ফাঁসি
ফাঁসি মৃত্যুদণ্ড দানের বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি। আধুনিক বিশ্বের যে সকল দেশে মৃত্যু রহিত করা হয় নি সে সব দেশের অনেকগুলোর আইনে মৃত্যুদণ্ড কার্য করার পদ্ধতি হিসেবে ‘মৃত্যু অবধি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখা’র বিধান রয়েছে।
ইতিহাস
[সম্পাদনা]মধ্যযুগ থেকেই পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই মৃত্যুদণ্ড দানের ক্ষেত্রে ফাঁসির পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। হোমারের ওডিসি গ্রন্থেও ফাঁসি দ্বারা মৃত্যুর পন্থা বর্ণিত আছে। আধুনিক যুগে সামরিক আইনের বিচারে ফায়ারিং স্কোয়াড, সাধারণ আইনে ইলেকট্রিক শক এবং ইসলামি শরিয়তি বিধানে প্রস্তর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিধান থাকলেও বর্তমানে অধিকাংশ দেশে মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্ত অপরাধীকে ফাঁসির মাধ্যমে সাজা দেওয়া হয়ে থাকে।
স্বাধীন ভারতে প্রথম ফাঁসি দেওয়া হয় মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকে (১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে)[১]
মৃত্যুদণ্ডতে ফাঁসির পদ্ধতি
[সম্পাদনা]সংক্ষিপ্ত ড্রপ
[সম্পাদনা]শর্ট ড্রপ হল ফাঁসির একটি পদ্ধতি যেখানে দণ্ডিত বন্দী গলায় ফাঁস দিয়ে মল, মই, গাড়ি বা অন্যান্য যানের মতো উঁচু সমর্থনে দাঁড়িয়ে থাকে। দড়ি থেকে ঝুলে থাকা ব্যক্তিকে রেখে সমর্থনটি তখন সরে যায়।
ঘাড় দ্বারা স্থগিত, শরীরের ওজন ঘাড়ের চারপাশে ফাঁস শক্ত করে, শ্বাসরোধ এবং মৃত্যুকে প্রভাবিত করে। এটি সাধারণত 10-20 মিনিট সময় নেয়।
1850 সালের আগে, শর্ট ড্রপ ছিল ফাঁসির আদর্শ পদ্ধতি, এবং এটি এখনও আত্মহত্যা এবং বিচারবহির্ভূত ফাঁসিতে সাধারণ (যেমন লিঞ্চিং এবং সংক্ষিপ্ত মৃত্যুদণ্ড ) যা নতুন পদ্ধতিতে ব্যবহৃত বিশেষ সরঞ্জাম এবং ড্রপ-দৈর্ঘ্য গণনা টেবিল থেকে উপকৃত হয় না।
স্ট্যান্ডার্ড ড্রপ
[সম্পাদনা]সাধারণত ফাঁসির মঞ্চে তোলার আগে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির দুই হাত পেছনের দিকে বাঁধা হয়। এসময় উপস্থিত থাকবেন কারা কর্তৃপক্ষ, সিভিল সার্জন, একজন ম্যাজিস্ট্রেট এবং ফাঁসিদার বা জল্লাদ। মঞ্চে তোলার পর আসামির দুই পা বাঁধা হয়। গলায় পরানো হয় ফাঁসির দড়ি। ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে একটি রুমাল থাকবে। রুমালটি হাত থেকে নিচে ফেলে দেয়ার সাথে সাথেই জল্লাদ ফাঁসির লিভারে টান দেন সঙ্গে সঙ্গে ফাঁসির মঞ্চে আসামির পায়ের নিচের তক্তাটি সরে যায় এবং আসামি শূন্যে ঝুলে থাকে। মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে গেলে ফাঁসির দড়ি থেকে নামানোর পর সব শেষে আসামির দুই পায়ের রগ কেটে তার মৃত্যু সম্পূর্ণ নিশ্চিত করে সিভিল সার্জন ও কারা কর্তৃপক্ষ।
ফাঁসির মঞ্চ
[সম্পাদনা]ফাঁসিতে যে কারণে মৃত্যু ঘটে
[সম্পাদনা]আত্মহত্যায় ফাঁসি
[সম্পাদনা]ফাঁসি হচ্ছে আত্মহত্যার জন্য একটি সাধারণ পদ্ধতি।
আগ্নেয়াস্ত্র বা বিষের দ্বারা আত্মহত্যার তুলনায়, ফাঁসির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সহজেই ব্যক্তির থাকে যেমন রশি,ওড়না,শাড়ি ইত্যাদি । তাই ফাঁসিই আত্মহত্যার জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পন্থা।
কানাডায় সবচেয়ে বেশি ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করা হয়।
বিশ্বব্যাপী উল্লেখযোগ্য অনুশীলনগুলি
[সম্পাদনা]ভারত
[সম্পাদনা]ফাঁসির প্রচলন করেছিল ব্রিটিশরা। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে সমস্ত মৃত্যুদণ্ড ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, যদিও আইনে ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে সামরিক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিধান রয়েছে। 1949 সালে, নাথুরাম গডসে , যিনি মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার জন্য মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন , তিনি ছিলেন স্বাধীন ভারতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা প্রথম ব্যক্তি।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট পরামর্শ দিয়েছে যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত শুধুমাত্র "বিরলতম ক্ষেত্রে"। দিল্লি জেল ম্যানুয়ালের ৮৭২ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, সূর্যোদয়ের আগে আসামীর ফাঁসির উল্লেখ রয়েছে। সরকারি ছুটির দিনে আসামীর ফাঁসি হয় না। সহবন্দীর মৃত্যদণ্ড প্রত্যক্ষ করতে পারেন না জেলে থাকা অপর বন্দিরা। যে দোষীকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে তাকেও আগে থেকে ফাঁসির মঞ্চ দেখানো হয় না। ফাঁসির প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া ও মৃতদেহ না সরিয়ে ফেলা পর্যন্ত সকল বন্দিকে আটকে রাখা হয় সংশোধনাগারে। কাউকে ফাঁসির মঞ্চের কাছাকাছি স্থান পর্যন্তও ঘেঁষতে দেওয়া হয় না। জেল ম্যানুয়াল অনুযায়ী ফাঁসি প্রক্রিয়া সময় একমাত্র উপস্থিত থাকতে পারে জেল সুপারইনটেনডেন্ট, ডেপুটি সুপারইনটেনডেন্ট, মেডিক্যাল অফিসার ইন চার্জ ও রেসিডেন্ট মেডিক্যাল অফিসার। এছাড়াও ম্যানুয়ালে উল্লেখ রয়েছে, স্থানীয় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মৃত্য়দণ্ড কার্যকর হওয়ার সময় উপস্থিত থাকবেন ও ওয়ারেন্টে পালটা স্বাক্ষর করবেন। ম্য়ানুয়ালে আরও উল্লেখ রয়েছে, জেল সুপারইনটেন্ট বিবেচনা সাপেক্ষে ফাঁসির সময় সাজাপ্রাপ্ত আসামীর ইচ্ছাকে মান্যতা দিয়ে তাঁর আস্থাভাজন নিজ ধর্মের পূজারিকে উপস্থিত থাকার অনুমতি দিতে পারেন।" সাজাপ্রাপ্ত আসামীর আত্মীয় বা অন্য বন্দিদের ফাঁসির সময় উপস্থিত থাকার অনুমতি নেই। তবে নিয়মে কয়েকটি ব্যতিক্রমও রয়েছে। ব্যতিক্রমী কয়েকটি ক্ষেত্রে ফাঁসির সাক্ষী হতে পারেন কয়েকজন। ম্যানুয়ালে বলা হয়েছে, সরকারের থেকে অনুপতি সাপেক্ষে জেল সুপারইনটেনডেন্ট সমাজ বিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের ফাঁসি প্রক্রিয়া দেখার অনুমতি দিতে পারেন। তবে সেক্ষত্রে তাঁরাই একমাত্র মৃত্যুদণ্ড প্রত্যক্ষ করার অনুমতি পাবেন যাঁরা মৃত্যুদণ্ড সংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন। ম্যানুয়ালটিতে বলা হয়েছে, "ফাঁসি প্রক্রিয়ায় কারও সাক্ষী থাকার বিষয়টি নির্ভর করবে জেল সুপারিনটেনডেন্টের বিচক্ষণতার উপর। তাঁর সিদ্ধান্তকেই এক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে।" উপরিউক্ত তালিকাভুক্ত ছাড়াও দশজন কনস্টেবল ও দুইজন হেড কনস্টেবল-সহ কমপক্ষে ১২ জন গার্ড প্রতিটি ফাঁসির সময় উপস্থিত থাকবেন।[২]
2001 সাল থেকে ভারতে আটজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। 1991 সালের ধর্ষক ও খুনি ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়কে 14 আগস্ট 2004-এ কলকাতার আলিপুর জেলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল । 2008 সালের মুম্বাই হামলার একমাত্র জীবিত সন্ত্রাসী আজমল কাসাবকে 21 নভেম্বর 2012-এ পুনের ইয়েরওয়াদা সেন্ট্রাল জেলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল । ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এর আগে তার করুণার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিল, যা পরে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এক সপ্তাহ পর তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ভারতীয় সংসদে 2001 সালের ডিসেম্বরে হামলার ষড়যন্ত্রের জন্য দোষী সাব্যস্ত সন্ত্রাসী আফজাল গুরুকে 9 ফেব্রুয়ারি 2013 তারিখে দিল্লির তিহার জেলে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। ইয়াকুব মেমন 27 জুলাই 2007-এ বিশেষ সন্ত্রাসবাদী এবং বিঘ্নিত কার্যকলাপ আদালত দ্বারা 1993 সালের বোম্বে বোমা হামলায় জড়িত থাকার জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। তার আপিল এবং ক্ষমার আবেদন সবই প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল এবং অবশেষে 30 জুলাই 2015 তারিখে নাগপুর জেলে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল । 2020 সালের মার্চ মাসে, তিহার জেলে ২০১২ দিল্লি গণধর্ষণ ও হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত চার বন্দিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Famous Murder Trial, P.K. Das (২০১০)। Mahatma Gandhi Assacination case। Delhi: Universal Law Publishing। পৃষ্ঠা 19। আইএসবিএন 978-81-7534-605-5।
- ↑ "Death penalty in India"।
আরো দেখুন
[সম্পাদনা]বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]- A Case Of Strangulation Fabricated As Hanging
- Obliquity vs. Discontinuity of ligature mark in diagnosis of hanging – a comparative study
- Death Penalty Worldwide ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৩ নভেম্বর ২০১৩ তারিখে Academic research database on the laws, practice, and statistics of capital punishment for every death penalty country in the world.