নুমিদীয় অশ্বারোহী বাহিনী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
নুমিদীয় অশ্বারোহী

নুমিদীয় অশ্বারোহী বাহিনী (স্পেনীয় - Caballería númida; কাবাইয়েরিয়া নুমিদা) ছিল একধরনের হাল্কা অশ্বারোহী বাহিনী। মূলত উত্তর আফ্রিকার নুমিদিয়ার (বর্তমান আলজিরিয়ার উত্তর অংশ ও তিউনিসিয়ার কিছু অংশ) অধিবাসীদের নিয়ে এই বাহিনী গঠিত হয়েছিল। হানিবলের নেতৃত্বে রোম অভিযানের সময় এই বাহিনী কার্থেজীয়দের পক্ষে অংশগ্রহণ করে। দ্বিতীয় পুনিক যুদ্ধে তাদের দক্ষতা এতটাই নজর কাড়ে যে রোমান ঐতিহাসিক টিটাস লিভিয়াস তাদের আফ্রিকার সর্বশ্রেষ্ঠ অশ্বারোহীবাহিনী বলে উল্লেখ করেন।[১]

ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র[সম্পাদনা]

নুমিদীয়দের ব্যবহৃত ঘোড়াগুলি ছিল তুলনামূলকভাবে সেই যুগে ব্যবহৃত অন্যান্য যুদ্ধাশ্বের থেকে একটু খাটো, কিন্তু খুবই দ্রুতগামী, কষ্টসহিষ্ণু ও দীর্ঘক্ষণ ছুটতে পারার ক্ষমতাসম্পন্ন। প্রকৃতপক্ষে আজকের বিখ্যাত আরব প্রজাতির ঘোড়াদের পূর্বসুরী ছিল তারা।[২] নুমিদীয় অশ্বারোহীরাও ছিল এতটাই দক্ষ যে ঘোড়ায় চড়ার জন্য তাদের কোনও লাগাম বা জিনের দরকার পড়ত না। ঘোড়ার গলায় জড়ানো একটি সাধারণ দড়ি আর একটি লাঠি দিয়েই তারা ঘোড়া চালনা করতে পারত। তাদের অস্ত্র বলতে ছিল দূর থেকে নিক্ষেপ করার বর্শা আর একধরনের খাটো তলোয়ার। চামড়ার একটি গোলাকার ঢাল ছাড়া আলাদা কোনও বর্মও তারা ব্যবহার করত না।[৩]

যুদ্ধকৌশল[সম্পাদনা]

এরা ছিল মূলত এক হাল্কা অশ্বারোহী বাহিনী। এদের মূল অস্ত্র ছিল জ্যাভেলিন বা বর্শা। এরা সাধারণভাবে কিছুটা ছাড়া ছাড়া ভঙ্গিমায় দূর থেকে শত্রুর উপর আক্রমণ চালাত। খুব দ্রুতগতিতে ধেয়ে এসে এরা দূর থেকে শত্রুর উপর বর্শা নিক্ষেপ করে সরাসরি সংঘাত এড়িয়ে আবার দ্রুতগতিতেই সরে যেত। ভারী ধরনের বর্ম বা অস্ত্রশস্ত্র বহন না করায় তারা ছিল খুবই দ্রুতগামী। যুদ্ধক্ষেত্রে এই দ্রুতগতিই ছিল তাদের আত্মরক্ষার প্রধান অস্ত্র। তাদের পোশাক ছিল মূলত একটি হাতাবিহীন টিউনিক বা আলখাল্লা ধরনের পোশাক। কোমরের কাছে সেটি একটি শক্ত কোমরবন্ধ বা বেল্ট দিয়ে বাঁধা থাকত।[৩] বিশেষত শত্রুবাহিনীর গতি যখন কম হত, এরা তাদের ক্রমাগত উত্ত্যক্ত করে তোলার বিষয়ে ছিল খুবই কার্যকরী। কিন্ত ভারী অশ্বারোহী বাহিনীর আক্রমণের মুখে এরা প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে খুব একটা কার্যকরী ছিল না।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুনিক যুদ্ধ[সম্পাদনা]

ক্যানির যুদ্ধে রোমান অশ্বারোহী বাহিনীকে পরাস্ত করার ক্ষেত্রে নুমিদীয় অশ্বারোহীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। তাদের সাহায্যেই কার্থেজীয়রা রোমানদের দ্রুত তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলতে সক্ষম হয়; পরিণামে রোমানরা (লাল) পরাজিত হয়।

দ্বিতীয় পুনিক যুদ্ধের সময় হানিবলের পক্ষে অন্তত ৪০০০ নুমিদীয় অশ্বারোহীদের একটি বাহিনী যোগদান করে।[৩] শত্রু এলাকায় ঢুকে খবর আনা ও স্কাউট হিসেবে তারা এইসময় হানিবলের অক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই যুদ্ধ মূলত ইতিহাস বিখ্যাত হানিবলের বাহিনীর হাতির ব্যবহারের জন্য। কিন্তু এই ধীরগতির হস্তিবাহিনীর পাশাপাশি যখনই গতির প্রয়োজন হয়, নুমিদীয় অশ্বারোহীদের অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এই যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। যেমন - ত্রেবিয়ার যুদ্ধে (২০১৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) রোমানদের ফাঁদে ফেলার উদ্দেশ্যে এই দ্রুতগতির নুমিদীয় অশ্বারোহীদেরই ব্যবহার করা হয়।[৪] তাছাড়া এই যুদ্ধে হানিবলের বাহিনীর দক্ষিণপার্শ্ব রক্ষার দায়িত্বও ছিল এদেরই হাতে।

খ্রিস্টপূর্ব ২১৬ অব্দে অনুষ্ঠিত ক্যানির যুদ্ধেও রোমানদের বিপক্ষে কার্থেজীয়দের পক্ষে নুমিদীয় অশ্বারোহীদের যোগদানের কথা জানা যায়। এই যুদ্ধে রোমানদের বিপক্ষে কার্থেজীয়দের জয়লাভের ক্ষেত্রে তাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকার উল্লেখ পাওয়া যায়।[৩] এছাড়া তৃতীয় পুনিক যুদ্ধেও অন্তত ৬০০০ নুমিদীয় অশ্বারোহী রোমানদের বিরুদ্ধে কার্থেজের পক্ষ অবলম্বন করে যুদ্ধে নেমেছিল বলে জানতে পারা যায়।[৩]

ইউগুর্তা বা জুগুর্তার যুদ্ধ[সম্পাদনা]

খ্রিস্টপূর্ব ১১৮ অব্দে উত্তর আফ্রিকার নুমিদিয়ার রাজা মিসিপসার মৃত্যুর পর তার পালিত পুত্র ইউগুর্তা বা জুগুর্তা রাজা হলে রোমের সাথে তার বিরোধ বাধে। ফলে ইউগুর্তা ও রোমের মধ্যে শুরু হয় যুদ্ধ (১১২ - ১০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। এই যুদ্ধেও নুমিদীয় অশ্বারোহীরা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। প্রথম তিন বছরের যুদ্ধে রোমানরা একের পর এক পরাজয়ের সম্মুখীন হয়। ১০৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমের সেনেট পরিস্থিতির চাপে যুদ্ধের নেতৃত্বের বদল ঘটাতে বাধ্য হয় এবং ১০৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমানবাহিনীর সেনাপতির দায়িত্ব এসে পড়ে গাইয়ুস মারিয়ুস'এর হাতে। তিনি নুমিদীয় অশ্বারোহীদের মোকাবিলার উদ্দেশ্যে রোম থেকে বিশেষ হাল্কা অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে এসে যুদ্ধে নিয়োগ করেন। অবশ্য তাতেও ইউগুর্তার বিরুদ্ধে রোমানরা খুব একটা অগ্রসর হতে পারেনি। শেষপর্যন্ত ১০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে ইউগুর্তা রোমানদের হাতে ধরা পড়লে এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।[৩][৫]

জুলিয়াস সিজারের আফ্রিকা অভিযান[সম্পাদনা]

জুলিয়াস সিজার যখন আফ্রিকায় আক্রমণ চালান, একাধিকবার তাঁর বাহিনীকে নুমিদীয় অশ্বারোহী বাহিনীর মুখোমুখি হতে হয়। তাঁর তুলনামূলক ভারী কিন্তু কম গতিশীল বাহিনী এদের হাতে ক্রমাগত উত্ত্যক্ত হয়। কিন্তু যখন রোমান ভারী অশ্বারোহী বাহিনী পালটা আক্রমণ শানায়, এদের পিছু হটে যেতে হয়। যেমন, এরকম একটি ক্ষেত্রে সিজারের গলদেশীয় অশ্বারোহীদের ৩০ জনের একটি দল তাদের থেকে সংখ্যায় অনেক বড় একদল মুর অশ্বারোহীকে পরাজিত ও বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়। আরও একটি ক্ষেত্রে সিজারের ভারী ইবেরীয় অশ্বারোহীরাও নুমিদীয়দের একটি দলকে তছনছ করে দেয়।

রোমানদের পক্ষে[সম্পাদনা]

নুমিদীয় অশ্বারোহীরা ইতিহাসে যদিও মূলত পরিচিত কার্থেজীয় বাহিনীর হয়ে তাদের দক্ষতা প্রদর্শন ও বীরত্বের জন্য, কিন্তু তারা বিভিন্নসময়ে অন্য বাহিনীর হয়েও যুদ্ধ করেছিল। যেমন রোমানরা তাদের এমনকি হানিবলেরই বিরুদ্ধে জামার যুদ্ধে (২০২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ব্যবহার করে।[৬] এই যুদ্ধে নুমিদীয় অশ্বারোহী বাহিনীই যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।[৭] এছাড়া জুলিয়াস সিজারও তাঁর গল অভিযানের সময় (৫৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) নুমিদীয় তীরন্দাজদের ব্যবহার করেন বলে জানতে পারা যায়।[৩]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Titus Livius. Römische Geschichte (জার্মান ভাষায়) Übersetzt von Konrad Heusinger. FRIEDRICH VIEWEG: Braunschweig, 1821. Kapitel 99. মুল লাতিন গ্রন্থ Ab Urbe Condita 29.35.8
  2. Epona. সংগৃহীত ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯।
  3. "THE NUMIDIANS". RedRampant. সংগৃহীত ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯।
  4. "The Invasion of Italy". UNRV. সংগৃহীত ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯।
  5. T. Mommsen, The History of Rome, (The Colonial Press, Massachusetts, 1958).
  6. Sidnell, Philip. Warhorse: Cavalry in the Ancient World. Bloomsbury, 2007. p.194. ISBN 978-1847250230.
  7. Fuller, J.F.C., Julius Caesar: Man, Soldier, and Tyrant. p. 28 ISBN 0-306-80422-0