসাধারণের নিকট উপস্থিত হইল। তাঁহার এই অধ্যবসায় যে সার্থক হইয়াছে, আমার বিশ্বাস সকলেই তাহার সমর্থন করিবেন। | ” |
(শান্তিনিকেতন, ৮ আশ্বিন ১৩৩৯)
বিশিষ্ট সাহিত্যিক রাজশেখর বসুও শ্রী চট্টোপাধ্যায়ের এই প্রয়াসকে সাধুবাদ জ্ঞাপন করে লিখেছেন,
“ | কেহই শ্রীযুক্ত হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের ন্যায় বিরাট কোষগ্রন্থ সংকলনের প্রয়াস করেন নাই। বঙ্গীয় শব্দকোষে প্রাচীন ও আধুনিক সংস্কৃতেতর শব্দ (তদ্ভব দেশজ বৈদেশিক প্রভৃতি) প্রচুর আছে। কিন্তু সংকলয়িতার পক্ষপাত নাই, তিনি বাঙলা ভাষায় প্রচলিত ও প্রয়োগযোগ্য বিশুদ্ধ সংস্কৃত শব্দের সংগ্রহে ও বিবৃতিতে কিছুমাত্র কার্পণ্য করেন নাই। যেমন সংস্কৃত শব্দের ব্যুৎপত্তি দিয়াছেন, তেমনি অসংস্কৃত শব্দের উৎপত্তি যথাসম্ভব দেখাইয়াছেন। এই সমদর্শিতার ফলে তাঁহার গ্রন্থ যেমন মুখ্যত বাঙলা সাহিত্যের প্রয়োজনসাধক হইয়াছে, তেমনি গৌণত সংস্কৃত সাহিত্য চর্চারও সহায়ক হইয়াছে। সংস্কৃত মৃত ভাষা কিন্তু গ্রিক লাটিনের তুল্য মৃত নয়। ভাগ্যবতী বঙ্গভাষা সংস্কৃত শব্দের অক্ষয় ভাণ্ডারের উত্তরাধিকারিণী, এবং এই বিপুল সম্পৎ ভোগ করিবার সামর্থ্যও বঙ্গভাষার প্রকৃতিগত। আমাদের ভাষা যতই স্বাধীন স্বচ্ছন্দ হউক, খাঁটী বাঙলা শব্দের যতই বৈচিত্র ও ব্যঞ্জনা-শক্তি থাকুক, বাঙলা ভাষার লেখককে পদে পদে সংস্কৃত ভাষার শরণ লইতে হয়। কেবল নূতন শব্দের প্রয়োজনে নয়, সুপ্রচলিত শব্দের অর্থপ্রসার করিবার নিমিত্তও। অতএব বাঙলা অভিধানে যত বেশি সংস্কৃত শব্দের বিবৃতি পাওয়া যায় ততই বাঙলা সাহিত্যের উপকার। বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় এই মহোপকার করিয়াছেন। তিনি সংস্কৃত শব্দের বাঙলা প্রয়োগ দেখিয়াই ক্ষান্ত হন নাই, সংস্কৃত সাহিত্য হইতে রাশি রাশি প্রয়োগের দৃষ্টান্ত আহরণ করিয়াছেন। এই বিশাল কোষগ্রন্থে যে শব্দসম্ভার ও অর্থবৈচিত্র্য রহিয়াছে তাহাতে কেবল বর্তমান বাঙলা সাহিত্যের চর্চা সুগম হইবে এমন নয়, ভবিষ্যৎ সাহিত্যও সমৃদ্ধিলাভ করিবে। | ” |
(৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৪)
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "রবীন্দ্রনাথকে অর্পণ করেন তাঁর দুটি চোখ"। anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-১৮।
- বঙ্গীয় শব্দকোষ, সাহিত্য অকাদেমি