পাইন প্রসেশনারী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

পাইন প্রসেশনারী
নিজস্ব ঢংয়ে মিছিলরত পাইন প্রসেশনারী শূককীট
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ: Animalia
পর্ব: Arthropoda
শ্রেণী: Insecta
বর্গ: Lepidoptera
পরিবার: Thaumetopoeidae
গণ: Thaumetopoea
প্রজাতি: T. pityocampa
দ্বিপদী নাম
Thaumetopoea pityocampa
ডেনিস এবং স্কিফারমুলার, ১৭৭৫

পাইন প্রসেশনারি (Thaumetopoea pityocampa) হল Thaumetopoeidae গোত্রের অন্তর্ভুক্ত মথ প্রজাতি। একে মাঝে মাঝে Traumatocampa গণের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটি মধ্য এশিয়া, উত্তর আফ্রিকাদক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলোতে অন্যতম বিধ্বংসী পোকা[১] শূককীটের বিষাক্ত আর কণ্টকময় আঁশ মানুষ ও অন্যান্য স্তন্যপায়িদের সাথে ক্ষতিকর বিক্রিয়া করে। প্রজাতিটি এর বিছাপোকা বা শূককীটের আচরণের জন্য প্রসিদ্ধ। নের্তৃস্থানীয় কীটবিজ্ঞানী জীন হেনরি ফেবার’র বর্ণনানুসারে, এসব শূককীট পাইন গাছের ডগায় তাবুর মতোন বাসা বানিয়ে শীতকাল অতিবাহিত করে, এবং বনের ভেতর দিয়ে নাক-থেকে-লেজ পর্যন্ত স্তম্ভাকারে মিছিল করে বেড়ায় আর ভীষণরকমের বিরক্তিকর আঁশ দিয়ে আত্মরক্ষা করে।[২]

ডিম[সম্পাদনা]

বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নলাকার ডিমপুঞ্জ দৈর্ঘ্যে ৪ থেকে ৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এসব ডিমের স্তুপ স্ত্রীপোকাদের পায়ুস্তবকের শল্ক দিয়ে এমনভাবে আবৃত থাকে, দেখে মনে হয় পাইনের ডাল।[৩]

পরিণত দশা[সম্পাদনা]

পূর্ণাঙ্গ মথ

প্রাপ্তবয়স্ক পাইন প্রসেশনারির বাদামি চিহ্নযুক্ত ক্রিম রঙের অগ্রপদ, এবং সাদা রঙের পশ্চাৎপদ থাকে। স্ত্রী মথের পাখার দৈর্ঘ্য ৩৬ - ৪৯ মিলিমিটার এবং পুরুষ মথের পাখার দৈর্ঘ্য ৩১ - ৩৯ মিলিমিটার হয়। এর উড়ার সময়কাল মে থেকে জুলাই।

পিউপা[সম্পাদনা]

পিউপাকরণ মাটির ভেতরে ডিম্বাকৃতির, গৈরিক-সাদা রেশমী গুটির ভেতরে ঘটে থাকে। অবটেক্ট পিউপা দৈর্ঘ্যে ২০ মিলিমিটার, ডিম্বাকৃতির, এবং ধূসর বাদামী-হলুদ রঙের হয় যা পরে গাঢ় লালচে বাদামীতে পরিবর্তীত হয়।[৩]

শূককীট[সম্পাদনা]

পাইন বৃক্ষে শূককীটের দ্বারা বানানো "তাবু"।

শূককীট হল বনের একটি অন্যতম বালাই যারা দলবদ্ধভাবে পাইন অথবা মাঝে সাঝে সিডার বা লার্চ বৃক্ষে বড় “তাবুর” মাঝে বসবাস করে। রাত্রিবেলা একটি সাড়িতে মিছিল করে (এ থেকেই এদের নামকরণ হয়েছে) এরা বৃক্ষের পাতা ভক্ষণ করতে বের হয়। একটি বৃক্ষে একাধিক “তাবু” দেখতে পাওয়া যায়। পিউপাকরণের জন্য যখন তারা প্রস্তুত হয়, শূককীটগুলো তাদের আপন ঢংয়ে মাটিতে নেমে আসে এবং এককভাবে পিউপাকরণের জন্য মাটির পৃষ্ঠে অথবা অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ে।

শূককীটকে কখনোই খালি হাতে ধরা ঠিক নয়, কারণ তাদের দেহের পর্যাপ্ত চুল ত্বকের মাঝে ভীষণরকম বিরক্তিকর চুলকানির সৃষ্টি করতে পারে।[৪] ৫ম স্তরের শূককীট ভীত বা পিড়ীত হলে পশম নিক্ষেপ করে।[৫] হারপুনের মতোন পশম তখন ত্বকে গেঁথে যায় এবং এর আশেপাশে চুলকানিসৃষ্টিকারি প্রোটিন দিয়ে বিরক্তিকর জ্বলুনির সৃষ্টি করে। ব্যক্তি যদি এসব পশমের প্রতি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হন তবে পরবর্তীতে এলার্জি বিক্রিয়া হতে পারে।[৬]

জীবন চক্র[সম্পাদনা]

পাইন প্রসেশনারির জীবন চক্র সাধারণত বার্ষিক হয়, কিন্তু অধিক উচ্চতায় অথবা উত্তর অক্ষাংশে পুরো পপুলেশনে বা এর কিছু অংশে এই চক্র ২ বছর পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। জীবন চক্রের দু’টি দশা রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক, ডিম এবং শূককীট হল বায়বীয় এবং পিউপা হল ভূ-গর্ভস্থ। পাইন গাছে পোকার মত ডিম পাড়ে। ডিম ফোটার পর পাইনের সূচাকৃতির পাতা খেতে খেতে শূককীট পাঁচটি ইনস্টার বা দশার মধ্য দিয়ে যায়। তাদের বানানো সাদা পশমী বাসা তাদের নিজের জীবন ধারণের জন্য আদর্শ। মার্চের শেষের দিকে শূককীটরা বাসা ছেড়ে দেবার জন্য প্রস্তুত হয় এবং বৈশিষ্ট্যমন্ডিত উপায়ে মিছিল করতে করতে গাছ থেকে নেমে আসে। অতঃপর তারা মাটি খুঁড়ে অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং পিউপায় বা মূককীটে পরিণত হয়। গ্রীষ্মের শেষের দিকে তারা আবির্ভুত হতে শুরু করে।[৩] গরম বসন্তে অধিক সংখ্যায় প্রাপ্তবয়স্ক পতঙ্গের আবির্ভাব পরিলক্ষিত হয়। [৭]

আশ্রম নির্মাণ[সম্পাদনা]

শূককীটরা অতিমাত্রায় দলবদ্ধ। প্রাথমিক অবস্থায় তারা যাযাবরের মতোন কয়েকটি নিডল বা পাতা ঘিরে পশম দিয়ে সুতা কেটে অনেকগুলো পাতলা আশ্রম তৈরী করে আবার ছেড়ে যায়, কিন্তু তৃতীয় ইনস্টার থেকে তারা স্থায়ী বাসা বানানো শুরু করে। শূককীটের যাতায়াতের জন্য নির্দিষ্ট কোনো মুক্ত পথ থাকে না। বরং আশ্রমগুলোর স্তরের মধ্য দিয়ে বল প্রয়োগ করে এরা ভিতরে ঢুকে আবার বাহির হয়। শুককীটেরা তাদের খাবারকে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে যে ফ্রাস উৎপন্ন করে তা আশ্রমের তলায় জমা হয়।[৬]

মধ্যশীতের খোরাক এবং তাপ নিয়ন্ত্রণ[সম্পাদনা]

পুরো শীতকাল জুড়ে উপনিবেশগুলো সক্রিয় থাকে। অবলোহিত সক্রিয়তা পর্যবেক্ষণের সাহায্যে বার্সেলোনা এবং কাতালোনিয়ার পাশে পাহাড়ী অঞ্চলের পাইন বনের উপনিবেশগুলোর খোরাক সংগ্রহকালীন সক্রিয়তা পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, সূর্যাস্তের সাথে সাথে শূককীটরা বাসা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে এবং এবং আশ্রয়দানকারী বৃক্ষের দূরপ্রান্তে অবস্থিত খাদ্য সংগ্রহের স্থানে ভ্রমণ করে। সেখানে তারা সারারাত ধরে খাবার খায় এবং ভোরবেলা ঘরে ফিরে যায়। মধ্য শীতের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, শূককীটরা শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রার প্রবল শীত উপেক্ষা করে খাবার-দাবার সংগ্রহ করে এবং ধীরগতিতে হলেও চলাচল করে। স্থায়ী বাসাগুলো এরা এমন জায়গায় তৈরী করে যেখানে সূর্যের আলো সরাসরি পড়ে এবং সূর্যালোকিত দিনে এসব ঘরের তাপমাত্রা কক্ষ তাপমাত্রার উপরে বিরাজ করে। শূককীটরা দিনের বেলা আশ্রমে বিশ্রাম নেয় এবং সূর্যালোকের ফলে আশ্রমের উচ্চ তাপমাত্রা, সারারাত ধরে সংগৃহীত খাদ্য পরিপাকে সহায়তা করে। মার্চের আগেই শূককীটরা পঞ্চম ইনস্টারে চলে যায় এবং পূর্ণাঙ্গরূপে বেড়ে ওঠে। এ সময়ে তারা আশ্রম ছেড়ে দিয়ে একজনের মাথা আরেকজনের লেজকে অনুসরণ করে মিছিল শুরু করে এবং মাটির মধ্যে পিউপাকরণের স্থান খোঁজাখুঁজি করতে থাকে।[৬]

চলার পথ চিহ্নিতকরণ এবং মিছিলের স্বভাব[সম্পাদনা]

আশ্রয়দানকারী গাছের ডাল ধরে আগানোর সাথে সাথে শূককীটরা তাদের উদরের অগ্রভাগ থেকে এক ধরনের ফেরোমোন ছেড়ে দিয়ে চিহ্ন ধরে রাখে। যদিও তারা এছাড়াও রেশম নিঃসরণ করে এবং এই উপাদান দিয়ে চলার পথ চিহ্নিত করে রাখে, এটি মূলত পথ অনুসরণে তেমন কাজে আসে না। খুব সম্ভবত এই রেশম তাদেরকে গাছের পৃষ্ঠে আটকে থাকতে সহায়তা করে। শূককীটেরা পুরোনো পথের সাথে নতুন পথের পার্থক্য করতে পারে। অধিকসংখ্যক শূককীট যে পথ ধরে চলে অন্যান্যরা সাধারণত সে পথই অনুসরণ করে। পথচিহ্ন শূককীটদেরকে খাবার স্থানে একত্র হতে আবার খাবার শেষে বাসস্থানে ফিরে যেতে সহায়তা করে। যখন তারা গাছের শাখা-প্রশাখা ধরে চলে, তখন তারা মাথা এবং লেজ স্পর্শ করে একাকী অথবা ছোটো দলে ভ্রমণ করে। একা হোক বা দলবেঁধে, পথ খুঁজে পেতে সবক্ষেত্রে তারা পথচিহ্নরেখার সহায়তা নেয়।[৬]

শিকারী বিরোধী আত্মরক্ষা[সম্পাদনা]

তৃতীয় এবং তার পরবর্তী ইনস্টারে পাইন প্রসেশনারীর শূককীট অধিক মাত্রায় চুলকানিময় হয়। পশমের সংস্পর্শে আসলে ত্বকে ফুসকুড়ি দেখা দেয় এবং চোখের জ্বালাপোড়া শুরু হয়। এছাড়াও অধিক সংবেদনশীল ব্যক্তি শূককীটের বা বিছাপোকার পশমের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রোটিনের কারণে এ্যালার্জি আক্রান্ত হতে পারে।[৬]

প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ[সম্পাদনা]

পাইন প্রসেশনারী হল দক্ষিণ ইউরোপের সরলবর্গীয় বনের একটি অর্থনৈতিক বালাই। এটি শিকারী, পরজীবী, এবং ভাইরাসের দ্বারা কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হয়। জীবন চক্রের নানান ধাপে এদের দ্বারা পাইন প্রসেশনারী আক্রান্ত হয়ে থাকেঃ

কৃত্রিম নিয়ন্ত্রণ[সম্পাদনা]

পাইন প্রসেশনারী নিয়ন্ত্রণের উপায়গুলোর মধ্যে রয়েছে Bacillus thuringiensis ব্যবহার করে জৈবিক নিয়ন্ত্রণ যা ডিম অথবা প্রথম ও দ্বিতীয় দশার শূককীটের উপর কার্যকরী।[৮] এছাড়াও রয়েছে কীটনাশক, যেমন, ডাইফ্লুবেনজুরন, একটি পতঙ্গ বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রক যা আকাশযান থেকে ছিটানোর মাধ্যমে কার্যকরী করা হয়।[৯] পোকার পর্যবেক্ষণের জন্য ফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহৃত হয়।[৮] নিয়ন্ত্রণের পুরোনো পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে তেলের মধ্যে কীটনাশক মিশিয়ে সরাসরি বাসার মধ্যে সেঁধিয়ে দেয়া, অথবা যন্ত্র দিয়ে বাসা অপসারন করা।[৮]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. পাইন প্রসেশনারী মথের বিস্তৃতির মানচিত্র
  2. "Report of poison in five dogs after contact with Thaumetopoea pityocampa" (পিডিএফ)। ২৮ জুলাই ২০০৭ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ আগস্ট ২০১৩ 
  3. "পেস্ট প্রোফাইল- পাইন প্রসেশনারী মথ" (পিডিএফ)। ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ আগস্ট ২০১৩ 
  4. জিন হেনরি ফেবার, "The PIne Processionary: The stinging Power ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৯ জুলাই ২০১৩ তারিখে", ষষ্ঠ অধ্যায়
  5. Bonnet, Catherine and Jean-Claude Martin and René Mazet (আগস্ট–অক্টোবর ২০০৮)। "La Processionnaire du Pin" (পিডিএফ)Stantari No. 14। INRA। পৃষ্ঠা 29–33। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ ডিসেম্বর ২০১১ 
  6. Pine Processionary Caterpillar Thaumetopoea pityocampa (Thaumetopoeidae)
  7. Mestre, João. Forest Health and Climate Changes. Universidade de Trás-os-Montes is Alto Douro, ২০১২।
  8. "পাইন প্রসেশনারী নিয়ন্ত্রণ" (পিডিএফ)। ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ আগস্ট ২০১৩ 
  9. "বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রক প্রয়োগ"। ২২ অক্টোবর ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ আগস্ট ২০১৩