টুরিং পরীক্ষা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

১৯৫০ সনে অ্যালান ট্যুরিং প্রথম ইমিটেশন গেম বা অনুকরণের খেলা নামে একটি টেস্ট আবিষ্কার করেন। একে ট্যুরিং টেস্ট বলে। এটি মূলত যন্ত্রের ওপর একজন মানুষের সমতুল্য বা মানুষ থেকে স্বতন্ত্র বুদ্ধিমত্তাগত আচরণ প্রদর্শন করার দক্ষতা নির্ণায়ক একটি পরীক্ষা । ট্যুরিং প্রস্তাব করেন যে, একজন মানুষ বিচারকের মূলত একজন মানুষ ও মানুষের মত সাড়া প্রদানের জন্য সৃষ্ট যন্ত্রের মাঝে স্বাভাবিক কথোপকথন এর মান যাচাই করতে হবে। বিচারকের প্রথমে জানা থাকতে হবে যে, কথোপকথনের মধ্যকার দুইজনের একজন হল যন্ত্র এবং প্রত্যেক কথোপকথনকারীকে একে অপরের থেকে আলাদা রাখতে হবে। কথোপকথন কেবল একটি লিখন মাধ্যমের ওপর সীমিত রাখতে হবে; যেমন, একটা কম্পিউটার কীবোর্ড আর একটা প্রদর্শনী স্কীন থাকতে পারে যাতে লেখাকে আবার কথায় রূপান্তরের জন্য যন্ত্রের বাড়তি সক্ষমতার ওপর নির্ভর না করতে হয়। যদি বিচারক মানুষ থেকে যন্ত্রকে আলাদা করতে না পারে(পাঁচ মি. কথার পর) তাহলে বলা যাবে, যন্ত্রটি পরীক্ষায় পাশ করেছে। যন্ত্রের পক্ষ থেকে কোন প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়ার সক্ষমতা যাচাই করা পরীক্ষাটির উদ্দেশ্য নয়, বরং এর উত্তর একজন মানুষের কতটা কাছাকাছি হয় শুধুমাত্র সেটাপরীক্ষা করা হয়।

টুরিং পরীক্ষার "মান ব্যাখ্যা"য়, যেখানে খেলুড়ে 'সি', প্রশ্নকর্তা, কে খেলুড়ে – 'এ' অথবা 'বি' – এর মধ্য থেকে কোনটি কম্পিউটার ও কোনটি মানুষ খুঁজে বের করতে দেওয়া হয়। প্রশ্নকর্তাকে শুধু লিখিত প্রশ্ন ব্যবহার করে প্রতিক্রিয়া বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।[১]


ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়-এ কাজ করার সময় "গণনীয় যন্ত্রপাতি ও বুদ্ধিমত্তা" শীর্ষক অনুচ্ছেদে টুরিং পরীক্ষাটি পরিচয় করিয়ে দেন (টুরিং, ১৯৫০; পৃ. ৪৬০)।[২] এটি একটি উক্তি খুলে দেয়: "আমি প্রশ্নটি বিবেচনা করার প্রস্তাব করছি, 'যন্ত্র কী চিন্তা করতে পারে?'"। কারণ, "চিন্তা"-কে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন, টুরিং "প্রশ্নটি প্রতিস্থাপন করে দ্ব্যর্থহীন শব্দের মাধ্যমে অন্য একটি অপেক্ষাকৃত কাছাকাছি প্রশ্ন প্রকাশ করেন"।[৩] টুরিং এর নতুন প্রশ্ন হল: "এমন কি কোন চিন্তনীয় সংখ্যাগত গণনাকারী যন্ত্র আছে যা অনুকরণ খেলায় ভাল করবে?"[৪] টুরিং বিশ্বাস করেন যে, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আসলেই সম্ভব। বাকি অনুচ্ছেদে সকল মূল বাধার বিরুদ্ধে তিনি আপত্তি তুলে যুক্তি দেখান যে, "যন্ত্র চিন্তা করতে পারে"।[৫]

টুরিং তার প্রথম পরীক্ষা চালু করার পর এটা অত্যন্ত প্রভাবশালী ও বহুল সমালোচিত হয়েছে এবং প্রমাণিত হতে সক্ষম হয়েছে যে, এটি দর্শনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা।[৬][৭]

ইতিহাস[সম্পাদনা]

দার্শনিক পটভূমি

যন্ত্রের পক্ষে চিন্তা করা সম্ভব কিনা এই প্রশ্নের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ যা মানবচেতনার দ্বৈতবাদীবস্তুবাদী পৃথক দৃষ্টিভঙ্গিদ্বয়ের মাঝেই গোড়াপত্তন করে। ১৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে র‍্যনে দেকার্ত তাঁর Discourse on the Method পুস্তকে টুরিং টেস্ট এর প্রাথমিক ধারণা দিয়েছিলেন-

[H]ow many different automata or moving machines can be made by the industry of man ... For we can easily understand a machine's being constituted so that it can utter words, and even emit some responses to action on it of a corporeal kind, which brings about a change in its organs; for instance, if touched in a particular part it may ask what we wish to say to it; if in another part it may exclaim that it is being hurt, and so on. But it never happens that it arranges its speech in various ways, in order to reply appropriately to everything that may be said in its presence, as even the lowest type of man can do.

এখানে দেকার্তে উল্লেখ করেছেন যে, অটোম্যাটা মানুষের মিথস্ক্রিয়া(হিউম্যান ইন্টারেকশন) এর বিপরিতে সাড়া দিতে সক্ষম। কিন্তু তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন যে, তৎকালিন এই অটোম্যাটা নামের যন্ত্রগুলো মোটেও মানুষের মত সঠিকভাবে সাড়া দিতে পারত না। দেকার্তে এভাবেই যন্ত্রের ভাষাগত প্রতিক্রিয়ার অপ্রতুলতাকে সংজ্ঞায়িত করার মধ্য দিয়েই টুরিং টেস্টের প্রাথমিক ধারণা প্রদান করেন; কারণ এটিই মানুষ থেকে যন্ত্রকে থেকে পৃথক করে। তবে দেকার্তে এটা ভাবতে ব্যর্থ হন যে, ভবিষ্যতের অটোমাটা হয়ত এই ধরনের ত্রুটি কাটিয়ে উঠতে পারতেও পারে তাই তিনি টুরিং টেস্টের মত কোনো কিছুর প্রস্তাব করেন নি, যদিও এই টেস্টের কনসেপচুয়াল অবকাঠামো এবং সীমা তারই ধারণায় প্রথম আসে।

ডেনিস ডাইডারোট তাঁর পেনসিস ফিলোসফিকসে একটি টিউরিং-টেস্টের ক্রাইটেরিয়া দাঁড় করান:

"যদি মানুষ এমন কোনো টিয়াকে খুঁজে পায় সবকিছুর উত্তর করতে পারে, আমি নির্দ্বিধায় একে বুদ্ধিমান প্রাণী বলে আখ্যা দেব।"

এই কথার মানে অবশ্য এমন নয় যে, তিনি এর সাথে একমত। বরং তৎকালে এটা বস্তুবাদের একটা সাধারণ বিতর্কের বিষয়ে পরিণত হয়েছিল।

দ্বৈতবাদ অনুযায়ী, চেতনা শরীরি নয়(বা বলা যায়, এর শরীরি বৈশিষ্ট্য নেই) এবং এজন্য চেতনা বা মননকে কোনো খাঁটি শারীরবিদ্যার পরিভাষায় ব্যাখ্যা করা যায় না। বস্তুবাদ অনুযায়ী, মনের ব্যখ্যার শরীরিভাবে দেওয়া যায়, ফলে কৃত্রিমভাবে মনন তৈরি করার সম্ভাবনার দ্বার খুলে যায়।

১৯৬৩ সনে, দার্শনিক আলফ্রেড আয়ার আদার মাইন্ডের স্ট্যান্ডার্ড দার্শনিক প্রশ্নটি বিবেচনা করেন: আমরা কীভাবে বুঝি যে, আমাদের মত হুবুহু চেতনার অভিজ্ঞতা অন্যদেরও আছে? তার বই, ল্যাংগুয়ে, ট্রুথ এন্ড লজিক, এ আয়ার একজন সচেতন আর অচেতন মানুষের মধ্যে পার্থক নির্ণয়ের পদ্ধতি প্রস্তাব করেন: "একটি চেতনাসম্পন্ন করে উপস্থাপিত কিন্তু বাস্তবে চেতনাসম্পন্ন প্রাণী নয়; বরং কেবল একটা পুতুল বা যন্ত্র কে নির্ণয় করার একমাত্র ভিত্তি হল যে, এটা যে ওই টেস্টে ব্যর্থ হবে যার মাধ্যমে চেতনা আছে কিন নেই তা নির্ধারণ করা যায়। (এই প্রস্তাবটি টুরিং সাহেবের টেস্টের খুবই কাছাকাছি কিন্তু এতে "বুদ্ধিমত্তার পরিবর্তে চেতনার টেস্ট করা হয়। আবার আয়ারের এই দার্শনিক পুরাণ যে টুরিংয়ের পরিচিত ছিল তাও নিশ্চিত নয়।) অপর কথায়, একটা জিনিস চেতনাসম্পন্ন হবে না যদি এটা চেতনার টেস্টে ব্যর্থ হয়।

অ্যালান টুরিং[সম্পাদনা]

১৯৫৬ তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্র তৈরির আগে যুক্তরাজ্যের গবেষকগণ প্রায় দশ বছর নাগাদ "যন্ত্রের বুদ্ধিমত্তা"(মেশিন ইন্টেলিজেন্স) বিষয়ে খোঁজ করেছেন। ব্রিটিশর সাইবারনেটিক্স এবং ইলেকট্রনিক্স গবেষকদের একটি সংস্থা, রেশিও ক্লাব এর সদস্যদের(যাদের মধ্যে টুরিং সাহেবও ছিলেন) মাঝে এটা একটা সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

টুরিং, বিশেষত, কমপক্ষে ১৯৪১ সাল থেকে মেশিন বুদ্ধিমত্তার ধারণাটি নিয়ে খাটাখাটনি করে আসছিলেন এবং প্রথম দিককার "কম্পিউটার বুদ্ধিমত্তা"-র উল্লেখ তার থেকেই পাওয়া যায় ১৯৪৭ সনে। টুরিংয়ের প্রতিবেদন, "ইন্টেলিজেন্ট মেশিনারি"-তে তিনি মূলত অনুসন্ধান করেন, "যন্ত্রের পক্ষে কখন বা আদৌ কি বুদ্ধিমানের মত আচরণ দেখানো সম্ভব কি না"। এতে তিনি এমন কিছু দাবি ও প্রস্তাব তুলে ধরেন যা হয়ত পরে তাকে এই পথে চলতে অনুপ্রাণিত করেছে:

It is not difficult to devise a paper machine which will play a not very bad game of chess. Now get three men as subjects for the experiment. A, B and C. A and C are to be rather poor chess players, B is the operator who works the paper machine. ... Two rooms are used with some arrangement for communicating moves, and a game is played between C and either A or the paper machine. C may find it quite difficult to tell which he is playing.

"কম্পিউটিং মেশিনারি অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স ১৯৫০"-ই ছিল মেশিন ইন্টেলিজেন্সের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে টুরিংয়ের ছাপানো প্রথম পত্রিকা। এই পত্রিকা তিনি শুরুই করেন এই দাবি করে যে, "আমি প্রস্তাব করি এটা চিন্তা করতে যে, মেশিন কি চিন্তা করতে পারে?" এভাবে তিনি মেশিন ও ইন্টেলিজেন্স এর সংজ্ঞা দেন। পরে অবশ্য জিজ্ঞাসাটাকে তিনি ঘুরিয়ে অন্যভাবে আরও ঘনিষ্ঠভাবে এবং দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, "মেশিন কি পারে আমরা যা পারি?"। টুরিংয়ের মতে এই নতুন জিজ্ঞাসা মূলত একটা সূক্ষ্ম রেখা টেনে দেয় একজন মানুষের শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতার মধ্যে।

এই উদ্যোগকে চাক্ষুস প্রদর্শন করাতে টুরিং একটা টেস্টে কথা বলেন যা মূলত একটা "অনুকরণের খেলা"(ইন্টিমেশন গেম) নামে পরিচিত দলীয় খেলা থেকে অনুপ্রাণিত। খেলাটিতে একজন পুরুষ আর একজন নারী ভিন্ন দুটো রুমে ঢুকে এবং অতিথিরা তাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করে ধারাবাহিকভাবে জিজ্ঞাসা লেখার মাধ্যমে আর এর ফেরত আসা লিখিত উত্তর পড়ে পড়ে। এই খেলায়, পুরষটি এবং নারীটি দুজনেই চেষ্টা করে নিজেকে অপরজন সেজে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করে। টুরিং তার খেলার নতুন সংস্করণের ব্যাপারে বলেন:

আমার এখন জিজ্ঞাসা হল, "কেমন হবে যদি একটা মেশিন এই খেলায় অংশ নেয়?" পুরুষ ও নারী নিয়ে যখন খেলা হয় তখন যেমন জিজ্ঞাসকারীরা ভুল করে তেমনি এখনও কি তারা ভুল করে ফেলতে পারে? অর্থাৎ, যার ফলে আরেকটি জিজ্ঞাসা দাঁড়িয়ে যায়, "মেশিন কি চিন্তা করতে পারে?"

পত্রের শেষ দিকে, টুরিং একটি "সমতুল্য" বিকল্প ফরমুলেশনের পরামর্শ দিয়েছিলেন যাতে একজন বিচারক থাকবে যে কথা যাচাই করবে। কেবল একটি কম্পিউটার এবং একজন ব্যক্তির সাথে কথোপকথনটি হবে। এরপর খেলার তৃতীয় আরেকটি সংস্করণ তিনি প্রস্তাব করেন। বিবিসি রেডিওতে টুরিংয়ের বক্তব্যে দেওয়া এই নতুন সংস্করণে একদল বিচারক কম্পিউটারকে জিজ্ঞেস করতে থাকবে আর কম্পিউটারের কাজ হল, বিচারকদলের একটা বড় অংশ সত্যিকার মানুষ সেজে ধোঁকা দেবে।

টুরিংয়ের পত্রিকাটিতে নয়টি গুরুতর আপত্তি ওঠে যেগুলো মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিরুদ্ধেই তখন পর্যন্ত উত্থাপিত আপত্তি।

এলিজা এবং পেরি[সম্পাদনা]

১৯৯৬ সনে জোসেফ ওয়েইযেনবাম এমন একটি প্রোগ্রাম রচনা করেন যা টুরিং টেস্টে সফল হয়। এলিজা(ELIZA) নামের এই প্রোগ্রামটি বিভিন্ন কীওয়ার্ডের জন্য ব্যবহারকারীর লিখিত মন্তব্যকে যাচাই করার মাধ্যমে চালিত হয়। যদি কোনো মন্তব্যের মধ্যে কোনো কীওয়ার্ড মিলে যায় তাহলে ওই মন্তব্য বিষয়ক একটি নিয়ম প্রয়োগ করা হয়। কোনো কীওয়ার্ড না পাওয়া গেলে, এলিজা হয়ত উত্তরে কোনো সাধারণ রিপোস্ট বা পূর্বের কোনো মন্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে। তাছাড়া, এলিজাকে তৈরি করার মূল উদ্যেশ্য ছিল, রজারিয়ান সাইকোথেরাপিস্টদের আচরণের মত হুবুহু অনুকরণ করতে শেখানো যা এলিজাকে সম্পূর্ণ মুক্তভাবে জানার ভাণ করতে শেখায়। এমনকি বাস্তবে নেই এমন জিনিসও সে যেন জানে! এই কৌশলগুলোর সাহায্যে ওয়েইজনবামের প্রোগ্রামটি কিছু লোককে বিশ্বাস করতে বোকা বানাতে সক্ষম হয়েছিল যে, তারা সত্যিকারের ব্যক্তির সাথে কথা বলছে, কিছু বিষয়ে বোঝানোই দায় হয়ে গেছিল যে, "ইলিজা মানুষ নয়"। এজন্যই দাবি করা হয় যে, এলিজা টুরিং টেস্টকে পার করার মত যোগ্য একটি প্রোগ্রাম।

কেনেথ কলবি ১৯৭২ সনে পেরি(PARRY) নামে প্রোগ্রাম তৈরি করেন যা অনেকটা এলিজার মতই। এর প্রচেষ্টা ছিল একজন অতি ভীতু স্কিযোফ্রিনয়ার রোগীর মত আচরণ করা। এতে ওয়েইযেনবাম এর মত(কিছুটা উন্নত) উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কাজটি স্বীকৃতির জন্য ১৯৭০ সনে পেরিকে বিভিন্ন ধরনে টুরিং টেস্ট করা হয়। একদল অভিজ্ঞ মনোচিকিৎসক সত্যিকারের রোগীদের এবং টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে পেরির কথা যাচাই করেন। ৩৩ জন মনোচিকিৎসকের আরও একটি দল কথোপকথনের লিপি প্রদর্শন করেন। এরপর দুটো দলকেই জিজ্ঞেস করা হয়, কোন রোগীরা আসল মানুষ কোনগুলো কম্পিউটার প্রোগ্রাম। মাত্র ৪৮ ভাগ সময়ে তারা সঠিক পরিচয় দিতে পেরেছিলেন।

২১ শতকে, এই প্রোগ্রামগুলোর বিভিন্ন সংস্করণ(চ্যাটবট নামে পরিচিত) মানুষকে বোকা বানাতে আরও অগ্রসর হয়। "সাইবার লাভার" নামে একটি ম্যালওয়্যার প্রোগ্রাম ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের শিকারে পরিণত করে তাদের থেকে পরিচয় আদায় করে, কিংবা এমন ওয়েবসাইটে ঢুকতে কনভিন্স করে যেখান থেকে ক্ষতিকারক জিনিস কম্পিউটারে ঢুকে যেতে পারে। এই প্রোগ্রামকে "প্রেমদিবসের ঝুঁকি" বা "ভ্যালেন্টাইন রিস্ক" নামে আখ্যা দেওয়া হয় কারণ, এটা মানুষের সাথে প্রেমের অভিনয় করেই তথ্যগুলো সংগ্রহ করছিল।

চাইনিজ রুম[সম্পাদনা]

জন সিয়ারলের ১৯৮০ পত্র মাইন্ড, ব্রেইন্স অ্যান্ড প্রোগ্রামস , "চাইনিজ রুম" চিন্তন এক্সপেরিমেন্টের কথা উল্লেখ করা হয় এবং বিতর্ক তোলা হয় যে, মেশিনের চিন্তন ক্ষমতা টুরিং টেস্ট ব্যবহার করে নির্ণয় করা সম্ভব না। সিয়ারল উল্লেখ করেন, আগের সব প্রোগ্রাম(যেমন এলিজা) টুরিং টেস্টকে ফাঁকি দিয়ে পার পেয়ে গেছে মূলত এমন কিছু প্রতীক উল্টে পাল্টে যেগুলো সম্পর্কে খোদ প্রোগ্রামগুলোর কোনই ধারণা নেই। না বোঝা সত্ত্বেও তাদের মানুষের মত "চিন্তাশীল" বলা যায় না। এজন্য সিয়ারলের শেষ কথা, টুরিং টেস্ট মেশিনের চিন্তন ক্ষমতা নির্ণয়ে অক্ষম। টুরিং টেস্টকে নিয়ে যেমন প্রথমে সমালোচনা করা হয়েছে তেমনি সিরারলের কথা নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা হয়।

ফিলোসফি অব মাইন্ড নিয়ে কাজ করা সিয়ারল ও অন্যদের যুক্তিগুলো ইন্টেলিজেন্স(বুদ্ধিমত্তা)-র প্রকৃতি, বুদ্ধিমান মেশিনের সম্ভাবনা এবং ১৯৮০ এবং ১৯৯০ এর দশকে অবধি চলে আসা টুরিং পরীক্ষার মান সম্পর্কে আরও তীব্র বিতর্ক তৈরি করে।

লিবনার পুরস্কার[সম্পাদনা]

লিবনার প্রাইজ ফলিত টুরিং টেস্টের জন্য বার্ষিক প্ল্যাটফর্ম প্রদান করে। প্রথম প্রযোগিতার প্ল্যাটফর্ম রচিত হয় ১৯৯১ সনে। হিউ লিবনারের সৌজন্যে এটা চালু হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ক্যামব্রিজ ২০০৩ পর্যন্ত পুরস্কারের আয়োজন করে। লিবনারের লিখনী থেকে যেমনটা জানা যায়, এই প্রতিযোগিতা শুরু করার মূল লক্ষ্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ সাধন। কারণ, টুরিং টেস্টের বিকাশে কেউ ৪০ বছরেও তেমন কোনো পদক্ষেপই হাতে নেয় নি।

১৯৯১ এর প্রথম লিবনার প্রাইজ কম্পিটিশনে আবার টুরিং টেস্ট এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়, গণমাধ্যম এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। প্রথম প্রতিযোগিতাটি জিতে নেয় একটি চিন্তাহীন প্রোগ্রাম যার বুদ্ধিমত্তার চিহ্নমাত্রও ছিল না। প্রোগ্রমটা বিচারকদের বোকা বানিয়ে পুরস্কারটা জেতে। এই বিষয়টি টুরিং টেস্টের বিভিন্ন ত্রুটিকে হাইলাইট করে: বিজয়ী জেতার কারণ ছিল প্রোগ্রাম মানুষের মত ভুল কথা লিখতে পারতো, অকৃত্রিম বিচারকগণ সহজেই বোকা বনে গেছেন এবং কতক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষকগণ এটা বুঝতে শুরু করেন যে, এই টেস্ট গবেষণার নামে যেন এক বিপর্যয়।

রৌপ্য ও স্বর্ণ পদক এখনও কেউ জেতে নি। যাই হোক, প্রতিবছর প্রতিযোগিতাটি ব্রোঞ্জ পদক ওই কম্পিউটার সিস্টেমকে দিয়ে থাকে যা -বিচারকদের- মতে মানুষের বেশিরভাগ কথোপথনের আচারণের নকল করতে পারে; ওই বছরের সকল প্রতিযোগীর চাইতে ভালোভাবে। আর্টিফিসিয়াল লিংগুইস্টিক ইন্টারনেট কম্পিউটার এনটিটি(A.L.I.C.E.) বর্তমান বছরগুলোতে(২০০০, ২০০১, ২০০৪) ব্রোঞ্জ মেডেল জেতে। লারনিং এআই জ্যাবার ওয়েকি ২০০৫ ও ২০০৬ এ জেতে।

লিবনার প্রাইজ মূলত কথা বলার বুদ্ধিমত্তা যাচাই করে, বিজয়ীরা সাধারণত চ্যাটারবট প্রোগ্রাম বা কৃত্রিম কথা বলা অংশগ্রহণকারী(ACE) হয়ে থাকে। প্রথম দিকের লিবনার প্রাইজে কথা বলার কিছু নিয়ম: প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী এবং গুপ্ত-মানুষ একই বিষয়ে কথা বলবে, জিজ্ঞাসাকারী একবারে এক লাইনে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারবে। ১৯৯৫ সালে লোবনার পুরষ্কারের এই ধরাবাধা নিয়ম তুলে নেওয়া হয়। বিচারক এবং অংশগ্রহণকারীর আলোচনার সময় বেশকম হতে পারে। ২০০৩ এর লিবনার প্রাইজে, সুরির শিক্ষপ্রতিষ্ঠানে ৫ মিনিট এবং পরে ২০০৪ ও ২০০৭ সনে ২০ মিনিটেরও বেশি সময়ের অনুমোদন দেওয়া হয়।

বিভিন্ন সংস্করণ[সম্পাদনা]

সাউল ট্রেইগার বলেন, এই টেস্টের প্রাথমিক ৩টি ভার্সন আছে। প্রথম দুটি ভার্সন "কম্পিউটার মেশিনারি অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স" এ প্রস্তাবিত এবং আরেকটিতে তিনি "স্ট্যান্ডার্ড ইন্টারপ্রিটেশন" বলে বর্ণনা করেন। তবে স্ট্যান্ডার্ড ইন্টারপ্রিটেশন নিয়ে বিতর্ক আছে যে, এটা কি আসলে টুরিং নিজে বর্ণনা করেছেন নাকি তার লেখা থেকে ভুল বোঝার দরুণ হয়েছে। তাছাড়া এই ৩টি ভার্সন সমপর্যায়ের নয়, এগুলোর মজবুতি ও দুর্বলতার দিকও আলাদা।

হুমা শাহ ঈঙ্গিত করেন যে, টুরিং নিজেই মেশিন কি চিন্তা করতে আদৌ পারবে কি না এ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন এবং এটা যাচাই করতেই মানুষ-যন্ত্রের কথোপকথনের মাধ্যমে পদ্ধতি বলে গেছেন। শাহ বলেন, এক ধরনের অনুকরণের খেলা (টুরিং বর্ণিত) আছে যা দুইভাবে করা যেতে পারে। যথা- ১. এক-এক বিচারক-যন্ত্র টেস্ট ২. ধারাবাহিকভাবে একটি যন্ত্রকে একজন মানুষের সাথে তুলনা; দুজনকেই বিচারক জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকবেন।

অনুকরণের খেলা[সম্পাদনা]

টুরিংয়ের মূল আর্টিকেলে একটি সাদা মাটা তিনজনের দলীয় খেলার বর্ণনা আছে। প্রথম খেলোয়াড় একজন পুরুষ, দ্বিতীয়জন নারী এবং তৃতীয়জন বিচারক(নারী-পুরুষ উভয় প্রজাতির হতে পারে)। ৩য়জন ১ম ও ২য়জন ছেলে কি না তা দেখতে পারবে না তবে চিরকুট লেখার মাধ্যমে কথা বলতে পারবে। ৩য়জনের চেষ্টা হবে কে ছেলে আর কে মেয়ে তা খুঁজে বের করা। বাকিদের কাজ তাকে ধোঁকা দেয়া।

এরপরই ট্যুরিং বলেন:

আমার এখন জিজ্ঞাসা হল, "কেমন হবে যদি একটা মেশিন এই খেলায় অংশ নেয়?" পুরুষ ও নারী নিয়ে যখন খেলা হয় তখন যেমন জিজ্ঞাসকারীরা ভুল করে তেমনি এখনও কি তারা ভুল করে ফেলতে পারে? অর্থাৎ, যার ফলে আরেকটি জিজ্ঞাসা দাঁড়িয়ে যায়, "মেশিন কি চিন্তা করতে পারে?"

দ্বিতীয় সংস্করণ পরবর্তীকালে ১৯৫০ সনে টুরিংয়ে পত্রে প্রকাশ পায়। মূল খেলার মতই, তবে ১ম খেলোয়াড় কম্পিউটার, ২য়জন একজন পুরুষ আর ৩য়জন বিচারক মানুষ। এই সংস্করণে ১ম ও ২য়জন মূলত বিচারকের সাথে চালাকি করে তাকে ভুল সিদ্ধান্তের দিকে পরিচালিত করতে চেষ্টা করে।

স্ট্যান্ডার্ড ইন্টারপ্রিটেশন[সম্পাদনা]

টুরিং টেস্টের সাধারণ আইডিয়া থেকে বোঝা যায় শুধু বিচারককে ধোঁকা দিতে পারাটাই নির্ণয় করা হয় না বরং কম্পিউটার কতটা মানুষের অনুকরণ করতে পারে সেটাই মূল। যদিও এই কথা টুরিংয়ের কথার মধ্যে পড়ে কি না তা নিয়ে বিবাদ বিসম্বাদ আছে। স্টেরেটের মতে পড়ে। যদিও অন্য কেউ কেউ যেমন ট্রেইগার, একমত নন। যাক, এই খেলায় ১ম খেলোয়াড় কম্পিউটার, ২য়জন একজন মানুষ(নারী বা পুরুষ)। বিচারকের দায়িত্ব পুরুষ নারী খোঁজা নয়; বরং কে কম্পিউটার আর কে মানুষ তা বের করা। তবে এই ভার্সনের সমস্যাই হল, বিচারক তাদের আলাদা করতে পারে না। সময়ও অনেক বেড়ে যেতে পারে- এটাও একট সমস্যা। সাধারণত এই খেলায় অনুকরণটাকেই মূখ্যরূপে দেখা হয়।

ইমিটেশন গেম বনাম স্ট্যান্ডার্ড টুরিং টেস্ট[সম্পাদনা]

ভার্সনগুলোর মধ্যে টুরিংয়ের উদ্যেশ্য ছিল কোনটা তা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। স্ট্যারেট বলেন, টুরিংয়ের ১৯৫০ সনের পেপার থেকে দুটো আলাদা খেলার কথা বের করা যায়; এ দুটো একই খেলা নয়। যে খেলা দলবদ্ধভাবে টেস্ট করে সঠিক সিদ্ধান্তের আনুপাতিক হার নির্ণয় করা হয় তা হল "মূল ইমিটেশন গেম টেস্ট" আর যে খেলায় মাত্র একজন মানুষ একটা কম্পিউটার আর একজন মানুষের সাথে আলোচনা করে তাকে বলে "স্ট্যান্ডার্ড টুরিং টেস্ট"; আর স্ট্যারেট এটাকে ইমিটেশন গেমের দ্বিতীয় ভার্সন না ধরে "স্ট্যান্ডার্ড ইন্টারপ্রিটেশন" এর সাথে মিলিয়ে ফেলেন।

বিচারকের কি কম্পিউটারের সম্পর্কে জানা উচিৎ?[সম্পাদনা]

টুরিং কখনওই পরিষ্কার করেন না যে, বিচারক কি জানে যে, দুজনের একজন কম্পিউার! তিনি খালি এটুকুই বলেন যে, প্রথম খেলোয়ারের স্থলে একটি কম্পিউটারকে বসিয়ে দাও কিন্তু বিচারককে জানানো হবে কি না তা বলেন না। যখন কলবি, এফডি হিফ, এস ওয়েবার এবং এডি ক্র্যামার পেরি(PARRY)-কে টেস্ট করেন তখন বিচারকদেরকে কম্পিউটারের ব্যাপারে জানানোর প্রয়োজনই বোধ করে নি কেউ। যেমনটা আইস সেইজিন, পিটার সয়ারস্কিসহ অন্যান্যরা বলেন, এ কারণ টেস্টের ফলে একটা বড় পার্থক্য তৈরি হয়। লিবনা এক-এক প্রাইজ এআই প্রতিযোগিতা ১৯৯৪-১৯৯১ এর উপাত্তের ওপর গ্রীসিয়ান ম্যাক্সি ভাইয়োলেনস এর একটি জরিপে তাকালে দেখা যায়, আইস সেইজিন ব্যাপক ব্যবধান পেয়েছেন জানা আর না জানার ক্ষেত্রে।



আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Image adapted from Saygin, 2000.
  2. "The Turing Test, 1950"turing.org.uk। The Alan Turing Internet Scrapbook। 
  3. Turing 1950, পৃ. 433।
  4. (Turing 1950, পৃ. 442) Turing does not call his idea "Turing test", but rather the "Imitation Game"; however, later literature has reserved the term "Imitation game" to describe a particular version of the test.
  5. Turing 1950, পৃ. 442–454 and see Russell & Norvig (2003, p. 948), where they comment, "Turing examined a wide variety of possible objections to the possibility of intelligent machines, including virtually all of those that have been raised in the half century since his paper appeared."
  6. Saygin 2000
  7. Russell ও Norvig 2003, পৃ. 2–3 and 948।
উদ্ধৃতি ত্রুটি: <references>-এ সংজ্ঞায়িত "FOOTNOTESaygin2000" নামসহ <ref> ট্যাগ পূর্ববর্তী লেখায় ব্যবহৃত হয়নি।