তাই তোমার আনন্দ আমার 'পর

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
"তাই তোমার আনন্দ আমার 'পর"
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক সঙ্গীত
ভাষাবাংলা
রচিত১২ জুলাই ১৯১০
ধারারবীন্দ্র সঙ্গীত
গান লেখকরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তাই তোমার আনন্দ আমার 'পর হলো ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুলাই (১৩১৭ বঙ্গাব্দের ২৮ শে আষাঢ়) কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত পূজা (নিঃসংশয়) পর্যায়ের গান। গানটি ১৩১৭ বঙ্গাব্দের ১১ মাঘ কলকাতায় ৮১ তম মাঘোৎসবে আদি ব্রাহ্ম সমাজে প্রথম গীত হয় এবং ওই বছরের চৈত্র মাসে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। [১]গীতবিতান ছাড়াও গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থেও (১২১ সংখ্যক) অন্তর্ভুক্ত ভক্তিরসে সমৃদ্ধ এই গানে কবি নিজের মধ্যে সমগ্র বিশ্বকে অনুভব করেন মরমি হৃদয়ে। জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনের কথা পরিস্ফুট হয়েছে গানটিতে। মরমি কবি ভাব-সাধনার অন্তিমে অরূপের সঙ্গে অনন্তের মিলন কামনা করেছেন।

গানের কথা[সম্পাদনা]

তাই তোমার আনন্দ আমার 'পর

তুমি তাই এসেছ নীচে—

আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর,

তোমার প্রেম হত যে মিছে।।

আমায় নিয়ে মেলেছ এই মেলা,

আমার হিয়ায় চলছে রসের খেলা,

মোর জীবনে বিচিত্ররূপ ধরে

তোমার ইচ্ছা তরঙ্গিছে॥

তাই তো তুমি রাজার রাজা হয়ে

তব আমার হৃদয় লাগি

ফিরছ কত মনোহরণ-বেশে,

প্রভু, নিত্য আছ জাগি।

তাই তো, প্রভু, হেথায় এল নেমে,

তোমারি প্রেম ভক্তপ্রাণের প্রেমে,

মূর্তি তোমার যুগল-সম্মিলনে সেথায় পূর্ণ প্রকাশিছে॥

সম্পর্কিত তথ্য[সম্পাদনা]

রচনা ও সুরারোপ-

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঊনপঞ্চাশ বৎসর বয়সে অধুনা বাংলাদেশের জানিপুর, গোরাই,-এ ১৩১৭ বঙ্গাব্দের ২৮ আষাঢ় তারিখে রচনা করেন গানটি। 'দেশ' (মিশ্র জয়জয়ন্তী) রাগ ও 'দাদরা' তালে গীত হয়। সুরারোপ করেছেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভীমরাও শাস্ত্রী। কবিগুরু নিজে গানটি ইংরাজীতে অনুবাদ করে সং অফারিংস-এ (৫৬ সংখক) অন্তর্ভুক্ত করেন। ইংরেজিতে কবিকৃত অনুবাদের প্রথম ছত্র - Thus it is that thy joy in me is so full ১৩৩০ বঙ্গাব্দের ৯ পৌষ শান্তিনিকেতনে খ্রিস্ট-উৎসব উপলক্ষে মন্দিরে উপাসনার সূচনায় রবীন্দ্রনাথ নিজে গানটি গেয়েছিলেন। ব্রহ্মসঙ্গীত হিসাবে ১৩২১ বঙ্গাব্দে ধর্মসঙ্গীতে অন্তর্ভুক্ত হয়। [১]

ভাবার্থ[সম্পাদনা]

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন নিজের মধ্যে সারা বিশ্বকে অনুভব করতেন, তার ভাবনা সেসময়ে আপনা আপনিই যেন মানবাত্মার সঙ্গে বিশ্বাত্মার যোগ স্থাপিত হয়ে যেত, সৃষ্ট হত বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। আর সেকারণেই তিনি হয়েছেন ঋষিকবি বা বিশ্বকবি। মহাবিশ্ব গঠনের প্রাথমিক অবস্থার জেরে আজকের মহাবিশ্বে জীবনের ধীশক্তিসম্মন্ন জগতের প্রকাশে, মানবীয় তত্ত্ব তথা 'উইক অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপল ' গুরুত্ব লাভ করেছে এবং সেই ভাবনায় আজকে বিজ্ঞানীরাও উৎসাহী হয়েছেন, [২] জগৎ জীবন, পরমস্রষ্ট্রা তথা বিশ্বনিয়ন্তা ও তার সৃষ্টি সম্পর্ক মরমি কবি অনুভব করতেন উপনিষদের সার কথা - জীবাত্মা আর পরমাত্মার দ্বৈতলীলা। প্রকাশের অভিসারে পরমাত্মাই নেমে আসে জীবাত্মার কাছে।[৩]

মরমিয়াবাদেরও মূলকথা হল আত্মশুদ্ধির দ্বারা জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার একাত্মতা বা নিকটবর্তিতা। বাউলেরা যেমন আত্মানুসন্ধানে মনের মানুষকে খুঁজে ফেরেন, সুফিরা যেমন সাধনমার্গে অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পরমকে পেতে চান, মরমি কবি রবীন্দ্রনাথ তার ভাবসাধনার উচ্চ স্তরে অরূপের সঙ্গে অনন্ত মিলনের কামনাই করেছেন উল্লিখিত গানটির ছত্রে ছত্রে।

কবিগুরুর ভাবনায় সকল মানুষের মাঝে আছে এমন এক সত্তা যা মানুষকে অসীমের পথে চালনা করে সেই সত্তাটি হল পরমসত্তা, যা পালনকর্তা রূপে জগতের সর্বত্রই 'মনোহরণ বেশে' উদ্ভাসিত আছে । মানুষের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়তে সেটি আবার ব্যক্তিরূপে প্রকাশমান। আর একে ঘিরেই রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা তত্ত্ব। এমন পরমসত্তাকে উপলব্ধির করে সন্তুষ্ট নন তিনি। তাকে পেতে চান। তাকেই শ্রদ্ধা জ্ঞাপনটাই হল মানুষের ধর্মবোধ। নিত্যদিনের কাজের মাঝে কর্মক্ষেত্রেই তাকে পাওয়া সম্ভব।

জীবনদেবতা রূপী পরমসত্তাটি ব্যক্তিরূপী ঈশ্বর হয়ে তার হৃদয়ে অবস্থান করছেন। তিনি জগতের সৃষ্টিকর্তা হয়েও ভক্তের সঙ্গে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চান। ভক্তের জীবন সার্থক হলেই তার নিজের সার্থকতা।

গানের এই গভীর মর্মবাণীর কারণে রবীন্দ্র সংগীতপ্রেমীদের কাছে এটি প্রতিদিনের প্রার্থনা সঙ্গীত যা অনাবিল আনন্দ সৃষ্টি করে শরীর ও মনে প্রশান্তি আনে। আবার কেউ বা কৃষ্ণভক্তির গান মেনে জীবনের প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী হিসাবে মেনে নিয়েছেন এই কালজয়ী গান।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার, সম্পাদক (২০১৯)। গীতবিতান তথ্যভাণ্ডারসিগনেট প্রেস, কলকাতা। পৃষ্ঠা ৩৫০/৩৫১। আইএসবিএন 978-93-5040-053-1 
  2. মণি ভৌমিক (২০১২)। বিজ্ঞানে ঈশ্বরের সংকেত। আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, year= ২০১০। পৃষ্ঠা ১৬৫। আইএসবিএন 978-81-7756-924-7 
  3. রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় (২০১৮)। "তপোবনে রবীন্দ্রনাথ"। সাহিত্যম, কলকাতা।